‘হিন্দ স্বরাজ’ ও গান্ধির শিল্পভাবনা

দেবোত্তম চক্রবর্তী

 

সারা দেশে যখন অর্থনীতি মুখ থুবড়ে পড়েছে; সরকারি ও বেসরকারি ক্ষেত্রে চলছে ব্যাপক ছাঁটাই; সুদের হার ক্রমশ নিম্নমুখী— তখন এই মুক্ত অর্থনীতি, এই অবাধ পণ্যায়ন থেকে মুখ ফিরিয়ে সাধারণ মানুষ এমন এক বিকল্প অর্থনীতির সন্ধানে দিশাহারা যেখানে দেশের অগণিত কৃষক-শ্রমিক-কারিগর পরিবার দু বেলা দু মুঠো খাবার অন্তত পেতে পারেন। এই প্রসঙ্গে অনেকেই গান্ধি প্রদর্শিত গ্রামোন্নয়নের চর্চা শুরু করেছেন। গান্ধি তৎকালীন ভারতবর্ষের প্রায় ৭ লাখ গ্রামের ৯০% মানুষকে যে বিকল্প অর্থনীতির স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তাঁর শিল্পভাবনা আজকের পরিস্থিতিতে কতটা প্রাসঙ্গিক; তাঁর গ্রামোন্নয়নের মডেল আজও কতটা প্রয়োগক্ষম কিংবা সেসব তদানীন্তন সময়েও সফল হয়েছিল কি না— তাঁর জন্মের সার্ধশতবর্ষে সেই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও নির্মোহ বিশ্লেষণ করার জন্যই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।

দক্ষিণ আফ্রিকায় জুলু যুদ্ধের অব্যবহিত পরে ১৯০৬-এর ২২ অগস্ট ট্রান্সভাল সরকারি গেজেটে ‘এশিয়াটিক ল অ্যামেন্ডমেন্ট অর্ডিন্যান্স’-এর কথা প্রকাশিত হয়। নতুন এই অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী ট্রান্সভালে বসবাসকারী আট বছরের ঊর্ধ্বে সমস্ত ভারতীয়কে নতুন করে নাম পঞ্জিভুক্ত করে ছাড়পত্র বা ‘পাসনেওয়ার কথা বলা হয় এবং এই ছাড়পত্র এক জায়গা থেকে অন্যত্র যাওয়া, আইন-আদালত ও অন্যান্য ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক করা হয়। এই আইনের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে গান্ধি শুরু করেন তাঁর জীবনের প্রথম অহিংস নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ সংগ্রাম যা পরবর্তীকালে ‘সত্যাগ্রহ’ নামে সমগ্র বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে।

যদিও গান্ধির সত্যাগ্রহ আন্দোলন ভারতীয়দের সমানাধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে আদৌ ফলপ্রসূ হয়নি। সেই ব্যর্থতার কথা স্বীকার করে হতাশ গান্ধি ১৯০৯ সালের ২৩ জুন নিজেই লিখেছিলেন— “… Indians have been begging for something to be brought to them from England [as a gift]. This shows our utter helplessness. The whites of the Colonies are the strong and favoured sons [of the Empire]. We are the weak and neglected ones. How can the neglected sons get a hearing from the mother against the favoured ones?” (The Collected Works of Mahatma Gandhi, Electronic Book, 98 Volumes, New Delhi, Publications Division, Government of India, 1999; Vol. 9, pp. 391-392; এর পর থেকে কেবলমাত্র CWMG, ৯/৩৯১-৩৯২ লেখা হবে)।

এর মধ্যে দু’দুবার (১৯০৬ এবং ১৯০৯) তিনি এ বিষয়ে ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করে ইংল্যান্ডে হাজির হয়েছেন এবং দু’বারই তাঁকে খালি হাতে দক্ষিণ আফ্রিকায় ফিরতে হয়েছে। এমতাবস্থায় ৩১ জুলাই, ১৯০৯ ইংল্যান্ড থেকে জাহাজে দক্ষিণ আফ্রিকা ফেরার পথে ১৯০৯-এর ১৩ থেকে ২২ নভেম্বর— মাত্র দশ দিনে গান্ধি গুজরাটি ভাষায় লেখেন ‘হিন্দ স্বরাজ’ নামক গ্রন্থটি, পরের বছর নিজেই ইংরেজিতে অনুবাদ করে তা প্রকাশ করেন ‘Hind Swaraj or Indian Home Rule’ নামে। সংস্কাররাচ্ছন্ন বৈষ্ণব পরিবারের প্রাত্যহিক বিচারহীন হিন্দু আচার— গুজরাটের জৈন ঐতিহ্য— বাইবেলের খ্রিস্টিয় পাপবোধ— রাসকিন (Unto This Last)-এর সরল ও সমবেত জীবনের আদর্শ— থরো (On the Duty of Civil Disobedience)-র অসহযোগ এবং টলস্টয় (The Kingdom of God Is within You)-এর খ্রিস্টিয় অহিংসা ও দারিদ্র্যব্রত চিন্তার জগাখিচুড়ি করে গান্ধি নিজে তাঁর রাজনৈতিক বয়ান হিসেবে ভবিষ্যতের ভারতকে চিত্রিত করেন এই গ্রন্থে।

এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠবে ১৯০৯ সালে যে গান্ধি ছিলেন সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ প্রভুদের ‘বিশ্বস্ত’ প্রজা; দক্ষিণ আফ্রিকায় সম্পন্ন ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সমানাধিকার পাওয়ার আশায় যিনি ভারতীয়দের আর্যজাতির বংশধর বলতেও দ্বিধাগ্রস্ত হন না; সারা জীবন যাঁর রাজনৈতিক প্রচারের অন্যতম সহায় হয় রেলপথ; প্রেস এবং টেলিগ্রাফের ব্যবহার যিনি যথেচ্ছ করেন; যিনি নিজে এবং তাঁর রাজনৈতিক সহযোগীদের অধিকাংশই ছিলেন আইনজীবী; সেই একই ব্যক্তি হঠাৎ ব্রিটিশ শাসন তথা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে তুলোধোনা করে ‘Railways, lawyers and doctors have impoverished the country so much so that, if we do not wake up in time, we shall be ruined’ (Hind Swaraj or Indian Home Rule, Ahmedabad, Navajivan Publishing House, 1938, p. 41; এর পর থেকে কেবলমাত্র ‘হিন্দ স্বরাজ’, পৃ. ৪১ লেখা হবে) বললেন কেন? আসলে আধুনিক সভ্যতাকে এই গ্রন্থে চরম আক্রমণ করে তিনি প্রকৃতপক্ষে তাঁর রাজনৈতিক জীবনকেই দীর্ঘস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় তাঁর সত্যাগ্রহের ক্রমাগত ব্যর্থতায় হতাশ গান্ধি উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর ভারতে প্রত্যাবর্তনের সময় সমাগত। এহেন পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষের চরমপন্থীরা পাশ্চাত্য সভ্যতাকে বর্জন করার যে সঙ্কল্প ও চরম অবস্থান নিয়েছিলেন, এই পুস্তকে তার থেকেও এক চরমতম অবস্থান নিয়ে দেখাতে চাইলেন তিনি তাঁদের চেয়েও বেশি র‍্যাডিক্যাল এবং ভারতীয় রাজনীতিতে অধিকতর গ্রহণযোগ্য।

গান্ধির ‘হিন্দ স্বরাজ’-এর মূল কথাই হল সামগ্রিকভাবে আধুনিক সভ্যতা তথা পাশ্চাত্য সভ্যতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এই ঘোষণার প্রধান ও প্রথম যুক্তি হচ্ছে ‘… India, as so many writers have shown, has nothing to learn from anybody else, and this is as it should be.’ (‘হিন্দ স্বরাজ’, পৃ. ৫৬)। এই যে ভারতীয় সভ্যতার প্রতি প্রায়-মৌলবাদী ঝোঁক; এই যে ভারতবর্ষের জানলা দিয়ে আসা অন্যান্য সভ্যতার আলোকে জোর করে বন্ধ করে রাখার চেষ্টা; তার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন: “আমাদের সমগ্র হৃদয়মনকে পাশ্চাত্যের প্রতি বিদ্বিষ্ট করিয়া তুলিবার এই যে বর্তমান সংগ্রাম ইহা একটা আধ্যাত্মিক আত্মহত্যার চেষ্টা মাত্র। আমাদের দম্ভের মোহে আমরা আমাদের গৃহচূড়া হইতে যদি চিৎকার করিয়া বলিতে থাকি যে মানুষের জন্য অসীম মূল্যবান কোনো কিছুই পশ্চিম উৎপাদন করিতে পারে নাই, তবে প্রাচ্যমনের যাহা কিছু দান তাহার মূল্য সম্বন্ধেও সন্দেহের বিশেষ কারণ ঘটাইয়া তুলিব।”

এই গ্রন্থে তিনি ভারতীয় শিল্পব্যবস্থার বিকল্পের সন্ধান দিলেন দেশীয় চরকার প্রসঙ্গ তুলে। শুধু প্রসঙ্গ তুলেই ক্ষান্ত হলেন না, ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের এই চরকা কাটার ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের কথাও বললেও তিনি। যদিও তিনি এই চরকা সম্পর্কে লিখছেন, “১৯০৯ সালে আমি যখন লন্ডন শহরে তখনই চরকা আবিষ্কার করলাম। … কিন্তু আমি তখন তাঁত এবং চরকার মধ্যে পার্থক্যটা জানতাম না এবং ‘হিন্দ স্বরাজ’-এ চরকা বোঝাতে তাঁত শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম” (CWMG, ৪৩/৩৪-৩৫)। পরেও বলেছেন, “এমনকি আমি যখন ‘হিন্দ স্বরাজ’ গ্রন্থে চরকাকে ভারতের বর্ধমান দারিদ্রের মহৌষধ বলে লিখলাম তখনও আমি তাঁত বা চরকা দেখেছি বলে মনে পড়ে না। এমনকি যখন ১৯১৫ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরলাম তখনও বাস্তবক্ষেত্রে কোনও চরকা আমি দেখিনি।”

যাই হোক, ভারতবর্ষে এসে চম্পারণ-আমেদাবাদ-খেড়া-রাওলাট সত্যাগ্রহ পর্বের শেষে গান্ধি ক্রমশ ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সর্বেসর্বা হয়ে উঠলেন। ততদিনে তাঁর রাজনৈতিক গুরু গোখলে প্রয়াত হয়েছেন, মারা গেছেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ তিলকও। এই সন্ধিক্ষণে গান্ধি দেশব্যাপী অহিংস অসহযোগের ডাক দিলেন আর তাঁর প্রধান অস্ত্র হল বিলিতি পণ্য বিশেষত বস্ত্র ‘বয়কট’ এবং অন্যদিকে গঠনমূলক কর্মসূচি হিসেবে ‘স্বদেশি’। এই স্বদেশিরই প্রধানতম রূপ হিসাবে তিনি স্থান দিলেন চরকাকে, যে চরকা তিনি ১৯১৫ সাল অবধি চাক্ষুষ করেননি বলে নিজেই জানিয়েছেন! এক বছরের মধ্যেই স্বরাজ আসার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তিনি জানালেন, “I am a salesman of swaraj. I am a devotee of khadi. It is my duty to induce people, by every honest means, to wear khadi. This, according to me, will help us in securing swaraj” (CWMG, ৩১/২০৩)। আর খদ্দর পরিধানের জন্য তিনি আপামর দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়ে ১৯২৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর বেলগাঁও কংগ্রেসের উদ্বোধনী ভাষণে বললেন, “I am convinced that swaraj cannot come so long as the tens of millions of our brothers and sisters do not take to the charkha, do not spin, do not make khadi and wear it” (CWMG, ২৯/৪৮৩)।

আমরা জানি যে অসহযোগ আন্দোলন সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছিল, স্বরাজও এক বছরের মধ্যে আসেনি; তবুও চরকার মাহাত্ম্য প্রচারে দমলেন না গান্ধি। আবারও ১৯২৫ সালের ২৪ ডিসেম্বর কানপুরে তিনি বললেন, “Even today I tell you with all the confidence that I can command that if only you all completely boycott all foreign and Indian mill-made cloth, you will achieve swaraj within less than a year” (CWMG, ৩৩/৩৪১)। তিনি নিজেই লিখেছিলেন চরকা হবে ভারতবর্ষের ৯০ শতাংশ কৃষিজীবী পরিবার (আগে যা ছিল ৭০% এবং ব্রিটিশ শিল্পনীতির ফলে তা আরও ২০% বেড়ে যায়) বছরের যে ৬ মাস চাষাবাদ না করে বেকার থাকতে বাধ্য হন তাঁদের বিকল্প জীবিকা। কিন্তু বাকি ছ’মাস যখন কৃষকরা চাষাবাদ করেন তখন তাঁদের জীবিকার্জনের ব্যাপারে গান্ধি নীরব। কেন নীরব? কেন তিনি বারংবার চরকার কথা বলেন কিন্তু কাস্তের কথা বলেন না? কারণ তাহলেই তাঁকে জমির মালিকানার অস্বস্তিকর প্রসঙ্গের মুখোমুখি হতে হবে! তিনি তো খোলাখুলিভাবে জমিদার ও মহাজনদের পক্ষে! কাজেই এ কথা স্পষ্ট, শ্রেণিসংগ্রামকে এড়িয়ে এবং ধনতন্ত্রকে বজায় রেখে কেমন করে সমস্যার সমাধান করা যায়— মূলত সেই লক্ষ্যেই গান্ধি গ্রামোন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন।

১৯২১ খ্রিস্টাব্দে আমেদাবাদে কংগ্রেসের বার্ষিক অধিবেশনের আগে রায়বেরিলিতে জমিদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের গণবিদ্রোহকে শান্ত করতে রায়তদের নির্দেশ দিয়ে গান্ধি ১৮ মে, ১৯২১ লেখেন, “Whilst we will not hesitate to advise the kisans when the moment comes to suspend payment of taxes to the Government, it is not contemplated that at any stage of non-co-operation we would seek to deprive the zemindars of their rent. The kisan movement must be confined to the improvement to the status of the kisans and the betterment of the relations between the zemindars and them. The kisans must be advised scrupulously to abide by the terms of their agreement with the zemindars, whether such agreement is written or inferred from custom” (CWMG ২৩/১৫৮)। এই অধিবেশনেও তাঁর নির্দেশে জমিদারগোষ্ঠীকে অভয় দিয়ে ঘোষণা করা হয়, “তাদের [জমিদারদের] বৈধ অধিকারের উপর হস্তক্ষেপ করবার কোনও ইচ্ছাই কংগ্রেস আন্দোলনের নেই। কৃষকগণ কর্তৃক জমিদারদের খাজনা বন্ধ করা কংগ্রেস প্রস্তাবের বিরোধী এবং মৌলিক স্বার্থের পক্ষে ক্ষতিকর।”

১৯২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির যে বারদোলি প্রস্তাবে অসহযোগ আন্দোলন প্রত্যাহার অনুমোদিত হয়েছিল, তার সাতটি ধারার মধ্যে অন্তত তিনটি ধারার উল্লেখ এখানে করলে কংগ্রেস তথা গান্ধির কৃষক-বিরোধী চরিত্রটি আরও একবার উন্মোচিত হয়ে পড়ে। প্রস্তাবের দ্বিতীয় ধারায় সরকারকে বকেয়া কর পরিশোধ করার নির্দেশ দিয়ে বলা হয়: “… the Working Committee of the Congress resolves that mass civil disobedience … be suspended, and instructs the local Congress Committees to advise the cultivators to pay land revenue and other taxes due to the Government, and to suspend every other activity of an offensive character.” জমিদারদের আশ্বাস দিয়ে যথাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম ধারায় বলা হয় “The Working Committee advises Congress workers and organisations to inform the ryots (peasants) that withholding of rent payment to the Zemindars (landlords) is contrary to the Congress resolutions and injurious to the best interests of the country” এবং “The Working Committee assures the Zemindars that the Congress movement is in no way intended to attack their legal rights, and that even where the ryots have grievances, the Committee desires that redress be sought by mutual consultation and arbitration” (R Palme Dutt – India To-Day, Bombay, People’s Publishing House, 1947, p. 290)।

১৯৩১-৩২ সাল নাগাদ পদুকোটা, জম্মু-কাশ্মীর, পুলরা থেকে কৃষক সংগ্রাম যখন সারা ভারতে ছড়াচ্ছে সেই সময় গান্ধি গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে ইংল্যান্ড যান। ইংল্যান্ড থেকে এই বিদ্রোহের বিরোধিতা ও সামন্তপ্রভুদের সমর্থন করে তিনি ঘোষণা করেন, “Even up to now the Congress has endeavoured to serve the Princes of India by refraining from any interference in their domestic and internal affairs” (CWMG ৫৩/৩৬১)। আবার ২৫ জুলাই, ১৯৩৪ জমিদারদের আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন— “ন্যায্য কারণ ছাড়া সম্পত্তির মালিক শ্রেণিদের তাদের সম্পত্তির থেকে আমি বঞ্চিত করতে চাই না। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে তোমাদের হৃদয় পরিবর্তন করা যাতে তোমরা তোমাদের সমস্ত সম্পত্তি তোমাদের প্রজাদের অছি হিসাবে রাখতে পার এবং মুখ্যত তাদের কল্যাণে তা ব্যবহার কর। … আমি কাজ করছি মালিক ও শ্রমিক এবং জমিদার ও প্রজার মধ্যে সহযোগিতা ও সংযোগের জন্য। … আমার স্বপ্নের রামরাজ্য রাজা ও নিঃস্ব উভয়ের অধিকার সুনিশ্চিত করতে চায়। … স্বাধীনতার শান্তিতে থাকার চেয়ে বড় কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা প্রজাদের নেই এবং তারা তোমাদের সম্পত্তি নিয়ে কখনও ঈর্ষা করবে না যদি তোমরা তা তাদের জন্য ব্যবহার করো  (CWMG ৬৪/২৩০-৩২)।”

কৃষকদের এই বাধ্যতামূলক চরকা কাটার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। অসহযোগের উন্মাদনার যুগে চরকার বিরুদ্ধে কলম ধরার জন্য তাঁকে প্রভূত সমালোচনা সহ্য করতে হয়েছে, তবুও এ ব্যাপারে সত্যনিষ্ঠ থেকেছেন তিনি। ১৯২১এর ২৯ অগস্ট ‘সত্যের আহ্বান’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ লেখেন— “একটি কথা উঠেছে এই যে, ভারতে শতকরা আশিজন লোক চাষ করে এবং তারা বছরে ছয় মাস বেকার থাকে তাদের সুতা কাটতে উৎসাহিত করবার জন্যে কিছুকাল সকল ভদ্রলোকেরই চরকা ধরা দরকার। প্রথম আবশ্যক হচ্ছে যথোচিত উপায়ে তথ্যানুসন্ধান দ্বারা এই কথাটি প্রতিপন্ন করা। অর্থাৎ কী পরিমাণ চাষা কতদিন পরিমাণ বেকার থাকে। যখন চাষ বন্ধ তখন চাষারা কোনো উপায়ে যে পরিমাণ জীবিকা অর্জন করে সুতাকাটার দ্বারা তার চেয়ে বেশি অর্জন করবে কি না। চাষ ব্যতিরেকে জীবিকার একটিমাত্র উপায়ের দ্বারা সমস্ত কৃষাণকে বদ্ধ করা দেশের কল্যাণের পক্ষে উচিত কি না সে সম্বন্ধেও সন্দেহ আছে। কিন্তু মূল কথা এই যে, কারো মুখের কথায় কোনো অনুমানমাত্রের উপর নির্ভর করে আমরা সর্বজনীন কোনো পন্থা অবলম্বন করতে পারব না, আমরা বিশ্বাসযোগ্য প্রণালীতে তথ্যানুসন্ধান দাবি করি। তার পরে উপায়ের যথাযোগ্যতা সম্বন্ধে বিচার করা সম্ভবপর।”

স্বদেশির পাশাপাশি অসহযোগের বয়কট অস্ত্রকে যুক্তিজালে ছিন্নভিন্ন করে ওই প্রবন্ধে তিনি আরও লেখেন— “কাপড় পোড়ানোর হুকুম আজ আমাদের ’পরে এসেছে। সেই হুকুমকে হুকুম বলে আমি মানতে পারব না, তার প্রথম কারণ হচ্ছে এই যে, চোখ বুজে হুকুম মানার বিষম বিপত্তি থেকে দেশকে উদ্ধার করবার জন্যে আমাদের লড়তে হবে— এক হুকুম থেকে আর এক হুকুমে তাকে ঘুরিয়ে হুকুম-সমুদ্রের সাতঘাটে তাকে জল খাইয়ে মারতে পারব না। দ্বিতীয় কথা হচ্ছে এই যে, যে কাপড় পোড়ানোর আয়োজন চলছে সে আমার কাপড় নয়, বস্তুত দেশবাসীদের মধ্যে যাদের আজ কাপড় নেই এ কাপড় তাদেরই, ও কাপড় আমি পোড়াবার কে। যদি তারা বলে পোড়াও তা হলে অন্তত আত্মঘাতীর ’পরেই আত্মহত্যার ভার দেওয়া হয়, তাকে বধ করবার ভার আমাদের উপর পড়ে না। যে-মানুষ ত্যাগ করছে তার অনেক কাপড় আছে আর যাকে জোর করে ত্যাগদুঃখ ভোগ করাচ্ছি কাপড়ের অভাবে সে ঘরের বার হতে পারছে না। এমনতরো জবরদস্তির প্রায়শ্চিত্তে পাপক্ষালন হয় না। বার বার বলেছি আবার বলব, বাহ্য ফলের লোভে আমরা মনকে খোয়াতে পারব না। যে কলের দৌরাত্ম্যে সমস্ত পৃথিবী পীড়িত, মহাত্মাজি সেই কলের সঙ্গে লড়াই করতে চান, এখানে আমরা তাঁর দলে। কিন্তু যে মোহমুগ্ধ মন্ত্রমুগ্ধ অন্ধবাধ্যতা আমাদের দেশের সকল দৈন্য ও অপমানের মূলে, তাকে সহায় করে এ লড়াই করতে পারব না। কেননা তারই সঙ্গে আমাদের প্রধান লড়াই, তাকে তাড়াতে পারলে তবেই আমরা অন্তরে বাহিরে স্বরাজ পাব।”

শুধু তাই নয়, উক্ত প্রবন্ধের পরেও এই বিষয়ে ১৩৩২ বঙ্গাব্দের আশ্বিনে সবুজপত্রে ‘স্বরাজ সাধন’ প্রবন্ধে তিনি লেখেন— “চাষী চাষ করা কাজের নিয়ত অভ্যাসের দ্বারা আপনার মনকে ও দেহকে একটা বিশেষ প্রবণতা দিয়েছে। চাষের পথই তার সহজ পথ। যখন সে চাষ করে তখনই সে কাজ করে, যখন চাষ করে না তখন কাজ করে না। কুঁড়ে বলে কাজ করে না, এ অপবাদ তাকে দেওয়া অন্যায়। যদি সম্বৎসর তার চাষ চলতে পারত, তা হলে বছর ভরেই সে কাজ করত। … চাষের উৎকর্ষ উদ্ভাবনের দ্বারা চাষীর উদ্যমকে ষোলো-আনা খাটাবার চেষ্টা না করে তাকে চরকা ঘোরাতে বলা শক্তিহীনতার পরিচয়। আমরা চাষীকে অলস বলে দোষ দিই, কিন্তু তার অবস্থার উন্নতিসাধনের উদ্দেশ্যে আমরা যখন তাকে চরকা ধরতে পরামর্শ দিই তখন সেটাতে আমাদেরই মানসিক আলস্যের প্রমাণ হয়।”

রবীন্দ্রনাথের চরকাবিরোধী চিন্তাধারার জন্য প্রফুল্লচন্দ্র তাঁর তীব্র সমালোচনা করেন। সমালোচনার উত্তরে ‘সবুজপত্র’-র ভাদ্র ১৩৩২ সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘চরকা’ নামক প্রবন্ধটি যেখানে তিনি প্রশ্ন তোলেন, “ভারতবর্ষের তেত্রিশ কোটি লোক স্বভাবস্বাতন্ত্র্যনির্বিচারে এই ঘূর্ণ্যমান চরকার কাছে যে যতটা পারে আপন সময় ও শক্তির নৈবেদ্য সমর্পণ করবে— চরকার কি প্রকৃতই সেই মহিমা আছে।” অসহযোগ পর্বে বিদেশি কাপড় পরিধানকে গান্ধি ‘পাপ’ হিসাবে বিবেচনা করে বলেছিলেন: “I consider it a sin to wear foreign cloth. I must confess that I do not draw a sharp or any distinction between economics and ethics. Economics that hurt the moral well-being of an individual or a nation are immoral and therefore sinful” (CWMG ২৪/৪১৫)। রবীন্দ্রনাথ এই মনোভাবের দৃঢ় বিরোধিতা করে যুক্তি সাজান এইভাবে। অর্থনীতি সম্পর্কে তিনি বলেন: “economics is bundled out and a fictitious moral dictum dragged into its place” [Sabyasachi Bhattacharya (Compiled and Ed.) — The Mahatma and the Poet: Letters and Debates between Gandhi and Tagore 1915–1941, New Delhi, National Book Trust, 2008, p.17]; বিলিতি বস্ত্র সম্পর্কে বলেন বস্ত্র কেনা উচিত ‘economic science’-এর ওপরে নির্ভরশীল হয়ে এবং গোটা ব্যাপারটাকে বিবেচনা করা উচিত ‘the language of economics’-এর ওপরে জোর দিয়ে (Ibid, p.88)।

কৃষকদের কথা ছেড়ে এবার শ্রমিক-কারিগরদের কথায় আসা যাক। যে গ্রামভিত্তিক কুটিরশিল্পের দিবাস্বপ্ন দেশবাসীকে দেখান গান্ধি, তার তত্ত্বগত ভিত্তি যে অত্যন্ত দুর্বল তা তাঁর শিল্পনীতির বিশ্লেষণ করলেই ধরা পড়ে। আমরা জানি, যখন থেকে ক্ষুদ্র উৎপাদনকারীদের উৎপাদন পণ্যে পরিণত হয় এবং ধনতন্ত্রের বাজারে কেনাবেচার বস্তু হয়, তখন থেকেই তা আর ধনতন্ত্রের বাইরে থাকে না, বরং ধনতন্ত্রেরই অধীন হয়ে যায়; বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে তা ধনতান্ত্রিক কেন্দ্রীকরণের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। লক্ষ লক্ষ হস্তশিল্পের শ্রমিক-কারিগর যখন ব্যবসায়ী-মহাজনদের হয়ে তাঁদেরই সরবরাহিত উপাদান দিয়ে সাধারণ মজুরির ভিত্তিতে কাজ করেন, তখন সেই শ্রমিক-কারিগররাও কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে না হোক পরোক্ষভাবে ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যান। সেই কারণেই আমরা দেখতে পাই পল্লী সংগঠনের উদ্দ্যেশ্যে গান্ধি যখন ‘অল ইন্ডিয়া স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশন’ (AISA) বা ‘অল ইন্ডিয়া ভিলেজ ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশন’ (AIVIA) জাতীয় উদ্যোগগুলি গ্রহণ করেন, তখন সেগুলোও ক্রমে ধনতান্ত্রিক চরিত্রের সংগঠনে পরিণত হতে বাধ্য হয়। ১৯৪৬ সালে গান্ধিও উপলব্ধি করেন, যাঁরা পণ্য তৈরি করেন তাঁরা সেইসব পণ্য পরবার জন্য তৈরি করেন না, পরেনও না— কেবল বিক্রি করেন (হরিজন ২১.৭.১৯৪৬)। আর শহরের যাঁরা সেসব পণ্য কেনেন তাঁরা গান্ধির মতে “… had to wear khadi and do the penance. They were willing to buy penance for a few extra rupees which they could easily spare and be called patriots into the bargain” (CWMG ৯১/২৭০-২৭১)।

শুধু কি তাই? এই শ্রমিক-কারিগররা মজুরিতে ঠকেন, মহাজনদের শোষণের শিকার হন। গান্ধি নিজেই লিখেছেন, ‘যাঁরা সুতো কাটেন তাঁরা মজুরিতে ঠকেন। মজুরি যথাসম্ভব কমানো হয়’ (হরিজন ১৩.৭.১৯৩৫)। এমনকি অবিকল ধনতান্ত্রিক রীতিতে ছাঁটাই-এরও প্রস্তাব ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (হরিজন ১০.৮.১৯৩৫)। কুটিরশিল্পের এই ধনতান্ত্রিক চরিত্রে রূপান্তর সম্পর্কে গান্ধি নিজেই স্বীকার করে লেখেন, “What we do today is to go to the villagers with a money-bag like bankers and promise four or six annas for spinning” (CWMG ৮৫/৪৯)। পাশাপাশি দেশ ছেয়ে যায় নকল খদ্দরে। এই তিক্ত অথচ বাস্তব অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়ে গান্ধি চেষ্টা করেন খদ্দরের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রাখতে, কিন্তু তাতেও যে তিনি সম্পূর্ণ আস্থাশীল হতে পারেন না সেটা স্পষ্ট হয় যখন তিনি লিখতে বাধ্য হন, “Letters are coming in from everywhere telling me that greedy persons have been selling foreign or mill-made cloth by passing it off as khadi and they also put up the price of such cloth. This does not surprise me. When the entire system of government is based on fraud, what else can we expect from people? … The easiest safeguard against this is that every village should produce its own khadi and that people in the cities should buy only such khadi as does not look like mill-made cloth, and that too preferably stamped with a Congress mark. Even if all these precautions are taken, there is no guarantee that there would be no danger of fraud” (CWMG, ২৪/১৭০)।

তিনি দেশীয় মিলমালিকদের সততার ওপরও ভরসা হারিয়ে ফেলে বলেন, “It is foolish to expect any big sacrifices from the mill-owners. They will be the last, not the first, to wake up, and we should conduct our struggle on that assumption. To blame them on this ground is to blame human nature. In their place we would certainly behave in much the same way” (CWMG, ২৪/৩৮০)। যদিও মিলমালিকরা খদ্দর পরিধানের এই লাগাতার প্রচারের ফলে যথেষ্ট লাভের সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত হন না! গান্ধির নিজের কথায়, “মিল সব খাদি প্রচারে রুষ্ট নয়। বরং তার বিপরীত। অনেক মিল এজেন্ট আমাকে নিশ্চিত করে জানিয়েছেন যে তাঁরা খাদি প্রচারে উপকৃত হয়েছেন। কারণ এই প্রচার বিদেশিবস্ত্র-বিরোধী আবহাওয়া গড়ে তুলেছে। এতে তাঁরা তাঁদের অপেক্ষাকৃত মোটা কাপড় বিক্রি করতে সক্ষম হচ্ছেন” (CWMG, ৪২/১০)। ওই একই প্রবন্ধে তিনি মিলে জাল খদ্দর উৎপাদনের পরিসংখ্যান তুলে ধরে দেখান যে মিলে জাল খদ্দর উৎপাদনও হু হু করে বেড়ে চলেছে।

‘হিন্দ স্বরাজ’-এর উনবিংশ পরিচ্ছেদে মিলমালিকদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ এড়িয়ে যাওয়ার কৌশল হিসাবে তিনি লিখেছিলেন, “We cannot condemn mill-owners; we can but pity them. It would be too much to expect them to give up their mills, but we may implore them not to increase them. If they would be good they would gradually contract their business. They can establish in thousands of households the ancient and sacred handlooms and they can buy out the cloth that may be thus woven” (‘হিন্দ স্বরাজ’, পৃ. ৮৯)। অথচ বাস্তবচিত্র দেখতে পেয়ে তিনি লেখেন, “নতুন মিল সহজে গড়া যায় না। তার জন্য কাউকে বিশেষ চেষ্টাও করতে হয় না। ধনীরা নিজেরাই চেষ্টা করে এবং সংখ্যা বাড়িয়ে যায়” (CWMG, ২১/৩৪)।

অর্থনীতির ইতিহাস পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই, কুটিরশিল্পের জন্য যাঁরা বেশি করে বলেন তাঁদের আসল বাসনা থাকে বৃহৎ শিল্পের জন্য সংরক্ষণ শুল্ক এবং তারই সাহায্যে ঘটে বৃহৎ শিল্পের প্রসার। বলা বাহুল্য, ভারতীয় শিল্পপতিরাও খাদিকে জনপ্রিয় করার চেষ্টার ওই অর্থই বুঝতেন। তাই ১৯২৪ সালের ১১ জুন ঘনশ্যামদাস বিড়লা গান্ধিকে চিঠিতে লেখেন, “আমরা খাদিকে জনপ্রিয় করতে পারি এবং সংরক্ষণ শুল্ক দ্বারা ব্রিটিশ পণ্যের বয়কটকে সুনিশ্চিত করতে পারি।” গান্ধিকেও বলতে দেখি, “Protection of her staple industry is her birthright. I would therefore protect the Indian mills against foreign competition even though for the time being it may result in mulcting the poor people. Such mulcting can take place only if the mill-owners be so unpatriotic as to raise prices owing to the monopoly they may secure. I have therefore no hesitation in advocating the repeal of cotton excise duties and imposition of a prohibitive import duty” (CWMG, ২৯/৪৫)। তাই যদি তিনি চান তবে তো এটাও তাঁর বোঝার কথা যে, একই সঙ্গে একই দেশে একদিকে কুটিরশিল্পের প্রস্তাব এবং অন্যদিকে সংরক্ষণ শুল্কের দাবি অচল কারণ মিল শিল্প একচেটিয়া হলে চরকার কোনও স্থানই থাকতে পারে না। তিনি তো দেখেছিলেন তাঁর সঙ্ঘের ধনতান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থায় রূপান্তর, দেখেছিলেন মিলমালিকদের অসততা, দেখেছিলেন খদ্দরের অকারণ মূল্যবৃদ্ধি তবুও তিনি সংরক্ষণ শুল্কের হয়ে ওকালতি করেন কাদের স্বার্থে?

আসলে গান্ধি কাদের প্রতিনিধি, কাদের হয়ে তিনি নিরন্তর সওয়াল করে চলেন তা তাঁর মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের চিন্তাভাবনা বিশ্লেষণ করলে আমাদের কাছে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে ওঠে। মালিক-শ্রমিক সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিত তার ছবি তিনি তুলে ধরেন ‘ইয়ং ইন্ডিয়া’ পত্রিকার ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯২০ সংখ্যায়— “If on the other hand they take their stand on pure justice and suffer in their person to secure it, not only will they always succeed but they will reform their masters, develop industries and both master and men will be as members of one and the same family.” ওই একই পত্রিকায় তিনি লেখেন: “…যখন কারখানার শ্রমিকরা কারখানার মালিকের সঙ্গে নিজেকে এবং নিজের স্বার্থকে এক করে দেখতে শিখবে, নিজেকে উন্নত করতে শিখবে, তখন তারা আর তাদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দেশের কলকারখানা সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠবে।”

শ্রমিক শ্রেণি যাতে ধর্মঘট করে বা বৃহত্তর আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়ে মালিকদের বেকায়দায় না ফেলতে পারে, সে বিষয়ে তিনি ছিলেন সর্বদা সতর্ক ও সচেতন। এই কারণেই ১৯২১ সালে রেলওয়ে এবং বাষ্পীয় জাহাজ শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রসঙ্গে তিনি লেখেন, “In India we want no political strikes. …We must gain control over all the unruly and disturbing elements, or isolate them. …We seek not to destroy capital or capitalists, but to regulate the relations between capital and labour. We want to harness capital to our side. It would be folly to encourage sympathetic strikes” (CWMG ২৩/২৮৫)। ১৯২১ সালে ইয়ং ইন্ডিয়া পত্রিকায় ‘দ্য লেসন অফ আসাম’ প্রবন্ধটিতে তিনি এ-ও বলেন: “In India we want no political strikes. … We must gain control over all the unruly and disturbing elements … We seek not to destroy capital or capitalists, but to regulate the relations between capital and labour. We want to harness capital to our side. It would be folly to encourage sympathetic strikes” (CWMG ২৩/২৮৫)। না, এখানেই তিনি থেমে থাকতে চাননি! বরং শোষকদেরই শোষিতদের অছি বা ট্রাস্টি হিসেবে দেখতে চেয়ে তিনি বলেন— “My attitude would be to convert the better-off classes into trustees of what they already possessed. That is to say, they would keep the money, but they would have to work for the benefit of the people who procured them their wealth. And for doing this they would receive a ‘commission’” (CWMG ৫৪/১০২-১০৩)।

সারা জীবন ধরে যিনি চরকাকে ‘অহিংসার প্রতীক’ বলে ঘোষণা করেছেন তিনি জীবনের উপান্তে এসে ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে স্বীকার করতে বাধ্য হন: “কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে ওইরূপ বাধ্যতামূলক শ্রমের কথা উল্লেখ করেছেন। যুগ যুগ ধরে চরকা হিংসার, শক্তিমানের শক্তি প্রয়োগ ও জোর করে বাধ্যকরণের প্রতীক থেকেছে” (CWMG ৮৪/৩৫৫)। চরকা নিয়ে গান্ধির এই নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা যে আদতে ব্যর্থ অভিযান মাত্র সে কথাও স্বীকার করে নিয়ে তিনি লেখেন: “There are seven lakh villages in India. Thousands of them do not even know what the charkha is. This is our fault and it is because of this fault that we have failed to put khadi work on a sound basis” (CWMG ৮৪/৩৪২)। হায়, তাঁর এই উপলব্ধি যদি ২৫টা বছর আগে হত!

 

গান্ধি রচনাবলি পাওয়া যাবে এই লিঙ্কে:

https://www.gandhiashramsevagram.org/gandhi-literature/collected-works-of-mahatma-gandhi-volume-1-to-98.php

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

3 Comments

  1. মরচে পড়া চিন্তার জগতকে অনেক টা রিচার্জ করে নিলাম। ধন্যবাদ লেখককে।

  2. না , গান্ধীজি আদৌ ভারতের খেটে খাওয়া মানুষদের শ্রেণীস্বার্থের মুখপাত্র নন । সে দাবি তিনি করেন নি । তাঁর স্বপ্নের ভারতে দেশি শিল্পপতিরা নিজেদের কাজ কর্ম বিনাবাধায় চালিয়ে যাবে , জমিদারেরাও তাই। তারা গরীবদের ‘ট্রাস্টি ‘ হয়ে তাদের সুখেদুঃখে পাশে দাঁড়াবে। ফলে শ্রমিক-কৃষক খুশি মনে ক্ষেতে এবং কারখানায় খাটতে থাকবে।
    এ এক মায়া-ভারত। এর দার্শনিক যুক্তি ঈশোপনিষদে আছে ‘ তেন ত্যক্তেন ভুঞ্জীথাঃ’, অর্থাৎ তোমার যা আছে তা আসলে তোমার নয় এটা জেনে ভোগ কর’। শরৎচন্দ্র গুরু-শিষ্য-সংবাদ লেখায় তীব্র ব্যঙ্গে এই দার্শনিক অবস্থানকে ধুয়ে দিয়েছেন। ফলে গান্ধীজির অর্থনীতি আসলে শ্রেণী-সমঝোতার অর্থনীতি এ নিয়ে কোন সন্দেহ থাকে না ।
    কিন্তু আমার বিনীত নিবেদনঃ গান্ধীজির অর্থনীতির মডেল কী নয় তা তো জানলাম, কিন্তু ফলিত স্তরে আরও কী সেটা জানা ও তো দরকার। আমরা গান্ধীজির থেকে সাম্যবাদী বা সমাজবাদী মডেল আশা করব কেন ? ট্রাস্টিশিপ তার একটা অংশ মাত্র । এটা গান্ধীজির কল্পনার আর্থিক-সামাজিক উৎপাদন সম্পর্ককে স্পষ্ট করছে। তিনি এই সম্পর্ক বদলের জায়গায় স্থিতাবস্থার পক্ষধর।
    কিন্তু ভাবুন তো, পশ্চিমভারতের বানিয়া সমাজ থেকে উঠে আসা এক ব্যক্তি যাঁর মানসভূমি তৈরি হয়েছে দার্শনিক চিন্তার চেয়ে বেশি করে হিন্দুসমাজের পুরাণকথায় এবং প্রতীকে, তিনি যখন ধীরে ধীরে বৃটিশ এম্পায়ারের সম্বন্ধে মোহমুক্ত হচ্ছেন তখন তিনি ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভোলুশনের সঙ্গে বৃটিশ সভ্যতাকে এক করে দেখবেন এটাই ত স্বাভাবিক। রবীন্দ্রনাথের মনন ও অন্তর্দৃষ্টি তাঁর ছিল নয়া, তাই তাঁর মডেলে বৃটিশ বিরোধিতা হয়ে দাঁড়ায় পাশ্চাত্ত্য সংস্কৃতির বিরোধিতা। তবু গ্রাম ভারত সাড়া দেয় তাঁর আন্দোলনের সহজ এবং ‘চতুর’ ইমেজারিতে, রাবীন্দ্রিক বৌদ্ধিক মননশীলতায় নয় । খেয়াল করুন, শুরুতে রবীন্দ্রনাথের চিন্তাতেও এই প্রাচীন ভারতকে নিয়ে পিছুটান ছিল। খেয়াল করুন, ‘শিবাজী উৎসব”, বা “অয়ি ভুবনমনমোহিনী”।
    প্রশ্নঃ স্বাধীন ভারতে ,এমনকি বামরাজত্বে শিল্পপতিদের স্বার্থ না দেখে শুধু শ্রমিক কৃষকের স্বার্থের বিপ্রতীপে মালিক স্বার্থকে দাঁড় করিয়ে প্রাথমিক উন্নয়ন সম্ভব? মাওয়ের ‘নয়া গণতন্ত্র’ ছেড়ে দিন , বাস্তবে কী করা সম্ভব জানতে চাইছি। সেখানে গান্ধীজির বা রবীন্দ্রনাথের সমবায় চিন্তা কোন মডেল হতে পারে কি ?
    রবীন্দ্রনাথের , গ্রামীণ অর্থনীতি এবং পল্লী উন্নয়ন চিন্তা নিয়ে দেবোত্তম চক্রবর্তী মশায়ের থেকে একটি প্রবন্ধের আবদার জানিয়ে শেষ করছি।

    • রঞ্জনবাবু, আপনার দীর্ঘ সুচিন্তিত মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আপনি গান্ধীর শিল্পভাবনাকে অল্প কথায় চমৎকার ব্যাখ্যা করেছেন এবং এটাই এ লেখার মূল সারাৎসার। তবে আমাকে যে গুরুদায়িত্ব আপনি দিয়েছেন অর্থাৎ ‘রবীন্দ্রনাথের গ্রামীণ অর্থনীতি এবং পল্লী উন্নয়ন চিন্তা’ তা পালন করতে আদৌ পারব কি না জানি না। তবে অবশ্যই রবীন্দ্রনাথের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা এবং তাঁর তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের প্রয়াস গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। এই পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী যদি সেই সম্পর্কিত আলাদা একটি প্রবন্ধ লেখার অনুরোধ করেন, তবে আমি আপ্রাণ চেষ্টা করব সেই বিষয়ে আমার নিজস্ব মনোভঙ্গি তুলে ধরার।

1 Trackback / Pingback

  1. আধুনিক ভারতের ইতিহাস – 1857-র পরে – WBCS Question Paper

আপনার মতামত...