হেমন্ত দিনে

অরূপ রায়চৌধুরী

 

পায়ে পায়ে হেমন্ত পাশ কাটিয়ে চলে যাওয়ার সময়কালটা চিরকাল উদ্বায়ী। নানা অঘটন ঘটে যেতে থাকে, আর না ঘটলেও যেকোনও সময়ে ঘটে যাওয়ার অপেক্ষায় তটস্থ থাকাটাই দস্তুর হয়ে গেছে। ক্যামোফ্লেজ অল্পবিস্তর সবারই থাকে, যত বড় হারামি অথবা বিপ্লবী হোক না কেন। এ’তে দোষ দেখার কিছু নেই। তাই মিষ্টি মিষ্টি শীতের কামড় টের পাওয়া যায় ভোর রাতে। বুকে বিব বাঁধা সোনামণি শিশু শীত। তুলতুলে, নরম নরম, আদুরে আর গল্প করার মতো। কামড়ায়, অথচ দাঁত ওঠেনি। মাড়ির কামড়, ঘুম ঘুম হেমন্তের ভোর রাতে; কি মিষ্টি যে লাগে! এসবই ক্যামোফ্লেজ। ভড়ং একপ্রকার, চালিয়াতি— শালা হারামি!

বাজার পরিসংখ্যান কোম্পানিগুলো শুধু আজ নয়, অনেকদিন ধরে বাজারে আছে। আজ থেকে বিশ পঁচিশ বছর আগেও উসকোখুসকো, পাতলাটে একটা বা দুটো তরুণী, বিনুনি বেঁধে বাম হাতে একগাদা সাইক্লোস্টাইল করা A4 কাগজ, আপনাকে ফুলবাগানের মোড়ে দাঁড় করিয়ে উটকো সব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেনি? জানতে কি চায়নি— ‘আপনি প্রত্যেকবার সিগারেট টানার আগে কি ঠোঁট চেটে নেন?’ অথবা ‘আপনার স্বপ্নে ডুবোজাহাজ কতবার এসেছে?’— এইরকম বেআক্কেলে কিছু? ওদের তখন ডিজিটাল ডেটাবেস থাকার কথা নয়। কিন্তু সেই বাঁ বগলের ন্যাতা হয়ে যাওয়া সাইক্লোস্টাইল প্রশ্নোত্তর অথবা জাব্দা খাতা ঘাঁটলে সহজেই জানা যাবে যে হেমন্ত দিনে খুব কম ঠোঁট তার দোসর পেয়েছে, জানা যাবে সেইসব ডাকঘরের খবর। কীভাবে চিঠির বাড়ন্ত ছিল চাকরি অথবা ভালোবাসার। পুরনো খবরের কাগজের আর্কাইভ একটু উল্টেপাল্টে দেখুন। জেনে যাবেন লাল-হলুদ কতবার বেমক্কা গোল খেয়ে গেছে কার্তিক অঘ্রাণে। এ’সবই তর্কাতীত, সবাই জানে আর আহাম্মক ছাড়া কেউ বিতর্কে ভেড়ে না। নব্য উত্তরায়ণের এই অসময়ে পাড়ার ঠেকে বা রাস্তার ফুটপাতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলেও যে বাংলা হিসেব সুবিধের হবার কথা নয়, সে তো আজ বুঝি।

তাই হেমন্তে ভয় জারি থাকে। জারি থাকে আলসেমি। জিন্দাবাদ ফিকে হতে থাকলে এডিস মশাগুলো পাক খায় ক্রমাগত, ভয় দেখায়, হাফ প্যান্ট ছেড়ে পায়জামা গলাই ভয়ে ভয়ে। হেমন্তের বিকেল বহু পুরনো ন্যাতা কাপড়ের মতো শব্দহীন ছিঁড়ে ফাৎড়াফাই হয়ে গেলে, অফিসফেরত কেষ্টপুর খালের উপর ওভার ব্রিজে ঘাপটি মেরে সে বসে থাকে। পিছু পিছু আসে। আমিও যেন ডাকি। চারতলায় উঠি ধীর পায়ে। সোফায় বসাই, ওর শরীরে হাত বোলাই। এ’কথা, সেকথা, চার কথা হলে জিজ্ঞাসা করি— ‘কী হে ছাইপাঁশ গিলবে নাকি এবার?’ অন্য পক্ষের সম্ভাব্য উত্তর জানা থাকলে প্রশ্নের ভঙ্গিমায় সহজাত আত্মবিশ্বাস ঘুগনির উপর ছড়ানো গোল মরিচের গুড়োর মতো ভেসে থাকে। আলস্য আহ্লাদে গা ঘেঁষে বসে। একটু ঘেঁষো আছে ব্যাটা। কিন্তু অলস মানুষ যে একটু স্বার্থপর হয়, সে’কথা ক্লাস ফাইভের বইয়ে স্পষ্ট লেখা আছে। আর MCQ-তে প্রায়শই জানতে চাওয়া হয়। আমার মেয়ে ক্লাস ফাইভের অ্যানুয়ালে rank করেছিল জানেন। ফলে আলস্যের এই সাইড এফেক্ট আমার অবগত না থাকার কথা নয়। তবু হেমন্তের বিকেল আলুথালু কেষ্টপুর খালে ডুব দিলেই সে পিছু নেয়।

আমি তো আর সেই পোস্টম্যান নই, যে ক্রমাগত ভালোবাসার চিঠি বিলি করে চলে গভীরতর অরণ্যে। সেই চিঠির অক্ষরগুলো অশ্রু বা আলিঙ্গন হয়ে ভেসে যেতে পারত। রাতের আলো দেখানো ফানুস হয়ে আকাশপ্রদীপগুলোর পাশে। তার চারপাশে বাতাসের পিঁড়ি পেতে বসে থাকে আমার দেহাতি পূর্বপুরুষ ও পূর্বনারীরা। ভগ্ন স্বপ্নের ছেঁড়া চাদর গায়ে দিয়ে। না, আমার পৌঁছে দেওয়ার মতো কোনও চিঠি নেই। নেই কোনও বার্তা— লিফলেটে, দেওয়ালে, মিছিলে, পোস্টারে লটকে দেওয়ার মতো। তাই নিয়ম করে বিপি মাপি, কোলেস্টেরল আর সুগার ফাস্টিং।

এতোলবেতোল ভাবনায় সুপর্ণার হাত ধরি শক্ত হাতে। সে আমাকে শীতকাল দেখাতে নিয়ে যাবে। কথা দিয়েছে। তোমাকেও সাথে নেব। আমাদের মিছিল হাওড়া ব্রিজ ছাড়িয়ে, মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে কলেজ স্ট্রিট পৌঁছলে ডানদিকে বাঁক নেবে। তোমার বাম কাঁধে তোমার চাইতেও অনেকটা বড় লালঝাণ্ডা, আমি সাদা পতাকায়। মুখে স্লোগান— “ভিক্ষা নয় ঘোষণা অতঃপর।/কে দেবে দাও বাড়িয়ে আছি মুঠো/ভালোবাসার সামান্য খড়কুটো”। কিন্তু মেডিকেল কলেজ পেরোবার সময় আমরা চুপ করে যাব। সেই ফুরসতে দেখে নেব কুয়াশামাখা আকাশ, আকাশ জুড়ে আবছায়ায়, তোমার কাজল টানা চোখ। শীতঘুমের শীতকাল নয়। খেজুরের রসে ভেজা শীতকাল, দুপুর জুড়ে ক্রিকেট খেলার শীতকাল, পাশ করে নতুন ক্লাসে ওঠার শীতকাল। লুকিয়ে চিঠিটা দ্রুত শেষ করে ফেলার শীতকাল। নিয়ে যাবে তো সুপর্ণা? কথা দিয়েছ কিন্তু! আলো পড়ে এলেও শীতকাল জারি থাকবে। ঝান্ স্কার নদীতে চাদর ট্রেকেরও প্ল্যান করতে পারি শীতকাল এসে গেলে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...