মন কি বাত

মন্দাক্রান্তা সেন

 

আবার, আবার, আবারও নাগরিকের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকারে হস্তক্ষেপ। আমাদের ভারতীয়দের কাছে পরমশ্রদ্ধেয় ও সম্মানিত নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ শ্রী অমর্ত্য সেনকেও তার থেকে রেহাই দিল না ধর্মান্ধ হিন্দুত্ববাদীরা। চিত্রপরিচালক সুমন ঘোষ তাঁকে নিয়ে যে তথ্যচিত্রটি তৈরী করেছেন, সেটি এখনও আমার দেখার সুযোগ হয়নি। স্বাভাবিক, কেননা ছবিটির মুক্তিই তো শর্তসাপেক্ষে আটকে দিয়েছে ভারতীয় সেনসর বোর্ড। সুমন বলেছেন তিনি ছবিটি অনলাইন প্রকাশ করে দেবেন। এখানে ছোট্ট করে তাঁর উদ্দেশে বলি, সুমন, আপনি এমন একটি ছবি বানিয়েছেন, যাতে হিন্দু মৌলবাদীদের গা’য় ফোস্কা পড়ছে, তার জন্য আপনাকে অভিনন্দন, এবং সেনসর বোর্ডের অযৌক্তিক শর্তের কাছে মাথা নত না করার মানসিক বলিষ্ঠতা দেখাতে পারার জন্য অভিবাদন।

আগেই বলেছি, ছবিটি আমি দেখিনি। কাল একটি টেলিভিশনে এই বিষয় নিয়ে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলাম, সেখানে একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হল ঠিক কোন কোন শব্দে বিপ দিতে বলা হয়েছে। কেউ বলছেন, গুজরাট, গরু, হিন্দু এবং হিন্দুত্ব। আবার কেউ হিন্দুত্বর বদলে বলছেন কাউ। সে যাই হোক না কেন, মোদ্দা ব্যাপারটা ঘুরে ফিরে তাই, স্বাধীন মতপ্রকাশে শাসকের বা শাসকদলের খবরদারি।

এখন দেখা যাক, এই শব্দগুলি শাসকদলের এত গা’য় লাগল কেন। তাদের কি কথাগুলো নিয়ে কোনও অস্বস্তিবোধ বা অপরাধবোধ আছে? তারা কি ভালোই জানে এই শব্দগুলির প্রেক্ষাপট ভারতবর্ষের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়! হ্যাঁ হ্যাঁ আমরা জানি এই শাসকদল মানুষের ভোটেই ক্ষমতায় এসেছে, কিন্তু কোথাও একটা খটকা থেকে যায়। সেটা হল, এই বিষয়গুলো নিয়ে তাঁরা যেভাবে ভাবাবেন, মানুষকে সেভাবেই ভাবতে হবে। মানুষ যদি নিজের মতো ভাবে, যৌক্তিকতা-অযৌক্তিকতা শুভ-অশুভ বিচার করে, তাহলে শাসকের বিপদ। এটা জেনেই কি তাদের এত স্পর্শকাতরতা! এত অসহিষ্ণুতা!

গরু একটি সাধারণ প্রাণী। তাকে গোমাতা বানিয়ে দেশে যাচ্ছেতাই কাণ্ড ঘটছে। সাধারণ মানুষের ওপর নেমে আসছে হিংস্র আক্রমণ। অজুহাত কী? না, তাঁরা গোমাংস ভক্ষণ করেন। আরে শাস্ত্রে পর্যন্ত আছে ব্রাহ্মণের গোমাংস আহার করার বহুবিধ বিবরণ ও যুক্তি, এরা দো দিন কা যোগী তাতে মানুষকে পিটিয়ে মারবে! আমরা সবাই জানি গুজরাটে দাঙ্গাটা কারা বাধিয়েছিল। সবাই জানে। তাই গরু ও গুজরাট নিয়ে কোনও কথা বলা যাবে না। কী আশ্চর্য!

আর হিন্দু ও হিন্দুত্ব! এ বিষয়ে ঠিকাদারি তো তারাই নিয়ে রেখেছেন। তারা বলেন হিন্দু ধর্ম সনাতন ধর্ম। কিন্তু ভুলে যান, হিন্দু আসলে ধর্মই নয়, প্রকৃতপক্ষে তা একটা জাতি। নিজেকে এই জাতির অংশ ভাবতে মানসিক অবসাদের শিকার হতে হয়। ওরা যদি বলে ওরাই সাচ্চা হিন্দু, ওরা যা মানুষকে বোঝায় সেই ভুল হিংস্র শিক্ষাগুলোই হিন্দুত্ব, তাহলে আমি কে? নাঃ, আমি হিন্দু নই। যে ধর্ম ধর্মান্ধতাকে প্রশ্রয় দেয়, তাকে নৃশংসভাবে গণহত্যায় ব্যবহার করে, আমি সেই ধর্মের কেউ নই।

অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ঠিক কী বলেছেন এখনও আমরা জানি না। কিন্তু জানাটা জরুরি। উনি অত্যন্ত মেধাবী একজন মানুষ। তাঁর প্রতিটি বাক্যে শব্দের ব্যবহার নিখুঁত। তাই প্রতিটি শব্দ মূল্যবান। সেগুলো দর্শকদের কাছে পৌঁছতে না দেওয়া দেশবাসীর কাছে একধরণের প্রবঞ্চনা, একটা বিশ্বাসঘাতকতা। হ্যাঁ, তিনি যা বলেছেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলি আমরা সবটাই শুনতে চাই। শোনা দরকার। এই আকালে তিনি জাতির বিবেক, তাঁর কথা শোনা প্রয়োজন।

আবার অন্যদিক দিয়ে মনে হয়, একটা বাক্যে বা একটা বক্তব্যে, একটা শব্দ ছেঁটে দিয়ে, হে শাসক, আপনারা আর কী করবেন? মূল কথাটা বুঝতে তাতে মানুষের কোনও অসুবিধে হওয়ার কথাই নয়। আপনারা বোকা। আপনারা ভাবেন গুজরাট কথাটা বাদ দিলে মানুষ (উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের কথা বাদ দিলাম, তারা মানুষ নয়, পিশাচ) গুজরাটের গণহত্যার কথা ভুলে যাবে, গরু বা কাউ বাদ দিলে একলাখের কথা ভুলে যাবে, হিন্দু ও হিন্দুত্ব কথাটা বাদ দিলে ভুলে যাবে তার অপব্যবহারের কথা। আপনারা জানেন আপনারা ভাবের ঘরে চুরি করছেন। ছবিটি প্রকাশ পাক, আরগুমেন্টেটিভ ইন্ডিয়ানরা পক্ষে-বিপক্ষে তর্ক-বিতর্ক করুন, এই অযৌক্তিক সেনসর কেন! আমি বলি কি, ছবিটা সেনসর করার আগে, নিজেদের মগজকে সেনসর করুন। দেখুন ওখানে অসুস্থ মানসিকতার কথা ক’টা আছে। তারপর সেগুলো রাখতে হয় রাখুন, কেটে বাদ দিলে দিন। নইলে মানুষই ওগুলো কেটে বাদ দেবে। না, অস্ত্র হাতে নয়। সচেতন স্বাধিকারবোধের ধারে।

কে যেন ধুয়ো তুলেছেন : ‘মন কি বাত’? এদেশে এখন মনের কথা বলতে দেওয়া হয় না। কিন্তু আমাদের মনের কথা এই, যে, এই ছবিটা আমরা দেখতে চাই, ওই শব্দগুলোর ওপর কাঁচি চালানো অবস্থায় নয়। আমরা অমর্ত্য সেনের কথা শুনতে চাই। আমরা, যারা বুঝতে পারছি দেশ কী বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তারা শুনতে চাই এই অন্ধকার যুগ পার হয়ে আলোর দিশার কথা।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. সেন্সরশিপ শাসকের ধর্ম। শাসক এই হাতিয়ার ব্যবহার করতেই অভ্যস্ত। কিন্তু এরা ব্যাপারটাকে একেবারে ছ্যাবলামোর পর্যায়ে নিয়ে গেছে…

Leave a Reply to ক.ব. Cancel reply