চার নম্বর নিউজডেস্ক
আজকের এই ভালো খবরের নতুন কিস্তি যে মানুষটিকে নিয়ে তাঁর নাম হেমা সানে। পুনে শহরের বাসিন্দা, সাবিত্রীবাই ফুলে পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বোটানিতে ডক্টরেট অশীতিপর এই বৃদ্ধা প্রায় চল্লিশ বছর পড়িয়েছেন পুনের গারওয়ার কলেজে, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় স্তরে একাধিক টেক্সট বুক লিখেছেন, লিখেছেন বৌদ্ধধর্ম, পরিবেশ ও জল সংরক্ষণ সহ বিবিধ বিষয়ে দশটির মত বই। এতদূর অবধি যে কোনও অ্যাকাডেমিশিয়ানের সাথে হেমা সানের কোনও তফাৎ চোখে পড়ছে না। কিন্তু যদি বলি যে তিনি সারাজীবন ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার করেননি? পুনের সদাব্যস্ত বুধোয়ার পেঠ এলাকায় তাঁর জরাজীর্ণ, গাছপালায় ঘেরা এক কামরা বাড়িতে সন্ধেবেলার পর আলো দেয় শুধু একটি কেরোসিন লণ্ঠন আর এক-দুটি দিয়া? পড়াশুনো আর লেখার অভ্যেস যেহেতু এখনও আছে, তাই নেহাৎ দরকার পড়লে জ্বালিয়ে নেন একটি সোলার পাওয়ার্ড ল্যাম্প?
ইলেকট্রিসিটিকে নিজের জীবন থেকে কেন সরিয়ে রেখেছেন হেমা? বিদ্যুৎ নামক আধুনিক প্রদীপের দৈত্যটিকে কেন হেলায় প্রত্যাখ্যান করেছেন? হেমাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি শুধু বলেন আমার বাবা-ঠাকুর্দা যেভাবে জীবন কাটিয়েছেন আমিও সেই পথেই চলেছি। বিদ্যুতের প্রয়োজনই অনুভব করিনি কখনও। অনেকে বলেন, বিদ্যুৎ ছাড়া জীবন কাটান কী করে? আমি প্রতিপ্রশ্ন করি, আপনারা বিদ্যুতের সান্নিধ্যে কেমন করে কাটান?
সত্যিই তো! বিদ্যুতের অভ্যেস তো ভারতের মানুষের হয়েছে মাত্র কয়েকটি দশক। তার আগে কেমন করে বাঁচত মানুষ? বিদ্যুৎ কি এতই অপরিহার্য? কিন্তু এরকম করে ভাবার অভ্যেস তো আমাদের নেই। আমরা অভ্যেসের দাস। আমাদের জীবনদর্শন তৈরি করে দেয় কনফর্মিটি। কেমন করে বাঁচব সেটা আমরা কবে আর ভেবেছি? শুধু ঢেউয়ে গা ভাসিয়েছি কারণ তার চেয়ে সহজ আর কিছুই হয় না। এই ভাসাভাসি কনজ্যুমারিজমের যুগে স্রোতের বিপরীতে ভাবতে পারে শুধু হেমা সানের মত দু-একজন ব্যতিক্রমী মানুষ। আর সেই ব্যতিক্রমী মানুষদের গায়ে চিপকানোর জন্য লেবেল তো তৈরিই আছে– উন্মাদ।
‘উন্মাদ’ বিশেষণে হেমার কোনও প্রতিক্রিয়া নেই। হ্যাঁ, তিনি উন্মাদ হতেই পারেন। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। তিনি নিজের মত করে বাঁচেন। এক কামরার ঘরের চতুর্দিকে বইপত্র ছড়ানো, ঘরের কোণে একটা গ্যাসের সিলিন্ডার, এক পাশে একটা ওভেন, আর রান্নার কৌটোবাটা। পাঁজর বেরোনো সবকটা দেয়াল, ভাঙাচোরা, হতশ্রী। দেয়ালের বাইরে হরজাই গাছপালার ভিড়, তলায় স্তুপাকৃতি শুকনো পাতা, মাঝ দিয়ে এক ফালি ঝাঁটিয়ে পরিষ্কার করা রাস্তা। হেমা নিজেই ঝাঁট দেন রোজ সকালে, কুয়ো থেকে জল তোলেন বালতি করে, গাছপালার সেবা সেরে স্নান করেন, পুজো করেন। সন্ধেবেলা দুটি গাছের গোড়ায় প্রদীপও জ্বালান। ওরাও তাঁর দেবতা।
“সবাই ভাবে, ইউনিভার্সিটির একজন বিভাগীয় প্রধানকে এমন হতে হবে, অমন হতে হবে। আমি দেখতে এরকম, জামাকাপড় মলিন, এভাবে জীবন কাটাই— এসব তারা মানতে পারত না। আমি বলি, কাজটা যখন আমার দ্বারা হয় তখন আমার ব্যক্তিগত যাপন নিয়ে কার কী এসে যায়?”
কোনওরকম ছকেই হেমাকে ফেলা যায় না। সারাজীবন ইলেকট্রিসিটি ব্যবহার না করার পেছনে যে তাঁর পরিবেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, সেটা বোঝা জটিল নয়। কিন্তু হেমা নিজেকে পরিবেশপ্রেমী বলে দাবি করেন না। কাউকে নিজের মতে দীক্ষিত করারও কোনও বাসনা নেই তাঁর। বলেন, আমি কাউকে বলতে যাই না যে বাড়ির কানেকশন কাটো। আমি এভাবেই বাঁচতে অভ্যস্ত, তাই এভাবেই বাঁচি। “যদি এভাবে বাঁচা সম্ভব হয় তবে আপত্তি কোথায়? পৃথিবীর সম্পদ সীমিত, বাঁচিয়ে না রাখলে চলে? ছ’টা ‘R’ মাথায় রাখা দরকার— রিফিউজ, রিডিউস, রিইউজ, রিসাইকল, রেস্টোর আর রেসপেক্ট। হেমার বেঁচে থাকা এই সব কথা মেনেই, বিশেষত ও মূলত শেষেরটি। শ্রদ্ধা— জীবনের প্রতি সর্বব্যাপী, নিঃশর্ত শ্রদ্ধা। তাই একলা একলা থেকেও কখনও নিঃসঙ্গ বোধ করেন না হেমা। সঙ্গী কুকুর বেড়াল বেজিরা আছে। আর আছে গাছের সূত্রে আনাগোনা করা কতশত পাখি। অনেকে হেমাকে বলেছেন, কেন বেচে দেন না আপনার এই বুনো আস্তানা? বিরাট অঙ্কের টাকা পাবেন তো! উনি বলেছেন, এটা আমার বাড়িই নয়— বাড়ি ওই ওদের। আমি ওদের দেখাশুনো করি শুধু। আমি ছেড়ে চলে গেলে ওদের কে দেখবে? এত গাছ, এত পাখি, কুকুর বেড়াল বেজি সাপ। হ্যাঁ, সাপও। হেমার বক্তব্য, সাপে আমার ভয় নেই অত, যত মানুষে। মানুষ বড় ভয়ানক। তাই বলে মানুষকে এড়িয়েও চলেন না তিনি— তাদের প্রতিও একই শ্রদ্ধা হেমার। সে পাবলিশারের অফিস থেকে প্রায়ই দেখা করতে আসা কর্মীই হোক, পড়া বুঝে নিতে চাওয়া কোনও ছাত্রী, অথবা প্রাক্তন ছাত্র বা দুটো কথা বলতে আসা কোনও পড়শি। হেমার দরজা সবার জন্য খোলা।
ইউটিউবে হেমা সানের নাম দিয়ে সার্চ করলেই দেখতে পাবেন ওনাকে। উনি মানসিকভাবে সুস্থ কিনা আমি বলতে পারি না, তবে পাগল হলে হেমা সানে আমার মনের মত পাগল। বুদ্ধের দর্শনে গভীর প্রজ্ঞাবান হেমা মনে করেন নিজের পথটা নিজেকেই খুঁজে নিতে হয়। জীবনযাপনের কোনও ফর্মুলা হয় না, বা গাইডবুক। একবার খুঁজে পেলে বাকি থাকে শুধু সেইমত বাঁচা— পূর্ণভাবে। ভালো থাকুন হেমা, আপনি পথ পেয়ে গেছেন। আপনি প্রত্যেকবুদ্ধ। আশীর্বাদ করুন যেন আপনার মত পাগল হতে পারি।