কোন বিধ্বংসী ঝড়ের মুখে ভারতের অর্থনীতি?

সুদীপ্ত মণ্ডল

 

লেখক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক, আইআইএম আহমেদাবাদ, ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি বিভিন্ন বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানে যুক্ত থাকার পর বর্তমানে ন্যাশনাল কাউন্সিল ফর অ্যাপ্লায়েড ইকোনমিক রিসার্চ (NCAER) সংস্থায় ডিস্টিংগুইশড ফেলো হিসাবে যুক্ত আছেন। বিকাশ অর্থনীতি (development economics), সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি-প্রণয়ন (macroeconomic policy and modelling), জনব্যয়নীতি (public expenditure policy) এবং শাসনপদ্ধতি (governance)-এর উৎসাহী গবেষক। 

ভারতের অর্থনীতি যে একটা ঈর্ষণীয় রকমের চমৎকার জায়গায় রয়েছে, এই কথা ইন্টারন্যাশনাল মনিটেরি ফান্ডের তদানীন্তন প্রধান ক্রিস্টিন ল্যাগার্ড খুব বেশিদিন আগে বলেননি। বিশ্বের মুখ্য অর্থনীতিগুলির মধ্যে সবচেয়ে দ্রুতহারে বাড়তে থাকা অর্থনীতি হিসাবে ভারত ছিল অন্যান্য প্রতিশ্রুতিবান এবং আর্থিকভাবে উদীয়মান দেশগুলির কাছে ঈর্ষার পাত্র, আর এই নিয়ে আমরা সকলেই যথেষ্ট উল্লসিতও ছিলাম। সেই ঈর্ষার আসন থেকে বর্তমানের এ অন্ধগলিতে পৌঁছতে খুব বেশিদিন সময় আমাদের লাগেনি।

মাত্র দেড় বছর সময়ের মধ্যে বৃদ্ধির হার ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষের চতুর্থ কোয়ার্টারে ৮.১ শতাংশ থেকে ২০১৯-২০-র দ্বিতীয় কোয়ার্টারে ৪.৫ শতাংশে পড়ল। এই সময়ের মধ্যে শিল্পের বৃদ্ধির হার পড়ল ৫.৩ শতাংশ থেকে মাত্র ০.৫ শতাংশে, আর কৃষিতে বৃদ্ধির হার হল মাত্র ২.১ শতাংশ। শিল্প উৎপাদন সূচকের মাসিক পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, এই মন্দা দ্বিতীয় কোয়ার্টার ছাড়িয়ে স্থায়িত্বের আভাস দিচ্ছে।  এক বছর আগের তুলনায় অক্টোবর ২০১৯-এ উৎপাদিত দ্রব্যের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ৩.৮ শতাংশ। খনিশিল্প ও উৎপাদনে মূল্যযুক্তির পরিমাপে যথাক্রমে ৮ এবং ২.১ শতাংশ ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। সবথেকে শোচনীয় পরিসংখ্যান দেখা যাচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদন শিল্পে, যা সঙ্কুচিত হয়েছে ১২.২ শতাংশ।

বিদ্যুৎ উৎপাদনের এতটা সঙ্কোচন বিশেষ দুশ্চিন্তার উদ্রেক করে, কারণ বিদ্যুৎ সমস্ত ধরনের উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত সাধারণ উপাদান, এবং সেই কারণেই কোনও দেশের অর্থনৈতিক ক্রিয়াশীলতা সম্বন্ধে ধারণা করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচক। বিদ্যুতের মত হাল আমদানিরও, যা কী না আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। আলোচ্য সময়কালে আমদানি পড়েছে ১৩.২ শতাংশ। রপ্তানি কমলেও তার হ্রাসের হার আমদানির তুলনায় কম, যার থেকে ধারণা করা যেতে পারে – ভারতের ক্ষেত্রে মন্দার হার তার সঙ্গে ব্যবসারত দেশগুলির তুলনায় কিছু হলেও বেশি। সাম্প্রতিক কালে মোট চাহিদা মাপার ক্ষেত্রে সবথেকে নির্ভরযোগ্য সূচক ব্যক্তিভিত্তিক ভোগব্যয়ের বৃদ্ধির হার মাত্র ৫.১ শতাংশ, যা এক বছর আগে এই সময়ে ছিল ৯.৮ শতাংশ। তবে সবচেয়ে ভীতিপ্রদ সম্ভবত স্থায়ী সম্পদে বিনিয়োগের ছবি। ২০১৯-২০ সালের দ্বিতীয় কোয়ার্টারে এই বিনিয়োগে বৃদ্ধির হার মাত্র ১ শতাংশ, যা মাত্র এক বছর আগেও ছিল ১০.২ শতাংশ। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমি (সিএমআইই)-র তথ্য অনুযায়ী বেকারত্ব রয়েছে ৫ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে।

এ-হেন সর্বব্যাপী অধোগতির বিষণ্ণ সময়ে তুলনামূলক মূল্যস্থিতি হয়তো একমাত্র সান্ত্বনা। এপ্রিল-মে সময়কাল থেকে কনজিউমার প্রাইস ইন্ডেক্স বা ভোক্তা মূল্যসূচক রয়েছে ৩ শতাংশের নিচে। নভেম্বর মাসে অবশ্য এই সূচক ছুঁয়েছে ৫.৫ শতাংশ, যা কী না গত বছরের নভেম্বরে ২.৩ শতাংশের থেকে দ্বিগুণের বেশি, আর রিজার্ভ ব্যাঙ্কের স্থির করা ৬ শতাংশের সর্বোচ্চ সীমার বিপজ্জনক রকমের কাছাকাছি।

আমরা কি তবে স্ট্যাগফ্লেশন বা নিশ্চলতা-স্ফীতির মত একটা দুঃস্বপ্নের কালের দিকে এগিয়ে চলেছি, যেখানে বেকারত্ব ও মুদ্রাস্ফীতি দুইই বিপদসীমার ওপরে? চার দশক ধরে একটা মোটের ওপর স্থিতিশীল অবস্থা রক্ষা করার পরে সত্তরের দশকের জ্বালান তেলের যোগান-বিপর্যয়ের পর প্রথম বিশ্বের দেশগুলির সামষ্টিক অর্থনীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব সঙ্কট দেখা দেয়, যখন মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব দুইই পাল্লা দিয়ে বাড়তে শুরু করে। মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্বের ভারসাম্য বা ব্যস্তানুপাতিক সম্বন্ধ দেখাবার ফিলিপ্স কার্ভ অন্তর্হিত হয়, এবং কনসেনসাস তত্ত্ব এই নতুন বিভ্রান্তির পরিবেশে পালাবার পথ পায় না। যাই হোক, আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন আপাতত এই যে, সামষ্টিক অর্থনীতির নীতি প্রণয়নকারীদের হতবুদ্ধি করে ভারতের অর্থনীতি এই একই ভাবে স্ট্যাগফ্লেশনের পথে যাচ্ছে কি না।

সৌভাগ্যক্রমে, মূল্যের ওঠানামার দিকে তন্নিষ্ঠ নজর রাখলে বোঝা যাচ্ছে যে অতটা অসহ অবস্থায় আমরা এখনও পৌঁছইনি। ক্রমবর্ধমান মূল্যবৃদ্ধির অবস্থাকে কোনওরকম সাধারণীকরণ দিয়ে বোঝা অসম্ভব। সাম্প্রতিক মুদ্রাস্ফীতির জন্য সম্পূর্ণত দায়ী খাদ্যদ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধি, যা এই নভেম্বরে গত বছরের তুলনায় বেড়েছে ১০ শতাংশ – গ্রাম ও শহরাঞ্চলে যথাক্রমে ৮.৮ ও ১২.৩ শতাংশ। খাদ্য ছাড়া অন্যান্য জিনিসের নিরিখে মুদ্রাস্ফীতির হার নভেম্বরে ছিল মাত্র ২.৮ শতাংশ। একটু তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, খাদ্যদ্রব্য-জনিত মুদ্রাস্ফীতি ঘটেছে মূলত এই কটি কারণে – শাকসবজির দামে ৩৫.৬ শতাংশ বৃদ্ধি, পেঁয়াজের জোগানে ঘাটতি, এবং প্রোটিনের মূল্যবৃদ্ধি। ডালের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ শতাংশ, সঙ্গে মাছ-মাংস ও ডিমের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৯.৪ ও ৬.২ শতাংশ। অন্যান্য খাদ্যের দাম বেড়েছে মোটের ওপর ৩ থেকে ৪ শতাংশ।

খুব সাঙ্ঘাতিক কোনও বিপদ ঘটে না গেলেও দামের ওঠাপড়ায় একটা অস্থিরতা অবশ্যই আছে। মুদ্রাস্ফীতি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বেঁধে দেওয়া ৬ শতাংশ সীমার কাছাকাছি চলে আসার প্রতিক্রিয়ায় মনেটরি পলিসি কমিটির (এমপিসি) সুদের হার কমানো স্থগিত রাখা সঠিক সিদ্ধান্ত। খাদ্যদ্রব্যজনিত মুদ্রাস্ফীতির ছায়া যদি অন্যান্য ক্ষেত্রেও হাত বাড়ায় এবং সমস্যা গভীরতর করে, এমপিসিকে হয়ত সুদের হার কিছুটা বাড়িয়ে মূল্যবৃদ্ধির মোকাবিলা করতে হতে পারে। আর্থিক নীতি দিয়ে হয়ত মুদ্রাস্ফীতির মোকাবিলা সম্ভব, কিন্তু রাজস্ব নীতি অবলম্বন করে স্বল্প সময়ে চাহিদা বাড়ানোর কাজটা খুবই কঠিন, বিশেষত দীর্ঘ সময়ের সংস্কারের সুফল যখন আপাতত নাগালের বাইরে। চাহিদা বাড়াতে চাই সরকারি ব্যয়ে একযোগে অনেকটা বৃদ্ধি। কিন্তু এই বর্ধিত ব্যয়কে যুঝতে যে ধরনের রাজস্ব পরিচালন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার সে বিষয়ে সরকারের সদিচ্ছার অভাব স্পষ্ট (এ নিয়ে ১৭ অক্টোবর ২০১৯ তারিখের মিন্ট পত্রিকায় আমার একটি নিবন্ধ আছে)। এর ফলে রাজকোষ ঘাটতি (fiscal deficit)-র লক্ষ্যমাত্রা তুলনায় বেশি আয়ত্তে আসতে পারে। তবে সরকারি খাতে ঋণের প্রয়োজন এমনিতেই বেশি থাকার কারণে আরও ঋণ হয়ত বেসরকারি উদ্যোগে লগ্নীকে পিছু হটতে বাধ্য করতে পারে, যার পরিণাম হতে পারে চাহিদার আশানুকূল বৃদ্ধি না হওয়া। অর্থাৎ, এই অবস্থা থেকে মুক্তির কোনও সরল পন্থা আপাতত চোখে পড়ছে না।

যেখানে অর্থনৈতিক সঙ্কটের ওপর নজর দেওয়া উচিত, সরকার সেখানে ব্যতিব্যস্ত থাকছেন রাজনৈতিক বিষয়গুলি নিয়ে। বিপুল জনাদেশ নিয়ে ক্ষমতায় আসার ঔদ্ধত্য এবং রাম মন্দির বিষয়ে অনুকূল রায় বিজেপিকে তার নির্বাচনে প্রতিশ্রুত হিন্দুত্বের অ্যাজেন্ডাকে প্রাধান্য দিতে উৎসাহিত করেছে। আর্টিকল ৩৭০ রহিতকরণের অব্যবহিত পরেই আমরা দেখলাম নাগরিকত্ব সংশোধন আইন (সিএএ)। জাতীয় পঞ্জীকরণের প্রস্তুতিও তুঙ্গে। এর নিয়ে আমাদের দেশের মুসলমান নাগরিকেরা সন্ত্রস্ত। হিন্দুত্বের সব আপন করে নেওয়া, শান্তিপ্রিয় বিবেকও এ নিয়ে যথেষ্ট আলোড়িত। সারা দেশের পথে পথে বিক্ষোভরত আমাদের ছাত্রেরা, আর সরকারের রাজনৈতিক বিরোধীপক্ষও এই বিষয়ে মোটের ওপর একজোট। এমতাবস্থায়, দেশের অর্থনীতির তরী যখন টলোমলো, সরকারের এই যুদ্ধং দেহি এবং অনমনীয় মনোভাব আমাদের কোথায় নিয়ে যায় সেটাই এখন দেখার।


নিবন্ধটি ইংরেজিতে কিছুটা পরিবর্তিত রূপে ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯ তারিখে মিন্ট পত্রিকায় প্রকাশিত। রচনাটি এখানে  পড়া যেতে পারে। অনুবাদ – চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...