![somen](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2019/07/somen.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সোমেন বসু
জঙ্গল আমাদের ছাড়া বাঁচবে না। আমরাও জঙ্গল ছাড়া বাঁচব না। দিন দুয়েকের জন্যও শহরে কাটানো আমাদের কাছে এক দুঃস্বপ্ন। আমাদের যদি ওখানে সারাজীবন কাটাতে বলা হয়, আমরা নিশ্চিতভাবেই মরে যাব। আমাদের জঙ্গল থেকে উৎখাত করার অধিকার কারও নেই। যদি কেউ তা করতে চায়, তবে সে আমাদের পরোক্ষে মরে যেতেই বলছে।
পূর্ব প্রসঙ্গ হিসেবে আগের লেখাটার[1] উল্লেখ থাক। এ লেখাটিকে তারই ধারাবাহিকতা বলা যেতে পারে।
প্রসঙ্গ পুনরুত্থাপনের সময় হয়েছে। কারণ সামনে ২৭শে জুলাই— সুপ্রিম কোর্ট যে সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিল রাজ্যগুলিকে তার অমানবিক স্বৈরতান্ত্রিক নির্দেশটিকে কার্যকরী করার জন্য। আর তারও আগে ২৪শে জুলাই— যেদিন এই নির্দেশের প্রেক্ষিতে আবেদনের ওপর সুপ্রিম কোর্টে শুনানির দিন ধার্য হয়েছে।
যাঁরা, অনেকেই নিশ্চিত, আগের লেখাটা খোলেননি, তাঁদের জন্য প্রসঙ্গটা উল্লেখ করে দিই। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট একটি রায় দিয়ে ১৮ লক্ষেরও বেশি আদিবাসী এবং অরণ্যবাসী মানুষকে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ করতে বলেছে। কারণ তাঁরা প্রমাণ করতে পারেননি যে তাঁরা তিন পুরুষ ধরে ওই জমিতে বসবাস করছিলেন। সেসব প্রমাণ চাওয়ার নানারকম ঘৃণ্য নজির রাজ্য সরকারগুলি রেখেছে, যার কিছু পূর্বোক্ত লেখাতে উল্লিখিত। এখানে সেগুলি আর বলব না। এবার আপনাকে কষ্ট করে ওটা খুলতেই হবে যদি জানতে চান।
সুপ্রিম কোর্ট এই যে রায় দিয়েছিল, তাতে কেন্দ্র সরকারের সরাসরি কোনও ভূমিকা ছিল না। মামলা করেছিল ওয়াইল্ডলাইফ ফার্স্ট সহ কিছু সংস্থা, রায় দিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত। কিন্তু এই প্রশ্নে বিজেপি সরকারের মনোভাব যে কীরকম, তা যথেষ্টই বোঝা গেছিল মামলায় সরকারের সন্দেহজনক নীরবতা এবং নিষ্ক্রিয়তায়। সরকার যেন তার নিজের বিরুদ্ধে হওয়া এই মামলায় হেরে যাওয়ারই উন্মুখ প্রতীক্ষা করছিল! এবং সেটা যে সত্যিই তাই, নিছক অপদার্থতা নয়, তা স্পষ্ট হয়ে যায় মার্চ মাসে, যখন ব্রিটিশদের ১৯২৭ সালের ইন্ডিয়ান ফরেস্ট অ্যাক্টের ওপর বিজেপি সরকার যে যে সংশোধনীর প্রস্তাবনা করেছে তা প্রকাশ্যে চলে আসে।
সংশোধনীগুলির ওপর একটু চোখ বোলানো যাক। ভুল ভাববেন না। মানে, ব্রিটিশ আইনটি যথেষ্ট কালাকানুন, তাতে সরকার যদি কোনও সংশোধনী আনতে চায়, তো ভালোই— এহেন ভুল ভাবনার কথা বলছি।
সংশোধনীগুলির দুটি দিক। প্রথমত সামরিক-আমলাতান্ত্রিক:
- বন দপ্তর ইচ্ছেমতো ২০০৬-এর ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টের ওপর ভেটো মারতে পারবে। অর্থাৎ, ওই আইন অনুযায়ী আদিবাসী এবং অরণ্যবাসী জনগণ বনজ সম্পদের ওপর যে অধিকার ভোগ করত, এখন থেকে বন দপ্তর সেগুলিকে নস্যাৎ করে দিতে পারবে।
- বন দপ্তরের সামরিক এবং বিচারবিভাগীয় ক্ষমতা উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হবে। তারা যথেচ্ছ গুলি চালাতে পারবে, যা প্রায় ‘শুট অ্যাট সাইট’ ধারার সমতুল্য।
- তাদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজ্য সরকারগুলিও কোনও আইনি ব্যবস্থা নিতে পারবে না।
- তারা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করে কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা নিলে, সেই অভিযুক্তেরই দায় থাকবে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করার।
- আগে বন দপ্তরের লাগু করা কোনও মামলা রাজ্য সরকারগুলি যে মকুব করে দিতে পারত, তা আর তারা পারবে না।
- কেন্দ্র সরকার প্রয়োজনমতো (পড়ুন, ইচ্ছেমতো) রাজ্যের অধীনে থাকা কোনও বনভূমির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। রাজ্যের সিদ্ধান্তকে নাকচ করে।
এবং অর্থনৈতিক:
- কেন্দ্র এবং বন দপ্তর যখনই মনে করবে তখনই কোনও বনভূমি— সম্পূর্ণ বা অংশত— বাণিজ্যিক অরণ্যায়ণের জন্য ব্যবহার করতে দিতে পারবে। সেই বাণিজ্যিক অরণ্যায়ন করবে বন দপ্তর বা কোনও বেসরকারি সংস্থা।
মূলত এই।[2]
এবার বলুন। প্রথমত, যে ধরনের সামরিক পরিবর্তনগুলির কথা বলা হচ্ছে সেগুলি আমরা মিসা, পোটা জাতীয় তথাকথিত সন্ত্রাস দমন আইনে দেখতে পাই। সেগুলিও কালাকানুন নিঃসন্দেহে, তবে তাতে অন্তত একটা ঘোষিত যুক্তি বা লক্ষ্য থাকে যে সেগুলি ব্যবহার করার লক্ষ্য তারাই যারা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে। আইনগুলির যেটুকু ন্যায্যতা, তা ওই জায়গাটিতেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু এক্ষেত্রে? কাদের বিরুদ্ধে বন দপ্তরকে এই অশ্লীল ক্ষমতা প্রদানের কথা বলা হচ্ছে? তাঁরা আমাদের দেশের আদিবাসী জনগণ, দেশের আদি বাসিন্দা, কেন্দ্রের বর্তমান শাসকদলের যে প্রিয় রক্তের বিশুদ্ধতা এবং বহিরাগত তত্ত্ব, সেই যুক্তিতে এই দেশটা আসলে ওই আদিবাসীদেরই। দেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রথমে রায় দিল তাঁদের ভিটে থেকে উচ্ছেদ করার। সরকার তাতে নীরব সম্মতি জানাল। আর তারপর নিজেরা আইন তৈরি করল, যাতে এই উচ্ছেদকার্য চালাতে চরমতম নৃশংস হতেও আর কোনও বাধা রইল না।
এবং সংখ্যাটাও ৮০ লক্ষ! একজন হলেও সেটা অন্যায়। কিন্তু এই বিপুল সংখ্যা সরকার কী চোখে তার দেশবাসীকে দেখে তার একটা পরিচায়ক তো বটেই!
কেউ কি বলছেন যে এই নির্মমতা প্রয়োজন চোরাশিকারি, কাঠপাচারকারী ইত্যাদিদের জন্য? এবং এই আইনের লক্ষ্য তারাই? তাহলে তাদের সবিনয়ে তিনটি কথা জানাই। এক, যে মামলার প্রেক্ষিতে এই এত সব— অর্থাৎ সুপ্রিম কোর্টের রায়, তাতে সরকারের নির্লজ্জ নীরবতা, এবং শেষমেশ ফরেস্ট আইন সংশোধনের এই উদ্যোগ— এই সবের পেছনে সেই ওয়াইল্ডলাইফ ফার্স্টের যে মামলাটি, সেটি হয়েইছিল কিন্তু আদিবাসী এবং অরণ্যবাসী জনগণের বিরুদ্ধে। ২০০৬-এর ফরেস্ট রাইটস অ্যাক্টে এঁদের বনজমিতে অধিকার প্রদানের কথা বলা হয় নানান শর্তসাপেক্ষে। তার বিরুদ্ধেই এই মামলা। এখানে চোরাশিকারিদের কোনও সুদূরতম গল্পও নেই। দুই, চোরাশিকারিরা চোর বা ডাকাত। সন্ত্রাসী নয়, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ফোশনা করেনি তারা। তাদের দমনের জন্য বিশ্বের তথাকথিত বৃহত্তম গণতন্ত্রকে যদি সশস্ত্র বাহিনীর হাতে বেপরোয়া ক্ষমতা তুলে দিতে হয়, তবে এটা মানে মানে মেনে নিতে হয় যে সে গণতন্ত্র নামের যোগ্য নয়, পুলিশ রাষ্ট্রই তার উপযুক্ত অভিধা। এবং তিন, বন দপ্তরের হাতে এইরকম যথেচ্ছ সামরিক ক্ষমতা এবং আইনি রক্ষাকবচ ভারতে নতুন নয়। কাজিরাঙায় বন দপ্তরকে এই অধিকার দেওয়া রয়েছে। যার পরিণাম ২০১০ থেকে ২০১৬-র মধ্যে ৬৫ জন মানুষকে গুলি করে হত্যা এবং ২০১৬-তে একটি সাত বছরের বাচ্চাকে গুলি করে তার জীবনটাকেই সঙ্কটে ফেলে দেওয়া। এ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি আছে। রইল।
কথাটা আগে বহুবার বলেছি, আবারও বলছি, মনে হচ্ছে বলতেও হবে বারবার। বন বলুন, বন্যপ্রাণী বলুন, কি সামগ্রিকভাবে পরিবেশ বা প্রকৃতি বলুন, রক্ষা করতে হলে দ্বারস্থ এবং নতজানু হতে হবে সেই মানুষগুলির কাছে যাঁরা তাঁদের জীবন দিয়েই প্রকৃতির সঙ্গে লেপটে থাকেন। এখন আর বেশি কথা না বাড়িয়ে দুটি উদাহরণ দিই।
এক, কর্নাটকের বিআরটি টাইগার রিজার্ভ যেটি ভারতের প্রথম ব্যাঘ্র অভয়ারণ্য যেখানে স্থানীয় সোলিগা আদিবাসীদের বাঘের সঙ্গেই জঙ্গলে বসবাসের অধিকার দেওয়া হয়েছে। সেখানে ২০১০ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে বাঘের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৬৮তে পৌঁছেছে, অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।[3]
দুই, তেলেঙ্গানা এবং অন্ধ্রের চেঞ্চু আদিবাসীরা জঙ্গলে বাঘের সঙ্গেই থাকেন।[4] তাঁদের একজন, থোকোলা গুরুভাইয়ার কথায়, “আমরা বাঘকে আমাদের সন্তানের মতো ভালোবাসি। যদি কোনও বাঘ বা লেপার্ড আমাদের গরু ছাগল মারে, আমরা রেগে যাই না বা দুঃখ পাই না। আমাদের মনে হয় যেন ভাই আমাদের বাড়িতে বেড়াতে এসে তার যেটা ভালো লাগে সেটা খেয়ে গেছে।”
এবার মিলিয়ে দেখুন শেষ অর্থাৎ অর্থনৈতিক সংশোধনীটির সঙ্গে। তাতেও যদি এই বেপরোয়া সামরিক আয়োজনের উদ্দেশ্য বুঝতে না পারেন তবে মনে করুন বস্তার, নিয়মগিরি, বেদান্ত, স্টারলাইট জাতীয় নামগুলি। সরকারের মতলব দিনের আলোর মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।
তাহলে? সরকার তৈরি, বিচারব্যবস্থা তৈরি, এককথায় রাষ্ট্র তৈরি। আমরা তৈরি তো? হ্যাঁ আমরা। এক ভয়াবহ বর্বরতার মুখে দাঁড়িয়ে থাকা দেশের ৮০ লক্ষ আদিবাসী এবং অরণ্যবাসী জনগণ আ-ম-রা-ই। সেটা যদি উপলব্ধি না করতে পারি তবে আমাদের দশা সেই ব্রেখটের কবিতার মানুষটির মতো হবে!
চরম আয়রনিটা হল, এটাই ঐতিহাসিক হুল বিদ্রোহের মাস!
_______________
[1] https://www.4numberplatform.com/?p=10834
[2] https://thewire.in/rights/modi-government-plans-more-draconian-version-of-colonial-era-indian-forest-act
[3] https://www.survivalinternational.org/news/11004
[4] https://survivalinternational.org/articles/3612-here-we-dont-need-money-to-eat-and-to-live-this-forest-is-our-breath-and-our-life