নিভন্ত এই চুল্লিতে মা…

শতাব্দী দাশ

 



লেখক গদ্যকার, শিক্ষক ও সমাজকর্মী।

 

 

গত শতাব্দীর শেষ দশকে রোজাভা বিপ্লবের মন্ত্রগুরু, আবদুল্লাহ অকালান ভবিষ্যদ্বাণী করেন— পুরো ঊনবিংশ শতাব্দী এবং বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পর্যন্ত বিপ্লবী আন্দোলনের পুরোভাগে ছিল শ্রমিকরা, বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে জাতীয় মুক্তি আন্দোলন, একবিংশ শতাব্দীতে নেতৃত্ব দিবে বিপ্লবী নারীরা। নারীরাই নাকি পিতৃতন্ত্র-ধর্মান্ধতা-পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলনে সামনের সারিতে থাকবে। তাঁর চিন্তার সঙ্কলন পড়া যেতে পারে Liberating Life: Women’s Revolution (2013) বইটিতে।

বর্তমান দশক ও পূর্ববর্তী কয়েক দশকের তাত্ত্বিক মস্তিষ্করা একরকমভাবে স্বীকার করে নিয়েছেন, শুধু শ্রেণিসংগ্রামের কথা বলা যথেষ্ট নয়। প্রান্তিকের মুক্তি একটি ইন্টারসেকশনাল ধারণা৷ লিঙ্গগত-জাতিগত-বর্ণগত প্রান্তিকতাও সেখানে আলোচিত হতে বাধ্য। সব ধরনের প্রান্তিককে সংগঠিত না করে, তাকে সচেতন না করে, বিপ্লব বড় বেশি দূর এগোতে পারবে না৷

তাই প্রীতিলতা, রোকেয়াদের নিয়ে নব উদ্যমে আলোচনা শুরু হয়েছে। পণ্ডিতা রমাবাঈ বা সাবিত্রীবাঈ ফুলে নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়েছেন। তাই রোজা লুক্সেমবর্গের জন্মদিনে এদিক ওদিক নানা আলোচনা সভা, বই প্রকাশের উদ্যোগ। তাই কুর্দি কম্যান্ডার নেসরীন আব্দুল্লাহ ছাত্র-ছাত্রীদের পরিচিত আইকন।

রোজাভা বিপ্লবের কথাই ধরা যাক। সেখানে নারীদের অগ্রপথিকের ভূমিকা গ্রহণ পৃথিবীকে বিস্মিত করেছে। মধ্যপ্রাচ্যের মত পশ্চাদাঞ্চলে, মুসলিম অধ্যুষিত পাহাড়ি জনগোষ্ঠীতে নারীরা কীভাবে এত রাজনৈতিকভাবে সচেতন হয়ে উঠতে পারল? কীভাবে তারা মানব ইতিহাসে সম্ভবত সবচাইতে বড় নারী গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে সক্ষম হল? কীভাবে তারা শরিয়ত অমান্য করে নারী-পুরুষের সমানাধিকারের কথা বলতে শিখল? কীভাবে রোধ করল বাল্যবিবাহ?

স্বদেশে যদি ফিরি, তবে গেরুয়া ফ্যাসিবাদ বিরোধী বর্তমান আন্দোলনে, এনআরসি-এনপিআর-সিএএ বিরোধী আন্দোলনে ভারতীয় নারীর ভূমিকা সেই সার্বিক আন্তর্জাতিক নারীজাগরণের আর এক অধ্যায়কে সূচিত করে৷ অতিহিন্দু সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মুখ হিসেবে উঠে এসেছেন সেই নারীরা, যাঁরা ‘বেটি বচাও, বেটি পড়াও’-এর সরকারি ভাষ্যকে ফালাফালা করছেন প্রতি মুহূর্তে৷ তাঁরা সেই সব অন্তঃপুরচারিণী, যাঁদের কাল পর্যন্ত ইভনিং বা নাইট শোতে সিনেমা দেখাও মানা ছিল।  তাঁরা আজ শাণিত বিদ্রুপের স্বরে বলছেন, পুলিশ বা সেনা পাঠিয়ে তাঁদের উঠিয়ে দেওয়ার চেষ্টা না করে, ‘তিন তালাক নিরারণকারী মঙ্গলময় প্রধানমন্ত্রী’ একবার অন্তত তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে পারতেন!

ব্যারিকেড গড়ে তুলে তাঁরা ঢুকতে দিচ্ছেন না সরকারের পদলেহনকারী মিডিয়া হাউজগুলিকে। উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে আসছেন এক প্রৌঢ়া৷ পুরুষের চোখে চোখ রেখে বলছেন— “আপনিই না? চ্যানেলে বলেছিলেন না শাহিনবাগে আমরা দৈনিক পাঁচশো টাকা উৎকোচের বদলে বসে আছি? ঢুকতে দেব না। ক্ষমা করবেন।” আবার সমমর্মী সাংবাদিকের মাইকের সামনে কান্না জড়ানো গলায় তাঁদেরই মধ্য থেকে শিশু কোলে এক তরুণী বলছেন— “এ আমার দেশ, আমি কোথায় যাব বাচ্চাদের নিয়ে এদেশ ছেড়ে?” সাহস আর আবেগের সম্মিলনে লিঙ্গগত প্রান্তিকের জাগরণের এ এক সন্ধিক্ষণ বটে।

সেদিন তরুণ কবি আমির আজিজের সঙ্গে আলাপ হল পার্ক সার্কাসে৷ সেখানে থেকে এসপ্ল্যানেডেও যাওয়া হল একসঙ্গে। দু জায়গার জমায়েতেই আমির তাঁর ইতোমধ্যে বিখ্যাত কবিতা ‘জামিয়া কি লড়কিয়া’ আবৃত্তি করলেন। জামিয়ার মেয়েদের কথাই ধরা যাক। সেই ভিডিও তো ভাইরাল, যেখানে ত্রস্ত ছেলেটিকে দিল্লি পুলিস মাটিতে শুইয়ে ফেলল। জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তখন টিয়ার গ্যাসের ধোঁয়া। জল কামান৷ এলোপাথাড়ি লাঠি। ছেলেটা পালাচ্ছে, হিঁচড়ে টেনে আনছে পুলিশ। হঠাৎ দৌড়ে এল তার হিজাব-ঢাকা বন্ধুনিরা। তারা তর্জনী তুলে হঠিয়ে দিচ্ছিল পুলিসকে। পুলিস পিছু হঠছিল। ওদের নাম লাদিদা আর আয়েশা। ত্রস্ত নারী আর ত্রাতা পুরুষের রূপকথা শেষ হয়েছে ওই দৃশ্যটির জন্ম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে।

আমরা দেখেছি, জেএনইউতে প্লাস্টার করা পা-টি চেয়ারে তুলে সভা করছে দৃপ্তা নামের মেয়েটি। মাথায় স্টিচ আর ভাঙা হাত নিয়ে ছাত্রনেত্রী ঐশী ঘোষ বলছে, ‘ডান্ডায় নয়, তর্কে জিতব’। লাজপত নগরে ভাড়াবাড়ির উপরতলা থেকে সূর্যা রাজাপ্পান ও তার বান্ধবী অমিত শাহের নাকের ডগায় প্রতিবাদী ব্যানার উড়িয়ে বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হলেন। পুনেতে ‘আওয়াজ দো…’ বলে হুঙ্কার দিচ্ছেন গৌরী সাওয়ান্ত, লিঙ্গপরিচয়ে যিনি হিজড়া। সমবেত নারী-পুরুষ প্রতি-হুঙ্কার দিচ্ছেন ‘হাম এক হ্যায়’। ভীরুকে ‘তুম হিজড়া হো ক্যায়া?’ বলার আগে পিতৃতন্ত্র থমকাচ্ছে। ছাত্রনেতা কানহাইয়া কুমার পিতৃতান্ত্রিক রেটরিক ব্যবহার করে ফেলছেন ভুলক্রমে, ‘চুড়িয়া পহেনকে নহি বৈঠে হ্যায়…’, তারপর ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছেন আন্দোলনের অগ্রনেত্রীদের কাছে। এসব এক দশক আগেও ভাবা যেত না৷ এমনকী প্রগতিশীল, বামমনস্কদের থেকেও এই সচেতনতা প্রত্যাশা করা যেত না৷ এই অসম্ভব সম্ভব করেছে মেয়েরাই।

এমন এক সময়কে আমরা চাক্ষুষ করছি, যখন শাহিনবাগের প্রবল শৈত্য উপেক্ষা করে, ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ছাত্রছাত্রীদের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদে তথা এনআরসি-সিএএ-র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন অশীতিপর বৃদ্ধা মা থেকে কুড়ি দিনের শিশু কোলে তরুণী মা। ‘মা’ শব্দটি বারংবার উল্লেখ করছি সচেতনেই, কারণ তাঁরা অনেকেই সমাজনির্দিষ্ট এই ভূমিকায় থিতু ছিলেন বেশ৷ পালিকা, সেবিকা, মা হয়ে থাকতে তাঁদের আপত্তি ছিল না৷ মাতৃত্ব ছাড়া বা মাতৃত্ববিহীন আর কী কী ভূমিকা তাঁদের হতে পারে, সে সম্পর্কে তাঁরা সম্যক সচেতন নন। কিন্তু ‘মাতৃত্ব’-কেও যদি একটা বিমূর্ত ধারণা হয়, তবে তার মূল উপাদান নিশ্চয়  সন্তানকে রক্ষা করার উদগ্র রোখ৷ সেই জেদই তাঁদের পথে নামাল।

পাভেল ভ্লাসফের মা পেলাগেয়া নিলভনাকে প্রায় সকলেই আমরা চিনতাম আকৈশোর৷ অন্তঃপুরবাসিনী মায়ের পতাকা কাঁধে তুলে নেওয়ার গল্প গোর্কিতে পড়েছিলাম। অথচ নিজের স্থান-কালে চোখে দেখেছি শুধু ‘মাধবীলতা’-দের নিয়ে রোম্যান্টিসিজম৷ বাবা মিছিলে যাবেন, মা সংসার সামলাবেন— এটাই তো ছিল ‘স্বাভাবিক’। তারপর আমরা দেখতে পেলাম রোহিত ভেমুলার মা রাধিকা ভেমুলাকে, নাজিব আহমেদের মা ফতিমা নাফিসাকে। ‘মাতৃত্ব’ নামক ব্যক্তিগত বা পার্সোনাল ভূমিকাটিকে পলিটিকাল হয়ে গেল চোখের সামনে।

কিংবা কলকাতার পার্ক সার্কাস ময়দানের কথাই ধরা যাক। আমাদের শহরের আজাদি তীর্থ। বিশাল তিরঙ্গা সেখানে অমলিন। জাতীয় পতাকার সামনে ভীমরাও আম্বেদকর। এখানে যে মেয়েরা জড়ো হয়েছেন, তাঁদের অনেকেই গতকালও ভাবতে পারতেন না, ‘খুলি আসমান’-এর তলায় স্লোগান দেবেন। পরপুরুষকে মুখ দেখানোও তাঁদের বারণ ছিল৷ যে মা মেটিয়াবুরুজ থেকে এসেছেন সন্তান কোলে, তিনি বাড়ি থেকে বাচ্চার স্কুল পর্যন্ত রাস্তাটুকু ছাড়া কলকাতা চিনতেন না। যে হিজাবি মেয়েটি সায়েন্স কলেজে পিএইচডি করছে, বাড়ি-ল্যাব-ইউনিভার্সিটি জুড়ে তার চারপাশে ছিল অপেক্ষাকৃত প্রশস্ত  লক্ষণরেখা। কিন্তু তার বাইরে আনাগোনা মানা ছিল তারও। সেই মেয়ে ইতোমধ্যে মাঠে-ময়দানে কাটিয়ে ফেলেছে দু-এক রাত। নেচে নেচে স্লোগান দিচ্ছে সে। এই মেয়েরা যবে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই জিতে ঘরে ফিরবে, সে ফেরা কি আর হবে আগের ফেরার মতো? ঘড়ির কাঁটা নির্দিষ্ট ঘর পেরোলে যে ত্রস্ততা, তা কি ফিরবে আর? যে পুরুষ অভিভাবক আজকের আন্দোলনে মেয়েকে বা স্ত্রীকে জড়িয়ে পড়তে দিলেন, তিনি কাল কোন মুখে বেঁধে রাখবেন তাদের? হিজাব ঢাকা মাথারা পুলিশগাড়ির বনেটে আর্ট পেপার বিছিয়ে লিখে নিচ্ছে পোস্টার— এমন সব শক্তিশালী দৃশ্য সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিমুহূর্তে। যে বাচ্চারা ছুটে বেড়াচ্ছে মা-মাসি-পিসিদের ফাঁক গলে, জিজ্ঞেস করে জানা যাচ্ছে, তারাও জানে, এনআরসির মানে৷ কারণ অরাজনৈতিক থাকা একটি প্রিভিলেজের নাম৷

পিতৃতন্ত্র আর ফ্যাসিবাদ একই সাপের দুই মাথা। দলিত ও সংখ্যালঘুকে কোণঠাসা করে যারা, সেই অতিদক্ষিণপন্থী শক্তি নারীকেও চার দেওয়ালে ফিরতে বাধ্য করে, তৃতীয় লিঙ্গকেও অবমাননায় ছুঁড়ে ফ্যালে তারা। তাই এসপ্ল্যানেডের মোড়ে বা রামলীলা ময়দানে তেরঙার পাশে রেনবো পতাকা। তাই লাল পতাকায় কবেকার ভুলে যাওয়া শহিদ প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। তাই রোজাভা, ব্রাজিল, পোল্যান্ড, নিকারাগুয়া, চিলিতে বিপ্লবে-বিদ্রোহে মেয়েদের বা এলজিবিটিকিউ সম্প্রদায়ের স্বতঃস্ফূর্ত যোগদান৷ এ এক সন্ধিক্ষণ বটে, তবে এ অবশ্যম্ভাবীই ছিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4658 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...