![asnirban](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2019/05/asnirban.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
অনির্বাণ ভট্টাচার্য
জামুরিয়া। পশ্চিম বর্ধমান। চুরুলিয়া। একশ কুড়ি বছরের শুরুর এক আগুন এই দুহাজার উনিশে। কতটা তীব্র? কাজী নজরুল, আপনি এখনও ব্যক্ত? আপনার মাটিতে? গ্রামে? মোটামুটি এই ছিল খোঁজার শুরুটা। কারণটা। পাশাপাশি সংরক্ষণ, আধুনিকতা, স্থানীয় ছোট বড় মুখ— এসব চেনারও একটা দায় থেকে যায়। মানুষটাকে চিনতে গেলে তার সময়টাকেও জানতে হয়। আগে, পরে অনেকটা পরিধি জুড়ে। প্রিয় পাঠক, আসুন, গল্পে ঢুকে পড়ি।
আসানসোল ঢোকার আগে জামুরিয়া থানার মোড় পেরিয়ে কুড়ি কিলোমিটার। চুরুলিয়া ঢোকার মুখে কাজী নজরুলের প্রতিকৃতি। একটু বেশি গরমে গেছিলাম। মনে হচ্ছিল ঘামছেন। মালায়, গরমে, অসময়ে। মনে হল, ভাল্লাগছে না দাঁড়াতে। হাঁটতে চাইছেন। এগোতে চাইছেন। পাশ কাটিয়ে এলাম।
কাজী নজরুলের প্রতিকৃতি, চুরুলিয়া ঢোকার মুখে
ডান পাশ ঘেঁষে বসতবাড়ি। মোটামুটি কবিতীর্থ চুরুলিয়ার সংজ্ঞা দেওয়া একটি গলি। কবির নিজস্ব ভিটে, খড়ের চালা দেওয়া বাড়ি আজ নেই। ওখানেই চুরুলিয়া নজরুল অ্যাকাডেমি হয়েছে। বাইরে দেওয়ালে দেওয়ালে শিল্পীর তুলি। নজরুলের জীবন। প্রমীলা দেবীর মুখ। লেখা, কথা, জীবনবোধের টুকরো টুকরো অংশ। অ্যাকাডেমির ভেতরে অফিস, ছবি, বইপত্র। বেশ কিছু দুর্মূল্য সংখ্যা নজরে এল। কিনে নিলাম। মুজফফর আহমেদের স্মৃতি। কখনও ডাক্তার বুদ্ধদেব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। নজরুলের জীবনের অনেক অন্য দিক। কাজের বাইরে। ঘর। ঘরণী। প্রমীলা দেবীর কথা। কবির ভ্রাতুষ্পুত্র কাজী রেজাউল করিম কবির স্মৃতি, লেগ্যাসি এখনও ধরে রেখেছেন। কবি, কবিপত্নীর ছবির নিচে বসেন। ওই জায়গাটা বড় প্রিয়। উঠতে মায়া হয়। মনে হয় ওঁদের কাছাকাছি আছেন। গল্পে, শিক্ষায়, জীবনবোধে এখনও সটান রেজাউল। বয়স আশি পেরিয়েছে। হাঁটছেন। আরও অনেকদিন হাঁটবেন।
চুরুলিয়া নজরুল অ্যাকাডেমি
কাজী রেজাউল করিম (কবির ভ্রাতুষ্পুত্র, সাধারণ সম্পাদক, নজরুল অ্যাকাডেমি)
চুরুলিয়ার দেওয়ালে নজরুল, প্রমীলার মুখ
অ্যাকাডেমির পাশেই একটি সংগ্রহশালা আছে। প্রদর্শনী। কবির জীবন। আলোকচিত্র, কিছু আঁকা ছবি। তথ্যবহুল। আলোকচিত্র জীবন্ত মনে হয়। ছোটবেলা। পুরনো ভিটে। অর্থকষ্ট। ‘… দারিদ্র অসহ/ পুত্র হয়ে জায়া হয়ে কাঁদে অহরহ/ আমার দুয়ার ধরি …’। বুলবুলের মুখ। সৈনিক, বেপরোয়া নজরুল। তারকেশ্বর সত্যাগ্রহকালীন তরুণ নজরুল। ধূমকেতুর সেদিনের সংখ্যাগুলো। কখনও পক্ষাঘাতে আক্রান্ত প্রমীলার পাশে নজরুল। তখন স্নায়ুর অসুখ মধ্যগগনে। শেষদিকের অসম্ভব মূর্ত কিছু ছবি। ভারত। বাংলাদেশ। আত্মীয়, বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী, সংবর্ধনার ভিড়। কেন্দ্রে নির্বাক, ছলছলে কবি। ঘোলাটে চোখ। ভাষাহীন।
প্রদর্শনীতে রাখা আলোকচিত্র, কবির জীবনের মুহূর্তেরা
আলোকচিত্রে কবির জন্মভিটে
কবির হাতের লেখা। মনে হয় এখনই উঠে আসা। কাগজ। উড়ে যাবে বলে চাপা দিয়ে রাখা। কবি আসছেন ফিরে। বসার আসন। ব্যবহৃত পোশাক। খাট, চেয়ার। কবি, কবিপত্নীর উষ্ণতা। ধুলো। চিহ্ন। পাওয়া যাবে? খুঁজলে? কবির তানপুরা। পুরনো গ্রামাফোন। রেকর্ড প্লেয়ার। মনে মনে রিভার্স ক্রনোলজিতে গান। কবির গলা। কোরাসে। কখনও তীব্র সোলো ভয়েসে। চুরুলিয়ার আকাশে…
কবির ব্যবহৃত আসবাব
কবির তানপুরা
কবির ব্যবহৃত গ্রামাফোন
পাশেই নজরুল গ্রন্থাগার। এখন নতুন করে সংরক্ষণের পথে। পাশে কবির ছোটবেলার মোক্তব, স্কুলের জায়গায় ১৯৭৩ সালে গড়ে ওঠা চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যাপীঠ। উত্তরসূরি। এখনও এদিকে ওদিকে ছোট ছোট মুখ। স্বপ্নকণ্ঠ। হেথা না আসতে গিয়ে, ইয়া বড় কাস্তে নিয়ে…
চুরুলিয়া নজরুল বিদ্যাপীঠ
স্কুলের পাশেই একটি খোলা জায়গায় প্রতি বছর নজরুল মেলা আয়োজন করে নজরুল অ্যাকাডেমি। ২৬শে মে থেকে ১ জুন। আশেপাশের মানুষের ভিড়। কবির জীবনচেতনার সঙ্গে সাম্প্রতিকতা, সংসারযাপন, মিলনের যোগসূত্র। উপাখ্যান।
পাশেই শয়নযান। কবিপত্নী প্রমীলার সমাধি। ১৯৬২-তে প্রয়াত প্রমীলাকে চুরুলিয়ায় এনে সমাধি দেওয়া হয়। ১৯৭৬-এ ঢাকায় প্রয়াত হন নজরুল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই তাঁর সমাধিস্থল থেকে কবিপুত্র সব্যসাচী কিছুটা মাটি চুরুলিয়ায় আনেন। বিপ্লবী গণেশ ঘোষ একটি অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে ওই মাটি প্রমীলার সমাধির পাশে প্রোথিত করেন। পরে, অনেক পরে একটি নতুন সৌধ নির্মিত হয়। গাছে ঢাকা এক অন্যরকম মায়াময় অঞ্চল। আরাম। আশ্রয়। অন্যলোক। ‘কত জন্ম পরে আমি প্রাণ ভরে ঘুমাইনু মুখ থুয়ে জননীর বুকে…’
কবি, কবিপত্নীর সমাধি
সমাধির পাশে কবির নামে নবনির্মিত স্মৃতিসৌধ
এসব ছাড়িয়ে আরেকটু এগোলে নজরুল অ্যাকাডেমির পূর্বে রাজা নরোত্তম সিংহের গড়। দক্ষিণে সাধক হাজি পালোয়ানের নামে নামাঙ্কিত পীরপুকুর। অদ্ভুত শান্ত পরিবেশ। গাছের ছায়া। নিটোল, নিরালা সকাল, দুপুর। স্নানরত মানুষ। ধর্মের আদানপ্রদান। অবগাহনে ধুয়ে যাওয়া সাম্প্রতিকতার যা কিছু রেশ। পুকুরের পূর্বপাড়ে মাজার শরিফ, পশ্চিমে প্রাচীন এক মসজিদ। উচ্চতায়, স্মৃতিতে যেন সেই একশ কুড়ি বছর পারাপার। কবির পিতা, পিতামহের হেঁটে আসা। আজান।
হাজি পালোয়ানের পীরপুকুর
চুরুলিয়া মসজিদ
এসবের মাঝেই এখনও ব্যক্ত নজরুল। কাজী রেজাউল করিমের কথায়, তাঁর আশি বছরের স্মৃতিতে এই গ্রামে কোনওদিন ধর্মীয় টেনশন দেখেননি তিনি। বাইরের পৃথিবীর রণরক্তসফলতা চুরুলিয়ার আগেই থমকে গেছে। কিছু মাটির বাড়ি, কিছু পাকা বাড়ি সরু সরু রাস্তা দিয়ে গাছের তলায় বেঁকে গেছে। দেওয়ালে লেখা আছে, আঁকা আছে কত কথা। ফেরার সময় মনে হল, কাজী নজরুল তাঁর নাম দিয়ে, জীবন দিয়ে, লেখা দিয়ে অসম্ভব জেগে আছেন চুরুলিয়ায়। এখনও। চলে যাওয়ার তেতাল্লিশ বছর পরেও …