আবিরের ছাই

তৃষ্ণা বসাক

 




লেখক কবি ও গদ্যকার।



রাধার নূপুর ও বাঁশিওলা

আমাদের ট্রেন ক্রমে বসন্তের মধ্যে প্রবেশ করে। বসন্তের নৃত্যপরা গাছ, তার পায়ে রাধার নূপুরের মতো আগুন, যে আগুনে ঘর বার এক হয়ে যায়।

চৈতী গানের মতো এই বসন্ত সমস্ত প্রত্যাখ্যানের আক্রোশ নিয়ে ওত পেতে থাকে রেললাইনের দুপাশে, কখনও সে শাহরুখ খানের মতো ট্রেনের ছাদে উঠে তাফাল মাচিয়ে দ্যায়– ‘চল ছাঁইয়া ছাঁইয়া ছাঁইয়া ছাঁইয়া, পাও চলতে ছাঁইয়া ছাঁইয়া’।
বাঁশিওলা ওঠে। তার সাড়ে চার ফুট শরীরে প্যান্টের ওপর লাল পাঞ্জাবি জলপ্রপাতের মতো মনে হয়। মেঘের কোলে বকের পাখার মতো ঠোঁটে সে বাঁশিতে ফুঁ দেয়। সুরের দমকে তার বোঁচা নাকের পাটা দুটো ফুলে ফুলে ওঠে। অবাক হয়ে শোনে ট্রেনের মেঝেতে বসা পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েটি। তার কোঁচড়ে মুড়ি, নাকে নাকছাবি, মাথার কাছে প্লাগ পয়েন্ট। তার গ্রামেও চৈত্র আছে, দ্বারভাঙ্গার বিসপি গ্রামে এখন চৈত্রই আছে শুধু, মল্লার নেই, কাজরা নেই, কাজ নেই। শুকনো পাতা মাড়িয়ে সে যেভাবে ট্রেনে চড়ল, সেখানে সমদাউনা গান গাওয়ার অর্থ হয় না কোনও। গায়ওনি কেউ, গানহীন চৈত্র থেকে আসা মেয়েটি, বাথরুমের পাশে বসে বসে মুড়ি খেতে খেতে চোখ তুলে বাঁশিওলাকে দেখতে পেল। বাঁশিওলার মেঘের মতো রং, লাল পাঞ্জাবি, চৈত্রের বনে আগুন লাগলে যেমন দেখায়।

রং দে বসন্তী

কেউ খেয়াল করেছে কি বসন্ত মানে শুধু ফাল্গুন নয়, চৈত্রও। চৈত্রে এই উপমহাদেশ কেমন উদাসীন হয়ে ওঠে, সংসারের ক্ষুদ্রতা ছেড়ে চৈত্র টান দেয় বাইরে। মানুষজন, যারা সারাবছর ছোট খুব ছোট কাজ করে, মরসুমি কাজ, আধা পেট খাওয়ার কাজ, পুরো একমাস সন্ন্যাস পালন করে মেতে ওঠে চড়কে, গাজনে। বাণ ফোঁড়ে, চড়ক কাঠে চড়ে বনবন করে ঘোরে। পঞ্জাবের বৈশাখীতেও রং দে বসন্তী। এই বাসন্তী রংটি শুধু প্রেমের নয়, আত্মত্যাগেরও রং যে।

চৈত্র মাসে হাওয়ায় হাওয়ায় কেমন একটা মনখারাপ ঘুরে বেড়ায়, শূন্যতা আর শুষ্কতা সমার্থক শব্দের মতো বুকে চেপে বসে, সেই চৈত্রমাসের ঝুলিতেও কত আনন্দসম্ভার! রাসমাঠের এককোণে শিবমন্দির, সারা বছর নিঝুম, রোজের পুজোপাঠ হয় নিশ্চয়, কুড়ো ঠাকুর কখন এক ফাঁকে পুজো করে যায় কে জানে। পুজোর চরিত্র আরাধ্য দেবতার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই। তিনি যে একটি বেলপাতাতেই তুষ্ট, সবার আড়ালে, নিজের বিশালত্ব কাউকে বুঝতে না দিয়ে পড়ে আছেন চুপচাপ।

শিবমন্দিরের উল্টোদিকে, সিংহদরজা পেরিয়ে সারি সারি গুমঘর পেরিয়ে, ডান হাতে রাধামাধবের মন্দির ফেলে আচমকা হাঁড়িকাঠ, আর তারপরই যে আনন্দময়ী তলা, সেখানে রোজই অগুন্তি ভক্ত, পুজো দেবার হিড়িক, সেখানে পুরোহিতও বেশ জাঁদরেল, ইন্দুমাধব ভট্টাচার্য, সংস্কৃতে এমএ, পুজোর কাজ গোছাতে গোছাতে চমৎকার সব গল্প বলেন।

সেই সারাবছরের একটেরে নির্জন শিবমন্দিরে, যার পেছনে লুকোচুরি খেলার সময় বহুক্ষণ লুকিয়ে থাকলেও কেউ খুঁজতে আসত না, এখনও পায়ে যার চাতালের বিকেলের উঠে আসা গরম ভাপ লেগে আছে, চৈত্রের এক সকাল থেকে কেমন সাড়া পড়ে যায়। এ মাসটা যে বাবার। গাজন, চড়ক, নীলষষ্ঠী। একদিকে চড়ক কাঠ পোঁতা, সেখানে সন্ন্যাসীরা ঘুরবে, অন্যদিকে একটি চালাঘর, নীলের জন্য।
কথায় আছে-

নীলের ঘরে দিয়ে বাতি
জল খাও রে ভাগ্যবতী

চৈত্রের শেষ সন্ধেটি বড় মনোরম। শিবমন্দিরের পাশের কোষাঘাট থেকে ঠান্ডা হাওয়া বয়ে আসছে। এককালে এই পুকুরটির সঙ্গে আদিগঙ্গার যোগ ছিল, কোষা নৌকা এসে লাগত এখানে, সেই থেকে কোষাঘাট। আধো অন্ধকার মাঠে হঠাত একটা কুমীরকে দেখে চমকে উঠি। প্রতি বছর নীলের ঘরের পাশে মাটির কুমীরটি বানানো হয়। জানি না কেন। কিন্তু কুচোকাঁচার দল বেজায় মজা পায় দেখে। কুমীরটি আজকেই ভেঙে ফেলা হবে না। যতদিন না বৃষ্টির জলে ধুয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যায়, ততদিন থাকবে এভাবেই। আমার হঠাৎ মনে হয় অন্তত কিছুদিনের জন্যে হলেও শিবমন্দিরের নিঃসঙ্গ শিবের একজন সঙ্গী জুটল।

প্রজাপতি কণ্ঠনালী গিলে ফেলেছিল

বসন্ত মালতী নামটা বোধহয় সেই কৈশোরের প্রথম লগ্নজিতা, যে কুহুস্বরের মতো গেয়ে গেয়ে পাগল করে দেয় ‘বসন্ত এসে গেছে!’ বসন্ত তো তখন একমাত্র ছিল পুরাতন ভৃত্যতে– ‘কোথা হা হন্ত চিরবসন্ত আমি বসন্তে মরি’, আর ছিল ভাব সম্প্রসারণে– ‘If winter comes can spring be far behind?’

এ দুয়ের বাইরে  বসন্ত করাঘাত করে ফিরে গেছে। তার ওপর আমার রংখেলায় তীব্র অনীহা, এক জবরদস্তি দোলের স্মৃতির মাসুল।

ক্লাস ইলেভেনে হঠাৎ তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিতে হল। আমার বিষয় পড়ল– তোমার প্রেমিক। দিদিমণিরা বললেন ‘ইচ্ছে করলে পালটে নিতে পারো।’ আমি চিরকালের বালক-স্বভাব, আগুনের দাহিকা শক্তি নিয়ে কোনও ধারণা রাখি না। অবলীলায় বলে গেলাম, সোনাঝুরি গাছ, চকিত সাইকেলচারী আর হাওয়ায় গচ্ছিত কথা। নদী, কবিতা আর শ্যাম্পেন। এই তো আমার প্রেম।

কথা থেমে গিয়েছিল? শুরুই তো হয়নি কখনও
প্রজাপতি কণ্ঠনালী গিলে ফেলেছিল
প্রেয়ার লাইনে সেই সোনাঝুরি গাছটার নিচে
দাঁড়াবার কথা ছিল উতল উত্তরীয় যার

চাঁদ ভেসেছিল একা, ভালবেসেছিল
ছাদ হয়ে তারাজ্যাোৎস্না অশ্রুর আড়ালে
বছর বছরগুলি জলের মতন
আঙুলের ফাঁক দিয়ে কালসিন্ধু পানে ছুটে গেল…
(টাইম মেশিন)


পত্রহীন পলাশের বনে

একবার পলাশের পথে গেছিলাম। বুন্দুর সূর্যমন্দিরের সাতটা ঘোড়া তাদের অতিকায় পুরুষাঙ্গ নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল বিবাহমণ্ডপের সামনে। দূর দূরের গ্রাম থেকে বিয়ে করতে এসেছে লাজুক বরকনে, হলুদমাখা চাল ছড়িয়ে রয়েছে। আর পথের দুপাশে পলাশ আর পলাশ। যেন আগুন হাঁটছে। পলাশ থেকে পলামৌ, আমাদের মুখে মুখে পালামউ। ড্রাইভার বাচ্চা সিং বলেছিল, ‘উয়ো কোয়ি কাম কা ফুল হ্যায় নেহি!’


‘এত প্রত্যাখ্যান কেন সাজিয়েছ, বসন্তের পুষ্পপাত্রে?
বুন্দুর সূর্য মন্দিরের সাত ঘোড়া,
তাদের অতিকায় পুরুষাঙ্গ নিয়ে, থমকে গেছে,
হলুদ চাল, বিবাহমণ্ডপে, কুসুম গাছের মতো,
পাতা লাল, যেন যোনি দ্বার…।

ওই পথে হৃদয় শোণিত ঝরা বন্ধ হবে, বলে ভেবেছিলে,
লাতেহার থেকে ওঠা মনস্বিনী হাওয়া,
অনেক শুশ্রূষা আনবে ভেবেছিলে, হায় রে করুণা!
এত প্রত্যাখ্যান তবু বসন্তের পুষ্পপাত্রে কেন সাজিয়েছ?
জননীর হাতে ঝোলে, এই আমারি মুণ্ডু,
শিরস্ত্রাণ হীন!
কবন্ধ শরীর ঘোরে হরিণের মতো,
পত্রহীন পলাশের বনে…
এত প্রত্যাখ্যান , আজো কেন সাজিয়েছ?’
(যারা প্রত্যাখ্যাত)

 

এই বসন্তের পথ থেকে ফিরেই গুটিবসন্ত হল আমার, আর তার পরেই মা চলে গেল। চিরকাল বসন্ত মানে তো ১২ মার্চ, ২৮ ফাল্গুন। বাবা মার বিয়ের তারিখ। মার সেই অদ্ভুত হালকা পিচ রঙের বেনারসী, পিঁজে যাওয়া, তার ভাঁজে ভাঁজে ন্যাপথলিনের মতো বসন্তের ইশারা।

অন্য বসন্ত

…চোখ বুজলে বৃন্দাবন, শূন্য মন্দিরে রিনিকিনি
চোখ খুললে অতর্কিতে ঢুকে যাচ্ছে আবিরের ছাই,
হলুদের পাশে আর কোন রং দাঁড়াতে পারছে না
এই বসন্ত আর একা হাতে কদিক সামলাবে?
(চৈত্রমাস)

ইতিহাসে একটা অন্য বসন্তও আছে, যার নাম আরব বসন্ত। ২০১১ সালের ২৫ জানুয়ারি কায়রোর তাহরির স্কোয়ারে বিশাল জমায়েত। সবাই চায় প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের পদত্যাগ। হোসনি মুবারক গেলেন, এলেন মহম্মদ মোরসি। যার পেছনে ছিল মুসলিম ব্রাদারহুড পার্টি। মোরসিও উৎখাত হলেন। তারপর চলল চরম নৈরাজ্য। প্রচুর মুসলিম ব্রাদারহুড খুন হল, অনেকে পালিয়ে আত্মগোপন করে রইল অন্য দেশে, তাদের মধ্যেও ভাঙন দেখা দিল, শাখা, উপশাখা হল, কেউ কেউ চাইল পুরনো ভাবধারা আমূল সংস্কার করে নতুন মিশরের জন্ম দিতে।

ইতিহাস মুছলেও পথরেখা মোছা যায় না। এমন বসন্তের ইশারা ছড়িয়ে থাকে। প্রতিটি বিপ্লবই তো বসন্ত, প্রতিটি বিশেষ দেখা হওয়া, যেমন দেখা হয়েছিল সার্ত্রে আর সিমনের, যেমন দেখা হয়েছিল বিবেকানন্দ আর নিবেদিতার, যেমন দেখা হয়েছিল বিদ্যাপতি আর রাজা শিবসিঙ্ঘের। চোখে চোখেই তো সর্বনাশ লেখা হয়, আর সেই সর্বনাশের ইস্তাহার ছড়িয়ে পড়ে সন্ত্রাসের মতো। পলাশ ফুটুক আর না ফুটুক।

বসন্তের বেওয়ারিশ লাশ

নেটওয়ার্ক ছিঁড়ে ছিঁড়ে যায়। কথা কেটে কেটে বসে। এইসব ঘটে চলে মেয়েটির মাথার কাছে প্লাগ পয়েন্টে। যমুনা তীর যুবতি কেলি কর উঠি উগল সানন্দা কাঁখের কলস ভরার ভঙ্গিমায় ফোন চার্জ করতে আসে যুবতীরা। এরা তেজপুর যাবে। সেখানে এদের শিক্ষা শিবির। ললিতা, মায়া বিশাখা। পরে জানা যায় ওদের আসলে একটাই নাম। একটাই স্প্যাগেটি কি নুডল স্ট্র্যাপ পরনে, শুধু কাপ সাইজ আলাদা।

মেয়েটা তার নিচে বসে মুড়ি খায় একটা একটা করে। সঙ্গের লোকটা তাকে জল এনে দিয়ে বলে ‘আরে রেন্ডি জলদি খা লে…’

একজন দাঁড়ায়, চার্জার লাগায়, তারপর একজন, তারপর… রাত হয়, সংলাপ বাড়ে। বুভুক্ষু ইঁদুরের মতো এলসিডি আলো এসথ্রি কোচ দাপিয়ে বেড়ায়। টপ-আপ, ছোটা রিচার্জ আর লাইফ টাইমের ছাই ওড়ালে হঠাৎ কানে আসে–

এখন ওখানে রঙ্গিলি বিহু না?

বাঁশিওলা কখন নেমে গেছে। হয়তো আজারায়, হয়তো মাধবগাঁও। মেয়েটা উঠতে চেষ্টা করে, তার মাথার ধাক্কা খেয়ে প্লাগ পয়েন্টে লাগানো ফোনটা একটা বেওয়ারিশ প্যাকিং বাক্সের ওপর পড়ে, দুলে যায় একা একা।

গুয়াহাটি স্টেশনে বাইটের জন্যে মরিয়া দৌড়চ্ছে যে বালিকা, সে এখনও খবর পায়নি, আসলে ট্রেনটা উড়িয়ে দেওয়ার অনেক আগেই বসন্তের সব সংলাপ শেষ হয়ে গেছিল।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4649 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...