গিরীশ কারনাড — থিয়েটার এবং প্রতিবাদীসত্তার আলোয়…

গিরীশ কারনাড | নট ও নাট্যকার

অনির্বাণ ভট্টাচার্য

 

দিন অবসান হল। শিল্পসাধনার সঙ্গে যুক্ত নিরলস একজন মানুষ যখন সমাজের ভেতর তীব্রভাবে জড়িয়ে পড়েন, তখন দুই সত্তা সেই মানুষটির যাপনের ভেতর দিয়ে এক যুগ রচনা করে। তাঁর চলে যাওয়া তাই একটা পরিধির পরিসমাপ্তি হয়। বাইরের দাগ মুছে যায়। ভেতরের বৃত্তে থেকে যায় কাজগুলো।

প্রয়াত গিরীশ কারনাডের কথা বলছি। চার দশকের বেশি সময় জুড়ে অ্যাক্টিভ নাট্য আন্দোলন। অন্যদিকে রাজনৈতিক সঙ্কট এবং হিন্দুত্ববাদের কট্টর সমালোচনা। থিয়েটারে মানুষের কথা বলার পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলনেও মানবতাবাদ এবং মানবাধিকারের পক্ষে সওয়াল। এই দুইয়ে মিলেই গিরিশ কারনাড। আলোচনা করলে দুটো দিকই সমান প্রাসঙ্গিক।

 

নাট্যব্যক্তিত্ব গিরীশ

গিরীশ কারনাড। থাকা, না থাকা এবং চিরকালীন লেগ্যাসি রেখে যাওয়া এক মানুষ, নাট্যব্যক্তিত্ব। দেশের সাংস্কৃতিক পরম্পরার সঙ্গে পাশ্চাত্য অনুষঙ্গের মিশেল— নাটকের নান্দনিকতার সংজ্ঞা দিয়েছিলেন গিরীশ। দেশের বাইরে কোনও ভারতীয় নাট্যকারের নাটকের প্রযোজনা সম্ভবত গিরিশের আগে এতটা ব্যাপকভাবে আর কারও ক্ষেত্রেই হয়নি। পথিকৃত গিরীশ। এদেশের থিয়েটারের শেকড় এবং বহির্বিশ্বের এক চমৎকার ব্লেন্ডিং নির্মাণ করেছিলেন গিরীশ।

নির্মাণ। নতুন আঙ্গিক, বিষয়বস্তু, নিজস্ব শিল্প রীতি। ‘তুঘলক’ মনে পড়ছে। গিরীশ তাঁর নিজের কন্নড় ভাষায় লিখেছিলেন, যার প্রথম ইংরিজি অনুদিত নাট্যরূপের নির্দেশক ই আলকাজি। তৎকালীন বোম্বেতে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামার পক্ষ থেকে যার প্রযোজনা। ২০১২। ফিরোজ শাহ কোটলার ধ্বংসাবশেষ, মুক্ত এক প্রাঙ্গন। তুঘলকের বিরাটাকার প্রদর্শন। নির্দেশনায় ভানু ভারতী। আলোকসজ্জায় ছিলেন আর কে ধিংড়া। মঞ্চসজ্জায় ইনোভেশন, প্রযুক্তির স্মার্ট উপস্থাপনা, মিনিম্যালিজম এবং অভিনয়— এই ‘তুঘলক’ সম্ভবত সবচেয়ে স্মৃতিময় উপস্থাপনা। মিথ এবং ইতিহাস— হাতে হাত ধরে দুইয়েরই সাম্প্রতিকতায় প্রবেশ। তুঘলকের তুরুপের তাস এখানেই। বলতে পারেন প্যারোডি। বলতে পারেন রাজনৈতিক স্যাটায়ার। দুই মিলিয়েই ইতিহাসের এক প্যানোরামিক প্রেক্ষাপটে চরিত্রায়ন, মনঃসমীক্ষা। একটি সিরিয়াস চরিত্রের কমিক ডবল— গল্পের প্রয়োজনে, নাটকের প্রয়োজনে চরিত্রটির রাজনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থান— এবং আড়ালে জাদুকর গিরীশ। তাঁর লেখনী। পরবর্তীকালে অধ্যাপক কে এস রাজেন্দ্রনের নির্দেশনায় ‘আগ্নি আউর বরখা’, ‘ওয়েডিং অ্যালবাম’, ‘বালি’, ‘হায়াবদন’, ‘নাগামন্ডলা’। ‘হায়াবদন’-এই অভিনয়ের ধারাকে পুরো বদলে ফেললেন। বি ভি করন্থ, সত্যদেব দুবে— নির্দেশকদের নিজস্ব প্রযোজনা ভঙ্গিতে ‘হায়াবদন’। মানুষ, মনুষ্যেতর চরিত্র— শরীর ও মনের শিল্পিত সমঝোতা। মিথ। কথা বলা পুতুল। দেবী কালীর আবির্ভাব, যদিও তাতেও বুদ্ধিদীপ্ত প্যাটার্ন। গল্প। ঈশ্বরের ভুল। ‘নাগামন্ডলা’। রহস্য এবং প্রেমের মোড়। অন্ধ নারী, তাঁর ছেলে, যক্ষিণী, একাকিনী এক নারী এবং এক সাপুড়ে। সম্পর্ক, সৃষ্টি ও ভাঙার গল্প। এককথায় যার সংজ্ঞা অসম্ভব।

গিরীশ নিজে আপসহীন ছিলেন। বহুক্ষেত্রে নির্দেশকের সঙ্গে বেঁধে যেত ছোটখাটো বচসা। কখনও মামলা মোকদ্দমা অবধি। নিজের কাজে একফোঁটাও বদল মেনে নেননি মানুষটি। নিজে সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান থাকার সময়ে নেহেরু শতাব্দী নাট্য সমারোহ আয়োজন করলেন— এক ম্যাজিকাল থিয়েটার উৎসব, দিল্লির বুকে ১৯৮৯ সালে যা দেশের নাট্য ইতিহাসে এক মাইলস্টোন ছিল। জীবনটাই নাটক এবং আপসহীনতায় মোড়া এক মানুষ গিরীশ। পছন্দ না হলেই মন্তব্য করতে দ্বিধা করতেন না। সমসাময়িক ভারতীয় নাটকের প্রেক্ষিতে যা মাঝেমধ্যেই বিতর্ক এনেছে, তবু, মানুষ গিরীশ তাঁর বক্তব্য থেকে সরেননি। ওই যে বললাম, আপসহীন। তাঁর যায় আসত না কিছুই।

সঙ্ঘ পরিবার, হিন্দুত্ব এবং প্রতিবাদী গিরীশ কারনাড

বাবরি মসজিদ থেকেই সেভাবে সরাসরি সঙ্ঘীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে হাঁটেন গিরীশ। লঙ্কেশ পত্রিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব। যোগাযোগ। বাবা বুদানগিরি দরগা। কর্ণাটকের ‘দক্ষিণের অযোধ্যা’। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল— হুলিগ্যানিজম। গৌরী লঙ্কেশকে ব্যক্তিগতভাবে অনুরোধ করে জাতীয় স্তরে প্রতিবাদ মিছিলে হাঁটলেন গিরীশ। সৌহার্দ্য বেদিকা সংস্থার হয়ে আন্দোলনে সামনের মুখ হিসেবে গিরীশের মতো প্রতিপত্তিশালী নাট্যব্যক্তিত্ব। ২০০৩ সালেও আরও বড় আকারের সম্প্রতি মিছিলে হাঁটার পরিকল্পনা। যদিও তাঁর আগেই গৌরী এবং গিরীশ গ্রেপ্তার।

সাম্প্রতিকতা। ইউ আর অনন্তমূর্তির সঙ্গে একাসনে গিরীশ। কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতের মূলে ২০১২ সালের কর্ণাটকের প্রিভেনশন অফ কাউ স্লটার অ্যান্ড প্রিজারভেশন (অ্যামেন্ডমেন্ট) বিলের বিরোধিতা। ২০১৫ সালে মহারাষ্ট্রে গোমাংসে নিষেধাজ্ঞায় প্রতিবাদ এবং সরাসরি রাস্তায় নামা। নিজে গোমাংস খাননি, তাহলে কেন প্রতিবাদী? সহজ সরল গিরীশ। একটি সনাতন সাংস্কৃতিক পরম্পরার সঙ্গে জড়িত এই অভ্যেস। যার ওপর নিষেধাজ্ঞা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের অধিকারে পড়ে না। হিন্দুত্ববাদীদের সঙ্গে সরাসরি সংঘাত। টিপু সুলতানের নামে বিমানবন্দরে সহমত। গৌরীর সঙ্গে বন্ধুত্ব। আলোচনায়, ঘটনার ক্রনোলজিতে সেই গৌরী। তাঁর আগে কালবর্গী, দাভোলকর, পানসারে। যুক্তিবাদী হত্যা। গোটা দেশ জুড়ে বীভৎস মব লিঞ্চিং। দলিত হত্যা। সংখ্যালঘু হত্যা। প্রতিবাদী গিরীশ। একসময় গৌরীর হত্যাকারীদের তরফ থেকেই গোপন সূত্রে পাওয়া খবরে গিরীশের নাম হিটলিস্টের এক নম্বরে, বাড়ির চারপাশে সন্দেহজনক মুখ। ওঁত পাতা। সব জেনেও, নির্ভীক এক ব্যক্তিত্ব। ইস্পাতকঠিন।

এবং শেষমেশ ২০১৮। সেপ্টেম্বর। গৌরী হত্যার বর্ষপূর্তিতে মিছিল। সভা। দেশজুড়ে ডেমোক্রেসি অফ ফিয়ার। ‘আরবান নকশাল’। রাস্তায় প্ল্যাকার্ড নিয়ে বসে পড়লেন গিরীশ। ‘মি টু আরবান নকশাল’। ২০১৪ এবং ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে সরাসরি শাসক দলের বিরোধিতা। ধর্মনিরপেক্ষতার স্বার্থে কংগ্রেসকে পূর্ণ সমর্থন।

এবং শেষমেশ জুন। সম্ভবত বিশাল দেশের অগোচরে কোথাও উল্লাস। মব। আরেকজন প্রতিবাদী চলে গেলেন। ক্রমশ যেন কাজ সহজ হয়ে যাচ্ছে ফ্যাসিবাদী শক্তির। তবু, যাঁরা আছেন, বিক্ষিপ্ত হলেও কোথাও গিরীশের লেগ্যাসি আঁকড়ে ধরে এগোবেন। প্রতিবাদী হবেন। থিয়েটার-প্রেমী এক তরুণ প্রজন্ম এখনও এই মাধ্যমকে ভালোবেসে এগোচ্ছেন। আধুনিকতা, কন্টেন্ট, ফর্মে নতুনত্ব আনছেন এঁদের অনেকেই। তৈরি হচ্ছেন, তৈরি হবেন আরও অনেক গিরীশ। হয়ত …

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...