শতাব্দী দাশ
ছোটবেলায় রানিদের পাড়ায় শীতলাগান হত। যখন পরীক্ষার পরের ছুটিটা পড়ত, তখন। রানি অনেকদিন পর্যন্ত জানতে পারেনি, শীতলা সাজত যে, সে ব্যাটাছেলে। হাওড়ার দিকে তার বাড়ি। হাওড়া বলতে রানি বুঝত হাওড়া ব্রিজ, তার তলায় মা গঙ্গা। মা বলত, ‘নমো করো’। তারপর স্টেশন। বড়ঘড়ি। পুরী বা দার্জিলিং-এর ট্রেন। এসব ব্যস্ততা, যানজট ফেলে অনেক দূর তক, যত ধানখেত-টেত… সবই যে হাওড়া, তখন তা কে জানত! রানি ভাবত, ব্রিজের আশেপাশেই কোথাও লোকটা থাকে।
পালা-টালায় বড়দের তেমন আগ্রহ ছিল না। কলোনিতে থাকলেও তাদের ছিল শিক্ষিত বংশ৷ বাবা ব্রিটানিয়া কোম্পানিতে হিসেবের কাজ-টাজ জুটিয়েছিল। কাকা ল পড়ছিল৷ ঠাকুরদাকে দ্যাখেনি রানি। তিনি নাকি ছিলেন স্কুলমাস্টার। পাড়ার যার-তার সঙ্গে মিশে বখে যাওয়া রানির মানা ছিল। ইচ্ছে হত, কলতলার পাশের ফাঁকা জমিনে ম্যারাপের তলায় সবার সঙ্গে বসে শোনে শীতলাগান। উপায় ছিল না। আসরের পাশেই অবশ্য দিদুর শোওয়ার ঘরের জানলা। দিদু একটা বড় টেবিল পেতে দিত জানলার পাশে। চারপাশ ঘিরে দিত বালিশ দিয়ে।
প্রতিবছর ঘুরে-ফিরে একই গান হত, একই লম্ফঝম্প। প্রথমে ঝ্যাননন করে সিম্বাল বেজে উঠত৷ বাদকেরা বসত রানির জানলার দিকে পিছন ফিরে। তারপর একটানা ঝমপরাপর৷ হারমোনিয়াম, বাঁশি, মঞ্জিরা, কত কী! রানি কান খাড়া রাখত। সেকেন্ড বেল! আর ওই… থার্ড ঝ্যানননন! তারপর পিঠ-ঢাকা কোঁকড়া চুল উড়িয়ে জরিওয়ালা লাল শাড়ি পরে লম্বা লোকটা আসত। অমন লম্বা মহিলা রানি দেখেনি কখনও। কিন্তু দেবী-টেবি অমনটা হতেই পারে, ভাবত সে৷ সেসময় রামানন্দ সাগরের রামায়ণও দেখত রানি সাদাকালোয়। কিন্তু সামনাসামনি দেবতা দেখার গ্র্যাঞ্জারই ছিল আলাদা।
***
এই গ্র্যাঞ্জার নিয়েই সেদিন কথা হচ্ছিল অনুষ্টুপের সঙ্গে। গর্তে ঢুকে যাওয়ার আগে, সেই শেষবার ওরা বসেছিল একটা বারে। অনুষ্টুপ ভয় পাচ্ছিল।
–মৃত্যুকে ভয় পেতিস না তো তুই!
–এভাবে মরতে চাইনি তা বলে! কোনও ইয়ে নেই যেন! যাকে বলে, গ্র্যাঞ্জার! প্লাস্টিকে পুরে তোকে ফেলে আসবে ধাপার মাঠে।
–তাতে কী! এপিটাফ ভাবা হল তোর? শেষকৃত্য যেভাবেই হোক, এপিটাফ তো আটকাচ্ছে না!
রানি জানত, নিজের এপিটাফে কী লেখা থাকবে, তা নিয়ে অনুষ্টুপের অনেকরকম খোয়াব ছিল। অনুষ্টুপের কাব্যে মৃত্যু নিয়ে নানা জল্পনা থাকত। যেমন, শান্ত নদীর পাশে হাঁ-মুখ শুয়ে আছে প্রাণহীন দেহখানি৷ চাঁদের আলো তার দাঁতের সারিকে উদ্ভাস দিচ্ছে। কিংবা, গড়ের মাঠে কেউ যখন মরে পড়ে আছে, তার চিবুক ছুঁয়ে যাচ্ছে শহরের রোদ। হেরে যাওয়া মানুষের অভিমানী গালে হাত-টাত বুলিয়ে দিচ্ছে চরাচর।
তবু এপিটাফ কী করে সম্ভব? রানি জিজ্ঞেস করেছিল বহুবার। যতসব বিদেশি ব্যাপার! দেহ পোড়ানো হলে আবার এপিটাফ কী? মুসলমানের গোরের উপরেও এপিটাফ দেখা যায় না বড় একটা৷ অনুষ্টুপ দমেনি৷ ধরা যাক, বাড়ির সামনে যে একচিলতে জমি… সেখানে মায়ের তুলসি মঞ্চ আছে… তার পাশে একটা বেদি মতো করা হয় যদি? উত্তরসূরিকে যদি বলে যাওয়া যায়? একটা ফলক থাকলেই চলবে!
অনুষ্টুপ বলত, বিষয়টা সযতনে ভাবার মতোই। একটা শ্বেতফলক, তার উপরে শব্দ সাজানো থাকবে কিছু। শব্দগুলোই পৃথিবীর সঙ্গে তার শেষ যোগসূত্র। তাই তাদের হতে হবে সুনির্বাচিত। কী লেখা যায়? গদ্যে, নাকি কবিতায় লেখা হবে? ‘এইখানে সমাধিস্থ আছে সেইজন…’ এইরকম কোনও সাধারণ কথা দিয়ে শুরু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়। যুৎসই লাইন হাতড়াতে হাতড়াতে সে অস্থির হত। কী আর চেয়েছে নশ্বর? সন্ধেয় নিজ স্মৃতিফলকের সামনে অফিস-ফেরত সহমানুষের দাঁড়িয়ে পড়া। দেড় মিনিটের বিষণ্ণতা। এইটুকু তো!
কিন্তু সেদিন অনুষ্টুপকে বাঁচার রোখে পেয়েছিল।
–এখন মরে যাওয়া মানে একটা সংখ্যা হয়ে যাওয়া স্রেফ। একশো একচল্লিশতম মৃত, বয়স এত, হাইপারটেনশন ছিল ব্লা ব্লা… গল্প শেষ!
***
রোগ ছড়াচ্ছিল জন থেকে জনে৷ স্পর্শ মানা, নৈকট্য মানা৷ ওষুধ নেই। তবে আবিষ্কার হতে পারে যে কোনও দিন। মানুষ অতএব ভয়ে হাত পা ছুঁড়ল কিছুদিন৷ খবর কাগজের প্রতিটা লাইন পড়ল প্রতিষেধকের সন্ধানে। মৃত্যুসংবাদে বিহ্বল হল। তারপর মৃত্যুর সঙ্গে ঘর করতে লাগল। সেই বনের গল্পের মতো৷ সকলকেই সিংহের কাছে যেতে হবে, আজ নয় কাল৷ আজকাল তারা মৃত্যুর গল্প এমনভাবে করতে পারে, যেন সিরিয়ালের সম্ভাব্য পরবর্তী পর্ব আলোচনা করছে। ভিডিও কলে অনুষ্টুপকে রানি জিজ্ঞেস করল, যা কখনও জিজ্ঞেস করা হয়নি।
–মৃত্যু নিয়ে এত বাড়াবাড়ি আশা কেন তোর? এত ফ্যান্টাসি কেন?
–একটা গ্র্যান্ড মৃত্যুর ইচ্ছা থাকলে জীবনটা কোনওরকমে পার করা যায়। এই যে মরেও কোথাও একটা থেকে যাওয়ার ব্যাপারটা, অনেকের মনে পড়ছে তোর কথা… এরকম ভাবতে দোষ কী!
ছোটবেলার লোকটার চোখে অনুষ্টুপের মতো উদাস কিছু ছিল, আর অনুষ্টুপের মতোই নিরাপত্তাহীনতা। যেমনটা থাকলে মায়া হয়। স্টেজে সে দাপিয়ে বেড়াত বটে, কিন্তু স্টেজের বাইরে, মেক-আপ ছাড়া তাকে একবারই দেখেছিল রানি৷ সে লোকটার লিঙ্গপরিচয় ছাড়া, আরও জানত না বয়স। লোকটা কিন্তু রেগুলার ছিল, ফি বচ্ছর একই শীতলা। বরং জ্বরাসুর সাজত যে, সে ছেলে বদলে বদলে যেত। মুখোশ পরে গাধাও সাজতে হত একজনকে, সে চার হাতে-পায়ে দুলকি চালে হাঁটত। কুলীন দেবীদের মধ্যে বাহন-টাহন বিলি হওয়ার পর গাধা ছাড়া হয়ত আর কিছু জোটেনি শীতলার। দেবীর মুখ আর ব্লাউজের বাইরের হাতটুকুতে রঙের তফাত তার শিশুচোখেও ধরা পড়ত। পালায় অবশ্য বলত, শীতলা রক্তাম্বরা সুন্দরী তরুণী। সেসব কল্পনা করে নিতে বেগ পেতে হত না। একবার পালার পরদিন, বিকেলে পার্কে যাওয়ার পথে কাকা একজন টাকমাথা দোহারা লোককে দেখাল। বয়স বোঝা যায় না। কাকা বলল, ‘ওই দ্যাখ, তোর শীতলামা!’ লোকটা দড়ি থেকে সিগারেটে আগুন ধরাচ্ছিল। অপ্রস্তুত হয়েছিল৷ হেসেছিল।
আজ অনুষ্টুপকে লোকটার কথা বলছিল রানি।
স্ক্রিনের দুপাশে দুজন। অনুষ্টুপের পানীয়ে আপাতত বরফেরা সাঁতার কাটছিল। বরফদের ধীরে গলে যাওয়া দেখছিল রানি। ব্যাকগ্রাউন্ডে কিছু একটা সুর বাজছিল একটানা। ঝমপরাপর নয়, ‘এপিটাফ’-এর মতো অভিজাত ও করুণ। অনুষ্টুপ বলছিল, সমাজমাধ্যমে সেদিন নাকি হতাশা বিষয়ক অনেক পোস্ট ছিল। অনুষ্টুপকে কি হতাশা গ্রাস করছে? অনুষ্টুপ প্রলাপ বকছিল, বলছিল পাপ আর প্রকৃতির প্রতিশোধের কথা। রানি মনে করাচ্ছিল, অতিমারির আগে অনুষ্টুপের যখন মৃত্যু পেত, কি শৈল্পিক ছিল সে মৃত্যু! দেহটি রিক্ত বাদামী খেতে পড়ে থাকলে কী বর্ণের ইঁদুরেরা মাটি ফুঁড়ে আসবে, সেসবও অনুপুঙ্খ ভেবে রাখত সে।
সে আশ্বাস দিচ্ছিল, প্রতিষেধক আবিষ্কার হতে পারে যে কোনও দিন৷ ক্রিজ আঁকড়ে থাকলে, এভাবে না মরে, অনুষ্টুপের মনোমত গ্র্যান্ড কোনও উপায়ে মরা যেতে পারে। আর তাদের আলোচনায় বারবার ঢুকে পড়ছিল বয়সের-গাছ-পাথর-নেই, লিঙ্গবিহীন সেই লোকটা।
আটাত্তর-ঊনআশি সাল নাগাদ নাকি বসন্ত মহামারির প্রকোপ মুক্ত হয় দেশ৷ তবু ভয় থেকে গেছিল ওদের ছোটবেলায়। আশির দশকের দ্বিতীয় অর্ধে। কলকাতার পাড়াতেও, তখনও, এসব আসর-টাসর বসত।
তুমি আদি, তুমি অন্ত, সত্য সনাতনী
অমলা কমলা তুমি ব্রহ্মারও নন্দিনী…
অনুষ্টুপ বলল, হাওড়ার সালকিয়ায় মামাবাড়িতেও শীতলার মেলা দেখেছে৷ সেই জিলা হাওড়া, যেখানে লোকটা থাকত।
***
অনুষ্টুপ বলছিল, সালকিয়ার পুজোটি আবার বিচিত্র। লোকালয় ভেদে লোকাচার যেভাবে বদলে বদলে যায়। সেখানে বড়, মেজ, সেজ, ছোট, নানা রকম শীতলা৷ নানা মারির অধিষ্ঠাত্রী দেবীরা। পুজোর আগে গ্রামের মেয়ে-বউ গান গেয়ে স্নানযাত্রায় নিয়ে যায় তাদের। শুধু ছোটজন মন্দিরের বাইরে বেরোয় না৷ কবে নাকি স্নানোৎসবে তার বিগ্রহ হারিয়েছিল। সেই থেকে বেচারা আজন্ম কোয়ারেন্টিনে। স্নানযাত্রার পর অন্য শীতলাদের সাক্ষাত করাতে আনা হয় ছোটবোনের সঙ্গে, তার মন্দিরে৷ লোক ভেঙে পড়ে ছোট শীতলার মন্দির ঘিরে। ছোটদের আলাদা কদর!
অনুষ্টুপ পর্দা থেকে অন্তর্হিত হলে রানির মনে পড়ে, দিদুর ছোট মেয়ে মরেছিল টিবিতে। যার কথা আর কেউ বলত না কখনও, শুধু রানির মুখের আদলে দিদু যাকে খুঁজত। সেই না-দেখা আত্মীয়াকে ঘিরে রানির প্রথম মৃত্যুচেতনা।
অনেক দিন পর, দিদু যখন মারা গেল, সে তখন ইউনিভার্সিটিতে। ততদিনে কলোনি ছেড়ে তারা উঠে এসেছে বেহালার বড় বাড়িতে। নেয়েধুয়ে, নখ কেটে, দিদু সেদিন বিষ্যুদবারের পুজো দিয়েছিল। তারপর ঢলে পড়েছিল। খবর পেয়ে সে ঠান্ডা মাথায় কফি হাউজ থেকে বেরিয়ে মেট্রো স্টেশনের রাস্তা ধরেছিল। মেডিকাল কলেজের ভিতর দিকে শর্টকাট করার সময় জ্বরা আর ব্যাধি ছড়িয়ে থাকতে দেখেছিল পথের দুপাশে, যেমন নিত্য থাকে। ভ্যাটের পাশে ঘেয়ো কুকুর শুয়েছিল, যেমন থাকে। স্বয়ংক্রিয় দরজা খুলে যেতে সে স্বয়ংক্রিয় পুতুলের মতো নেমে পড়েছিল টালিগঞ্জে৷ শখের বাজারের অটোর লাইনে দাঁড়িয়েছিল। কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু তত নয়। দুঃখিত, কিন্তু বিচলিত ছিল না সে৷ শ্রাদ্ধশান্তি হয়েছিল। ‘গ্র্যাঞ্জার’ যা কিছু। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ছিল না আশির বৃদ্ধার মৃত্যু। বিহ্বলতা তাহলে মৃত্যুজনিত, নাকি আকস্মিকতাজনিত? তাই যদি হয়, তাহলে এখন আবালবৃদ্ধবনিতার মৃত্যুই তো বসন্তের রক্তপলাশের মতো স্বাভাবিক! নতুন স্বাভাবিকতায়, নতুন স্থানাঙ্কে স্থিত হতে দোষ কী? সে বোধে উপনীত হতে পারা, তাতেও কি গ্র্যাঞ্জার নেই?
শীতলার কথাই ধরা যাক। সে বেটি যে জ্বরের দেবী না উপশমের, তা ঠিকমতো বুঝতে পারত না রানি ছোটবেলায়।
রোগের জননী তুমি খ্যাত ত্রিভুবনে
সর্বরোগহরা তুমি চারিবেদ ভনে…
ওই জ্বরাসুর, স্থানভেদে কোথাও সে শীতলার প্রতিপক্ষ। কোথাও শীতলারই সহচর। তাহলে? ব্যাধি আর উপশম, জীবন আর মৃত্যু, ক্ষয় আর স্বাস্থ্য, কে কেন্দ্রীয় চরিত্র আর কে অপর? নাকি সবই দৃষ্টিভঙ্গি-নির্ভর, স্থানাঙ্ক-নির্ভর?
***
পরদিন নির্দিষ্ট সময়ে অনুষ্টুপের সবুজ বাতি জ্বলে না। রানি রান্না চাপিয়ে অগত্যা বসে টিভির সামনে। এক্সপোনেনশিয়াল প্রগ্রেশনে মৃত্যু বাড়ছে। এক্ষণে সবই স্ট্যাটিস্টিক্স আর গেম থিওরি। কোনও অভিঘাত নেই ব্যক্তিমৃত্যুর। মনকে এহেন বৈরাগ্যে আগেই উন্নীত করতে পেরেছিল বলে রানি খানিক অহমিকা বোধ করে। এখন দেখার, এ মারি এক লাখ মারে, নাকি এক কোটি। নাকি দশ কোটি? দশ কোটি হল টেন টু দি পাওয়ার এইট, আর পৃথিবীতে মনুষ্যসংখ্যা এইট ইন্টু টেন টু দি পাওয়ার নাইন। অর্থাৎ দশ কোটি মরলেও, মরবে এক পার্সেন্টের কম। তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত ব্লা ব্লা ব্লা..
পরিযায়ী শ্রমিকেরা ঘরে ফিরছে৷ ছেলে কাঁখে, বোঝা মাথায়। এভাবেই কি দিদু তার মেয়েকে নিয়ে হেঁটেছিল? পথের ধারে কোথায় সে মেয়ের সমাধি কে জানে! ওরা মৃত্যু থেকে পালাচ্ছে নাকি বহন করছে মৃত্যুকে? কী অসহায়, অথচ কী ভয়ঙ্কর ওরা! জীবাণু ভরে নিচ্ছে শরীরে, বারুদের মতো। মানববোমা হয়ে উঠছে। আছড়ে পড়বে সভ্যতার বুকে। অনুষ্টুপকে জানাতে হবে, শুধু প্রকৃতির নয়, আর্তেরও প্রতিশোধ। এদেরই আরাধ্য ছিলেন শীতলা-টিতলা, যিনি মারিরও দেবী, উপশমেরও।
শীতলার এক হাতে ছিল মার্জনী আর অন্য হাতে কলস। ঝাড়ু মেরে রোগ নাশেন মা, আর কলসে প্রাণ-জুড়ানো নিরাময় বারি। ‘শীতলা’ নামেই নিহিত আরাম। কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে শীতলতা আসে কিসে? যে নিরাময় সাময়িক, তাতে? নাকি মৃত্যুতে? দিদুর গা জুড়িয়ে গেছিল হাসপাতালে পৌঁছতে পৌঁছতে। বিষ্যুদবারের পুজোর আগে দিদু সাবান-শ্যাম্পু মাখত। শ্যাম্পু করা সাদা চুল উড়ছিল। শবকে বড় স্নিগ্ধ দেখাচ্ছিল। মৃত্যু, অর্থাৎ চিরস্থায়ী যে নিরাময়! শীতল চিরজ্বরাব্যাধিহীনতা।
কিন্তু তার আগে জাগতিক কাজগুলো করে যাওয়া যায়। অনুষ্টুপকে বলে যাওয়া যায়, যা কিছু বলা হয়নি৷
–মৃত্যু নিয়ে অস্তিত্ববাদী উদাসীনতা আমার আছে। থাকুক। তবু তুমি এপিটাফের কথা বললে, আসলে আমার কষ্ট হয়।
অথচ অনুষ্টুপের সবুজ বাতি পরদিনও জ্বলে না৷ এমন তো হয় না! রানি অস্থির হয়। অনিষ্টচিন্তা আসে। কেন আসে? আউশভিজে কি সহমৃত্যুপথযাত্রীরা একে অন্যের জন্য উদ্বিগ্ন হত? বন্ধু বন্ধুর জন্য? প্রেমিকা প্রেমিকের জন্য? মৃত্যুকে বিশ্বজনীন ভরকেন্দ্র মেনে নিলেও কেন ব্যক্তিগত ভালোবাসা, উদ্বেগ, স্নেহ, বেদনা মরে না? ঘুমের মধ্যে ছায়ামূর্তি আসে এক। সাদা চুল উড়ছে। দিদু ভেবে কাছে গিয়েও চমকে সরে আসে রানি। পালাগানে শীতলা পক্ককেশ বৃদ্ধা সেজে ছলনায় ভুলিয়ে রোগ ছড়াত। সিম্বাল বেজে ওঠে৷ ঝনননন। একটা লোক দড়ির আগুন দিয়ে নিজের মুখাগ্নি করে।
পরদিনও আসে না অনুষ্টুপ। তার পরদিনও না৷ রানির নির্লিপ্তির চাঙড়ে চিড় ধরে৷
–কথা বলতে হবে না অনুষ্টুপ! আছ তো? একবারটি বাতি জ্বালো।
–‘লাস্ট অ্যাক্টিভ’ সময়ছাপ বদলাক শুধু। আছ তো?
দিন যায়।
–আছ কি?
ছাদে পালিয়ে কেঁদে নিচ্ছিল রানি। অদূরে বসন্ত মাথা চাড়া দিয়েছিল। জ্বরা কই? বরং প্রকৃতির অসুখ সেরে উঠছে৷ এমন উতলা বাতাস বহুদিন বয়নি বিকেলে৷ কৃষ্ণচূড়ায় রাঙা ফুটপাথ। বৈদ্যুতিন তারের কাটাকুটির ফাঁক গলে ঘননীল ঝাঁপিয়ে পড়ছে৷ এর চেয়ে বেশি কী গ্র্যাঞ্জার তোমার প্রজাতির শ্রাদ্ধে আশা করেছিলে অনুষ্টুপ? কোকিল অক্লান্ত ডাকছিল। সশব্দ কান্নায় তার সুরভঙ্গ হল ক্ষণিকের জন্য। তারপর সে আবার ডাকল।
এই মহামারী নিয়ে এমন অসামান্য একটা গল্প এত তাড়াতাড়ি পড়তে পাব, সত্যিই ভাবিনি। শুধু একটা মহামারী তো নয়, রোগ-ক্ষয় ছাপিয়ে মৃত্যু আর জীবনকে নতুন গ্র্যাঞ্জারে বাঁচিয়ে তুলল গল্পটি।