আমার চেনা মৃণাল সেন

সোমা চ্যাটার্জি

 

 

 

লেখক ফ্রিলান্স সাংবাদিক, চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ ও গ্রন্থপ্রণেতা। মৃণাল সেনের বন্ধু।

 

 

মৃণাল সেনের সবথেকে বড় গুণ ছিল— তিনি নিজের সঙ্গে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের, বা ‘মানুষী’-র, কোনও প্রভেদ করতেন না।

সাংবাদিক হিসাবে আমি বোধহয় এক ডজনেরও বেশিবার ওঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। প্রথম সাক্ষাৎকার নিয়েছি ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে, আর শেষটা ২০১০ সালের মে মাসে— ওঁর পদ্মপুকুরের বাড়িতে— যেখানে গতমাসের ত্রিশ তারিখে উনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। মাঝে কিছুদিন আমার বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা দূরত্বে বেলতলা অঞ্চলের একটা ফ্ল্যাটে ভাড়া ছিলেন। ওঁর বাড়ি গেলে দরজা খুলে দিতেন উনিই।

বাড়িতে ছাড়াও রুদ্ধদ্বার ফিল্ম স্ক্রিনিং বা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালগুলোতেও আমাদের দেখা হয়ে যেত। আমাকে দেখলেই সকলের সামনে হয়ত বলে উঠলেন— “এই আমার বান্ধবী এসে গেছে! ও এত লিপস্টিক লাগায় যে চুমুই খেতে পারি না!” সেই শুনে প্রচণ্ড লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম।

আমার ষাটতম জন্মদিনে হঠাত করে ওঁর বাড়ি চলে গেছি। পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেই— উনি এ-ব্যাপারটা তেমন পছন্দ না-করলেও আমায় বাধা দেননি— জিজ্ঞাসা করলেন বয়স কত হল। ষাট, এ-কথা জানাতেই উনি ছদ্ম-হতাশায় বলে উঠলেন— “ওহ! তবে তো তোমার সঙ্গে আর অ্যাফেয়ার করা যাবে না!” এমনই ছিলেন মৃণাল সেন— বৃষস্কন্ধ না হয়েও এমনই সহজে বহন করতে পারতেন তাঁর বিশ্বজোড়া খ্যাতি।

এই রকমই ছিলেন মৃণাল সেন। যাঁরা জানেন তাঁরা জানেন। যে-ক’দিন সচল ছিলেন, নিজের পায়ে হাঁটতে পারতেন, সে-ক’দিন প্রায় সমস্ত আমন্ত্রণ রক্ষা করেছেন, সমস্ত ধরনের সিনেমার প্রাইভেট স্ক্রিনিং-এ ডাকা হলেই উপস্থিত থেকেছেন। বন্ধুবান্ধব বা সহকর্মীর স্মরণসভায় যেতেন— আক্ষেপ করতেন, উনি রইলেন কিন্তু বয়সে ছোটরা সব একে-একে বিদায় নিচ্ছে।

প্রথম ইন্টারভিউয়ের কথা বলি।

আমি তখন সদ্য-সাংবাদিক। ফিল্ম ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক রামচন্দ্রনজি আমাকে ভার দিলেন ওঁর ইন্টারভিউ নেবার। ফোনে সময় নেওয়া ছিল। তখন থাকেন মতিলাল নেহরু রোডের ফ্ল্যাটে। নিজেই দরজা খুললেন। ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বই-ফাইল-পোর্টফোলিওতে ঠাসা আসবাবে ভর্তি বসার ঘর। সেখানে তখন বসে আছেন সিনেমাটোগ্রাফার কে কে মহাজন, কুমার সাহানি, অভিনেতা অনুপ কুমার (যিনি আবার মৃণাল ও গীতার আত্মীয় ছিলেন)-এর মতো মানুষ যাঁদের মধ্যে প্রথম দুজন তখনও লেগে রয়েছেন প্রতিষ্ঠা পাবার চেষ্টায়। এত সবের মধ্যে গীতা সেন ব্যস্ত হয়ে সকলকে চা, মুড়ি আর গরম-গরম আলুভাজা পরিবেশন করছেন।

অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করছিলাম, দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র পরিচালকের সকলের সঙ্গে সাধারণ, স্বাভাবিক ব্যবহার। শ্রেষ্ঠত্বের ভান নেই এতটুকু। মাথার পিছনে নেই কোনও জ্যোতির্বলয়। আমার সঙ্গে এমনভাবে কথা বলতে শুরু করলেন, যেন আমি ওঁর কতকালের চেনা। ইন্টারভিউয়ের বিষয় ছিল ওঁর কলকাতা ’৭১ ছবিটি, যার শুটিং তখন চলছে। কিন্তু উনি এমনভাবে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে যেতে লাগলেন যে আমার তৈরি করা প্রশ্নপত্র ফেলে দিলেই হয়! ওঁর ছবি বিষয়ে আমার জ্ঞান সীমাবদ্ধ ছিল কিছু বিখ্যাত ছবিতেই— যেমন ভুবন সোম, ওঁর প্রথম হিন্দি ছবি, যদিও ওঁর নিজের হিন্দি ছিল একেবারে ভয়ঙ্কর! সে-কথা অবশ্য উনি স্বীকারও করতেন খোলাখুলি। নিজেকে নিয়ে মজা করার যুগপৎ অসাধারণ ক্ষমতা ও গুণ ছিল মৃণালদার।

এই প্রথম সাক্ষাৎকারের সময়ে, কথাবার্তার ফাঁকে কেউ একজন কোনও এক পত্রিকায় প্রকাশ হওয়া গীতা সেনের ছবি ওঁকে দেখালেন। একেবারে শিশুর মতো খুশি হয়ে মৃণাল সেন গীতার দিকে ফিরে বললেন— “তোমার ছবি কাগজে দেখলে কী ভালো যে লাগে!” শুনে স্বভাবসিদ্ধ মৃদু হাসি গীতাদির মুখে। এইটুকুতেই ওই বসার ঘরে ওঁদের মধ্যকার ভালোবাসার চেহারাটা যেন দেখতে পাওয়া গেল।

অন্য একটা সাক্ষাৎকারে ওঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল— কখনও ওঁর ছবির প্রধান নারী চরিত্রদের প্রেমে উনি পড়েছিলেন কী না। বিশেষত আন্তোনিওনি, বার্গম্যান প্রমুখ সকলেই যখন এ-বিষয়ে একই পথের পথিক। উনি একেবারে অট্টহাসি দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন— “আমার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখো, বুঝতে পারছ না যে আমি আমার নায়িকাদের প্রেমে পড়ানোর মতন অ্যাট্রাক্টিভ নই? আর, আমি ফিল্ম করতে এসেছি বিয়ের পরে। গীতা তখন থিয়েটার করে। তেমন ঘুরে-ফিরে বেড়াবার মতো সুযোগ হল কই? স্ট্রাগলেই তো কেটে গেল কতটা সময়। মানিকবাবুর (সত্যজিৎ রায়ের) ব্যাপার অন্য। অমন হ্যান্ডসাম মানুষ। অভিনেত্রীরা যে ওঁর প্রেমে পড়বেন সেটা তো স্বাভাবিক। একজন অবশ্য পড়েওছিলেন।”

আমাদের দেশের খুব কম চিত্রপরিচালকেরই সৌভাগ্য হয়েছে দুই ভাষায় রচিত প্রায় এক ডজন বইয়ের বিষয় হতে পাবার। মৃণাল সেন ছাড়া ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, আদুর গোপালকৃষ্ণণ আর হাতে-গোনা কয়েকজনেরই এমন স্বীকৃতি মিলেছে। সিনেমার ভাষা ও গঠনপ্রকৃতি সম্পূর্ণ আলাদা হলেও সত্যজিৎ, ঋত্বিক ও মৃণালের মধ্যে কিছু মিল ছিল। এঁদের প্রত্যেকের আদি সাকিন ছিল পূর্ব পাকিস্তান (অধুনা বাংলাদেশ), জন্ম হয়েছিল মোটামুটি একই সময়ে (বিশের দশকে), আর এঁরা প্রত্যেকেই চেয়েছিলেন শিল্প, কলাকুশল আর সিনেমার ভাষার মাধ্যমে একটা নতুন দুনিয়া তৈরি করতে।

১৯৯৯ সালে ভারত ও পাকিস্তান— এই দুই সদ্য-পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন দেশের মধ্যে দু’মাসব্যাপী কার্গিল যুদ্ধের ফলে ভারতের পক্ষে ১৩০০ ও পাকিস্তানের পক্ষে ১৭৫০-এর বেশি মানুষ প্রাণ দিয়েছিলেন। তারপর ২০০১ সালে ভারতীয় সংসদে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক টানাপোড়েন নতুন মাত্রা নিল। তরজা তুঙ্গে উঠল ২০০২ সালে, যখন দুই দেশের মধ্যে আবারও তৈরি হল যুদ্ধ-পরিস্থিতি।

এই ২০০২ সালের এক সন্ধ্যায় দিল্লিতে— তখন রাজ্যসভার সাংসদ হিসাবে ওঁকে ঘন-ঘন দিল্লি যেতে হত— হোটেলের ঘরে বসে মৃণালদা টিভি দেখছেন। এনডিটিভি-র রাজদীপ সরদেশাই তখন ইসলামাবাদে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সঙ্গে কথা বলছেন— আমলা, রাজনীতিবিদ, পথচলতি মানুষ, কে নেই!

মৃণালদা বলছেন— “একটা সময় ক্যামেরাটা রাস্তার এক সবজিবিক্রেতাকে ধরল। রাস্তায় ভিড় ছিল। সরদেশাই মানুষটিকে যুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে বললেন। মানুষটি— হয়ত আনপড়, ফিরে একবার দেখলেন। তারপর একটাই শব্দ উচ্চারণ করলেন— ‘নুকসান’। তারপর যা করছিলেন তাতেই আবার লেগে পড়লেন। হোটেলের ঘরে একা বসে এই একটা কথা আমাকে একেবারে নাড়িয়ে দিল।” বলছেন মৃণাল সেন, যখন জানতে চাওয়া হল ‘আমার ভুবন’ ছবির ভাবনার মূলের কথা। “আমার মনে হল, সীমান্তের এই পারের যে মানুষটা ওঁর মতন— তাঁর জাত, ধর্ম, বর্ণ যা-ই হোক না কেন— যুদ্ধের বিষয়ে সে-ও একই ভাষায় কথা বলবে। যুদ্ধের যা মানে, তার থেকে এই মানেটা অনেক বেশি জোরালো।”

“মানুষকে মান দিয়ে শ্রদ্ধা জানাতে হয়”, এ-কথা বলেছিলেন চে গেভারা। এই নির্দেশ বরাবর মেনে চলেছেন মৃণাল সেন।

আমার ভুবন-এর পরে ছবি করা বন্ধ করে দেন মৃণালদা। ছবিটি তুমুলভাবে সমালোচিত হয়। বাংলা নবধারার ছবির ত্রিনাথ— যাঁরা দেশ আর ভাষার গণ্ডি পার করে বাংলা ছবিকে বিশ্বের মানচিত্রে স্থায়ী স্থান করে দিলেন— তাঁদের শেষতম প্রতিনিধি হয়ে থেকে যান মৃণাল সেন। গত ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখ পর্যন্ত।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4873 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...