ঋতুরাজের চিঠি

সায়ন্তন ঠাকুর

 




লেখক গদ্যকার।


 

আমাকে কেউ পত্র লেখেনি কখনও, পোস্টাপিস জীবনবীমা সুদ ও বন্ধকির কারবারি আর পাওনাদারেরা চিঠি পাঠিয়েছেন অনেক, কিন্তু পত্র আসেনি কোনও।

একসময় আমি লিখেছি কতজনকে, খসখসে বালি-বালি কাগজে মোটা নিব আর কালো কালির কলমে লিখেছি তিন পাতা চার পাতা, সেসব এতাল বেতাল প্রলাপ, তার কোনও উত্তর হয় না। উত্তর দেয়ওনি কেউ। অনেকদিন আগে আমবারুণী মেলার আগে পত্র দিয়েছিলাম এক ভৈরবীকে। তখনও চৈত্র মাসের অমাবস্যা গিলে খায়নি চন্দ্রালোক, লিখেছিলাম,

“ভৈরবী, তোমার আমার মাঝে দুলতে থাকা সেই ভারী পর্দাটা আর নেই। দিকচক্রবাল রেখার কাছে জমে ওঠা হেমন্তের কুয়াশা দিয়ে তৈরি ওই পর্দা ছিঁড়ে গেছে।

ঘরে সেদিন জ্বেলে দিয়েছিলে নরম আলো। উপচার সাজিয়ে রেখেছিলাম আমি। পানপাত্রে ঢেলে দিয়েছিলাম কাঁচা মদ। পিপাসার জল, সুবাসিত তেল, লাল টিপ, সাদা শাড়ির গন্ধে ভরে উঠেছিল বাতাস। মাংস এনে রেখেছিলাম পাত্রে।

ওগো ভৈরবী, তবুও জেনো, ওই শরীর, আমার চেনা তুমি নও। কতজন্ম ধরে চিনি তোমার শরীর। এই চক্র সাধনা পার করে এসেছি আমরা কত যুগ আগে। কিন্তু সে তুমি নও! কেন তবে আমার এই ছেলেখেলা?

মায়াভরা হাতদুটি দিয়ে একবার ছুঁয়ে দাও আমার কপাল!  আলতো আদর দাও আমার মনে। সেই নির্জন গঙ্গাবক্ষে ভাসমান সহস্র চাঁদের মতো প্রতিবিম্বিত হোক আমাদের আত্মার ছায়া। ভৈরবী, তুমি জানো, আমিও জানি এই শরীর পার করে আমাদের হেঁটে যেতে হবে লক্ষ মাইল পথ। তবেই না সম্পূর্ণ হবে আমাদের যাত্রা। মিলিয়ে যাব একে অপরের হৃদয়ে। আলাদা করে আর চেনা যাবে না দুজনকে। ততদিন আমাকে পথ দেখাও আমার ভৈরবী।

দুর্গম রাত্রি। বিদ্যুতে অশান্ত বাতাসে টলমল করছে নৌকো। বৃষ্টি এসেছে ঝেঁপে। আবছা হয়ে এসেছে এই মায়া জগৎ।তোমার চোখের অলৌকিক আলো জ্বেলে আমাকে পার করে দাও এই ভবসমুদ্র! আমার যে আর কেউ নেই তুমি ছাড়া, ভৈরবী!”

আরেকজন ছিল কুসুমপুরে, বেলা গড়িয়ে সংসারের সব কাজ সেরে দাওয়ায় ভাতের থালা নিয়ে বসতো। ঠাণ্ডা হড়হড়ে ভাত, মাছের কাঁটা দিয়ে চচ্চড়ি, ওই একটা ল্যাজার দিকের মাছের টুকরো – কোনও কোনওদিন তাও জুটতো না, কামরাঙা নাকি চালতার একটু টক, কাঁচা লঙ্কা লবণ মেখে ভারী তৃপ্তি করে খেত। কেউ তার জন্য থালা সাজিয়ে বসে থাকেনি, খেয়েছে কিনা খোঁজও নেয়নি কখনও। তবুও কী এক আনন্দে মশগুল সে, চান করে একখান পরিস্কার কল্কাপাড় সুতির শাড়ি পরেছে, দুটি কাজলের মতো ভ্রূয়ের মাঝে সিঁদুরের গোল টিপ, মাথায় গন্ধতেল, কোনও অলঙ্কার নাই, সাজ নাই, দিনান্তের আলো মুখ নিচু করে বসে আছে তার থালার পাশে। দূরে গাছগাছালির মাথায় অপরাহ্ন আসি আসি করেও থমকে দাঁড়িয়ে আছে। কী একটা পাখি একটানা সুর করে বলে চলেছে, গেরস্তের খোকা হোক! খোকা হোক!

ওই পাখির ডাক শুনলেই ভারী লজ্জা লাগে যুবতির, খাওয়া সেরে একরাশ বাসন নিয়ে যাবে পুকুরঘাটে, বাসন মাজতে মাজতে হলদে হবে দিন, ওইদিকে বাঁশবন, পুকুরজলে কত শাপলা ফুটেছে, দুটি ভ্রমর উড়ছ আপনমনে, বকুলফুল সই আজ এল না তো! কচু পাতায় ঢাকা ঘাটের পৈঠা, লাল লাল ক্ষয়াটে ইঁট, এটা ওই রায়বাবুদের ঘাট, তা তাদের বংশে বাতি দিতে আজ আর কেউ বেঁচে নাই, সেসব কত গল্প। একেকদিন পৈঠায় বসে থাকে যুবতি, কত কী মনে পড়ে, আবছা পটচিত্র যেন, ভালো ঠাহর করতে পারে না। আগামী জন্মে ওই ভৈরবী হবে যুবতি, গতজন্মে পুরাতন আখড়ার বোষ্টুমি ছিল, শ্যামচাঁদের সঙ্গে দেখা হয়েছিল কিনা মনে পড়ে না আর। পাশ দিয়ে বয়ে যায় অনিত্য সদা চঞ্চল কালস্রোত।

ওই যুবতির নাম ছিল টগরবালা। পত্র লিখেছিলাম তাকেও। কলিকাতা থেকে।মনে মনে তাকে পদ্মাবতী বলে ডাকতাম।
“আমি আগামী চৈত্র মাসে গৃহে যাইতে পারিব না। গেলবার বলিয়াছিলে গন্ধতৈলের কথা, উহা কিনিয়াছি। একশিশি তরল আলতাও লইয়াছি, একটি কাঁকণও লইয়াছি। হারুদের গৃহে রাখিয়া আসিব, তুমি লইয়া যাইও। আমি নিজহাতে লইয়া যাইলে অহেতুক অশান্তি হইবে, গ্রামের পাঁচজনে নানা কুকথা রটাইবে। উহা ভালো দেখাইবে না। তুমি আমার স্নেহাশীষ ও প্রেম লইও। অধিক আর কী লিখিব, কাব্য লিখিবার ক্ষমতা তো আমার নাই, শুধু একা বসিয়া থাকিলে তোমার মুখখানি মনে পড়িয়া যায়। “

পত্রখানি দিয়েছিলাম মধু হরকরার হাতে। তা মধু রণো ডাকাতের বিল পদ্মদীঘির ঘাট কত আগাটা জঙ্গল ভুলোর চর কত জ্যোৎস্নালোকিত প্রান্তর জনপদ কত কুসুমাচ্ছন্ন ধুলিপথ দেবদেউল সংসার পার হয়ে সেই যে গেল, আর তো ফিরে এল না। মধুর হাতে ছিল ঘণ্টিবাঁধা বাঁশের লাঠি আর রেঢ়ির তেলের লম্ফ, তিনটি পয়সা নিয়েছিল নগদ, কিন্তু আর কখনও তাকে দেখতে পেলাম না। মিলিয়ে গেল মহাকালের মুখগহ্বরে। টগরবালা জানতেও পারল না কোনওদিন আমার পত্রখানির কথা।

কিছুদিন আগে পর্যন্তও পদ্মাবতীর কাছে পত্র পৌঁছে দেওয়ার বাসনা ছিল আমার। একদিন দুপুরের দিকে হেঁটে হেঁটে ফিরছি, চৈত্র মাস, ধু ধু শুখা আলো বাতাসময় ভুবনডাঙা, দুপাশে ঝর ঝর করে খসে পড়ছে মরা পাতা, সন্ন্যাসীর মতো দণ্ডী হাতে কোথায় যেন চলেছে ওই বাসনামুক্ত দ্বিপ্রহর। হঠাৎ দেখি রিকশা করে আসছে এক অল্পবয়সী তরুণী, ছিপছিপে চেহারা, কাঁধ অবধি মসৃণ চুল, অল্প সাজগোজ করেছে, কিন্তু চোখদুটি যেন হারিয়ে গেছে চিরতরে। কী অচঞ্চল! কী স্থির, এই অসময়ে যেন স্বয়ং বিষাদঋতু রূপ ধরে এসেছে। দু এক মুহূর্তমাত্র, মনে হল, অশ্রু থমকে আছে নয়ন কিনারে। রিকশা চলে গেল, দু এক মুঠি চৈত্রধুলি উড়ল বাতাসে। আমি শুধু ভাবছি তখন, অশ্রুর অন্তরালে ওই অলৌকিক অচঞ্চল নয়নতারার অন্তরে যে অপরূপ মন ঘর পেতেছে তার কথা।

সেই থেকে ব্যক্তিগত চিঠির আশা মরে গেল। পত্র লেখার বাসনাও আর নাই, কেউ চিঠি লেখার অনুরোধ করলে ক্লান্তি আসে এখন। পত্রের কথা উঠলেই ওই অচেনা চোখদুটির কথা মনে ভেসে ওঠে। সেই কি তবে ভৈরবী? নাকি পদ্মাবতী? রূপবদল করে ফিরে এসেছিল চৈত্র মাসে? কী জানি! বিচিত্র সংসার।

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...