গিলাডাঙ্গা এস্টেট

সুবীর সরকার

 

ক।

সে তো ৫০/৭০ বছর আগেকার কোন পৃথিবী। কালখণ্ড থেকে বেরিয়ে আসা টুকরোগুলিকে একপ্রকার অগ্রাহ্য করেই বুঝি গায়ত্রী সিং জলঢাকার চর পেরোতে পেরোতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়লে মধ্য শীতের রোদমায়ায় অসম্ভব এক পুলক জাগে। মাথায় শোলার টুপি। হাতে দোনলা বন্দুক। গোঁসাইহাট ফরেস্ট থেকে শিকারফেরত গায়ত্রী, হীরা সিং-এর কাঁধে হাত রাখলেই বিশাল প্রান্তর যেন ডেকে নিতে থাকে গিলাডাঙ্গা এস্টেটের ভিতর। গায়ত্রী তার অন্যমনস্কতাকেও অগ্রাহ্য করে; গভীর কোনও গান ভেসে আসতে থাকে,

‘হামার দেশত বড় বাঘের ভয় রে সোনা রায়
ফান্দত পড়িয়া বুড়া বাঘা কান্দে রে রূপা রায়’

গানের ভিতর কেমন এক যাদু থাকে। মায়া থাকে। গান ছড়িয়ে পড়ে গানে গানে ভরে ওঠে টাড়িবাড়িখেতখামারবৃক্ষনদী। অন্যমনস্কতা থেকে ফিরে আসবার মরিয়া প্রয়াস গায়ত্রীর। পৃথিবীর ভিতর পুরাণসকল ঢুকে পড়তে থাকলে পুরাতন পৃথিবীর পটভূমির ভিতর এসে জড়ো হতে থাকে রাজার হাতি, শিকারজুলুস কিম্বা গায়ত্রী সিং-এর জোতজমি।

খ।

গায়ত্রীর চোখের তারায় তারায় আন্ধার আতির জোনাই জ্বলে ওঠে। অতীতময়তায় দিন কাটে তার। কোথাও চলে যাওয়া ঘোড়ার ক্ষুরধ্বনি আর ফিরিয়ে আনতে পারে না সে। চলমানতা দিয়েই তো তার দীর্ঘ যাপন, যা তাকে স্মৃতিকাতরতার দিকে ঠেলে দিলে তার কিছুই করার থাকে না আর। জলঢাকার তরমুজবাগিচায় কুয়াশাশিশিরের কুহকে শেয়ালেরা ডেকে ওঠে। বিভ্রমে ঢুকে পড়তে পড়তে গায়ত্রী আবার বুঝি জাগিয়ে তোলে, পুনরুদ্ধার করে গিলাডাঙ্গা এস্টেট। হেমন্তের ফসলবোঝাই মহিষের গাড়ি। বিষাদু মইষালের বাওকুমটা বাতাসের গান। কোথাও বুঝি চলে যেতে হয় মানুষকে! পুরাতন পৃথিবীর ভিতর দীর্ঘনিঃশ্বাসেরা ঘনবদ্ধ হয়। জিপগাড়ির ভাঙা পাদানিতে দাঁড়িয়ে হেসে চলেছে হীরা সিং। সময় অতিক্রম করতে গিয়ে বুঝি একপর্বে গায়ত্রী সময়াতীতের ধারাবাহিকতাতেই আটকে পড়ে!

গ।

আঞ্চলত মুছিনুং হয় তোর
সোনা মুখের ঘাম…

নয়ারহাটের জমজমাটির ভিতর দাঁড়িয়ে আমাকে শুনতে হয়েছিল গায়ত্রী সিং-এর গল্প। ২৫ বর্গমাইল বিস্তৃতির পূর্বতন গিলাডাঙ্গা এস্টেটের পুরনো নতুন সব মানুষের কাছেই যিনি মিথের মতো। মিথ ভেঙে দিয়ে তৈরি হওয়া নতুনতর মিথের জালকে আটকে গিয়েও নিজেকে স্মরণযোগ্য করে রাখবার প্রয়াসটুকুন তাকে চলমানতা দিতে না পারলেও; সে কিন্তু মাথায় শোলার টুপি হাতে বন্দুক সহ আদ্যন্ত এক গায়ত্রী সিং হয়েই যেন উঠে আসছেন জলঢাকার পুরাতন চরের খুব খুব গভীর থেকেই।

ঘ।

ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতে কিংবা স্বপ্নতাড়িত কোনও এক ঘুমকুহকে ঢুকে যেতে যেতে মাতব্বর তার সমগ্রতায় এক ধরনের শিহরণ টের পায়; তার মনে হয় কোথাও জায়মানতা থাকে না; কেবল নদীর ভিতর জেগে ওঠে অগণন নদী যাদের আঞ্চলিক প্রবাহের ফাটল ছুঁয়ে বিষণ্ণ সব বুদবুদ জেগে ওঠে। মাতব্বর আবার দেখতে পান ফালাকাটা শহরের কবেকার সেই শহর কাঁপানো বাঘটিকে। বাঘ কেবল আর বাঘ থাকে না, তার গায়ের ডোরাকাটা হলুদের উজ্জলতায় বারবার মানুষের তাড়া খাওয়া, জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসা বাঘের ভীতসন্ত্রস্ত দিশেহারা ছুটে বেড়ানোটুকু বুঝি মাতব্বরের ঘুমকে হিমশৈলের মতো জাগিয়ে রাখে। অনন্ত ঘুমের কুয়াশাময় আর্তিতে কোচবিহার রাজার শিকারী ভাই, ফালাকাটা শহরের বিপুল জমায়েত, ডোরাকাটা বাঘের দিকে ঘোড়া ছুটিয়ে আসা জার্মান সাহেব; সব যেন তুমুলভাবে দুলে উঠতে থাকে।

ঙ।

মাতব্বর তার ঘুমকে সঞ্চরণশীল মেঘের মতো, বৃষ্টিপতনের মতো স্থিরতা এনে দিতে না পারলেও তার প্রয়াসটুকু জারি থাকে। জোতদারবাড়ির ভগ্ন আগাছা গজানো বর্তমানে এসে নস্টালজিয়ার রেশ ও রেণু সর্বাঙ্গে মাখতে মাখতে মাতব্বরকে ঘুমের পাঁকে পাঁকে তুমুল ডুবেই যেতে হয় পরিত্রাণহীন ভবিতব্যতায়, সুদূরপ্রসারী কোনও গানের মতন।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সুবীর সরকারের একটি বই দু’ দিন আগে পড়লাম গাঙচিল-এ, বইটির নাম সম্ভবত মাতব্বরবৃত্তান্ত। লেখকের ভাষা আমাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। এবং আজও। কি নম্র ও শান্ত ভাষায় যে একের পর এক ছবি আঁকেন সুবীরবাবু!

আপনার মতামত...