ইয়ং বেঙ্গল-এর স্বাদেশিকতা

রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য

 

১৯৫৮-য় ডিরোজিও আর ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন অধ্যাপক সুশোভন সরকার। এর আগেই, ১৯৪৬-এ অমিত সেন ছদ্মনামে বাঙলা নবজাগরণ (‘বাঙলার’ নয়) নিয়ে তাঁর একটি পুস্তিকা বেরিয়েছিল। তারও পরে বেরিয়েছিল বাঙলা নবজাগরণের ভেতরকার দ্বন্দ্ব নিয়ে তাঁর আরও একটি প্রবন্ধ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৬৭)। ১৯৭৯-এ অন দ বেঙ্গল রেনেসাঁস বইটিতে ডিরোজিও বিষয়ে প্রবন্ধটির একটি পরিপূরক টীকা (সাপ্লিমেন্টারি নোটস)-য় সুশোভনবাবু জানান: আমাদের অল্পবয়সে আমরা লালিত হয়েছিলুম এই ভাবনায় যে ডিরোজিও আর ডিরোজিওপন্থীরা ছিলেন একদল বিপথচালিত ভ্রান্ত লোক; অন্ধ ইংরেজপ্রেমে ভরপুর, আমাদের নিজেদের দেশ ও জনসাধারণ সম্পর্কে উদাসীন, ব্যক্তিগত জীবনে উচ্ছৃঙ্খল আর মদ্যপ (২০০২ পৃ. ১৬০)। ডিরোজিও আর ইয়ং বেঙ্গল নিয়ে সুশোভনবাবুর ১৯৫৮-র লেখাটি ছিল তাঁদের আন্দোলনের সমর্থনে। তার কারণ: তাঁদের নির্দিষ্ট যুক্তিশীল আদর্শবাদ, তাঁদের সাহস আর ব্যক্তিগত দৃঢ়তা (ইনটিগ্রিটি)। বৃদ্ধ বয়সে সুশোভনবাবু লক্ষ্য করলেন ডিরোজিওপন্থীদের সপক্ষে উল্টো প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যেসব বিপ্লবী আধুনিক গুণ তাঁদের ওপর আরোপ করা হচ্ছে সেগুলি তাঁদের প্রকৃত স্বভাবের কাছে অচেনাই লাগত (২০০২ পৃ. ১৬০)।

এর থেকে সুশোভনবাবু সিদ্ধান্ত করেছিলেন: যে-মুহূর্তে কেউ মূর্ত প্রসঙ্গ থেকে বেরিয়ে আসেন, তাঁর পক্ষে ঐতিহাসিক ভারসাম্য রক্ষা করা সত্যিই কঠিন, কারণ সুখদুঃখ বিষয়ে দ্রষ্টা (অবজারভার)-র নিজের একটি ধাঁচা (স্কিম) থাকে (২০০২ পৃ.১৬০)।

আসলে ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বলতে একটি সমসত্ত্ব (হোমোজেনাস) গোষ্ঠী বা দল কল্পনা করাই ভুল। যাঁরাই হিন্দু কলেজে ডিরোজিওর কাছে পড়েছেন, তাঁরা সবাই সবদিক দিয়ে একইরকম ভাবনাচিন্তায় অভ্যস্ত হবেন— এমন ভাবাও অবাস্তব। ‘ইয়ং বেঙ্গল’ বলতে সবদিক দিয়ে একমত কিছু তরুণ কোনোদিনই ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে নানা মত-অমত অবশ্যই ছিল। কিন্তু একটি দিক সকলের ক্ষেত্রেই লক্ষ্য করার মতো: সবকিছু জানার ইচ্ছে আর সেই জানা-কে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে।

একজন ‘ইয়ং বেঙ্গল’-এর দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক, যিনি একইসঙ্গে নিয়ম ও ব্যতিক্রম: প্যারীচাঁদ মিত্র (১৮১৪–১৮৮৩)। জীবনের কোনো পর্যায়ে তিনি মদ ছুঁয়ে দেখেছেন কিনা সন্দেহ। বরং প্যারীচরণ সরকারের আগেই মদ্যপান নিবারণীসভা-র ভিত তৈরি করেছিলেন তিনি, মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কী উপায় (১৮৫৯?) বইটি লিখে। ধর্মীয় মতামতের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন পাকা হিন্দু। নিরীশ্বরবাদ দূরের কথা, সংশয়বাদও তাঁর ধাতে সইত না। আর সে-কথা বলতেও তিনি কোনোদিন দ্বিধা করেন নি (২০১৫ পৃ. ১৬৭)। ইংরিজিতে তিনি প্রচুর লিখেছেন, কিন্তু তার জন্যে তাঁকে অন্ধ ইংরেজপ্রেমী বা নিজের দেশ ও জনসাধারণ সম্বন্ধে উদাসীন ভাবার কোনো সুযোগ নেই। বরং বাঙলা সাহিত্যিক গদ্যর তিনি অন্যতম নির্মাতা। বিশেষ করে মাঝারি ও নিচুরীতির গদ্য রচনায় তাঁর দক্ষতা অসাধারণ। সেকালে (উনিশ শতকের প্রথমভাগে) মেয়েদের পড়ার উপযোগী পত্রিকা বার করা, তাতে ধারাবাহিক উপন্যাস (টেকচাঁদ ঠাকুর ছদ্মনামে আলালের ঘরের দুলাল) রচনা, সংলাপের আড়ালে বিধবা বিবাহ-র মতো সামাজিক সমস্যা নিয়ে মজাদার আলোচনা— এগুলিই তাঁর অক্ষয় কীর্তি। তাঁর গদ্যরীতির নামই হয়ে গিয়েছিল ‘আলালী’, যদিও টেকচাঁদী বা প্যারীচাঁদী বললেই ঠিক হতো। ঘর-সংসার, ব্যাবসাপত্র সব সামলে তিনি নিয়মিত পড়তেন বিচিত্র বিষয়ে: ভারতের ইতিহাস থেকে ব্রহ্মবিদ্যা (থিওজফি)— এমন অনেক কিছু নিয়ে অজস্র পড়েছেন ও লিখেছেন তিনি। তাঁর ইংরিজি রচনাগুলি হালে আবার ছাপা হয়েছে (২০১৫, ২০১৮)। সেগুলি পড়লে একটি বিষয় স্পষ্ট হয়। সেটি এই: শিক্ষিত মানুষদের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধিতার সূচনা হয় কীভাবে। তাঁর জীবন কেটেছে মহারানির, অর্থাৎ ভিক্টোরিয়ার শাসন চালু হওয়ার (১৮৫৮) আগে ও পরে। ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির আমলে উপনিবেশবাদের রূপ আদৌ স্পষ্ট ছিল না, যদিও সেই আমলেই অনেক কটি বিদ্রোহ দেখা দিয়েছিল। সুপ্রকাশ রায়ের বই (১৯৮৯)-এ সেগুলির কথা জানা যাবে। তবে নীলবিদ্রোহ, সিপাহিবিদ্রোহ ইত্যাদি সবই ১৮৫৭ ও তার পরের ঘটনা। প্যারীচাঁদ বা ইয়ং বেঙ্গল-এর কেউই, যতদূর জানি, এইসব বিদ্রোহ সমর্থন করেন নি বা বিদ্রোহীদের সপক্ষে কলম ধরেন নি। জমিদার ও রায়ত— এই দুয়ের মধ্যে তাঁরা একটিকে বিনা ব্যতিক্রমে সমর্থন করতেন না; বরং দুটি শ্রেণীর মধ্যেই ভালো-মন্দ দু ধরণের লোকই আছেন— এই বলে শ্যাম ও কুল দুইই বজায় রাখতেন। আবার বঙ্কিম তাঁর ‘সাম্য’, ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ইত্যাদি রচনায় যে-ধরণের দোলাচল দেখিয়েছেন, তেমন কোনো দৃষ্টান্ত প্যারীচাঁদ বা ইয়ং বেঙ্গল-এর মধ্যে বোধহয় পাওয়া যাবে না। বঙ্কিমের আগেই ইয়ং বেঙ্গল-এর সদস্যরা দ বেঙ্গল স্পেকটেটর-এ যা লিখেছিলেন, তাতে কৃষকদের তথা গ্রামের গরিবদের প্রতি তাঁদের সহানুভূতি চোখে না পড়ে যায় না। বিপাশা রাহা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছেন (২০১২)। এখানে তার উল্লেখই যথেষ্ট।

বিশেষ করে জমিদারের শোষণ আর খাজনা আদায়ের জন্যে রায়তের ওপর বীভৎস অত্যাচার— এই বিষয়টি দ বেঙ্গল স্পেক্‌টেটর-এর অনামা লেখকরা যে-ভাবে হাজির করেছেন তাতে অবাক হতে হয়। কলকাতাবাসী এই তরুণরা কী করে এত খবর জোগাড় করেছিলেন— সেও আশ্চর্য। জমিদারের কর্মচারীদের (খাজনা আদায়ের জন্যে যাদের নিয়োগ করা হতো) আঞ্চলিক নাম ইত্যাদি বোধহয় দ বেঙ্গল স্পেক্‌টেটর ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না, কোনো অভিধানে এখনও সেগুলি নেই। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত চালু হওয়ার আগেও কৃষকদের ওপর কী বর্বর অত্যাচার করা হতো তার এমন নমুনা সে-যুগের আর কোথাও— পত্রিকা বা বইতে— মিলবে কিনা সন্দেহ। সুতরাং বিশ শতকের গোড়ার দিকে, সুশোভন সরকারের কৈশোর-যৌবনে ইয়ং বেঙ্গল-এর বিরুদ্ধে যা যা বলা হতো— সেগুলো আদৌ ঠিক নয়।

আর ইংরেজপ্রেম! আলাল-এর পরিচ্ছেদ ২৫-এ নীলকর সাহেব আর ম্যাজিস্ট্রেট-এর আঁতাত-এর যে-ছবি আছে সেটি একবার পড়ে দেখুন। এরকম আরও নমুনা থাকতে পারে। সেগুলিও খুঁজে বার করা দরকার।

সব শেষে প্যারীচাঁদের হিন্দুদের অধীনে [অর্থাৎ পাঠান-মোগল শাসনেরও আগে] হিন্দুস্তানের অবস্থা রচনা (১৮৩৯-১৮৪১)-টির কথা ভাবা যাক। সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা (সোসাইটি ফর দ অ্যাকুইজিশন অফ জেনেরাল নলেজ, ১৮৩৮-এ প্রতিষ্ঠিত) প্যারীচাঁদ যে-প্রবন্ধগুলি পড়েন সেগুলির ছত্রে ছত্রে তাঁর ভারতপ্রেমই বরং প্রকট। স্বাদেশিকতার একটি লক্ষণই হলো প্রাচীন ঐতিহ্য নিয়ে গৌরব। সেকালে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্পর্কে অল্পই জানা ছিল। সে-নিয়ে ইংরিজিতে যা-কিছু লেখা হয়েছিল, তার প্রায় সবই পড়েছিলেন প্যারীচাঁদ। সংস্কৃত বইও ছাপা হয়েছিল অনেক কম। ভারতের ধর্ম (বৌদ্ধ-জৈন সমেত), রাষ্ট্রনীতি, ব্যাবসা-বাণিজ্য, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা, বিচারপদ্ধতি, আর সব শেষে রাজস্ব ও আরক্ষা (পুলিশ)— এই সবকটি বিষয়েই প্যারীচাঁদ বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন। সর্বদাই সেগুলি প্রশংসাসূচক, সমালোচনামূলক নয়। দেশপ্রেমিক প্যারীচাঁদ কোনো না-সূচক দিকের কথা লেখেন নি। বরং ভারতের নারীশিক্ষা নিয়ে তাঁর বন্ধু, প্রাক্তন ইয়ং বেঙ্গল, পরে পাদ্রি আলেকসান্ডার ডাফ-এর প্রভাবে স্কটিশ প্রেসবিটারিয়ান ধর্মমণ্ডলীর অনুগত, ‌ রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় যা বলেছিলেন, তারই প্রতিবাদ করতে দেখা যায় প্যারীচাঁদকে।

কৃষ্ণমোহন-এর একটি পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রবন্ধর বিরোধিতা করে সাধারণ জ্ঞানোপার্জিকা সভা-র এক অধিবেশনে (১২ জানুয়ারি ১৮৪২) প্যারীচাঁদ একটি রচনা পাঠ করেন। তিনি মনে করিয়ে দেন: এদেশে পুত্র জন্মালে তার বাবা-মা অশুচি হয়ে যান, কিন্তু কন্যা জন্মালে তা হন না। বিভিন্ন পুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি নিজের অন্যান্য বক্তব্য সমর্থন করেন। এমনকি মনুসংহিতা (২।৬৬ ; ৪।১৮৫)-কেও টেনে আনেন।

নারীশিক্ষার ব্যাপারেও, প্যারীচাঁদ দেখাতে চান: প্রাচীন ভারতে মেয়েরাও লেখাপড়া শিখতেন। তার দৃষ্টান্ত আসে কালিদাস-এর কুমারসম্ভব, বিক্রম-উর্বশী আর শকুন্তলা থেকে; ভাগবতপুরাণ-ও তাঁকে সমর্থন জোগায়, কৃষ্ণকে লেখা রুক্মিণীর চিঠির দৃষ্টান্ত দিয়ে। লীলাবতী-র পাশাপাশি আসে তামিল দেশের এক মহিলা দার্শনিকের কথা।  এ ব্যাপারে এইচ. এইচ. উইলসন-এর দ এশিয়াটিক রিসার্চেস আর জার্নাল অফ দ এশিয়াটিক সোসাইটি-তে প্রকাশিত প্রবন্ধ তাঁর সহায়। ‘স্ত্রী-শিক্ষাবিধায়ক জনৈক বুদ্ধিমান হিন্দু ভদ্রলোক’-এর কাছে শোনা কাশীর হটী বিদ্যালঙ্কার-এর নাম করেন তিনি। ঐ মহিলা বিশারদ ছিলেন স্মৃতি এবং ন্যায়শাস্ত্রে। এছাড়া কাল্পনিক চরিত্র, কালিদাস-এর বিদুষী স্ত্রী, ও কর্ণাট দেশের রাজার স্ত্রী, খনা, গার্গী— এঁদের কথাও প্যারীচাঁদ তুলেছেন।

এরকম নানা দৃষ্টান্ত ও যুক্তি দিয়ে প্যারীচাঁদ প্রমাণ করতে চান, তাঁর বন্ধু কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ঠিক কথা বলেন নি। যতভাবে পারেন ততভাবে প্যারীচাঁদ প্রমাণ করবেন: প্রাচীন ভারতে মহিলারা এমন কিছু দুর্দশায় থাকতেন না। তার জন্যে এলফিনস্টোন, মিল প্রমুখের ইতিহাস তাঁর ভরসা। এমনকি স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যে বহুবিবাহ করা যেত না— একথাও তিনি বলেন। অবিবাহিত কন্যারও পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকার ছিল— এ ব্যাপারে প্যারীচাঁদ আশ্রয় করেন রামমোহন রায়-এর নারীজাতির অধিকার সংক্রান্ত পুস্তিকাটির। সেখানেই মনু, বৃহস্পতি প্রমুখ স্মৃতিকারদের বিধান: ছেলে না-থাকলে মেয়েও সিংহাসনে অভিষিক্ত হতে পারবেন। এর সমর্থনে প্যারীচাঁদ উদ্ধৃত করেন মহাভারত-এর একটি বচন।

এতেও সন্তুষ্ট না-হয়ে, গ্রীস ও রোম-এর নারীদের অবস্থার সঙ্গে তুলনা করে মিশর ও ভারতকেই তিনি জিতিয়ে দেন।

কথাটা এই নয় যে, প্যারীচাঁদ যা যা বলেছেন সবই গ্রাহ্য। কিন্তু যে-ভাবে তিনি রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতের বিরুদ্ধে প্রাচীন ভারতের সপক্ষে সওয়াল করেছেন, তাঁর দেশপ্রেমই তাতে প্রকাশ পায়। প্যারীচাঁদ একাই এমন ভাবতেন, প্রাচীন ভারতের গৌরবকে যে-কোনো উপায়ে তুলে ধরার চেষ্টা করতেন— তা না-ও হতে পারে। বরং ইয়ং বেঙ্গল-এর মধ্যে প্যারীচাঁদের মতো একই মনোভাবের লোক আরও ছিলেন— এমন ভাবাই সঙ্গত।

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত একবার লিখেছিলেন: ‘বাঙ্গালার বিপ্লববাদের ইতিহাস বর্ত্তমান বাঙ্গালার ইতিহাস হইতে বাদ দেওয়া যায় না, কারণ ইহা exotic নহে। ইহা বঙ্গের জাতীয় ইতিহাসের ক্রমবিকাশের একটি স্তর মাত্র’ (১৯৮৩ পৃ. ৬)। তাঁর মতে, প্রথম স্তরের সূচনা হয়েছিল ‘রামগোপাল ঘোষের সময় হইতে (নব্য বঙ্গের) ইয়ং বেঙ্গলের অভ্যুদয়’-এ।

কথাটা ভুল নয়। বাঙলা ভাষার চর্চায়, বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে ভারতকে প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় তাঁরাই যথার্থ অগ্রদূত। ২৫ ডিসেম্বর ১৮৩১-এ এঁরাই অকটরলনি মনুমেন্ট (এখন যার নাম শহিদ মিনার)-এর মাথায় ফরাসি সাধারণতন্ত্রর নীল-সাদা-লাল পতাকা উড়িয়ে পালন করেছিলেন ফরাসি বিপ্লবের স্মৃতি দিবস। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত এর সঙ্গে যুক্ত করেছেন রামমোহনের জীবনের একটি ঘটনাকে। ইংল্যান্ডে যাওয়ার পথে একটি ফরাসি জাহাজে সাধারণতন্ত্রর পতাকা উড়তে দেখে অধীর হয়ে উঠেছিলেন রামমোহন। নিজের জাহাজ থেকে ঐ জাহাজে উঠে সেই নীল-সাদা-লাল ঝান্ডাকে সেলাম জানান তিনি। ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত মন্তব্য করেছেন:

[রামমোহন-এর] শিষ্যেরা কলিকাতার মনুমেন্টের শীর্ষদেশে ত্রিবর্ণের পতাকা এক সময়ে উড়াইয়া ছিলেন বলিয়াই আজ [পৌষ, ১৩৪০] ন্যাশনালিষ্টগণ সেই স্থানের নীচে ভারতের জাতীয় আন্দোলনের পতাকা উড়াইতেছেন এবং শ্রমিক আন্দোলনের নেতারা তথায় শ্রমিকদের রক্তপতাকা উড়াইতেছেন (নির্মাল্য বাগচী ১৯৯৪ পৃ. ১৬২-তে সঙ্কলিত)।

গাঁধি তথা ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসকে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমস্ত কৃতিত্ব দেওয়ার জন্যে তার আগের যাবতীয় সূচনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে অনেকদিন ধরে। যেন, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গাঁধি ভারতে ফেরার পরেই সবকিছু ঘটল, তার আগে অবধি সবটাই এক অন্ধকার পর্ব। ইয়ং বেঙ্গল-কে যাঁরা বিশ শতকের গোড়ায় স্বদেশবিমুখ ইংরেজপ্রেমী বলে প্রচার করতেন তাঁরাও প্রকারান্তরে ঐ একই অপপ্রচারের ভাগীদার। ইয়ং বেঙ্গল-এর হ্যাঁ-সূচক দিকগুলিকে তুলে ধরার চেষ্টা সুশোভন সরকারই প্রথম করেছিলেন। এখন নতুন নতুন আবিষ্কারের ভিত্তিতে তাঁদের দেশপ্রেমিক ভূমিকাকে আরও বেশি স্মরণ করা উচিত। না, তাঁরা রাজনৈতিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন নি, কোনো বিপ্লবী রাজনৈতিক চিন্তা প্রচার করেন নি। কিন্তু রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের মূলে যে দেশের মানুষ— একেবারে খেটে-খাওয়া চাষি— তাঁদের অবস্থা, দেশের অতীতকে জানা— এই গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলি করেছিলেন প্যারীচাঁদ মিত্র প্রমুখ ইয়ং বেঙ্গলও। ইয়ং বেঙ্গল সম্পর্কে অরবিন্দ ঘোষ (পরে, শ্রীঅরবিন্দ) ১৮৯৩-এ মন্তব্য করেছিলেন, ‘উদ্দেশ্যর দিক দিয়ে প্রখর দেশপ্রেমিক হলেও মনোভাবের দিক দিয়ে তাঁরা ছিলেন বিজাতীয়ভাবিত (ডিন্যাশনালাইজড)…’ (১৯৬৪ পৃ. ৮)। এই কথাই এখনও আমাদের মনে গেঁথে আছে। ইয়ং বেঙ্গল-এর মূল্যায়নে তাই একটা বিরাট ভুল হয়ে চলে। আমি নিজেও এই দোষে দোষী (২০০৫, পৃ. ৬০; ২০১০ পৃ. ৬০ দ্র.)। আমিও ইয়ং বেঙ্গল সম্পর্কে অবিচার করেছি। এখন সেইসব ভুল শুধরে নেওয়ার সময় এসেছে।

 

রচনাপঞ্জি:

  • নির্মাল্য বাগচী। রামমোহন চর্চা: ইতিহাসে বঞ্চনা ও অবহেলা। সুবর্ণরেখা, ১৯৯৫।
  • ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম। নবভারত, ১৯৮৩।
  • রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বাঙালির নতুন আত্মপরিচয়: সমাজসংস্কার থেকে স্বাধীনতা। অবভাস, ২০০৫, ২০১০।
  • সুপ্রকাশ রায়। মুক্তি-যুদ্ধে ভারতীয় কৃষক। ভারতী বুক স্টল, ১৯৮৯।
  • Mittra, Peary Chand. Selected English Writings. Bangiya Sahitya Parishat, 2015.
  • Mittra, Peary Chand. State of Hindoostan under the Hindoos. Radiance, 2018.
  • Raha, Bipasha. The Plough and the Pen: Peasantry Agriculture and the Literati in Colonial Bengal. New Delhi: Manohar, 2012.
  • Sarkar, Sushobhan. On the Bengal Renaissance. Papyrus, 2002.
  • Sri Aurobindo. Bankim Chandra Chatterji. Pondicherry: Sri Aurobindo Ashram, 1964.

 

কৃতজ্ঞতাস্বীকার:

পার্থসারথি মিত্র, শ্যামল চট্টোপাধ্যায়, সৌরভ বসাক।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4888 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. এইসব প্রবন্ধ যেন পত্রিকার সরতাজ ! প্যারীচাঁদ, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এইসব সত্যিকারের ‘দামাল’ছেলে আজ আর কোথায় ! নিও লিবেরালিজম কি তাদের সম্ভাবনাকে একেবারেই শেষ করে দিল ? নাকি অন্য কোন কারণ ? হিন্দু পেট্রিয়টে চাষির ওপর নীলকরের শোষণের যে তথ্য দিনের পর দিন সরাবরাহ করা হয়েছে তাতে সত্যি আশ্চর্য লাগে ভবানীপুরে বেড়ে ওঠা হরিশ্চন্দ্র গ্রামে গ্রামে ঘুরে কী আগ্রহে এবং আবেগে এতো তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন!

আপনার মতামত...