জেমস কোয়ান্ট
অনুবাদ : সত্যব্রত ঘোষ
সিগাল দ্বারা পুনঃপ্রকাশিত ‘মন্তাজ : লাইফ, পলিটিক্স, সিনেমা’ নামক বইটি নিয়ে লিখেছিলেন টরেন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল, সিনেমাথেক্-এর সিনিয়র প্রোগ্রামার জেমস কোয়ান্ডট। ২৪শে মে, ২০১৮-এ নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত সেই নিবন্ধতে মৃণাল সেনের জীবন দর্শন এবং কৃতি নিয়ে নির্মোহ এক আলোচনা করেছেন উনি। নিবন্ধটির বাংলা তর্জমা তাঁর অনুমতিক্রমে চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম-এর পাঠকদের জন্য।
বিগত প্রায় এক শতাব্দী ধরে গণদুর্ভিক্ষ এবং দেশভাগ ছাড়াও নিজের জন্মস্থানকে অন্য দেশে বিচ্ছিন্ন হতে দেখেছিলেন বাঙালি চিত্রপরিচালক মৃণাল সেন। কলকাতার রাস্তায় নকশালদের সঙ্গে পুলিশের প্রাণঘাতী সব সংঘাত এবং বামপন্থী ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ পশ্চিমবঙ্গে দক্ষিণপন্থী রাষ্ট্রবাদের ক্রমশ শক্তিবৃদ্ধি ও ক্ষমতা দখলের সাক্ষী ছিলেন তিনি। ঐতিহাসিক এই সংকটগুলিতে সাড়া দিতে তিনি যেভাবে তৈরি হচ্ছিলেন, তা ওনার নিজের ভাষায় বললে বলা যায় “কীভাবে রূঢ়তা আনব। ”
এর জন্য তিনি তাঁর শহরবাসী সত্যজিৎ রায়ের প্রথাসিদ্ধ সুচারু শিল্পবোধ এবং টোনাল সূক্ষ্মতা, যা অন্য অনেকের অনুপ্রেরণাস্বরূপ, তা নাকচ করেছিলেন সচেতনভাবে। সংবাদপত্রে তাঁদের মতবিরোধ প্রায়ই প্রকাশিত হত। অপু ট্রিলজিতে সত্যজিৎ রায় যে মানবতাবোধের স্বাক্ষর রেখেছেন, মৃণাল সেন সেই বোধকে পরীক্ষামূলক দিকে প্রসারিত করে ভারতীয় সমান্তরাল সিনেমার এক অন্যতম প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন। অবশ্য, নামে সমান্তরাল হলেও এই ধারার সিনেমা ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ফিল্মমেকিং মডেল, যাকে চলতি ভাষায় বলিউড বলা হয়, তাকে নাকচ করবার তুলনায় পরিপূরকের ভূমিকা পালন করেছে বেশি। মানবিক, বুদ্ধিজীবী (যদিও নিজেকে আদৌ শিক্ষিত বলে মনে করতেন না উনি), অজ্ঞেয়বাদী এবং রাজনৈতিকভাবে র্যাডিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে নির্মোহ গুণগ্রাহিতার পাশাপাশি চতুর অস্পষ্টতার বৈপরীত্যকে সঙ্গে করে মৃণাল সেন ক্রমশ একজন তার্কিক থেকে এমন এক কবিতে পরিণত হচ্ছিলেন, যিনি অনিশ্চয়তার প্রতিই দায়বদ্ধ। তিনি বলতেন,
জীবনটাই তো অনিশ্চিত এবং মীমাংসাহীন। তাহলে আমার সৃষ্টিতে মীমাংসা কেমনভাবে রচনা করব? সেই কারণে আমার ছবিগুলি ওপেন-এন্ডেড।
চুরানব্বই বছরের মৃণাল সেন বয়ঃসন্ধিতে পৌঁছে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে মহাত্মা গান্ধির প্রতিবাদ দেখেছিলেন ফরিদপুরে, যাকে তিনি “ছোট্ট অজানা এক শহর, যা ছিল অবিভক্ত ভারতের এক প্রাচীন ভূখণ্ড” হিসেবে নিজের অসংলগ্ন কিন্তু হদয়স্পর্শী স্মৃতিচারণে বর্ণনা করেছেন সিগাল দ্বারা পুনঃপ্রকাশিত তাঁর প্রবন্ধ এবং সাক্ষাৎকার সমগ্র মন্তাজ : লাইফ, পলিটিক্স, সিনেমা-তে। বহু দশক পরে সেই জন্মভূমির অনিচ্ছুক দর্শনের অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গক্রমে, যা ১৯৪৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়ে গেছে।
বারো জন ভাইবোনের সঙ্গে বড় হওয়ার পাশাপাশি তিনি তাঁর আইনজীবী বাবার প্রগতিশীল, ব্রিটিশ-বিরোধী সত্তাটির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন। গ্রেপ্তারের ঝুঁকি নিয়ে তিনি তাঁর বাবাকে সেইসব স্বাধীনতা সংগ্রামী এবং অন্যান্যদের মামলা লড়তে দেখেছেন, যারা তাঁর পারিশ্রমিকের টাকা দিতে অপারগ। তাঁর জন্মভিটেটি প্রশস্ত হলেও লোকসংখ্যা সেখানে অল্প নয়। তবু সেই বাড়িতেই বারবার আশ্রয় পেতেন এমন মানুষেরা যাদের নিকট আত্মীয় ফাঁসির জন্য জেলে দিন গুনছেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর পরে তিনি যখন চিত্রপরিচালক হিসেবে স্বমহীয়ান, তখন তাঁর ফ্যামিলি ড্রামাগুলিতে দমবন্ধ যে ঘরোয়া পরিবেশের নিপুণতা আমরা দেখি, তার উৎসে হয়তো বাল্যকালের ঐ দিনগুলির স্মৃতির একটি বড় ভূমিকা আছে।
বাবার রাজনৈতিক মতাদর্শ অনুসরণ করে আট বছর বয়সে প্রথম প্রেপ্তার হন তিনি। একটি প্রতিবাদ মিছিলে সামিল হওয়ার অপরাধে। কনিষ্ঠতম এই অংশগ্রহণকারীকে এক পুলিশকর্মী পিটিয়ে ছাতু করে দেওয়ার হুমকি দেয়। আজীবন মার্ক্সিজমে আস্থা রাখলেও তিনি কখনওই ক্ষমতাশালী কম্যুনিস্ট পার্টির কার্ডধারী সদস্য হননি। সদ্যনির্বাচিত দক্ষিণপন্থী তৃণমূল কংগ্রেসের সোচ্চার সমালোচক হওয়ার অপরাধে বার্ধক্যে পীড়িত এই চিত্রপরিচালকটি ২০১৬ সালের কলকাতা ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল-এ তাঁর ছবির রেট্রোস্পেক্টিভ বানচাল হতে দেখেছেন। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের অপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি এটাও সত্যি যে পশ্চিমের দেশগুলিতে সীমিত বিতরণের কারণে তাঁর খারিজ (১৯৮২) ছবিটি উপযুক্ত মর্যাদা পায়নি। তাঁর ছবিগুলির পুনর্মূল্যায়ন আশু প্রয়োজন।
“আমি সিনেমাতে এসেছি অনেক দেরিতে।” এভাবেই তিনি মন্তাজ-এর প্রথম নিবন্ধটি শুরু করছেন যেখানে চলচ্চিত্র নির্মাণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করবার বিবরণ পাওয়া যায়। তাঁর ভাষায়, এই “অনিশ্চিত যাত্রা”-র শুরু স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনার শেষে ভ্রাম্যমাণ ওষুধ বিক্রেতার চাকরি ছাড়বার পর। অভিভূত হওয়ার মতো ছোট ছোট কিছু ঘটনার কথা বলেছেন তিনি। তার মধ্যে একটি হল কলকাতায় পাকাপাকিভাবে চলে আসবার আগে ফরিদপুরের বাড়িতে কাটানো শেষ রাতটির কথা।
বাবা শুনতে পাবেন এটা নিশ্চিত হওয়ার পর মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি কি আমার মধ্যে কোনও অসাধারণ গুণ লক্ষ করেছ, মা? মানে, যেমন মহৎ ব্যক্তিত্বদের ছোটবেলায় যেসব গুণ দেখা যেত? প্রতিভাবানের কোনও চকিত ইঙ্গিত?
তেমন কোনও ইঙ্গিত মৃণাল সেনের প্রথম দিকের ছবিগুলিতে দুর্লভ। যেগুলি তিনি ইম্পিরিয়াল (ন্যাশনাল) লাইব্রেরিতে বসে রুডল্ফ আর্নহাইম-এর চলচ্চিত্রের নন্দনতত্ত্ব নিয়ে লেখা ‘ফিল্ম অ্যাজ আর্ট’ বইটি পড়ে উদ্বুদ্ধ হয়ে প্রথমে শব্দযন্ত্রী হিসেবে চিত্রজগতে প্রবেশ করবার পর পরিচালক হিসেবে বানিয়েছিলেন। মাঝেমাঝে তাঁর আত্মসমালোচনা এত ঝাঁঝালো হয়ে উঠত যে তখন তিনি বলেই ফেলেন তাঁর প্রথম ছবি রাতভোর (১৯৫৫) মুক্তি না পেলেই ভালো হত। নিজের অপারদর্শিতায় তিনি এতটাই লজ্জিত যে মন্তাজ-এর প্রথম পাতাতেই তিনি তাঁর দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নীচে (১৯৫৯) ছবিটিকেও “ওভার সেন্টিমেন্টাল, কারিগরি দিক থেকে কাঁচা এবং দৃশ্যগতভাবে দুর্বল” বলে নাকচ করে দেন। যদিও তিনি এই কথাটি যুক্ত করেন, “ছবিটি যে রাজনৈতিক দর্শনকে তুলে ধরে তাতে এই ধারণা স্পষ্ট হয় যে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে ফ্যাসিজম এবং সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে উদার দুনিয়ার লড়াই ওতপ্রোতভাবে যুক্ত”, যা জহরলাল নেহেরুর প্রশংসা লাভ করে।
তিনি অবশ্য মেনে নেন তাঁর তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ (১৯৬১), “বানাতে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ছবি হিসেবে অতটা ভালো না হলেও, আমার মন ভরিয়েছে।”
ক্ষয়িষ্ণুতার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার জন্য যে ভগ্নপ্রায় বাড়িটি নির্বাচিত করা হল, সেখানে স্থানের একান্ত অভাব। পরিচালকের দাবি,“ক্যামেরা বেশিরভাগ সময়ে ইনডোরেই রয়ে যায়… একবারই বাইরে আসে।” এবং তেতাল্লিশের মন্বন্তরের অনুষঙ্গকে তির্যকভাবে ব্যবহার করে একটি পুরুষের জন্য তার মায়ের পছন্দ করে আনা অল্পবয়সী বৌয়ের শীতল হয়ে যাওয়া সম্পর্ককে ক্রমশ ধ্বংসের মুখে এনে ফেলেন তিনি। মৃণাল সেনের পরবর্তী ছবিগুলির ক্ষেত্রে বিষয়গতভাবে রীতিসিদ্ধ একটি ছাঁচের রূপ নেয় বাইশে শ্রাবণ। অংশত, ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক নীতির কারণে সৃষ্ট এই মন্বন্তরে লক্ষাধিক প্রাণহানি ঘটে। কলকাতার রাস্তা তখন মৃত এবং মরণাপন্ন মানুষে ভরে গেছে, যা মৃণাল সেনের বিভিন্ন ছবিতে হয় বাস্তবে রূপায়িত হয়, নয় রূপক হিসেবে ফিরে আসে।
বাইশে শ্রাবণ-এর ক্ষেত্রে এই মন্বন্তর এক অনিবার্য বিঘ্নস্বরূপ এসে জুড়ে বসেছে গ্রাম্য এক তরুণ দম্পতির সংসারে, যা মরিয়া স্ত্রীটিকে শেষে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়। কিন্তু মন্বন্তরকে সরাসরি দেখানো হয় না পর্দায়। কাহিনীর যে ত্বরণ, তার থেকে দর্শকদের বুঝে নিতে হয় এর বিবরণে মন্বন্তরের কী ভূমিকা আছে। একইভাবে, মাধ্যমটির উপর পরিচালকের প্রাথমিক দখল বোঝা যায় যখন মহিলাটির মৃত্যু বোঝানোর জন্য শুধুমাত্র তিনি দুলতে থাকা কড়িবরগা-র একটি শট ব্যবহার করেন, যার থেকে ঝুলে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। তার স্বামী দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে যখন মৃতদেহটি আবিষ্কার করে, তখনও সেই কড়িবরগাটি নড়ছে। একটি দৃশ্যকল্পকে আরেকটি দৃশ্যকল্পের জন্য ব্যবহার করবার এই পদ্ধতিটি রবার্ট ব্রেসো-র ছবি মনে করিয়ে দেয়। ওনার পরিচালিত ছবিগুলি অত্যন্ত পছন্দ করতেন মৃণাল সেন। পরবর্তীকালে তিনি ব্রেসো-র অন্য একটি পদ্ধতিও নিজের ছবিতে ব্যবহার করেন। একটি বিশেষ দৃশ্যের আনুষঙ্গিক শব্দরাশিকে আগের দৃশ্যের শেষ শটের উপর ব্যবহার করা।
“বোঝাই যায়, এই ধরনের ছবির আর্থিক সাফল্য জোটে না,” স্বভাবগত ন্যূনত্ব নিয়ে এমনটাই লিখছেন মৃণাল সেন। তবুও বাইশে শ্রাবণ তাঁকে শুধু তাঁরই ভাষায় “ছবির জগতে পায়ের তলায় শক্ত জমি” দেয়নি। ছবির নতুন একটি ধারারও জন্ম দিয়েছে বাইশে শ্রাবণ।
এবং যে কোনও কারণেই হোক, এরপর আমি ঠিক করে নিই নতুন নতুন দিকগুলিতে পা ফেলব রীতির সব শিকল ভেঙে এবং অভিব্যক্তির নতুন মাত্রা আনব (ছবিতে)। সবটাই ঝুঁকি, অত্যন্ত ঝুঁকির কাজ। এখনও। প্রতিটি ক্ষেত্রে, যেকোনও বিষয়ে।
অবান্তর ভাবনা এবং মিশ্র রূপকল্পের এই অসংলগ্ন কথোপকথন দিয়ে ওনার লেখালেখিকে চিহ্নিত করা যায়। পরোক্ষ বাচ্যের প্রতি ওনার নির্ভরতা। যেমন, “টেবিলগুলিকে সজোরে বাজানো হচ্ছিল”— এমন একটি বাক্য দিয়ে তিনি জেনেসিস (১৯৮৬) ছবির সেটে একটি আচমকা বিস্ফোরণের বর্ণনা করছেন, যা যতটা না মর্মভেদী, তার চেয়েও বেশি ক্লান্তিকর। এবং ওনার সতীর্থ ঋত্বিক ঘটকের শ্রদ্ধার্ঘে অনুরণন ঘটানোর লক্ষ্যে যেভাবে একই শব্দ একাধিকবার ব্যবহার (এপিস্ত্রোফি) করেছেন তাতে আর্তনাদের চেয়ে ক্রোধের উদ্রেক হয় বেশি:
কোমাচ্ছন্ন ঋত্বিক, জীবনের-চেয়ে-বড় ঋত্বিক, বেপরোয়া ঋত্বিক, হৃদয়হীন ঋত্বিক, নিয়মশৃঙ্খলাহীন ঋত্বিক … একই রকম জীবনের-চেয়ে-বড় ঋত্বিক, বেপরোয়া ঋত্বিক, হৃদয়হীন ঋত্বিক, নিয়মশৃঙ্খলাহীন ঋত্বিক।
নন্দনতাত্ত্বিক উদ্ভাবনের প্রতি আন্তরিকতা থেকেই ওনার প্রথম জনপ্রিয় ছবি ভুবন সোম (১৯৬৯)-এর জন্ম। নামের চমৎকারিত্বের আড়ালে একজন বয়স্ক আমলাকে নিয়ে শ্লেষাত্মক এক মিষ্টি মধুর ছবি। রেল কর্মচারী এই প্রৌঢ়টি নিজের সততা বজায় রাখবার প্রতি এতটাই কঠোর যে নিজের ছেলের বিরুদ্ধেও আলসেমির অভিযোগে চরম সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্ত নয়। সেই মানুষটিই গুজরাটে পাখি শিকারের একটি অভিযানে এসে গ্রাম্য এক তরুণীর সাহচর্যে জীবনটাকে একটু সহজ করে নেওয়ার জন্য অন্তরঙ্গতা, পারস্পরিক আস্থা এবং একচিলতে অসততার পাঠ গ্রহণ করে। চিত্রপরিচালক শ্যাম বেনেগাল দাবি করেন ভারতীয় নিউ ওয়েভ (অথবা সমান্তরাল সিনেমা)-র পথিকৃৎ ভুবন সোম ভারতের চলচ্চিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রায় এক দশক আগে বানানো সত্যজিৎ রায়ের অপু ট্রিলজির সমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
ক্ষুধার্ত এক সিনেমা দর্শক হিসেবে ১৯৬৫ সালে ফ্রাসোয়া ট্রুফো-র ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ (১৯৫৯) এবং ‘জ্যুলে এত্ জিম’ (১৯৬২) ছবি দুটি মৃণাল সেনকে যথেষ্ট প্রভাবিত করে। ফরাসি এই চিত্রপরিচালকের প্রভাব যে ওনার উপর কতটা পড়েছিল তা বোঝা যায় ভুবন সোম-এ নিউ ওয়েভ সিনেমার বিভিন্ন কারিগরি প্রয়োগের মুহুর্মুহু ব্যবহারে। ছবির শুরুতেই বাস্তব ঘটনার একটি দ্রুত মন্তাজ (কলকাতার রাস্তায় সতীর্থ বাঙালি সত্যজিৎ রায় এবং রবিশঙ্করের প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটা), ফ্রিজ ফ্রেমের অকুণ্ঠ ব্যবহার, যা দিয়ে ‘দ্য ফোর হান্ড্রেড ব্লোজ’ শেষ হয় এবং ইমেজ মাস্কিং-এর চমকপ্রদ ব্যবহার, ট্রুফো যে সেকেলে কারিগরিটিকে ‘জ্যুলে এত্ জিম’ ছবিটিতে নতুনভাবে ফিরিয়ে এনেছিলেন। উদাহরণস্বরূপ, ভুবন সোমকে ওয়াইড ক্লোজ আপে চুরুট চিবোনোর শটকে উনি ফ্রিজ করে উপর এবং নিচ থেকে মাস্কিং করে লেটার বক্সের মুখের মতো একটা আকৃতি এনে দর্শকদের একজন আমলার সংকীর্ণ জগৎ সম্পর্কে ধারণা দেন।
ভুবন সোম-এর স্থূল কমেডির মধ্যে বলিউডের সেই ললিপপ মার্কা ছবির চিহ্ন রয়ে গেছে, যা উনি পরিহার করে এসেছেন অনমনীয়ভাবে (আমি “আমাদের স্বাদহীন দেশীয় ছবিগুলির প্রতি তীব্র এক অপছন্দের মানসিকতা তৈরি করেছি।”) তবে ওনার ছবিতে শব্দগত এবং দৃশ্যগত পরীক্ষা-নিরীক্ষার পাশাপাশি মাঝেমাঝে যে কাহিনীগত ইম্প্রোভাইজেশন লক্ষ করা যায়, তা বলিউডের প্রচলিত চটকদার রোমান্টিক-মিউজিক্যাল ধারা থেকে একেবারে আলাদা।
ওনার চিত্রগ্রাহক (কে কে মহাজন) যে ট্রাইপডটি ব্যবহার করতেন, তা সরিয়ে ক্যামেরাটিকে দিয়ে প্রক্ষিপ্ত অ্যানিমেশন ফিল্মের ধরন আনলেন নিজের খেয়ালখুশিতে (ভুবন সোম যখন পাখি শিকারের বাইবেলের পাতায় মন দিয়েছে, তার মাথার উপর তখন হাতে আঁকা উড়ন্ত পাখিদের পাখসাট দেখি আমরা)। এছাড়া সুইশ প্যান (অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ডানদিক অথবা বাঁদিকে ঘোরানো), পয়েন্ট অফ ভিউ শট, ব্ল্যাকআউট, একটি ফটোগ্রাফে অনবরত জুম করতে থাকে ক্যামেরা এবং তার সঙ্গে ইন্টারকাটে একটি ট্রেনের শটের ছন্দহীন এক মন্তাজ। (ওনার ট্র্যাভেলিং শটগুলি এখানে প্রসারিত, যাতে হয় ক্যামেরাকে ভুবন সোমের গাড়ির চাকায় বেঁধে তোলা হয়, নয়তো তা শ্লথগতির গরুর গাড়ি অনুসরণ করে— ম্যানোয়ি দ্য অলিভেরা-র মডার্নিস্ট সিনেমায় যানবাহনের উপস্থাপনে যার ছাপ পড়েছে।) সাউন্ডট্র্যাকের ক্ষেত্রেও উনি এখানে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন। সেখানে তবলা আর সেতারের মূর্ছনাকে বিস্ফোরিত করা হয়, ইলেক্ট্রনিক ডিস্টর্শন ঘটে, নৈঃশব্দ হঠাৎ এসে ছাপিয়ে যায় সবকিছু।
মৃণাল সেনের ভালোবাসার শহরটি ফুটে ওঠে তথাকথিত কলকাতা ট্রিলজিতে, যেখানে ১৯৭০-এর নকশাল-পুলিশ সংঘাত “উন্মত্ত এবং… সতেজ” এক মানসিকতা নিয়ে চিত্রায়িত করা হয়। ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩)— এই তিনটি ছবির ক্ষেত্রে ওনার অন্যতম কৃতিত্ব হল, তিনি ফরাসি নিউ ওয়েভ আন্দোলনকে নিজের ছবির মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন। এখানে অবশ্য জঁ লুক গোদারের ১৯৬৮-র বিক্ষোভমুখর আন্দোলন থেকে উঠে আসা জঙ্গি মনোভাবের পরিবর্তে ট্রুফো-র সঙ্গীতময়তাকেই বেছে নিয়েছেন তিনি। এবং শিল্পী হিসেবে নিজেকে পুনরাবিষ্কার করেছেন:
তখন আমি উন্মত্ত। পাগলামি, অস্থিরতা, ভীতি, প্রাণময়তা, ভাসন্ত এবং এমনকি বাচালতার যতটুকু আমার মধ্যে ছিল, তা থেকে মুক্তি পেতে আমি গোঁড়াবাদীদের বানানো সব সীমারেখাগুলিকে মরিয়া হয়ে ভাঙছিলাম।
ট্রিলজির প্রথম ছবি ইন্টারভিউ-এ রঞ্জিত মল্লিক প্রথম পর্দায় এলেন একজন হতভাগ্য যুবকের রূপে। একটি ব্রিটিশ কোম্পানিতে চাকরির ইন্টারভিউতে যাওয়ার জন্য সে কোট-প্যান্ট কিনতে বার হয়েছে বন্ধের দিনে। সিনেমার চতুর্থ মাত্রাটিকে একটি দৃশ্যে নস্যাৎ করে দেওয়া হয়। যেখানে ভিড় ট্রামে একজন যাত্রী অভিনেতাটিকে ভবানীপুরের মল্লিকবাড়ির ছেলে বলে চিনতে পারে। মৃণাল সেন-এর জীবনীগ্রন্থে লেখক দীপঙ্কর মুখোপাধ্যায় এই দৃশ্যটিকে ভারতীয় সিনেমায় প্রথমবার ব্রেখটিয়ান অ্যালিয়েনেশনের ব্যবহার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যদিও মৃণাল সেন স্বীকার করেননি যে উনি ব্রেখট দ্বারা প্রভাবিত। (সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ ছবিতে ব্রেখটের ছায়া লক্ষ করলে খুঁজে পাওয়া যাবে।) “আমি একেবারেই স্টার নই” রঞ্জিত মল্লিক সরাসরি ক্যামেরার দিকে চেয়ে বলছেন। যা গোদারের “ল্য সিনিয়জ” (১৯৬৭) ছবিতে জঁ পিয়র ল্যুড করেছেন চিত্রগ্রাহক রাউল কুটার্ড তাঁর ক্যামেরা সহ ছবির ফ্রেমে আসবার পর। তা অনুসরণ করেই মৃণাল সেন তাঁর চিত্রগ্রাহক (কে কে মহাজন)-কে হ্যান্ড-হেল্ড ক্যামেরা সহ দেখান।
পেশাদার অভিনেতা নন, এমন মানুষদের প্রায়ই মৃণাল সেনের ছবিতে দেখা যেত। এবং গোদারের মতো তিনিও তাঁদের ব্যক্তিগত বিবরণগুলিকে অভিনীত চরিত্রদের সঙ্গে যুক্ত করতেন। অভিনেতা স্বগতোক্তিতে বলেন, “আমার নাম রঞ্জিত মল্লিক। আমি ভবানীপুরে থাকি এবং একটি সাপ্তাহিক পত্রিকায় কাজ করি। ছাপাখানায় যাই, প্রুফ দেখি আর অন্যান্য কাজ করি। আমার জীবন অতি সাধারণ, জানেন? তবুও সেই কারণেই, হ্যাঁ সেই কারণেই তা মৃণাল সেনকে আকর্ষণ করে। হ্যাঁ, হ্যাঁ, ফিল্ম বানায়, চেনেন তো?”
চমকে যাওয়া এক যাত্রী ক্যামেরার ভিউফাইণ্ডারে উঁকি দিয়ে বলে ওঠে, “আচ্ছা, এটাকেই বুঝি সিনেমা বলে?” ছবিটির পরের দিকে একটা জাম্প কাটে আমরা রঞ্জিত মল্লিকের হাতে হঠাৎ একটা থানইট দেখি। সে একটি পোশাকের দোকানের কাঁচে তা ছুঁড়ে মারবে। সেই মুহূর্তে মৃণাল সেন একরাশ ছবির বন্যা পর্দায় আনেন— রাস্তার প্রতিবাদী মিছিল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ, বোমা বিস্ফোরণ।
পরবর্তীকালে ইন্টারভিউ-কে যা উনি “শিশুসুলভ উৎসাহ” বলে বর্ণনা করেছেন, তা ট্রিলজির দ্বিতীয় ছবি কলকাতা ৭১-এর ক্ষেত্রে পরিশীলিত হয়। এখানে পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত কয়েকটি গল্প বলা হচ্ছে, যার মধ্যে দিয়ে কলকাতার গত চার দশক ফুটে ওঠে— মন্বন্তরের সময় থেকে নকশাল আন্দোলনের দিন। এবং তৃতীয় ছবি পদাতিক-এ আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া এক নকশাল কর্মীর জীবন দেখানো হয়, যে এক তরুণীর বাড়িতে আপাতত আশ্রয় নিয়েছে। সূক্ষ্মতা নিয়ে মৃণাল সেনের মাথাব্যাথা নেই। উনি পরে স্বীকার করেন, “একজন প্যামফ্লেটিয়ার হিসেবে যদি নিজের বক্তব্য প্রকাশ করা যায়, তাহলে তা হতে আমার বিন্দুমাত্র সংকোচ নেই।” বিলাসবহুল এক ককটেল পার্টিতে মাতাল বুর্জোয়াটি ঘোষণা করে “নতুন এক ভারতের জন্ম হয়েছে।” কলকাতা ৭১-এ উনি এই দৃশ্যের পাশাপাশি কলকাতার বস্তিতে তারস্বরে চিৎকার করে কেঁদে ওঠা বাচ্চাদের দৃশ্যকে আনেন এবং “হতাশা” শব্দটি দিয়ে সিনেমার পর্দাটা ভরিয়ে তোলেন গোদারের ইন্টারটাইটেলিং-এর ধাঁচে।
“আমি যখন ব্ল্যাটেন্ট (মোটাদাগের) শব্দটি ব্যবহার করি, তখন আমি তাকে যথার্থেই লিখি ইতিবাচক দিকটা ভেবে।” মৃণাল সেন এভাবেই মন্তাজ-এ নিজের বেপরোয়া মানসিকতা স্পষ্ট করেন। (শহরে কলকাতা ৭১ ছবিটি হিট হয় কিছুটা এই কারণেও যে, রাস্তায় নকশাল ও পুলিশের লড়াইয়ের যে দৃশ্যগুলি এতে আছে, তাতে পুলিশের গুলিতে নিহত বহু ছাত্র-ছাত্রীর জীবনের শেষ মুহূর্তটি দেখবার জন্য তাদের শোকার্ত বন্ধু এবং আত্মীয়স্বজন ছবিটি দেখতে আসতেন।) যদিও পদাতিক-এ ওনার নিজস্ব স্টাইল লক্ষ করা যায় দীর্ঘস্থায়ী শটগুলিতে, যার মাধ্যমে ঘরের পরিসর দিয়ে আসা যাওয়ার জটিলটা ফুটে ওঠে। ছবিতে একটা সময় পাঞ্জাবি মেয়েটি যখন তার তিক্ত অতীতের অভিজ্ঞতার কথা বলছে, পর্দায় আমরা প্রায় টানা দু’মিনিট ধরে আনএডিটেড শট দেখি, যেখানে ক্যামেরা চরিত্র এবং আসবাবপত্রের মধ্যে ঘোরাঘুরি করছে।
উনি লক্ষ্য করছেন, “বয়স এবং অভিজ্ঞতা বাড়তে থাকলে আমি সাবধানী এবং সাদাসিধে হতে থাকি।” ওনার কেরিয়ারের এই পরিবর্তনটিকে সত্যজিৎ রায়ের কেরিয়ারের ঠিক উল্টো দিক হয়ে ওঠে, যার প্রতি তিনি একটি অধ্যায়ে বুদ্ধিমত্তা এবং নম্রতার সঙ্গে শ্রদ্ধার্ঘ লিখছেন, যার নাম অপু, চিরকারের অপু। সত্যজিৎ রায়ের ছবির ধরনে যখন নীতিগর্ভ এবং কারিগরি দক্ষতার অনমনীয়তা তৈরি হচ্ছে, মৃণাল সেন তখন নিন্দাবোধের প্রলোভন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ক্রমশ সংযমী হয়ে উঠছেন। একটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে, যা মন্তাজ-এ অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেখানে নকশাল আন্দোলন চলাকালীন সাবধানী বিশ্লেষণী চোখে বানানো সত্যজিৎ রায়ের কলকাতা ট্রিলজি (‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ — ১৯৭০, ‘সীমাবদ্ধ’ — ১৯৭১ এবং ‘জন অরণ্য’ — ১৯৭৬)-র প্রসঙ্গে মৃণাল সেন মনে করেন যে ১৯৫৫ থেকে ১৯৬৫— এই এক দশকে তাঁর শৈল্পিক শ্রেষ্ঠত্ব সীমিত। এভাবেই হয়তো উনি ভুবন সোম-এর প্লটের সমালোচনায় সত্যজিৎ রায়ের শ্লেষাত্মক মন্তব্য “Big bad bureaucrat reformed by rustic belle.”-এর প্রত্যুত্তর দিলেন। বিশেষত, সত্যজিৎ রায়ের শেষ তিনটি ছবি দেখে মৃণাল সেন ‘অস্বস্তি’ অনুভব করেন। এবং সাম্প্রতিক ভারতে লোভ এবং অসহনশীলতা বিষয়ে সত্যজিৎ রায়ের কটু অবধারণায় তিনি ‘let down’ হন। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর পাঁচ বছর বিশ্রাম নিয়ে ব্যাপকভাবে পূজিত সত্যজিৎ রায় যে স্টুডিও-বন্দি উপদেশমূলক ট্রিলজি (‘গণশত্রু’ — ১৯৯০, ‘শাখাপ্রশাখা’ — ১৯৯২ এবং ‘আগন্তুক’ — ১৯৯২) শেষ করবার অব্যবহিত পরেই মারা গেলেন, তা মৃণাল সেনের সমালোচনায় অম্লতা যোগ করে।
মৃণাল সেন মনে করতেন অন্তর্মুখীনতা থেকে “বহির্জগতের বাস্তব”-এর দিকে সরে আসাটা সত্যজিৎ রায়ের ভুল হয়েছিল কারণ এই পরিবর্তনটি ওনার জীবনচর্চার ঠিক বিপরীত। মন্তাজ-এর প্রথম অধ্যায়ে তিনি লিখছেন একটি পরিবারের বড় মেয়ে ফিরে না আসবার ফলে বিনিদ্র রাত কাটানো নিয়ে ১৯৭৯-এ বানানো একদিন প্রতিদিন-এ “ফিল্মমেকার হিসেবে আমার কেরিয়ারে নতুন এক পর্ব শুরু হয়… আমি অন্তরে ঢুকতে চাইছি যা বাইরের দুনিয়া আড়াল করে রাখে। সেই রহস্য, হতাশা, বিভ্রান্তি এবং বৈপরীত্যের আবিষ্কারে।”
উনি নিজের শিল্পশৈলীর সেরা দশ বছর উপভোগ করেন ১৯৭৯-র একদিন প্রতিদিন থেকে ১৯৮৯-র একদিন অচানক সময়কালে। (‘একদিন’ শব্দটির পুনর্ব্যবহারে যেন প্রতিশ্রুত এক সামঞ্জস্যবোধ চিহ্নিত হয়।) এর মধ্যবর্তী ছবিগুলিতেও উনি কলকাতার রাস্তা ছেড়ে শহুরে মধ্যবিত্তের ভাঙাচোরা ঘরবাড়ি এবং একসময়ের অট্টালিকার বর্তমান ধ্বংসস্তূপের ভিতর চলে এলেন। এই পরিবর্তনের ফলে যে সিনেমাগুলি (আকালের সন্ধানে — ১৯৮১, চালচিত্র — ১৯৮১, খারিজ — ১৯৮২, তসভির আপনি আপনি — ১৯৮৪, খণ্ডহর — ১৯৮৪ এবং জেনেসিস — ১৯৮৬) তৈরি হল তার সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের কেরিয়ারের মধ্যভাগে বানানো চেকোভিয়ান গল্পগুলির অল্পের চেয়ে কিছু বেশিই সাযুজ্য আছে।
মৃণাল সেনের খণ্ডহর ছবিটিতে তিন তরুণ সপ্তাহান্তে কলকাতা ছেড়ে নিরিবিলি এক গ্রামে যায়। সত্যজিৎ রায়ের ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ (১৯৬৯) ছবিতেও আমরা দেখেছি কলকাতার চার কেরিয়ারিস্ট শহর ছেড়ে এমনই এক যাত্রায় গেছে। হঠাৎ বেড়িয়ে পড়ার মানসিকতা নিয়ে দুটি ছবি শুরু হওয়ার পর ক্রমশ ছায়াচ্ছন্ন হতে থাকে। জীর্ণ অট্টালিকা এবং অরণ্যের মাঝে শহরবাসী এই অনধিকার প্রবেশকারীরা বিভিন্ন টেনশন সৃষ্টি করে। কিন্তু ওরা কেউ তা সম্পর্কে অবহিত নয়। সত্যজিৎ রায়ের মতোই সাহিত্যিকনির্ভর মৃণাল সেনও বিভিন্ন গল্প এবং উপন্যাস অবলম্বনে ছবি বানিয়েছেন, যদিও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের (সত্যজিৎ রায়ের প্রিয়) গল্প এড়িয়ে চলতেন এই কারণে যে মূল কাহিনীগুলিকে উনি নিজের প্রয়োজনমতো কাটাছেঁড়া করে নিতেন। মন্তাজ -এ তিনি প্রশ্ন তোলেন,
“মিউজিয়ামে রাখা কাঁচের বাক্সে সংরক্ষিত ভঙ্গুর এক শিল্পসামগ্রীর মতো মূলপাঠকে ব্যবহার করাটা কি আমার পক্ষে বাধ্যতামূলক?” এবং চিন্তিত হন এই ভেবে যে রবীন্দ্রভক্তেরা এই ধরনের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন।
দৃশ্যগত দিক থেকে মৃণাল সেন ‘যা একটা কিছু’ ধরনের পরীক্ষামূলক কম্পিত স্টাইলে যে রাজনৈতিক ছবিগুলি বানিয়েছেন, পরিণত বয়সে তাঁর দৃশ্যরচনায় মার্জিত এক ব্যঞ্জনা লক্ষ্যণীয়। প্রথম দিকের ছবিগুলিতে ক্যামেরাকে তিনি যে রুক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করেছেন, তার তুলনায় পরের ছবিগুলিতে শহরের জীর্ণ বাড়িগুলির আনাচেকানাচে ব্যবহৃত ট্র্যাক শটগুলি (উনি বলতেন ট্রলি শট’) অত্যন্ত নমনীয় মনে হয়। এই ট্রলি শটগুলি যে শিল্পসুষমায় আকালের সন্ধানে, খণ্ডহর, এবং জেনেসিস ছবিতে প্রযুক্ত হয়েছে তাতে বিচক্ষণতার সঙ্গে ক্যামেরার মাধ্যমে আউটডোরের গ্রামীণ এলাকাগুলিকে খোলা আকাশের নিচে অপেক্ষাকৃত ছোট অথচ প্রসারিত কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলে ভাগ করা হয়েছে। এই পরিসরগুলির পারস্পরিক যে সম্পর্ক উনি প্রতিফলিত করেন ছবিতে, তা ছিন্ন হয় যখন ক্যামেরা ঘরের অভ্যন্তরকে পর্দায় আনে। একদিন অচানক-এ দেখানো ব্যালকনিটি হয়ে ওঠে পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন বাবার নিজস্ব ব্যর্থতাগুলিকে নির্জনে ফিরে দেখবার স্থান। যে একাকিত্বে নিজের প্রতি সন্দেহ ঘনীভূত হয়। খারিজ-এ কাজের ছেলেটির এক শীতের রাতে ঊষ্ণতার আরাম পেতে সিঁড়ির নিচে নির্দিষ্ট জায়গাটির বদলে রান্নাঘরে শোওয়ার সিদ্ধান্তটি প্রাণঘাতী হয়। যার কথা বাড়ির কর্তা ও গিন্নি না জানলেও তাঁদের জীবনে নৈতিক সংকট ডেকে আনে।
একদিন প্রতিদিন, খণ্ডহর এবং একদিন অচানক— এই তিনটি দ্ব্যর্থক, সচেতনভাবে অসমাপ্ত পারিবারিক ড্রামা বানানোর পর সম্ভবত মৃণাল সেন পিছু ফিরে সামগ্রিকভাবে চিন্তা করে এগুলিকে জবরদস্তি তাঁর ‘দ্য অ্যাবসেন্স ট্রিলজি’ হিসেবে অভিহিত করেন। সেই ট্রিলজির দুই প্রান্তে কলকাতাকেন্দ্রিক যে দুটি ছবি অন্তর্ভুক্ত, তাতে অবশ্য কাঠামোগতভাবে অনুপস্থিতির বিষয়টি রয়েছে। শেষের ছবিটিতে পরিবারের সদস্যরা বিরক্তি সহ বাড়ির কর্তা, একজন শিক্ষাবিদের ফেরবার প্রতীক্ষা করে, যিনি হঠাৎ একদিন বাড়ি ছেড়ে বার হয়ে আর ফিরে আসেন না।
তবে খণ্ডহর-এ অনুপস্থিতির বিষয়টি অপেক্ষাকৃত তির্যক ভঙ্গিতে এসেছে এক তরুণীর গল্পে। যে গ্রামের একদা বিশাল অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষের মাঝে তার অন্ধ শয্যাশায়ী মায়ের শুশ্রূষায় নিবেদিত। পরিচালকের স্ত্রী এবং তাঁর বিভিন্ন ছবির অভিনেত্রী গীতা সেন মায়ের ভূমিকাটিতে অনবদ্য। এখানে অনুপস্থিত মানুষটি হল দীপু নামে এক তরুণ যে তার মেয়ে সরমাকে বিয়ে করবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শহরে চলে যায় এবং অন্যত্র বিয়ে করে। প্রলাপকারী মা এখনও বিশ্বাস করেন দীপু ফিরে এসে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে এবং কলকাতা থেকে যে তিন যুবক ঘুরতে এসেছে, তাদের মধ্যে দীপু আছে। দস্তভয়েস্কির গল্পটি মৃণাল সেন পড়েছিলেন কিনা জানা নেই, যা অবলম্বন করে রবেয়ার ব্রেসো “ফোর নাইটস অফ আ ড্রিমার” (১৯৭১) বানিয়েছিলেন। মন্তাজ-এর শেষ অধ্যায়ের একটি অংশ এই ছবিটির আলোচনায় নিবেদিত।*
অভিনেতা, কলাকুশলী এবং আত্মীয়স্বজন— সবাই যাকে ভালোবেসে ‘মৃণালদা’ বলে সম্বোধন করতেন, সেই মানুষটি অভিনেতাদের ভুল হলে মেজাজ হারাতেন না। ধৈর্য সহকারে একটার পর একটা টেক নিয়ে যেতেন। (অভিনেতা ও কলাকুশলীরা তাদের প্রাপ্য সম্মানদক্ষিণার অনেক কম মূল্যে ওনার সঙ্গে কাজ করতে রাজি ছিলেন।) কিন্তু তিনি অন্যান্য চিত্রপরিচালকদের অনেকের প্রতি তত উদার ছিলেন না। মাইকেলঅ্যাঞ্জেলো আন্তোনিয়নিকে তিনি একজন ভ্রষ্ট ওস্তাদ বলতে চেয়েছেন। আলজেরিয়ার প্রমুখ চিত্রপরিচালক মহম্মদ লাখদার-হামিনাকে তিনি অসৎ এবং নপুংসক বলে অভিযুক্ত করেছেন। এমনকি নিজেকেও ছেড়ে কথা বলেননি। ‘জেনেসিস’ ছবিতে মার্ক্সিস্ট রূপকের অনুষঙ্গকে “বস্তাপচা” বলে নাকচ করেছেন।
আকালের সন্ধানে এবং খণ্ডহর ছবিদুটিতে নিজের শিল্পী সত্তাটিতেই আঁচড়েছেন উনি। খণ্ডহর-এর কেন্দ্রে রয়েছে একজন ফটোগ্রাফার (মূল গল্পটিতে তরুণটি ছিপ ফেলে মাছ ধরতে ভালবাসত)। আকালের সন্ধানে-তে একজন চিত্রপরিচালকের গল্প বলা হয়েছে যে তেতাল্লিশের মন্বন্তর নিয়ে একটি ছবি বানাচ্ছে। দুই শিল্পীর মধ্যেই আত্ম-প্রতিকৃতির আভাস পাওয়া যায় যে ক্ষয় এবং যন্ত্রণার ছবি তুলতে দারিদ্রে আক্রান্ত গ্রামে অনধিকার প্রবেশের স্পর্ধা সম্পর্কে অবহিতই নয়। হতভাগ্য মানুষগুলিকে লাঞ্ছনার মাঝে ফেলে অনায়াসে আরামের সন্ধানে শহরে ফিরে আসে তারা।
উনি একসময়ে বলেছিলেন, “আমি ঘটনাচক্রে ফিল্মমেকার হয়েছি এবং বাধ্য হয়ে কলম ধরেছি।” লেখার প্রতি তাঁর এই তাড়না থেকে জন্ম নেওয়া বইটি বিক্ষিপ্তভাবে সম্পাদিত যেখানে পুনরুক্তি এবং বিভিন্ন লেখনীগত এবং তথ্যগতভাবে অসমীচীন কথা প্রকাশিত। যে স্রষ্টা নিজের শিল্পী হয়ে ওঠাকে দুর্ঘটনা বলে মনে করেন, মন্তাজ-এ প্রকাশিত ভুলগুলি সম্পর্কে তাঁর বিশেষ মাথাব্যাথা থাকবে না। উনি লেভ কুলেশভের ফিল্মিক রিপ্রেসেন্টেশনের ভুল ব্যাখা করেছেন, চিত্রপরিচালক (স্টর্ক, গ্লেজার), কিউরেটর (টম লাডি), ছবির চরিত্রের নাম (ইয়োগো)-র ভুল বানান লিখেছেন, ছবির ভুল নাম (স্টকার) লিখেছেন এবং বহু ছবির বিবরণ ভুল দিয়েছেন, যার মধ্যে প্রমুখ হল আন্তোনিয়নির ‘ল্য নট্টে’।
ছবিতে দেখানো জায়গা নিয়ে ওনার বিভ্রম হওয়া সম্ভব। ইস্তভান জাবো’র ‘সুইট এম্মা’, ‘ডিয়ার বোবে’ কোন শহরে চিত্রায়িত তা চিনতে পারেননি উনি। এবং ‘ফোর নাইটস অফ আ ড্রিমার’-এর ক্ষেত্রে উনি ভুলবশত জোর দিয়ে বলেন, “একটি তরুণী ছাদ থেকে ঝাঁপিয়ে আত্মহত্যা করতে যাচ্ছে” এমন একটি দৃশ্য দিয়ে ছবিটি শুরু হয়। কিন্তু এই সমস্ত ক্ষুদ্র প্রমাদগুলিকে বড় করে দেখলে মৃণালদাকে ছোট করা হয়। যে মানুষটি নিজেকে এবং নিজের শিল্পকে উদ্ভাবন করেছেন এতটা নিরন্তর এবং অবিচলিতভাবে যে, নিজের আত্মজীবনীর নাম রেখেছিলেন “অনবরত জন্মগ্রহণ”।
মূল রচনার ঠিকানা : https://www.nybooks.com/articles/2018/05/24/mrinal-sen-filmmaker-by-accident/
শ্রী ইন্দ্রনীল চক্রবর্তীর সৌজন্যে প্রাপ্ত
From The New York Review of Books
Copyright © 2018 by James Quandt