![header 27](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2019/03/header-27.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সৌমিত্র দস্তিদার
ঠিক কীভাবে এ লেখা শুরু করব তাই নিয়ে বড় দ্বিধায় আছি। দিনক্ষণ, সংখ্যা তারিখ সব কেমন আবছা হয়ে যাচ্ছে। খোলা আকাশের নিচে যারা অনশনে বসে আছেন তাদের বিষণ্ণ অথচ ক্রুদ্ধ মুখগুলো চোখে ভাসছে। এমন এক রাজ্যে আমরা আছি সেখানে কোনও দাবি অধিকার চাওয়া ‘অপরাধ’। মাননীয়ার মর্জিমাফিক সব চলবে। তিনি কবিতা লিখবেন। চাটুকারের দল বলবে— এ লেখা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও পারতেন না। তিনি ছবি আঁকবেন, ভাঁড়ের দল মুগ্ধ হয়ে তারিফ করবে। তিনি সকাল থেকে রাত আমাদের সকল কাজের অনুপ্রেরণা। তিনি একদা নন-ইস্যুকে অনায়াসে ইস্যু করে আসর মাত করে দিতেন। চম্পলা সর্দার থেকে বিধানসভায় ভাঙচুর। আমরা ‘গণতন্ত্রের স্বার্থে’ কিছু মনে রাখিনি। মনে রাখিনি তানিয়া ভরদ্বাজ ডাক্তার গড়াই কামদুনি পার্ক স্ট্রিট কালনা কাটোয়া কার্টুন কাণ্ড। সাম্প্রতিক ভবিষ্যতের ভূত। আদ্যন্ত স্বৈরতন্ত্রের রাজত্বে দিনের পর দিন ভবিষ্যতের শিক্ষকেরা নিজেদের যথার্থ দাবি সামনে রেখে অনশন চালিয়ে যাচ্ছে আর তাতে মাননীয়া কর্ণপাত করছেন না বলে আমি অন্তত বিস্মিত হচ্ছি না।
পড়ুন — যে যেখানে লড়ে যায়
বিস্মিত হচ্ছি যে বাংলাকে চিনতাম তাকে চিনতে পারছি না বলে। বামপন্থী বাংলা অনেক দিন ধরেই দক্ষিণপন্থার হাত ধরেছে। জনমোহিনী রাজনীতি আর সংস্কৃতি যখন থেকে বামপন্থী দলের একমাত্র চালিকাশক্তি হয়েছে তখন থেকেই পরিবর্তনের সূচনা। নব্বই-পরবর্তী মুক্ত অর্থনীতির দৌলতে যে নব্যবাবু সম্প্রদায় আমাদের চেতনায় এক সুবিধাবাদী ধারার জন্ম দিয়েছে, সেটাই এই দক্ষিণপন্থার ভিত্তি মজবুত করেছে। এত দিন হয়ে গেল ছেলেমেয়েরা না খেয়ে রাস্তায় শুয়ে আছে, ইতিমধ্যেই অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন, আর আমরা অধিকাংশ লোক শুধু সমাজমাধ্যমে তাদের জন্য সহমর্মিতা জানাচ্ছি। অনেকে মেয়ো রোডেও যাচ্ছেন সহমর্মিতা জানাতে। কিন্তু তা যত না পাশে থাকা তার চেয়ে বেশি আত্মপ্রচার। না, সবাই নিশ্চয়ই তা নন। কিন্তু অনেকের মধ্যেই যে এ প্রবণতা আছে সেটা ফেসবুক পোস্ট দেখলেই পরিষ্কার হবে। বামপন্থী সব দল নিঃসন্দেহে প্রথম থেকেই অনশনকারীদের সঙ্গে আছেন। তাদের নেতাকর্মীদের আন্তরিকতার অভাব নেই। ছাত্ররাও আছেন। এখন যাদবপুর প্রেসিডেন্সির ছাত্ররাও আন্দোলনের সমর্থনে প্রতীকী অনশনে বসেছেন। ভালো কথা। কিন্তু কোথায় যেন গোটা বিষয়টির তাল কেটে যাওয়া চেহারা। ঝাঁঝ নেই। বামপন্থীদের অজস্র গোষ্ঠী আলাদা আলাদা কম্পার্টমেন্টে ভাগ হয়ে ভিড় করছে। গোটা চত্বরেই কেমন মেলা মেলা মেজাজ। শুধু মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন তাঁরাই যাঁদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। দীর্ঘ দিন ধরে সংসদীয় রাজনীতি বামপন্থীদেরও কীভাবে শৌখিন করে তোলে তা আর একবার পরিষ্কার হবে অনশনস্থলে এলে। অবাক হয়ে ভাবছি এরকম পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জি কী করতেন! কিম্বা ষাটের, সত্তর দশকের বামেরা! অতি মাত্রায় ছাপোষা, সুবোধ এই বামেদের জন্য কষ্ট হচ্ছে। মেলা মেলা পরিবেশ আর যাই হোক গণআন্দোলনের হাত শক্তিশালী করতে পারে না। এবার কিন্তু অনশনে বসা ছেলেমেয়েদের জন্য সত্যি সত্যি চিন্তা হচ্ছে।
চিন্তা হচ্ছে এজন্যই যে নাগরিক সমাজ যতই চাপ সৃষ্টি করুক রাজনৈতিক বিরোধী দল আন্দোলনের রাশ নিজেদের হাতে তুলে নিতে না পারলে সমস্যা সমাধান হওয়া কঠিন। আর একটা দিক হতে পারে। স্বয়ং মমতা ব্যানার্জি এগিয়ে এসে জট খোলার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা নিলেন। তখন এতদিনের এত জটিলতা নিমেষে মিটে যাবে। আজ শোনাও যাচ্ছে শিক্ষাদপ্তরের কাছ থেকে এ বিষয়ে রিপোর্ট চেয়ে পাঠিয়েছেন তিনি। অর্থাৎ সেদিকেই বিষয়টি এগিয়েছে। তাই যদি হয়, তাহলে ভোটের আগে একসঙ্গে অনেকগুলি বার্তা দিতে পারবেন মাননীয়া। এক, শিক্ষামন্ত্রীটন্ত্রী কেউ নয়। যা করার আমাকেই করতে হয়। নিজের দলের লোকদেরও বুঝিয়ে দেওয়া। তোমরা যে সব অকম্মার ঢেঁকি তা আর একবার জনসমক্ষে নিয়ে আসা। মধ্যবিত্ত এক বড় অংশের চোখে মুখ্যমন্ত্রীর ভাবমূর্তি বলা বাহুল্য আরও উজ্জ্বল হবে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে তাহলে এতদিন তিনি চুপ করে ছিলেন কেন! এটাও তো এক রণকৌশল। জনসাধারণকে বুঝিয়ে দেওয়া সমস্যা সমাধান যখন অসম্ভব হয়ে যাচ্ছে তখন একজনই পারে তার মীমাংসা করতে। এটা যদি হয়, তখন বিরোধী বিশেষ করে বামেদের ওপর আস্থা আজকের অনশনকারীদেরও কতটা থাকবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে। মনে রাখবেন এই ছেলেমেয়েদের অধিকাংশই কিন্তু ঘোষিতভাবে অরাজনৈতিক মানসিকতার। ফলে মমতা ব্যানার্জি আসরে নামলে খুব কমজন মনে রাখবেন বিমান বসু বা সূর্য মিশ্ররা তাদের কী সান্ত্বনা দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই জনসাইকি মমতা ব্যানার্জি খুব ভালো বোঝেন। ‘শত্রু’কে ছোট করে দেখার প্রবণতা আর যাই হোক পরিণত বোধের পরিচয় দেয় না। বামপন্থী চেতনার মানুষ কিন্তু দলে দলে যোগ দিয়েছে এই সঙ্কট সময়ে।
পড়ুন — ইলেকশন এক্সপ্রেস ২০১৯
পাশাপাশি, এই আন্দোলনের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক বোধহয় সমাজের নানা স্তরকে বিষয়টি ভাবিয়েছে। এবং তৃণমূল রেজিমে সম্ভবত এই প্রথম বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশকে আমরা যাবতীয় ভয় ভীতি উপেক্ষা করে প্রতিবাদ করতে দেখলাম। তাদের মধ্যে তথাকথিত সেলিব্রিটি সংখ্যায় কম হলেও কবি অভিনেতা গায়ক নাট্যব্যক্তিত্ব আবৃত্তিকার লেখক নিজের নিজের মতো করে আন্দোলনকারীদের পাশে ছিলেন। যদিও তাদের অনেকেই আবার এসেছিলেন প্রচার পেতে। এতদিনের অনশন তাও নাগরিক সমাজকে সেভাবে নাড়া দিল না বলে অনেকেই আক্ষেপ করছেন। আমি সেই দলে নেই। অর্থনীতি যে নব্য বাবু সম্প্রদায়ের জন্ম দিয়েছে তারা স্বাভাবিকভাবেই আত্মকেন্দ্রিক, সংগ্রামবিমুখ অরাজনৈতিক। ফলে তাদের কাছে কোনও প্রত্যাশা নেই। বামপন্থীরাও সেই বাবু ভদ্দরলোকের অংশ এটা মেনে নিতে এখনও খারাপ লাগে। তাদের শ্রেণিচরিত্র মূলত এলিট মধ্যবিত্ত তা কিন্তু এই বিরাট লড়াইয়েও স্পষ্ট হয়ে গেল।