![satabdif](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/02/satabdif.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
শতাব্দী দাশ
লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার, সমাজকর্মী এবং শিক্ষক।
গত ৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে বইমেলায় কিছু অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটেছে, যা ইতোমধ্যেই যথেষ্ট আলোচিত৷ সে ঘটনার খানিক চোখে দেখা, খানিক শোনা। আমার মতো অনেকেই শনিবার বইমেলায় অশান্তির আঁচ পেয়েছেন। আর রবিবার র্যাফ-পুলিশে ছয়লাপ অবরুদ্ধ মেলার ছবি তো প্রায় সকলেই দেখেছেন৷ এখন, অকুস্থলে উপস্থিত থাকার কিছু ভালো ও মন্দ দিক আছে। আপনি সরাসরি ঘটনাটি অবলোকন করতে পারেন একদিকে। আবার অন্যদিকে তা নিয়ে আপনাকে যখন নিবন্ধ লিখতে হয়, তখন কষ্ট করে সেই স্থান ও কাল থেকে নিজের একটি নৈর্ব্যক্তিক সত্তাকে টেনে বের করতে হয়, বর্ণনা শুধু নয়, বিশ্লেষণের উদ্দেশ্যে৷
যাইহোক, প্রথমে যা যা দেখলুম তার বর্ণনা দেওয়া যাক। গত আট তারিখ সন্দেশের স্টল-এর সামনে পরিচিত বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে স্বচক্ষেই দেখি, দুটি ছেলেকে হিঁচড়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে পুলিস ভ্যানের উদ্দেশ্যে৷ তারপর একইভাবে নিয়ে যাওয়া হয় একটি মেয়েকে। মেয়েটি বলছিল, ‘আপনি আমার ফোন সিজ করতে পারেন না…’ ইত্যাদি। কর্তব্যরত পুলিশবাহিনী তাদের শিকার সংগ্রহ করে দ্রুত অন্তর্হিত হয়। আমরা পলায়মান এক নির্বিবাদী ভদ্রলোকের থেকে জানতে পারি, এরা চোর ছ্যাঁচড় নয়, নেহাতই ছাত্র, বিজেপির স্টলের বাইরে লিফলেটিং স্লোগানিয়ারিং করছিল। পুলিশ শুধুমাত্র এ কারণেই গ্রেফতার করছে এবং সমাজবিরোধীদের মতো করে ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতে নিয়ে যাচ্ছে এ কথা হয়ত বিশ্বাস করতাম না। কারণ মেলামাঠে বিশাল পর্দায় তখন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর এনআরসি বিরোধী ভাষণ, ক্যা ক্যা ছি ছি আবৃত্তি সহযোগেই, প্রচারিত হচ্ছে। কিন্তু ঠিক তার আগের দিন, ৭ তারিখ, সন্ধে সাতটার দিকে আরেক কাণ্ড দেখেছি। কিছু মেয়ের দল বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সামনে এনআরসি বিরোধী লিফলেটিং করতে চেয়ে হেনস্থা হয়েছিল। মহিলা পুলিশ ব্যারিকেড করে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের নিকটবর্তী এলাকাকে মন্ত্রীবর্গের কনভয়ের মতো ঘিরে রেখেছিল৷ সেদিনও তাদের লিফলেটিং-এর অনুমতি দেওয়া হয়নি হিন্দুত্ববাদী স্টলগুলির সামনে। ধরে নেওয়া গেল, শান্তিরক্ষাই শান্তিরক্ষকের উদ্দেশ্য ছিল। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ বা জনবার্তা গিল্ডের অনুমতিক্রমেই বইমেলায় স্টল দিয়েছেন। অবশ্যই সেখানে নিজেদের মতাদর্শের বই তাঁরা বিক্রি করতে পারেন, তা যতই সাম্প্রদায়িক উস্কানিমুলক হোক না কেন। তেমনই যাঁরা এই বিভেদের সংস্কৃতিকে ভারতের সনাতন ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর ঠাওরাচ্ছেন, তাঁরা প্রতিবাদও করতে পারেন সাংবিধানিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে। এই প্রক্রিয়ায় কোনও বিবাদ সৃষ্টি হলে শান্তিরক্ষকের কর্তব্য সম্ভবত বিবাদ আটকানো। কিন্তু সেটা করার পদ্ধতি নিয়ে অনেক সাধারণ নাগরিকের মধ্যেই অসন্তোষ আছে, দেখা গেল। অন্তত কিছু পরে বইমেলার পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে হালচাল দেখে তাই মনে হল।
লিটল ম্যাগ প্যাভিলিয়নে বসে কিছু পরে খবর পাই, বইমেলায় বিধাননগর পুলিশ কন্ট্রোল রুমের সামনে প্রবল গণ্ডগোল। ছাত্র-ছাত্রীদের নাকি মারধোর করা হচ্ছে। চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন করতে সেদিকে দৌড়ই। দেখি, ‘দেব সাহিত্য কুটির’-এর প্রায় পাশে বিধাননগর পুলিশের আস্তানার সামনে তখন শুধু ছাত্রছাত্রী নয়, সাধারণ মানুষ ও মিডিয়ার ভিড়। সাধারণ মানুষ কৈফিয়ত চাইছেন, লিফলেটিং বা স্লোগানিয়ারিং-এর জন্য আটক করা বা মারধোর করা কি ঠিক? শুনতে পাই, গ্রেপ্তারের আগে পুলিশ নারী-পুরুষ না বিচার করে নাকি মেরেছেও বটে৷ ঘটনার যে বর্ণনা সেখানে পাওয়া যায়, তা এরকম:
জনবার্তার ৩৭৬ নম্বর স্টলের বাইরে রাহুল সিনহার পদার্পণ উপলক্ষে স্লোগানিয়ারিং চলছিল বাম ছাত্রছাত্রীদের৷ ফলস্বরূপ ৩৭৬ নং স্টল থেকে বেরিয়ে আসে কিছু মারমুখী গেরুয়া পুরুষ। তারা নাকি শুধু মারধরেই অংশ নেয়নি, মেয়েদের যথেচ্ছভাবে যৌন নির্যাতনও করেছে। ‘গ্রোপ’ করেছে, শাড়ি ধরে টেনেছে, মাটিতে ফেলে পেটে পা তুলে দিয়েছে। ধর্ষণের হুমকি দিয়েছে৷ পুলিশকে সেই গেরুয়া দলের কাউকে গ্রেপ্তার করতে দেখা যায়নি বলে অভিযোগ। শুধু তাই নয়, পুলিশ কয়েকটি মেয়েকে আলাদা করে সরিয়ে নিয়ে যায় বলে অভিযোগ। তারাও নাকি যে ভাষা প্রয়োগ করে, তাকে পরিভাষা অনুসারে ‘স্লাট-শেমিং’ বলে। ‘বেশ্যা, রেন্ডি’ ইত্যাদি ভাষা তারাও ব্যবহার করে বলে অভিযোগ।
ভিড় বাড়ছে দেখে পুলিস এবার সঙ্ঘবদ্ধভাবে ক্রাউডকে পিছনে ঠেলতে থাকে। কিল চড় রদ্দা চলতে থাকে। ভিড় হঠানো ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য ছিল না মনে হয়, কিন্তু সেটা করা হতে থাকে খুবই বিশ্রীভাবে৷ একজন বয়স্ক মানুষের কলার ধরে ঝাঁকাতেও দেখলাম পুলিসকে। মহিলাদের ঠেলে সরাতে থাকে পুরুষ পুলিসই। মিডিয়ার একটি ক্যামেরা ভাঙে। স্লোগানিয়ারিং শুরু হয় আবার। পুলিশ ‘সরি উই আর অ্যারেস্টিং ইউ’ বলে এক এক করে আরও ছেলেমেয়েদের তুলতে থাকে। বাকিদের ঘাড় ধরে ঠেলে সরানো হয়।
*****
কিছু মেয়ে ঠিক করে, বিধাননগর থানায় যাবে মলেস্টেশনের অভিযোগ করতে। বিধাননগর ইস্ট থানায় ছেলেমেয়েদের আটক করা হয় বটে, কিন্তু মলেস্টেশনের অভিযোগ দায়ের করার জন্য মেয়েদের বিধাননগর নর্থ-এ পাঠানো হয়। সেখানে আইসির অনুপস্থিতিতে এফআইআর নেওয়া হচ্ছে না, এমন খবর পাওয়া যায়৷ অথচ যৌন নির্যাতনের অভিযোগ যেকোনও সময়ে নেওয়া উচিত, সহযোগিতা ও সহমর্মিতার সঙ্গেই তা নেওয়া উচিত বলে জানি।
এসব বর্তমান লেখকের ব্যক্তিগত অভিমত নয়। ভারতের পিনাল কোডের 166A(c) ধারা অনুযায়ী, থানায় যৌন হেনস্থা/নির্যাতনের অভিযোগ গ্রহণ করতে অস্বীকার কোনও অবস্থাতেই করা যায় না নাকি৷ যাইহোক, সেসময়ে যারা বিধাননগর থানায় উপস্থিত হয়, তাদের একজনের বক্তব্য সরাসরি শোনা যাক:
আমরা কয়েকজন বিধাননগর উত্তর পুলিশ থানায় যাই এফআইআর দায়ের করতে। ইচ্ছা ছিল এফআইআর করে আবার বইমেলাতেই ফিরে আসব। থানায় গিয়ে প্রথমেই আমাদের বলা হয় ‘বড়বাবু নেই’, এখন এই সব হবে না।’ আমরা বলি যৌন নির্যাতনের অভিযোগ নিতে আপনি বাধ্য…. তাতে আমাদের হাতে চারটে কাগজ ধরিয়ে বলা হয় যান বাইরে থেকে লিখে আনুন। ভেবে দেখুন, তিনটি মেয়ে, যৌন নির্যাতনের শিকার তাদের অভিযোগপত্রটি থানার সামনে মাটিতে বসে লিখতে হয়। লেখার পর তা জমা দিয়ে এফআইআর করতে গেলে গ্রিল আটকে এক পুলিশ দাঁড়িয়ে তিনটি অভিযোগপত্র হাতে নিয়ে বলে, ‘এবার আসুন।’ আমরা বলি, এফআইআর করতে চাই আমরা, মলেস্টেশনের বিরুদ্ধে! আমরা রিসিভড কপি চাই। তাতে পুলিশ বলেন, ‘কাল আসুন!’… কথাকাটাকাটির পর উনি জানান শুধুমাত্র যাদের অভিযোগ তারাই আসতে পারবে! এর পর দুজনকে ঢুকতে দেওয়া হয় অন্যজনকে বাইরেই রেখে দেওয়া হয়।
এর মধ্যে একটি মেয়ে জানায়, ‘পুরুষ পুলিশও আমাকে মলেস্ট করেছে, আমি সেফ বোধ করছি না, আমার সঙ্গে অন্তত একজনকে আসতে দিন।’ তাতে পুলিশ তাকে জানায় ‘তুমি তাহলে বেরিয়ে যাও।’
এইখানে দুইটি কথা বলে রাখা কর্তব্য। এক, ক্রিমিনাল কোডের ১৫৪ নং ধারা অনুযায়ী পুলিশ এফআইআর নিলে রিসিভড কপি দিতে বাধ্য৷ সুতরাং যে এফআইআর-এর রিসিভড কপি পাওয়া গেল না, তা আদৌ গৃহীত হয়েছে কিনা, সে সম্পর্কে সন্দিহান হওয়া স্বাভাবিক।
দুই, ভার্মা কমিশন যৌন নির্যাতনে পুলিশের ভূমিকা সংক্রান্ত যে সুপারিশ করেছিল, তা যদি পড়া যায়, তাহলে এও জানা যাবে যে নিগৃহীতাকে একা এফআইআর করতে আসতে বাধ্য করা যায় না৷ তিনি যদি আত্মীয়, বন্ধুর উপস্থিতি চান, তাহলে পুলিশকে তা মেনে নেওয়ারই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
পরের ঘটনা অনভিপ্রেত ও ‘কেওটিক’। তাঁদেরই ভাষায়:
এরপর পুলিশ ধাক্কা দিতে শুরু করায় স্বাভাবিকভাবেই পাল্টা ধাক্কাধাক্কি হয়। থানার মধ্যে পুলিশ যথেষ্ট মারধর করে ধাক্কা মেরে সবাইকে বের করে দিতে চায়, ফের মলেস্টে করে আর একটি মেয়েকে! মেরে একজনকে অজ্ঞান করে দেওয়া হয়। তখনই ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়!…
এই অংশটি এবং শুধুমাত্র এই অংশটিই আমরা নিউজ চ্যানেলে দেখতে পাই। সেখানে মহিলা পুলিশের চুল টানাটানির চিত্র নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়। অন ডিউটি পুলিস, মহিলা হোন বা পুরুষ, তাঁর গায়ে হাত তোলা আইনানুগ নয়।
শেষ পর্যন্ত প্রতিবেশী থানার বড়বাবু আসেন, হস্তক্ষেপ করেন৷ বলেন, মেয়েরা এক এক করে মলেস্টেশনের অভিযোগ জানাতে পারেন। কিন্তু কোনও উকিল সঙ্গে থাকতে পারবে না।
*******
এদিকে সামাজিক মাধ্যমে তখন বিজেপি আরএসএস নিজস্ব কায়দায় প্রচারাভিযান শুরু করে। এক তরুণ তার বন্ধুর থেকে খবর পেয়ে বইমেলায় পুলিশি নিগ্রহ নিয়ে এক পোস্ট লেখে ফেসবুকে। ০৯.০২.২০২০ তারিখে Joint Admission Test for MSc. (JAM) থাকায় সেই তরুণ নিজে নাকি ৮ তারিখ বইমেলা যায়নি। কিন্তু বিজেপির বেশ কিছু পেজ এই ছেলেটির নামেই গুজব ছড়াতে থাকে, সে নাকি বিশ্ব হিন্দু পরিষদের স্টলে গীতার উপর দাঁড়িয়ে নৃত্য প্রদর্শন করে হিন্দুজনের ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছে।
এমন ঘটনা ঘটে থাকলে ভাবাবেগে আঘাত লাগতেই পারে। কিন্তু ঘটনাচক্রে ছেলেটি বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংস্কৃতজ্ঞা গৌরী ধর্মপালের দৌহিত্র এবং পারিবারিকভাবে হিন্দু দর্শনে অনুরাগের উত্তরাধিকারী। উপরন্তু তার নিজের ভাষ্য অনুযায়ী, সে ছিল অনুপস্থিত। অনেকেই বলেন মিথ্যা ছড়ানোর ব্যাপারে বিজেপি গোয়েবলসের নীতি মেনে চলে। সে যাই হোক, গীতার উপর নৃত্য পরিবেশনের ঘটনাটি প্রমাণাভাবে রহস্যজনকই থেকে যায়।
******
এরপর ১১ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার, ছাত্রছাত্রীদের এক ফোরাম, “Students Against NRC NPR CAA”-র সদস্য আজিজুর রহমানকে সন্ধে নাগাদ তার রাজারহাটের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায় বিধাননগর পুলিশ। ওয়ারেন্ট আছে কিনা জিজ্ঞেস করলে পুলিশ তাকে জানায়, তাকে অ্যারেস্ট বা ডিটেইন করা হচ্ছে না। শুধুমাত্র জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। “Students Against NRC NPR CAA” ফোরামের ছাত্রসদস্যরা, মানবাধিকার সংগঠন এপিডিআরের কর্মীরা সে রাতেই পৌঁছোন বিধাননগর নর্থ থানার সামনে। বারবার পুলিশের কাছে তাঁরা জানতে চান কেন আজিজুরকে তুলে আনা হয়েছে। সদুত্তর পাওয়া যায় না। মধ্যরাত নাগাদ জানা যায়, “যা হওয়ার কাল সকালে (১২ ফেব্রুয়ারি) হবে।” সকালে জানা যায়, আজিজুরের নামে মোট ৯টি ধারায় (যার মধ্যে ৭টি জামিন অযোগ্য ধারা) পুলিশ এফআইআর করেছে এবং তাকে অ্যারেস্ট করেছে।
আজিজুরকে বিধাননগর কোর্টে (ময়ুখ ভবন) তোলা হয়। প্রথমে ১২ দিনের জেল হেফাজত ধার্য হয়, পরে আন্দোলনকারী এবং উকিলের চাপে সেই মেয়াদ কমিয়ে ৯ দিন হয়। পরবর্তী হিয়ারিং ২১ শে ফেব্রুয়ারি।
কিছু প্রশ্ন এ বিষয়েও থেকে যায়। নাগরিককে বিনা ওয়ারেন্টে জিজ্ঞাসাবাদ করার নামে থানায় তুলে নিয়ে এসে একরাত রেখে, পরের দিন তার নামে এফআইআর করে অ্যারেস্ট করা হয় কেন? সে যদি অপরাধী হয় তাহলে ওয়ারেন্ট দেখিয়েই তাকে গ্রেপ্তার করা হয় না কেন? তাকে চাপ দিয়ে বাকি আন্দোলনকারীদের চিহ্নিত করতে বলা হয় কেন? আন্দোলনকারীরা তো এনআরসি-বিরোধী আন্দোলনে যুক্ত মাত্র। এনআরসি-বিরোধিতা তো বইমেলা প্রাঙ্গনে মুখ্যমন্ত্রী সহ আরও অনেকেই করেছেন। আজিজুরের দোষের সপক্ষে ভিডিও ফুটেজ আদালতে দেখানো গেছে কি?
*****
গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগেই আজিজুরের কীবোর্ড থেকে যে লেখা জন্ম নিয়েছিল, তা এখনও তার ফেবু দেওয়ালে মজুত আছে। সেটি তুলে দেওয়া যাক।
আমি কোনো বিপ্লবী না। কিছুদিন আগে পর্যন্ত স্কুলে বৃক্ষরোপণ আর বিভিন্ন দিবস পালন ছাড়া কোনোদিন আন্দোলনে নামিনি। ব্যক্তিগত লড়াই ছাড়া কারোর জন্য রাস্তায় নামিনি। জীবনের এতটা সময় শান্তির ঘুমে কাটিয়েছি। টিভি আর সোশাল মিডিয়াতে অন্যায় দেখলে বাড়িতে বসে প্রতিবাদ জানিয়েছি। নিজের শখ পূরণের জন্য উদগ্রীব ছিলাম এতদিন। দূর থেকে বিপ্লবের খবর পেলে খুশি হতাম ঠিকই কিন্তু দিনের কোনো কাজে তার প্রভাব থাকেনি। তারপরে আস্তে আস্তে একদিন দূরের অন্যায় গুলো আমাদের ঘরের কাছে এগোতে শুরু করলো। আমার হঠাৎ চোখগুলো আমার আরামের গণ্ডির থেকে বেরোতে শুরু করলো। দেখতে থাকলাম যে আমার ভাতের থালার মধ্যেও কাদের অক্লান্ত পরিশ্রম চুরি করে রাখা আছে। বড়ো বড়ো ইমারতের মধ্যেও কাদের শ্রমচুরির ইতিহাস লেখা আছে। তারপরে চেনা পৃথিবীটা অচেনা লাগতে শুরু করলো।বড়ো বড়ো প্রাসাদের নীচের ভাঙাচোরা ঘরগুলো বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করলো। আমার দেশের স্বল্প কিছু সম্পদ নিয়ে কোটি কোটি মানুষের লড়াই ভীষণ ভাবে স্পষ্ট হতে শুরু করলো। আবার দেখলাম দিগন্ত বিস্তীর্ণ সম্পদের মালিকানা মাত্র কটা কালো হাতে আটকে বন্দী রয়েছে। ইতিহাসের কথা খুব মনে পড়ছিল। বুঝলাম পুরোটা ইতিহাস এই এক চিত্রের অনেকগুলো রূপ মাত্র। এর মধ্যে আমাদের প্রথাগত শাসশ্রেণী মানুষের মাঝে সেই প্রাচীন ধর্মীয় নেশার বিষ ছেটাতে শুরু করলো। দেশের মধ্যে শুরু হলো ভিনদেশী বানানোর এক অদ্ভুদ প্রক্রিয়া। বাড়িতে বসে বসে কেমন যেন অস্থির লাগতে শুরু করলো। রাস্তায় না নামার আর কোনো কারণ খুঁজে পেলাম না। জানিনা কীভাবে ঠিক লড়তে হবে। আমি হয়তো কোনোদিন কোনো আন্দোলনে সার্থকতা আনতে পারবোনা। আমি কোনো জটিল বিপ্লবী তত্ত্ব বুঝিনা। লড়াইটা সঠিক ভাবে কীভাবে করবো জানিনা। আমার শিক্ষা ভীষণ স্বল্প, যা আমাকে খুব গভীর কোনো বিষয়ের কিনারায় নিয়ে যেতে পারেনা। তবে এটুকু বুঝি যারা এতদিন আমার নিশ্চিন্তে ঘুমের পিছনে দিনরাত পরিশ্রম করতো তারা ভালো নেই। তাই পরের সুখের রাত আসার আগে রাস্তায় নেমে সাথ দিতে হবে মানুষের লড়াইকে।[1]
এই পোস্টের প্রসঙ্গে এসে পড়ে আরও কিছু কথা৷ এ নিশ্চয় বর্তমান শাসকদলের ফ্যাসিবাদী নির্যাতনেরই কেরামতি যে, আজ এ দেশের ছাত্রসমাজ, স্মার্টফোনে মুখ গুঁজে থাকা, পোকেমন-পাবজিতে নিমজ্জিত ছাত্রসমাজ, হয়ে উঠেছে রাজনৈতিকভাবে চূড়ান্ত সজাগ। সত্তর-পরবর্তী দশকগুলিতে, সত্তরের সমাজ বদলের স্বপ্ন ব্যর্থ হওয়ার ফলেই হয়ত, সাংস্কৃতিকভাবে, পারিবারিকভাবে ‘অ্যাপলিটিকাল’ হওয়ার মন্ত্রদীক্ষা সম্পন্ন হয়েছিল৷ ভালো ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে, বড় জোর কিছু অরাজনৈতিক সমাজকল্যাণমূলক কাজে হাত লাগায়, আর মন্দরা রাজনীতির ঝামেলা পাকায়— এ ধারণা যুবমানসে বদ্ধমূল হয়েছিল। ফলত, যাদবপুর-জেএনইউ-হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি যে যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে রাজনৈতিক চর্চা গভীরভাবে হত, তাদের ‘ঝামেলাবাজ’ বর্গে ফেলা সহজ হয়েছিল। অথচ জামিয়া মিলিয়ায় ছাত্র-নিগ্রহের ঘটনার পরে সারা দেশের ছাত্রসমাজ হঠাৎ-ই রাজনীতিহীনতার ঘুম থেকে জেগে উঠল, আমরা দেখলাম। আইআইটি, আইআইএম, আইএসআই আন্দোলনে নামবে, এ কি কেউ কখনও ভেবেছিল? মেধাভিত্তিক কৌলীন্যর বিভাজনও আমরা মুছে যেতে দেখলাম এইবেলা। এলিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাধারণ কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, সকলেই পথে নামল, কারণ এইবার সমস্যা নাগরিকত্ব হারানোর৷ এইবার প্রশ্ন, ক্যাম্পাসে পুলিশি নিগ্রহের। এইবার, সোজা কথায়, অস্তিত্ব সঙ্কট।
আজিজুর সেই বৃহৎ ছাত্রসমাজের এক প্রতিনিধি মাত্র। রাষ্ট্র তার নবজাগ্রত রাজনৈতিক বোধ যে নিবিয়ে দিতে চাইবে, তা বলাই বাহুল্য।
******
এরপর আরও এক আশ্চর্য ঘটনা ঘটে। ৮ তারিখে থানায় যৌন নিগ্রহের অভিযোগ করা এক ছাত্রী ১৩ তারিখে ফেসবুকে লেখে:
F.I.R করতে গেলাম চ্যাং-দোলা করে বাইরে ফেলে দিলো। আবার করলাম। পাত্তা দিলোনা। শুধু নিলো। পরের কি করার কিছুই বললোনা। আজ ৫ দিন হলো। F.I.R টা মিনিমাম এগোয়নি। অথচ ১১ জনের টিম নিয়ে বাড়ি গিয়ে তছনছ করে আসতে পেরেছে৷ বাবা মাকে হুমকি দিয়ে আসতে পেরেছে। বেশ। আইনের ছাত্রী হয়ে এটা ভালোই জানি যা লেখা থাকে তার বিন্দুমাত্রও কাজে হয়না। এবার দেখি কি কি আসলে হয়।
অর্থাৎ আমরা জানতে পারলাম, যারা যথাযথভাবেই নিজেদের নাম ঠিকানা দিয়ে থানায় যৌন নির্যাতনের অভিযোগ করেছিল আরএসেস/বিজেপি কর্মী ও পুলিশের বিরুদ্ধে, তাদের একজনের বাড়িতে এগারো জনের এক পুলিশবাহিনী যায়। তদন্তের কারণে পুলিশ কি যেতে পারে না? নিশ্চয় পারে। কিন্তু ‘হুমকি’ ও ‘বাড়ি তছনছ করা’-র অভিযোগ আমরা শুনি। এইখানে লিঙ্গরাজনৈতিক কর্মী হিসেবে বর্তমান লেখক শঙ্কিত হয়ে পড়েন। প্রশ্ন জাগে, যে কোনও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ জমা পড়লে, তা যার বিরুদ্ধেই হোক না কেন, অভিযোগকারিণী বা তাঁর বাড়ির লোকের সঙ্গে এমন আচরণ করা যায় কি, যাতে তিনি/তাঁরা আতঙ্কিত হন? সহমর্মিতা নয়, হুমকি হিসেবে বর্ণনা করেন পুলিশি হস্তক্ষেপকে?
এক্ষেত্রে আরও বলার থাকে, পরবর্তী সময়ে আজিজুরের মুক্তির দাবিতে মিছিল হয়েছে। ছাত্রনিগ্রহেরও প্রতিবাদ হয়েছে। তুলনায় যৌন নিগ্রহ নিয়ে আলোচনা কম, এমনকী প্রতিবাদী মহলেও৷ যেন ধরেই নেওয়া হয়েছে, লড়াকু মেয়েদের নির্যাতনের মধ্যে যৌন নির্যাতন পড়বেই, যেন এই কোল্যাটারাল ড্যামেজের জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়েই লড়তে আসতে হবে মেয়েদের। অথচ যৌন নির্যাতন (যদি তা হয়েই থাকে) একটি স্বতন্ত্র ও গুরুতর অপরাধ। পৃথকভাবে গুরুত্ব দিয়েই তার তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।
*******
পরিশেষে এটুকুই বলার যে, এই সময়ের গণআন্দোলনের ধারাই বোধ করি এই যে তা নেতৃত্বের পরোয়া করে না৷ শুধু কলকাতা থেকে দিল্লি নয়, সারা বিশ্বেই আপন খেয়ালে লড়ে যাওয়ার এই ঝোঁক। চিলির কথাই ধরা যাক। এরকম আন্দোলনে ভুলভ্রান্তি থাকবে, হঠকারিতাও থাকবে। এরকম আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেও নিশ্চিত নই। কিন্তু তবু এ আন্দোলনকে নিগড়ে বাঁধা শক্ত। পদ্ধতিগতভাবে অবশ্যই বয়োজ্যেষ্ঠদের কিছু শেখানোর আছে, তাঁরা শেখাবেনও। সংবিধান রক্ষার দায়িত্ব যারা নিয়েছে, তারা আইনবহির্ভূত কোনও কাজ করবে না, এটাই কাম্য। কিন্তু বড়দেরও শেখার আছে কিছু স্বতঃস্ফূর্ততা। আশা করা যায়, প্রবীণ-নবীনের পারস্পরিক আদানপ্রদানের মাধ্যমে, ব্যাকরণগত কিছু ভুল-ভ্রান্তি শুধরে নিয়ে, আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
[1] বানান অপরিবর্তিত
লেখক এর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত।