অনিন্দিতা গুপ্ত রায়ের কবিতা

পাঁচটি কবিতা -- অনিন্দিতা গুপ্ত রায়

পাঁচটি কবিতা

 

শিকড়

সত্যি শব্দের বিপরীতে সবসময় মিথ্যে বসে না। মাঝেমাঝে স্বপ্নও! ব্যাকরণের পাতা আর টেবল-ল্যাম্পের সমঝোতার বাইরে তাদের দেখা হয়ে যায়। আলোর চেয়েও দ্রুত ও সংক্রামক বিষণ্ণতা শরীর ভর্তি করে রাখে। যে চিৎকার আমার মাথার ভিতর গরম ভাতের টগবগ তারই বাস্প চোখ ভেদ করে আমাকে ভাসিয়ে দিচ্ছে সোনামন! ঘুমিয়ে পড়ার আগে অন্ধকার থেকে কুড়িয়ে তুলি আরও আরও চিহ্ন যাকে অনুসরণ করে ভোর পর্যন্ত হেঁটে যেতে পারি অন্যতর স্বপ্নে। এই দ্যাখো আমার হাতের রেখা, দ্যাখো মানচিত্রলিপি। অজস্র নদী ও গিরিপথের দুর্গম ডিঙিয়ে মেঘরঙের একটা আলো ছড়িয়ে আছে তোমার ভূখণ্ডে। নাম উচ্চারণ করোনি, অথচ শ্রবণের ভিতর পৌছে দিয়েছ নিঁখুত শব্দবন্ধ। অভিমান শব্দকে খুলতে খুলতে মা ছুঁয়ে স্বরলিপি স্তব্ধ তখন। ডুবসাঁতারের গায়ে আমি জল আঁকি, তৃষ্ণা লিখি। একটা একটা করে পাথর সরিয়ে দেখি গভীর অবধি শিকড়ের সংসার সাজানো রয়েছে কতকাল!

 

ভ্রমণ

সাদা এক বরফের দেশ থেকে আগুন কুড়োতে বলো। নিজের বুকের ওপর কান রাখা যায় না বলেই কেবল অন্য অন্য পাহাড়ের ভাঁজে উপত্যকায় খুঁজে ফেরো বিস্ফোরণের পরবর্তী স্তব্ধতা। শান্ত হয়ে আসা তো একটা প্রক্রিয়া— সময়ের থিতিয়ে পড়ায় আস্তে আস্তে ডুবে যাওয়া স্নায়ুর গল্প। ঘুমের আলগা পর্দায় ঢেকে যাওয়া আপসের কাহিনী। বাঁশির সুরের লোভে আমিই কি কাঠের টুকরো খুঁজে ক্রমাগত ফুঁ দিই উন্মাদ ঘোরে! মৃৎপাত্র উপচিয়ে সুর বাজে মৃদঙ্গে হাতের ছোঁয়ায়। আগুন পেরিয়ে তাকে এত পথ আসতে হয়েছে, মাটি জানে?

 

অঘ্রাণ

দু’একটা স্থির চিহ্নের পাশ দিয়ে যাতায়াত লেখা থাকে। বন্ধ দরজার ওপর জলছিটে এঁকে চুপচাপ ভোর ফিরে যায়। ধুলোমাখা থ্যাঁতলানো শহরের থেকে দলছুট শালিক বিষণ্ণ খয়েরি মেখে একা একা ওড়ে বহুদূর। সকালের  অপেক্ষায় যে বাতাস ঝিমিয়ে পড়েছে, লবণ ও রুটির দিন আনি দিন খাই করতে করতে সেইই উগরে তুলছে রাগের বাস্প— কুয়াশার গন্ধ টপকে যেন বা বারুদ! হেমন্তে মাঠ খুব একলা হতে জানে ফসলের ভিড়ে, উদাসীন চেয়ে থাকা জানে। সেসবই শেখার ছলে এত আসা যাওয়া। তারপর সাদা পৃষ্ঠায় ইচ্ছেমত রং আর জল মেশামেশি করলে অনুবাদের অতীত একটা ছায়া, তোমার শরীরের মাপে। এই নাও— বাকিটা পৃথিবী আমি শর্তহীন দানপত্র লিখে দিলাম!

 

প্রতিধ্বনি

অনেকদূর বিস্তৃত নির্ঘুমের মধ্যে আকাশগঙ্গা পেরিয়ে চলে যাচ্ছিল একলা কয়েকটি সংখ্যা। আমি তাদের গুনতে গুনতে সোজা ও উলটো দিকে বুনে ফেলছিলাম অদৃশ্য মখমলি দস্তানা। এসময় তীব্র শীত করে ওঠে দিন ছোট হয়ে এলে। প্রস্তুতিপর্ব জুড়ে পিঁপড়ের নিপুণ ব্যস্ততা চিনি তুলে রাখে। কাকেদের হৈ হৈ হেঁসেলের এঁটো খুঁজে ওৎ পেতে থাকে। প্রতিজ্ঞার ভিতর নিজেকে গুছিয়ে রেখে প্রাণপন আলো হয়ে ওঠার মহড়ায় গুনগুন করি সমবেত স্বর। খুব মৃদু অথচ অস্পষ্ট একটা ডাক মাথার ভিতর ফাঁকা প্রেক্ষাগৃহে। অবিশ্বাস্য জেনে তাকে আমি পূর্বজন্মের কাছে গচ্ছিত রেখে আসি এই অবেলায়।

 

অনতিকথন

স্তব্ধতার ভিতর ক্রমাগত আলো আর অন্ধকারের জায়গা বদল। পাঁজর থেকে ঠোঁট অবধি যাতায়াতের মধ্যে কতবার দিন ও রাতের বাচালতা ক্ষমার যোগ্য হয়ে ওঠে বলিনি তোমাকে? মনকেমনের গল্পে একটা বিকেলের গন্ধ নিজেকে মিশিয়ে দিতে থাকে। প্রতিটি ব্যাখ্যার শেষে ক্লান্ত লাগে খুব। তবুও কিছুই বলা হয় না আসলে জেনে আচমকা শীতকাল, আচমকা ফুরোনো প্রহর। নুড়িপাথরের মত শ্বাসহীন আছি দেখে মাছের ঠোকর, শ্যাওলার ছোপ আড়মোড়ার মধ্যে ঢুকে পড়ে। জলের প্রশ্রয় দিতে দিতে দেখি তুমি ছাড়া আর কোনও নেশাও শিখিনি অভ্যেসে!

 

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...