মুসাফির এ মন

নীলাঞ্জন হাজরা

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

ফেনজ দেবীর প্রসাদ অথঃ অ্যাফ্রোডিজিয়াক

ইস্তানবুল দুনিয়ার সেই তিনটি শহরের এক নম্বর (অন্য দুটি আমি মনে করি কায়রো আর বাগদাদ) যেখানে ইতিহাস আর কিংবদন্তি এমনভাবে মিলে মিশে এক হয়ে গিয়েছে যে বহু পাড়াতেই ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে মনে হয় একটা ঘোরের মধ্যে আছি৷ কোনটা যে সত্যি আর কোনটা এক্কেবারে গাঁজাখুরি তা ঠাহর করাই মুশকিল হয়ে ওঠে৷ এই গভীর নীল মার্মারা সাগর, এই বসফরাস, এই বিশাল বিশাল রঙিন প্রাসাদ— তোপকাপি,  দোলমাবাহেচ, কুচুকসু, চিরাগান৷ এই বুক চিতোনো সব মসজিদ৷ এই জাহাজঘাটার ঘন ঘন ভোঁ৷ দিগন্তের এপার থেকে ওপার গাণ্ডীব ধনুকের মতো টানটান অত্যাধুনিক ডিজাইনের বসফরাস সেতু, যার এপারে থাকলেই এশিয়া আর পেরোলেই ইউরোপ৷ এই সম্পূর্ণ কালো হিজাবে মোড়া (তবে বোরকায় নয়) অপরূপ সুন্দরী নারী টার্কিশ এয়ারলাইন্স-এর আপিসে বসে দুপুর বেলা টেবিলে কুচকুচে কালো হাই-হিল জুতো সমেত পা তুলে দিয়ে দিব্যি সরু লম্বা সিগারেট টানছেন৷ এই ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট৷ এই রাস্তার পাশে অপূর্ব সুন্দর সোনালি বাহারের পশরা সাজিয়ে এরা কী বিক্রি করছে, সামনে আবার কেতার একখানা বার-স্টুল— ওমা এ তো বুট-পলিশ, যেমন বাহারের বুট-পলিশ আর দুনিয়ার কোত্থাও দেখিনি!

সব মিলে মিশে সময়ের বোধটাকে গাঁজার নেশার মতো গুলিয়ে দেয়৷ এই পঞ্চদশ শতকে ছিলাম, এই হাজির একবিংশ শতকে৷ আর এই হল সাড়ে পাঁচশো বছরের পুরনো দুনিয়ার প্রথম শপিং মল, যা কিনা আজও বিশ্বের বৃহত্তম বাজারগুলির একটি, তার গেট৷ গেটের ওপরে বড় বড় হরফে লেখা— Kapalicarsi Grand Bazar, 1461৷ আর সে গেটের সামনে দুনিয়ার যত শ্বেতাঙ্গ টুরিস্টের কলকলে ভিড়৷

সে বাজার যে কী গ্র্যান্ড তা বর্ণনা করাও কঠিন৷ অনেক ডাকসাইটে বাজারই দেখার সুযোগ হয়েছে জীবনে—  দিল্লির শাহজাহানাবাদের চাঁদনি চক, হায়দরাবাদের চারমিনারের চুড়ি বাজার, লাহোরের আনারকলি বাজার, এথেন্স-এর মোনাস্তিরাকি মার্কেট, বুদাপেস্টের বুদায় নাজ-ভাসারচারনোক, ভেনিসের রিয়ালতো মের্কেতো, মার্কিন দেশের নর্থ ক্যারোলাইনা-র র‍্যালে ফ্লি মার্কেট, আমাদের কলকাতার হগ সাহেবের নিউ মার্কেট, কিন্তু একমাত্র ইরান ছাড়া এমন বাজার আর কোথাও দেখিনি— ঢুকেই কেমন পাগল পাগল লাগতে শুরু করে৷ সোনালি কারুকাজ করা খিলান দেওয়া গলির পরে গলির পরে গলি৷ আর এক একটা গলিতে এক এক রকমের পশরা৷ রঙের পরে রঙের ঢেউ— কাল্পাকিচিলার কাদেসি— স্যাকরাদের গলি, দিবরিকি কাদেসি— আসবাবপত্রের গলি, সাহাফলার কাদেসি— কার্পেটের গলি, পের্দাচিলার কাদেসি— চামড়ার জিনিসের গলি— সব মিলিয়ে এমন ৬১টা গলি৷ চার হাজার দোকান৷ প্রতিদিন এ বাজারে আসেন ২৫০০০০ থেকে ৪০০০০ ক্রেতা বা আমার মতো দর্শনার্থী৷

আর এই কাপালি চারসি-র শুখা ফল আর মশলার পাড়াতে ঘুরতে ঘুরতেই ঢুকে পড়েছিলাম সেই গোপন কিন্তু তত গোপনও নয় দুনিয়ায়৷ যে কোনও বাজারেরই শুখা ফলের পাড়ার প্রতি আমার একটা বিশেষ আকর্ষণ এই কারণেই যে তেমন রঙের রোশনাই আর কোনও পাড়ায় দেখা যায় না৷ ঘুরছি, ছবি তুলছি, এটা সেটা দেখছি, হঠাৎ এক টুপিওয়ালা বুড়ো দেখি চোখ টিপে আমায় জিজ্ঞেস করছেন—  ‘মিস্তার, মেসির মাজুনু লাগবে? মেসির মাজুনু? খাস মাল আছে— খেলেই শরীর গরম!’ ভাবছি, শীত তো মোটেই নেই৷ তা হলে খামখা শরীর গরম করতে যাবে কেন? অমনি দেখি আমার বন্ধু, যার বাড়িতে উঠেছিলাম, সেই হাকান গুলস্বেন, আমার হাত ধরে এক টান, ‘চলো, চলো৷ ওসব তোমার দরকার নেই৷’ ‘কেন দরকার নেই কেন? খেয়ে দেখি না?’

তার পরেই হাকানের কাছে জানতে পারি বুড়ো যে আমায় শরীর ‘গরম’ করার কথা বলছিল, সে গরম এমনি গরম নয়! সে গরম ঠান্ডা করতে গেলে অন্য ব্যবস্থা চাই! আর তা থেকেই জানতে পারি ইস্তানবুলের বিখ্যাত মেসির মাজুনু-র কাহিনি৷ একটা ইশারা দিলেই সমঝদারেরা বুঝে ফেলবেন ব্যাপারটা কী— অটোমান হারেমে যে রাত্রে সুলতান আসতেন, সে দিন খুব চাহিদা পড়ে যেত এই মেসির মাজুনু-র৷ সুলতানেরও, বেছে নেওয়া হারেমবাসিনীদের মধ্যে!

কাহিনি এ রকম— ১৫২৩ সাধারণাব্দে সুলতান সুলেমানের মা আইশে হাফসা সুলতানা সাংঘাতিক অসুস্থ হয়ে পড়েন৷ বহু হাকিম-বদ্যি দেখে শুনে জবাব দিয়ে দেয়৷ শেষে ডেকে পাঠানো হয় ইয়াবুজ সেলিম মসজিদের মাদ্রাসার প্রধান মের্কেজ মুসলিহিদ্দিন এফেন্দি-কে৷ তিনি মাদ্রাসার সংলগ্ন একটি চিকিৎসালয়ে শিকড়-বাকল দিয়ে রোগীদের চিকিৎসা করতেন৷ সুলতানাকে পরীক্ষা করে তিনি ৪১টি জড়ি-বুটির একটি ওষুধ তৈরি করে সুলতানাকে খাওয়ান৷ সুলতানা সেরে ওঠেন৷ এই মিষ্টি মিষ্টি খেতে ওষুধটির নাম মেসির মাজুনু৷ অভিভূত সুলতানা বলেন প্রত্যেক বসন্ত উৎসব নেওরুজ-এ মানুষের মধ্যে বিলি করা হবে এই মেসির মাজুনু৷ সেই থেকে শুরু হয় মেসির মাজুনু উৎসব৷ আজও সে উৎসব রমরমিয়ে চলছে৷ এমনই রমরমিয়ে চলছে যে, তুর্কি সরকার ইউনেস্কো-র কাছে আর্জি জানিয়েছে তাকে ‘ইন্ট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ’-এর তালিকায় তোলা হোক! ইউনেস্কোর ওয়েবসাইটে গেলেই দেখা যাবে সে উৎসবের বর্ণনা আর ছবি— ১৪ জন মহিলা মিলে তৈরি করেন মেসির মাজুনু বড়ি৷ ২৮ জন ইমাম সেই হাজার হাজার বড়িতে আশীর্বাদ করেন৷ তারপর তা বিলি করা হয়৷

কিন্তু এই কাহিনির সঙ্গে যে শরীর ‘গরম’ করার ব্যাপারটা কী ভাবে জড়িয় গেল তা আমি মোটেই খুঁজে পাইনি৷ ইস্তানবুলের মশলা বাজারে একটু ঘোরাফেরা করলেই জানা যাবে নারী এবং পুরুষ উভয়ের মধ্যেই মেসির মাজুনু-র যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধির, যাকে ইংরেজিতে বলবে ‘অ্যাফ্রোডিজিয়াক’, সেই অ্যাফ্রোডিজিয়াকের দুরন্ত ক্ষমতার কথা৷

আসলে অ্যাফ্রোডিজিয়াক ব্যাপারটাই এ রকম৷ কোনও পাশ দেওয়া ডাক্তার স্বীকার করবে না অ্যাফ্রোডিজিয়াক (এখানে অবশ্য ভায়াগ্রার মতো রাসায়নিক ওষুধের কথা ধরছি না৷ তাকে অ্যাফ্রোডিজিয়াকের প্রাচীন খানদানে ঢুকতে দেওয়াই যায় না) ব্যাপারটার আদৌ কোনও বৈজ্ঞানিকভাবে পরীক্ষিত ভিত্তি আছে কিনা, তা আমার জানা নেই৷ কিন্তু সারা দুনিয়ায় এমন কোনও সংস্কৃতি নেই যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে হরেক রকমের অ্যাফ্রোডিজিয়াকের প্রচলন নেই— ভারতে মধু থেকে চিনে বাঘের পুরুষাঙ্গ পর্যন্ত, স্পেনে ক্যান্থারাইড সবুজ মাছি (যার দেহ নিঃসৃত রসের নাম ক্যান্থারাইডিন) থেকে কেনিয়ায় মোন্দিয়া হোয়াইটেয়ি গাছের শিকড় পর্যন্ত! রোমহর্ষক তার বিবর্তনের ইতিহাস৷ মেসির মাজুনু তো সেদিনের খেলোয়াড়!

অ্যাফ্রোডিজিয়াক কথাটা এসেছে গ্রিক ভাষা থেকে৷ ৭০০ পূর্বসাধারণাব্দ, মানে আজ থেকে ২৭০০ বছর আগে বিখ্যাত গ্রিক কবি হেসিয়োদোস তাঁর থিওজনি কাব্যে দেবতাদের যে বংশতালিকা তৈরি করেছিলেন তাতে রয়েছে সেই রুদ্ধশ্বাস বর্ণনা— ‘ক্রুদ্ধ ক্রোনাস যখন ইউরেনাস-এর অণ্ডকোষ ছেদন করিয়া মহাসমুদ্রে নিক্ষেপ করিলেন সমগ্র জলরাশি শুভ্র ফেনায় ভরিয়া উঠিল এবং তাহা হইতে জন্মিলেন প্রেম ও রূপের দেবী অ্যাফ্রোডাইট৷’ আর সেই জন্যেই অ্যাফ্রোডাইট শব্দের আক্ষরিক অর্থ ফেনা জাত বা ফেনজ!

***

 

অবাক জলাধার

মেসির মাজুনুর কিংবদন্তি থেকেই আবার ইস্তানবুলে হাজির হয়ে গিয়েছিলাম এক সুপ্রাচীন গা ছমছমে ইমারতে, যেমনটা ইস্তানবুল ছাড়া আর দুনিয়ার কোথাও দেখিনি।

অন্যদের কথা বলতে পারি না, কিন্তু আমার সত্যিই গা ছমছম করছিল৷ এক একটা করে ধাপ নামছি আর ঠান্ডাটা বাড়ছে৷ আলো কমছে৷ এই ভাবে ৫২ ধাপ৷ মেঝেতে এসে যখন পৌঁছলাম তখন শরীরের শীত-শীত ভাব, মনের মধ্যে কেমন যেন একটা রুদ্ধশ্বাস ভাব আর বুকের মধ্যে একটা গা-ছমছমের ভাবের মধ্যে কোনটা কম কোনটা বেশি লেগেছিল তা আলাদা করে বলা অসম্ভব৷

ইস্তানবুলের অন্যতম আকর্ষণ মা মেরির লাবণ্যময়ী ফ্রেস্কো আঁকা হাজিয়া সোফিয়া মসজিদ থেকে বেরিয়েছি৷ বাইরে ঝলমলে রোদ্দুর৷ পেটে চনমনে খিদে৷ আমার বন্ধু— থাকছিলুম যার বাড়িতে— হাকান গুলস্বেনকে বলি, ‘চলো তোমাদের খাস তুর্কি খানা খাই কোথাও৷’ খাইয়েছিল৷ এক্কেবারে খাস তুর্কি খানা৷ সঙ্গে খাস তুর্কি পিনা৷ কিন্তু সে অনেক বেলায়৷ সে সময় আমার অনুরোধের উত্তরে যা বলল, তাতে একটু চমকেই উঠে ছিলাম— ‘আগে চলো, আমার মতে ইস্তানবুলের সব থেকে রোমহর্ষক কীর্তিটা দেখিয়ে আনি তোমায়৷ মাথা খারাপ হয়ে যাবে৷ কাছেই৷ জাস্ট্ উল্টো দিকেই বলা যায়!’

মনে মনে আমি একটু বাঁকা হাসি হাসি৷ এ দেমাকটা আমি রোমেও লক্ষ করেছি৷ রোমবাসীদের একটা ধারণা রোমে যা-কিছু আছে, মানে যা-কিছু প্রাচীন, তা দেখলেই বাইরে থেকে আসা সকলের মাথা খারাপ হয়ে যাবে৷ তুর্কিদেরও দেখছি সে রোগ! আমার এমনটা ভাবার কারণ, হাকান যেখানে টেনে নিয়ে চলেছে আমায় সেটাকে আমি জেনে বুঝেই আমার ইস্তানবুলের ‘অবশ্য-দ্রষ্টব্য’-র তালিকা থেকে বাদ দিয়ে ‘সময় পেলে দেখা যাবে’-র তালিকায় ঢুকিয়ে রেখেছি৷ কী সেটা? না জলের ট্যাঙ্ক৷ মাটির তলার জলাধার৷ তুর্কিতে— ইয়েরেবাতান সারনিচি৷ ইংরেজিতে Basilica Cistern৷ শুনতে খারাপ লাগতে পারে, কিন্তু আমার জীবনে ভাই খাওয়াটা একটা ব্যাপার৷ সেই আশ্চর্য যুক্তিপূর্ণ মানুষদের মধ্যে আমি একেবারেই নই, যাঁরা শরীরটাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য খাওয়া-দাওয়া করেন— চারা-পোনা খেলে শরীরের রক্ত বাড়ে বলে চারা-পোনার ঝোল খেয়ে বছর কাটিয়ে নিজের এবং নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টের ভবিষ্যৎ আশ্চর্যভাবে সুনিশ্চিত করে তোলেন৷ পারলাম না৷ খিদে পেলে, বিশেষ করে বিদেশ বিভুঁয়ে বেড়াতে এলে, খুঁজে-পেতে সাধ্যমতো একটু খাস খানা সাবড়াব— এটাই আমার দস্তুর৷ এহেন আমার খিদে পেয়েছে, আর হাকান আমায় টেনে নিয়ে চলেছে কোথায়? না একটা জলের ট্যাঙ্ক দেখতে৷

কিন্তু কী করা? কাজেই সেই ৫২ ধাপ সিঁড়ি বেয়ে নীচে৷ আর তার পরেই সেই শীত-শীত, সেই গা-ছম ছম আর সেই রুদ্ধশ্বাস ভাব৷ এ কোন দুনিয়া? এ কেমন জলের ট্যাঙ্ক? চোখটা ধাতস্থ হতে সময় লাগে একটু৷ যত দূর দেখতে পাই খিলানের পর খিলানের পর খিলান৷ ইটের৷ আর তার মাঝখানে মাঝখানে আবছা আবছা পিলারের আভাস৷ পিলারের পায়ের কাছে টিমটিম করছে আগুন রঙের ক্ষীণ আলো৷ কিন্তু সেই আলোগুলো নীচের মেঝেতেও কেন? আর মেঝের আলোগুলো এমন হালকা কাঁপছে কেন? ওটা কী? ওটা মেঝে নয়৷ জল৷ যতদূর চোখ ঠাহর করতে পারে জল৷ ১০৫০০০ (এক লক্ষ পাঁচ হাজার) বর্গফুট জুড়ে জল৷ আর সেই জলের ওপর দিয়ে চলে গেছে পাটাতন৷ সেই পাটাতন ধরে ধরে ঘুরে বেড়ানো যায় সর্বত্র৷ সাবধানে পা ফেলে ফেলে৷ আবছা ভূতুড়ে আলোর হিমে৷

সারি সারি পিলারের মধ্যে দিয়ে৷ ‘লক্ষ করে দেখো, এখানে দু ধরনের পিলার আছে— ‘‘আয়নিক’’ আর ‘‘করিন্থিয়ান’’!’ ফিস ফিস করে বলে আমায় হাকান! (কিছু কিছু জায়গা আছে, যেখানে কেউ বারণ না করলেও সকলে ফিস ফিস করে কথা বলে৷ এটাও দেখলুম সেরকম৷ বেশ কিছু টুরিস্ট ঘুরছে, কিন্তু কোনও শব্দ নেই৷ ছায়ার মতো!)৷ আমি তখন বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়লেও মনে মনে জটায়ুর ঢঙে বলি, ‘পিলার পিলার৷ লম্বা লম্বা থাম মেঝে থেকে ছাদ অবধি৷ তার আবার রকম কী মশাই?’ কিন্তু পরে জেনে নিয়ে ছিলাম৷ যে বস্তুটির ওপর ভর করে গোটা সভ্যতাটাই দাঁড়িয়ে আছে কত অজস্র তার রকম-ফের৷ এখানে যে পিলার দেখছি সেগুলি হল গ্রিকো-রোমান স্থাপত্যের ‘ধ্রুপদী ধাঁচের’, যাকে বলে ‘ক্ল্যাসিকাল অর্ডার’৷ এই ধাঁচের পিলার তিন রকম— আয়নিক, করিন্থিয়ান, ডোরিক আর তুস্কান৷ এ ছাড়াও আছে মধ্যযুগীয় ধাঁচের— বাইজেন্টাইন, রোমানেস্ক, গথিক৷ আছে ‘প্রাগৈতিহাসিক ধাঁচের’, ‘মিশরীয় ধাঁচের’, ‘পারস্য ধাঁচের’, ‘উত্তরাধুনিক ধাঁচের’ ইত্যাদি৷ (সঙ্গের স্কেচ থেকে কিছুটা আন্দাজ মিলবে)৷ কলকাতায় ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন বাড়ির পিলারের ধরন বোঝাটাই বেশ একটা মজার খেলা হতে পারে৷

এই বিচিত্র জলাধারে রয়েছে ৩৩৬টি মার্বেলের তৈরি আয়নিক আর করিন্থিয়ান পিলার৷ ১২টি সারি৷ প্রত্যেক সারিতে ২৮টি পিলার৷ প্রত্যেকটি পিলার ঠিক ১৬ ফুট দূরত্বে বসানো৷ আর প্রত্যেকটি পিলারের উচ্চতা ৩০ ফুট৷ এই জলাধারের চারপাশের দেওয়াল ১৩ ফুট চওড়া৷ আর যখন ব্যবহার হত, তখন এই ট্যাঙ্কে থাকত এক লক্ষ টন জল! কোথা থেকে আসত এই জল? শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের বেলগ্রাদ অরণ্য থেকে৷

এই জলাধারে ঘুরে বেড়াতে বেড়তে মনের মধ্যে একটা রুদ্ধশ্বাস ভাব জাগে এই কারণেই যে মাটির তলায় এই বিপুল আয়োজন তৈরি করা হয়েছিল আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগে বাইজেন্টাইন সম্রাট জাস্টিনিয়ানাস-এর রাজত্বের সময়৷ মানে, ৫২৭ থেকে ৫৬৫ সাধারণাব্দের মধ্যে! এইখানে ইস্তানবুল শহরের ইতিহাসটা একটু বুঝে নিতে হবে৷ এ শহরের ইতিহাসকে যুগ ধরে মোট চার ভাগে ভাগ করা যায়—

  1. ৩৩০ সাধারণাব্দ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত এ শহরের নাম ছিল কনস্ট্যানটিনোপল৷ এর মধ্যে ৩৩০ থেকে ১২০৪, তার পর ফের ১২৬১ থেকে ১৪৫৩ পর্যন্ত এ শহর ছিল রোমান-বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের রাজধানী৷
  2. তার মাঝখানে, মানে ১২০৪ থেকে ১২৬১, এ শহর ছিল রোমানিয়ানদের লাতিন সাম্রাজ্যের দখলে৷
  3. ১৪৫৩-তে শহর হয়ে যায় অটোমান সাম্রাজ্যের রাজধানী৷ টানা ১৯২২ পর্যন্ত৷ আর অটোমানদের সময় থেকেই শহরের নাম হয়ে যায় ইস্তানবুল৷
  4. অবশেষে, ১৯২৩ সাধারণাব্দে কেমাল আতাতুর্ক প্রতিষ্ঠা করলেন তুরস্ক প্রজাতন্ত্র, যার রাজধানী আজও ইস্তানবুল৷

এই বাসিলিকা সিসটার্ন সেই ষষ্ঠ শতকে তৈরি হওয়ার পর অন্তত ১৯০৯ পর্যন্ত ব্যবহৃত হয়েছে৷ তোপকাপি সরাইয়ের জল যেত এখান থেকে৷ যতই ঘুরছি ততই ভেবে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি যে কী ভাবে ১৫০০ বছর আগে তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল এই অবাক জলাধার৷ তার পর ‘পাম্প’ নামক বৈদ্যুতিক যন্ত্রটি ছাড়া (যা ছাড়া একটা দিনও চলে না আমাদের) ১২ কিলোমিটার দূর থেকে মাটির গভীরে সেই জল ভরে তা ফের নিয়ে যাওয়া হত মাটির উপরের তোপকাপি প্রাসাদে৷ মনে পড়ল, মুঘল সাম্রাজ্যের সময় শুধু বাঁধ দিয়ে আর খাল কেটে, সেই খালের প্রস্থ হিসেব করে জলের এমন চাপ তৈরি করা হত যে, দিল্লির যমুনার জল বয়ে যেত ওই অত উঁচুতে লাল কেল্লার মধ্যে দিয়ে!

আর এই আলো-আঁধারি জলের দুনিয়ায় ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ বুকটা ধড়াস করে ওঠে৷ আবছায়ার মধ্যে থেকে বিশাল একটা মুখ তাকিয়ে আছে আমার দিকে! বিশাল একটা মেডুসার মাথা৷ ধড় থেকে কাটা৷ অন্য কোথাও ছিল মূর্তিটা, এখানে এনে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে৷ তাও আবার উল্টো করে। অবাক ব্যাপার হল, এই জলাধারের প্রত্যেকটা পিলারই তাই৷ একটাও এর জন্য তৈরি নয়৷ বিভিন্ন ধ্বংসস্তূপ থেকে আনা বা পড়ে থাকা পিলার৷ স্থাপত্যের দুনিয়ায় ‘রিসাইক্লিং’-এর এক আশ্চর্য উদাহরণ৷

আসলে একটা নয়, এই জলাধারে রয়েছে দুটো মেডুসার মাথা৷ যাদের চুল থেকে কিলবিলিয়ে নেমে আসছে সাপ। মেডুসা হল গ্রিক কিংবদন্তির এক ভয়ঙ্কর জীব, যাকে বলে ‘গরগন’৷ কথাটা এসেইছে ‘গোর্গোস’ শব্দ থেকে, যার মানেই ভয়ঙ্কর৷ আর কিংবদন্তি হল এই মেডুসার দিকে যে তাকাবে সেই পাথর হয়ে যাবে৷ সত্যিই, এই পাতালপুরী দেখে স্থাণু হয়ে গিয়েছিলাম৷

 

(ক্রমশ)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...