কোন পথে এল কোভিড-১৯?

কোন পথে এল কোভিড-১৯? -- প্রবীর মুখোপাধ্যায়

প্রবীর মুখোপাধ্যায়

 



লেখক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি নিয়ে চর্চা করতে ভালোবাসেন

 

 

 

এক ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির সামনে আমরা দাঁড়িয়ে আছি– কোভিড-১৯ (COVID-19) ভাইরাস সংক্রমণের মুখোমুখি। প্রতিদিন নতুন মানুষ এই সংক্রমণের শিকার হচ্ছে, সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে নতুন এলাকায়, আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে মৃতের সংখ্যা বেড়েই চলেছে।

হঠাৎ করে একটা বিরাট এলাকা জুড়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটলে যেরকম পরিস্থিতি হয় তার সঙ্গে আজকের পরিস্থিতিটার কিছুটা তুলনা করা যায়। তবে বিরাট একটা পার্থক্য আছে, অগ্নিকাণ্ডের মতন এই ঘটনা শুধু এক জায়গায় ঘটেনি, ঘটেছে বিশ্বজুড়ে আর প্রতিদিন নতুন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ছে, আক্রান্ত করছে নতুন নতুন মানুষকে। যাই হোক, আগুন লাগলে আমরা কী করি? স্বাভাবিকভাবেই প্রথম কাজ হয় যেখানে আগুন লেগেছে তার আশপাশের লোকেদের নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া আর আগুনটা যেন নতুন জায়গায় ছড়িয়ে না পড়ে তার ব্যবস্থা করা। দমকল কর্মীদের যথেষ্ট সাজ-সরঞ্জাম দিয়ে আগুন নেভানোর কাজে সবরকম সহায়তা করা। যে লোকেরা অগ্নিদগ্ধ হয়েছেন তাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। যে লোকেদের আশপাশের জায়গা থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের থাকার, খাওয়ার, শোবার উপযুক্ত ব্যবস্থা করা। একটু ভেবে দেখুন, এখনকার পরিস্থিতিও একই রকম। পার্থক্য শুধু এইখানে যে এত বড় দেশে গোটা দেশ জুড়ে আগুন কখনও লাগে না। কিন্তু মহামারি সংক্রমণ– বিশেষ করে এই কোভিড-১৯ কিন্তু শুধু সারা দেশ নয়, সারা দুনিয়া জুড়ে বিস্তার লাভ করে চলেছে।

এই রোগ-সংক্রমণের সূত্রপাত হয়েছিল চিনে। সেখানে অনেক মানুষের প্রাণ গেছে এই রোগে, অনেকে রোগাক্রান্ত হয়ে অবশেষে সুস্থ হয়ে উঠেছেন। প্রাথমিক তীব্রতা কাটিয়ে উঠে ঐ দেশে অবস্থা এখন কিছুটা শুধরে গেছে বলা হচ্ছে, দক্ষিণ কোরিয়া আর সিঙ্গাপুরের অবস্থাও তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল। ইওরোপে ইতালি আর স্পেনের অবস্থা খুবই খারাপ। ব্রিটেন সহ ইওরোপের অন্য দেশগুলিতেও ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমণ। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এর থাবা বসেছে, ওখানে এখনও মৃত্যুহার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ভারতে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, কিন্তু অন্য দেশের তুলনায় সেই হার বেশ কম। এমনকি মৃত্যুহারও আমাদের এখানে কম। এটা মানসিক স্বস্তির বিষয় হলেও সংক্রমণ প্রতিরোধ প্রয়াস কোনও কারণেই কমানো উচিত নয়, বরং আরও দৃঢ় করতে হবে ভবিষ্যতের দিকে নজর দিয়ে।

অনেক বিষয়ে আমাদের খামতি আছে, সেগুলিকে যত তাড়াতাড়ি পারা যায় ঠিক করতে হবে। যেমন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী যারা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েও সংক্রমণ-প্রতিরোধের প্রথম সারির যোদ্ধা তাদের হাতে যথোপযুক্ত সাজ-সরঞ্জাম তুলে দিতে হবে। হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে উপযুক্ত পরিকাঠামো গড়ে তুলতে হবে। যথেষ্ট ‘কোয়ারেন্টিন’ ও ‘আইসোলেশন’ সেন্টার তৈরি করতে হবে যাতে করে ‘সংক্রামিত’ ও ‘সংক্রামিত-হতে-পারে-এই-সন্দেহভাজন’ লোকেদের ব্যাপক জনগণ থেকে পৃথক করে সংক্রমণের গতিরোধ করা যায়। স্থানচ্যুত ও ‘লক-ডাউনের’ ফলে কর্মচ্যুত লোকেদের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে হবে। এরকম অনেক প্রাথমিক কাজ এই মুহূর্তে করতে হবে। আশা করা যায় আমরা এই চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা সফলভাবেই করব আর করতে পারব। আবার স্বাভাবিক জীবনের ছন্দ ফিরে আসবে। তবে কতদিনে সেটা ভবিষ্যতের হাতে।

কিন্তু একটা প্রশ্ন এখনই মনের মধ্যে উঁকিঝুঁকি মারছে। আসলে আগুন তো আপনা থেকে লাগে না, আমাদের কারও কোনও ভুলত্রুটি থেকেই ঘটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। তেমনই, রোগসংক্রমণও আকাশ থেকে টুপ করে ঝরে পড়ে না। আমাদের এই পৃথিবীর বুকেই প্রাকৃতিক কোনও ক্রিয়ার মধ্য থেকেই জন্ম নিয়েছে এই মারণ-ভাইরাস কোভিড-১৯। এর আগেও অনেক ব্যাক্টিরিয়া ও ভাইরাসের কারণে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে মহামারি হয়েছে, এমন কি সারা পৃথিবী জুড়েও হয়েছে। ঠিক এক শতাব্দী আগেই ঘটে গেছে ‘স্প্যানিশ-ফ্ল্যু’জনিত মহামারি। আর এখনও মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে ঘটে চলেছে কখনও বার্ড ফ্ল্যু, কখনও সোয়াইন ফ্ল্যু, কখনওবা নানা নতুন ধরনের ইনফ্ল্যুয়েঞ্জা যেমন H1N1, H1N2v, H3N2v, H5N1, H5N2 ইত্যাদি ইত্যাদি। কেন বারবার এমন রোগ-সংক্রমণ ঘটছে জানতে গেলে পারিপার্শ্বিক অবস্থা আর কী ধরনের কাজকর্ম আমরা করে চলেছি সেদিকে নজর দিতে হবে।

দমকল বাহিনীর হাতে অগ্নি-নির্বাপক আরও যন্ত্র, জলের ট্যাঙ্ক বা অগ্নিনিরোধক সাজসরঞ্জাম তুলে দিলেই তো আগুন লাগা বন্ধ হয়ে যাবে না। আগুন যাতে না লাগে তার ব্যবস্থা করতে হবে। আর সেইজন্য আগুন কেন লেগেছে সেই কারণ খুঁজে বার করতে হবে। অগ্নিকাণ্ডের যে কোনও ঘটনার দিকে আমরা যদি নজর দিই তাহলে অনেক ত্রুটি-বিচ্যুতির দিকে আমাদের নজর পড়ে যাবে। তার কিছু হয়ত অসাবধানতা কিংবা অজ্ঞানতাবশত হয়েছে। কিন্তু সেগুলি ছাড়াও বড় অন্য অনেক কারণ দেখতে পাব। যেমন, বাড়ি তৈরির সময়ে অগ্নি-নিয়ন্ত্রণের যে ব্যবস্থাগুলি করার কথা ছিল সেগুলি হয়ত করা হয়নি সঠিকভাবে। এমনকি পয়ঃপ্রণালী ও জলসরবরাহ ব্যবস্থাও হয়ত নিয়ম অনুসারে করা হয়নি। এ সব কাজে যাদের পরিদর্শন ও নজরদারি করার কথা ছিল তারা সেই কাজ ঠিকমত করেনি বা করার দিকে নজরও দেয়নি। অর্থাৎ আগুন লাগা প্রতিরোধ করা আর আগুন লাগলে তার প্রতিকার করার যেসব নিয়ম-নীতি মেনে চলার কথা ছিল সেগুলির অনেকটাই হয়ত পালন করা হয়নি। আর এই না করা কাজের জন্যই ঘটল অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা যার মূল্য চোকাতে হবে সমাজের সকলকে। আমাদের বর্তমান অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সমাজ-কাঠামোয় উপযুক্ত পাত্রে আর স্থানে প্রয়োজনীয় অর্থমূল্য ধরে দিলে সঠিক কাজ না করেই আইনগ্রাহ্য ছাড়পত্র সহজেই পাওয়া যায় একথা আমাদের সকলেরই জানা। আগুন লাগার পরে তদন্ত কমিটি যখন জানায় যে আগেই বে-আইনি কাজ হয়েছে আর সেই কারণেই অগ্নিকাণ্ড তখন অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। যে বা যারা এইসব বে-আইনি কাজ করেছিলেন তাদের কোনও শাস্তি আজ অবধি কোন ঘটনায় হয়েছে বলে বর্তমান লেখকের জানা নেই।

সেই কারণে বিশ্বব্যাপ্ত কোভিড ১৯ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করতে হলে বর্তমান আর্থ-রাজনৈতিক পটভূমি সম্বন্ধে সচেতনতা প্রয়োজন। ৮০-র দশক থেকে উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়ন (Liberalisation-Privatisation-Globalisation, সংক্ষেপে L-P-G)-এর মাধ্যমে এই সময়ে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশ এক অর্থনৈতিক সূত্রে বাঁধা পড়ে গেছে। আর এই এই অর্থনীতির মূল কথা মুনাফা সৃষ্টি– ক্রমশ বেশি বেশি করে মুনাফা সৃষ্টি করা। কত কম অর্থ ব্যয় করে কত বেশি ধরনের পণ্য কত বেশি পরিমাণে উৎপন্ন করা যায় তার প্রতিযোগিতা চলেছে। আর এই প্রতিযোগিতা চালাচ্ছে বিরাট বিরাট বহুজাতিক সংস্থা আর তাদের অধীনস্থ দেশীয় সহায়ক সংস্থাগুলি, যাদের আমরা সাধারণ ভাষায় কর্পোরেট সংস্থা নামে জানি। বিশ্বায়নের সুযোগে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পুঁজির যাতায়াত প্রায় অবাধ। নতুন নতুন এলাকায় পুঁজি লগ্নি করে উৎপাদন কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। প্রথাগত বা চলে আসা শিল্পজাত পণ্যের উৎপাদনে আগের মত মুনাফা করা যাচ্ছে না। বরং অনেক ক্ষেত্রেই চাহিদার তুলনায় উৎপাদন বেশি হয়ে সেই শিল্পে সঙ্কট তৈরি করেছে। তাই নতুন পণ্য বাজারে আনতে হবে। বিশ্বায়নের সুবাদে বিভিন্ন দেশের মধ্যে মানুষজনের পারস্পরিক যোগাযোগ অনেক বেড়ে গেছে। ফলে সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান নতুন পণ্যের চাহিদা সৃষ্টি করছে। নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে। একদিকে চিনের উহান শহরের চাকচিক্যময় বিরাট সব শপিং মল আর সেখানে বাজার করতে আসা শৌখিন শহুরে ক্রেতা আর একদিকে বিস্তীর্ণ পশ্চাদভূমি যেখান থেকে আসছে এই সব বনজ আর প্রাণিজ খাদ্যবস্তু– এর যোগসূত্রটা খুঁজে আর বুঝে দেখতে হবে। আর একই সঙ্গে এই বাজারের ভৌগোলিক বিস্তারে বিশ্ব কর্পোরেট পুঁজি কিভাবে কাজ করছে সেটাও জানার চেষ্টা করতে হবে।

মানুষের সঙ্গে তার পারিপার্শ্বিক প্রকৃতির নিত্য ঘাত-প্রতিঘাতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে সাংস্কৃতিক বহুমুখী বিকাশ ঘটতে ঘটতে আজকের পৃথিবীতে আমরা পৌঁছেছি। যে কোনও অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রার রীতিনীতি গড়ে উঠেছে অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান থেকে। যেহেতু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বা অঞ্চলে আবহাওয়া, জমির চরিত্র, ভৌগোলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশ বিভিন্ন সেই কারণে বসবাসকারী লোকেদের মধ্যে জীবনধারণের প্রক্রিয়ার মধ্যে বিভিন্নতা দেখা যায়। কী খাওয়া উচিত, কী ধরনের কাপড় পরা ঠিক হবে বা ভাল হবে জীবনযাত্রার এইসব খুঁটিনাটি গড়ে উঠেছে যুগ যুগ ধরে প্রাপ্ত অভিজ্ঞতা থেকে। এটা একটা চলমান প্রক্রিয়া, কোন এক পর্যায়ে থেমে নেই, সেটা যেমন ঠিক, তেমনই বিশেষ পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতিতে কতকগুলি জিনিস একেবারেই করতে নেই বা করা উচিত নয় এ অভিজ্ঞতাও আমরা অর্জন করেছি।

বাজারের পশ্চাদভূমি এলাকায় বনজ আর প্রাণিজ সম্পদ আহরণ করতে করতে আমরা জনমানবহীন ফাঁকা জায়গায়, ইংরাজিতে যাকে wilderness বলা হয়, পৌঁছে গেছি। সেখানে চিরাচরিত তরিতরকারি, ফল, মাছ, মুরগি ইত্যাদির সঙ্গে একই সঙ্গে উৎপাদন করা হচ্ছে ‘অপরিচিত অচেনা বিচিত্র’, “এক্সোটিক” সবজি ও প্রাণী। এইসব “এক্সোটিক” খাদ্যবস্তু নিয়ে আসছে নতুন ধরনের স্বাদ আর তার সঙ্গে বেড়ে যাচ্ছে এসবের চাহিদা। বাজার বাড়ছে আর বাড়ছে মুনাফা। শিল্প উৎপাদন পদ্ধতি ঢুকে পড়ছে অরণ্যের অন্তঃস্থলে। কিন্তু একই সঙ্গে যে ‘অপরিচিত অচেনা বিচিত্র’, “এক্সোটিক” প্যাথোজেন বা ব্যাকটিরিয়া/ভাইরাস এদের সঙ্গে সরাসরি চলে আসছে মানুষের সংস্পর্শে সে সম্বন্ধে আমাদের চিন্তা করার সময় নেই। মুনাফা বড় বালাই।

কিন্তু ২০০৮-০৯ এর আর্থনীতিক সঙ্কটের পর থেকে বাজার অর্থনীতিতে একটা বড় পরিবর্তন আসে। ভারী শিল্পের বিকাশ শেষ সীমায় পৌঁছে গেছে কি না জানা নেই, কিন্তু একে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া বেশ কঠিন হয়ে উঠছে আর এর থেকে প্রাপ্তব্য মুনাফার হার ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে এটা স্বীকৃত সত্য তাই বিকাশের ঝোঁক এখন ভূগর্ভস্থ খনিজ পদার্থ আর বনাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের দিকে। আর সেই কাজ করতে গেলে এই সব এলাকা থেকে আদিবাসীদের উচ্ছেদ করে করতে হবে রাস্তাঘাট নির্মাণ আর নগরায়ন। কর্পোরেট পুঁজি এখন নতুন এলাকায় নিজেদের দখলদারি বাড়াতে ব্যস্ত। বাজারের ব্যাপ্তি বাড়াতে গিয়ে গভীর অরণ্য অঞ্চল থেকে ‘এক্সোটিক’ [বিদেশাগত বা বহিরাগত] নানা ধরনের প্রাণিজ ও উদ্ভিজ্জ খাবার এখন বিক্রির জন্য শোভা পায় বড় বড় শপিং মলের খাবারের দোকানের র‍্যাকে। আর শহরের মানুষের কাছে বৈচিত্রের কারণে এর আকর্ষণ অনস্বীকার্য। গভীরতম অরণ্যের মধ্যে যে বাদুড়েরা বেঁচে আছে তাদের মধ্যে অনেক রকম ভাইরাস/ব্যাকটিরিয়া থাকতেই পারে যাতে ঐ বাদুড়ের বা তার আশেপাশের প্রাণী বা উদ্ভিদের কোন ক্ষতি হয় না। কারণ প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় ঐ বাদুড়ের দেহে অ্যান্টবডি তৈরি হয়েছে যা ওই ভাইরাসকে নিষ্ক্রিয় করে রেখেছে। কিন্তু ঐ ভাইরাস মানুষের দেহের মাধ্যমে এসে গেলে ত্বরিৎগতিতে নিজের বৃদ্ধি ঘটিয়ে ফেলতে পারে আর অন্য লোকেদের সংক্রামিত করে মেরে ফেলতে পারে। কারণ এই ভাইরাসের সঙ্গে মানুষের দেহের কোনওদিনই সংযোগ হয়নি আর সেইজন্য এর প্রতিরোধকারী অ্যান্টিবডিও মানুষের দেহে সৃষ্টি হয়নি। অজানা ভাইরাস/ব্যাকটিরিয়া যাতে ক্ষতি করতে না পারে সেইজন্য মহাকাশচারীদের জন্য বিশেষ প্রতিরোধী পোষাক বা ‘স্যুট’ আছে। কিন্তু গভীর জঙ্গলে যেখানে আজ অবধি কোনও মানুষ প্রবেশ করেনি সেখানে যেতে হলে এ ধরনের পোশাক পরার কোনও প্রচলন নেই। বনজ সম্পদ দখল করতে কর্পোরেট পুঁজি যেমন একটু একটু করে গভীরতর অরণ্যে প্রবেশ করেছে তেমনই বন্য জীবজন্তুদের/পোকামাকড়দেরও মানুষের সঙ্গে ঘাত-প্রতিঘাত বেড়ে চলেছে। আর তাদের শরীরের নানা ভাইরাস/ব্যাকটিরিয়া, যারা আগে কোনওদিন মানুষের সংস্পর্শে আসেনি, তারা এখন মানুষের শরীরে ঢুকে পড়ার রাস্তা পেয়ে যাচ্ছে। আর যেহেতু এদের সঙ্গে মানুষের কোনও সংস্পর্শ এতদিন ছিল না, মানবশরীরে এদের প্রতিরোধক অ্যান্টিবডি-ও সৃষ্টি হয়নি।

এখনও অবধি এটা স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে কোনও এক জাতীয় বাদুড়, অথবা সাপ (অথবা প্যাঙ্গোলিন?) এর দেহে বাস করে এই SARS-CoV-2 ভাইরাস। চিনের উহান শহর থেকে এই ভাইরাস মানুষের দেহে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। কিন্তু যে কথা এখন বলা হচ্ছে যে এটার সূত্রপাত ২০১৯-এর ডিসেম্বর মাস থেকে সেটা বোধহয় ঠিক নয়। এর বেশ আগেই জানা গেছিল যে বন্য জীবজন্তুদের আবর্জনাস্তূপে সার্স (SARS) ভাইরাসের মতো ভাইরাস পাওয়া গেছে।[1] বনজ খাদ্যবস্তুর সরবরাহ-শৃঙ্খলের (সাপ্লাই চেন-এর) একপ্রান্তে এটা পাওয়া যায়, কিন্তু মাত্র আটমাসের মধ্যে এই ভাইরাস মানুষ-থেকে-মানুষে শৃঙ্খল তৈরি করে ছড়িয়ে পড়ে উহানের অপর প্রান্তে। প্রথমদিকে স্থানীয়ভাবে এই ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধ করার চেষ্টা করা হয়, কিন্তু এই সংক্রমণ লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়িয়ে পড়ে প্লেন-ট্রেন এইসব গণ-পরিবহনকে আশ্রয় করে।

মনে রাখতে হবে এইসব বনজ খাদ্যদ্রব্য কিন্তু উহান শহরের অন্ধকারাচ্ছন্ন কোনও গলিঘুঁজি থেকে লুকিয়ে বিক্রি করা হয়নি, বা রাস্তায় একটা ট্রাক দাঁড়িয়ে পড়ে হঠাৎ করে এরকম কিছু খাবার বিক্রি করে পালিয়ে যায়নি। বিরাট বিরাট শপিং মলে র‍্যাকে সাজিয়ে রেখে যথোপযুক্তভাবে বিজ্ঞাপিত করে ক্রেতাদের আকর্ষিত করে অন্য সব খাবার জিনিসের সঙ্গে এদেরও বিক্রয় করা হয়েছে। প্রশ্ন আসে তাহলে কোথায় গেল খাদ্যদ্রব্যের গুণমাণ পরীক্ষা ব্যবস্থা? কোথা থেকে দেওয়া হয়েছিল এই খাদ্যবস্তু বিক্রির লাইসেন্স বা ছাড়পত্র? না কি উদারীকরণের সুবাদে লাইসেন্সের আর প্রয়োজন নেই? আজ পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে সংগঠিত বাজারগুলির মাধ্যমে বিভিন্ন বনজ খাদ্যবস্তু বিনা পরীক্ষায় অবাধে বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা এই সব বাজারের বিরাট বিরাট বাড়ি আর চাকচিক্য দেখে এদের বিক্রীত পণ্যের গুণবত্তা নিয়ে আর সন্দেহই করি না, যাচাই করি না। আর এর সঙ্গে আছে বিজ্ঞাপনের বিরাট প্রভাব। সব মিলিয়ে ক্রেতার যা খুশি হোক না কেন, মুনাফা যখন আসছে তখন এই ব্যবস্থা চলছে এবং চলবে।

উহানের বাজারের এরকম কোনও এক পশ্চাদভূমি থেকে হয় এসব সবজি-ফল-প্রাণীর মাধ্যমে অথবা যেসব ট্রাকে করে এইসব পণ্য বাজারে আসছিল সেখানকার কোনও শ্রমিকের শরীরে আশ্রয় পেয়ে গেল এতকাল অরণ্যের গভীরে থাকা কোন গুহাবাসী প্রাণীর শরীরের আশ্রয়ে থাকা সার্স-২ ভাইরাস। শহরের সীমা বড় হতে হতে পৌঁছে গেল অরণ্যের প্রান্তসীমায়। তাই শুধু মুনাফা সৃষ্টিকারী বিক্রয়যোগ্য পণ্য এল না সেখান থেকে, একই সঙ্গে এল এতদিন মানব শরীরের সঙ্গে যাদের কোনও সংস্রব ছিল না সেইসব প্যাথোজেন অর্থাৎ রোগ-সৃষ্টিকারী ব্যাকটিরিয়া আর ভাইরাস। আর একবার শহরে ঢুকে পড়লে যে সারা পৃথিবীতে সহজেই ছড়িয়ে পড়বে বাজারের বিশ্বায়নের দৌলতে সেটা বুঝতে পারা খুব কঠিন কিছু নয়।

এই যোগাযোগের বিষয়টা আরেকটু বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা দরকার। খাবারের মধ্যে দিয়ে সংক্রামিত হয় যেমন স্যালমোনেল্লা, প্রধানত মুরগির থেকে সংক্রামিত হয় ক্যাম্পিলোবেক্টার— এদের কথা আমরা জানি। অরণ্যসংলগ্ন জনমানবহীন ফাঁকা জায়গায়, ওয়াইল্ডারনেসে, শিল্প উৎপাদনের কায়দায় কৃষি উৎপাদন ও পশুপালন ব্যবস্থা চালু হওয়ার সময় থেকেই কোভিড-১৯-এর মতন অনেক নোভেল প্যাথোজেনের প্রায় ৬০ শতাংশ বনজ উদ্ভিদ আর প্রাণী থেকে সেই অঞ্চলের মানবদেহে সংক্রামিত হচ্ছে একথা গবেষকেরা অনেক দিন থেকেই জানতে পেরেছেন। এর মধ্যে কয়েকটি প্যাথোজেন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছে।[2]

বিশ্ব কর্পোরেট পুঁজি মুনাফা সৃষ্টির তাগিদে অরণ্যসংলগ্ন জনমানবহীন ফাঁকা জায়গায়, ওয়াইল্ডারনেসে, শিল্প উৎপাদনের কায়দায় কৃষি উৎপাদন ও পশুপালন ব্যবস্থা চালু করেছে তৃতীয় বিশ্বে। এর ‘গালভরা’ নাম দেওয়া হয়েছে বিকাশ আর উন্নয়ন। ফলে শহরের প্রান্তসীমা ধরে ধরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য ‘বস্তি’ যেখানে চরম অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতিতে বাস করতে বাধ্য হচ্ছে শ্রমিকেরা। এইসব ঘনবসতিতে যে কোন রোগের সংক্রমণ অত্যন্ত দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ে। এলপিজি-র নাম করে সামাজিক সুরক্ষা, সামাজিক স্বাস্থ্যব্যবস্থা, উৎপাদন ব্যবস্থায় কোনওরকম নিয়ন্ত্রণ এসব তুলে নেওয়া হয়েছে। ফলে ‘আগুন’ লাগলে তা ছড়িয়ে পড়ছে দাবানলের মত। সব মিলিয়ে পরিবেশ এতটাই দূষিত হয়ে উঠেছে যে ইবোলা, জিকা, ম্যালেরিয়া, পীত জ্বর এইসব রোগ নতুনভাবে অনেক বেশি ক্ষমতা নিয়ে এখন আমাদের ফিরে এসে আক্রমণ করছে।

নতুন নতুন এলাকায় কৃষিজ ও প্রাণিজ পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু করার তাগিদে ধ্বংস করা হচ্ছে প্রাকৃতিক বনভূমি, অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানকে অগ্রাহ্য করে পালটে ফেলা হচ্ছে প্রথাগত কৃষি ও পশুপালন ব্যবস্থা। ফলে এইসব মারাত্মক প্যাথোজেন অবাধে ঢুকে পড়তে পারছে ঘনবসতিপূর্ণ মহানগরের মধ্যে। এইভাবে সম্পূর্ণ উৎপাদন ব্যবস্থা এমন এক শৃঙ্খলের সৃষ্টি করছে যার ফলে নতুন ধরনের প্যাথোজেন ছড়িয়ে পড়ছে, আরও বেশি সংক্রামক হয়ে উঠছে, ত্বরিৎ গতিতে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে পৌঁছে যাচ্ছে। খরচ কমানো আর মুনাফা বাড়ানোর লক্ষ্যে পশুপালনের ফার্মের আকার যত বড় করা হচ্ছে ততই সেখানে একটি প্রাণী সংক্রামিত হলে অপর সকলের মধ্যে রোগ সংক্রমণ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। মুরগির খামারে এখন ছ সপ্তাহের মধ্যে মুরগিদের কেটে ফেলা হচ্ছে যাতে তাদের মাংস নরম ও সুস্বাদু থাকে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে যে মুরগির মধ্যে যথেষ্ট রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ‘ইমিউনিটি’ গড়ে ওঠেনি সেকথা খেয়াল করা হচ্ছে না। ফলে ঐ মুরগির মধ্যে সুপ্ত কোনও রোগ থাকলে তা সহজেই তাদের মধ্যে চলে যেতে পারে যারা এগুলি প্যাকিং ও বিক্রির ব্যবস্থা করছে। একই সঙ্গে সরকারি যেসব নিয়ম-নীতি স্বাস্থ্যসুরক্ষা সুনিশ্চিত করে সেগুলিকে তুলে নেওয়া হচ্ছে বিনিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে উৎপাদন বাড়ানোর ধুয়ো তুলে। পুঁজির মুনাফা অর্জনের ক্ষমতা বাড়ানোর লক্ষ্যে জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া হচ্ছে।

এবারে এই বিশ্ব কর্পোরেট পুঁজির চলাচল কীভাবে হচ্ছে একটু পর্যালোচনা করা যাক। ঠিক এই মুহূর্তে কোভিড-১৯-এর হাত থেকে বাঁচার জন্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক মহানগরে সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধান করছে। কোভিড-১৯-এর সংক্রমণের সূত্রপাত কিন্তু পৃথিবীর অপর প্রান্তের উহান শহরে। মার্কিন বিনিয়োগকারী সংস্থা গোল্ডম্যান স্যাকস চিনের কৃষিজ পণ্য ব্যবসায়ে যুক্ত এক বিরাট সংস্থা শুয়াংঘুই ইনভেস্টমেন্ট এন্ড ডেভেলপমেন্ট-এর ৬০ শতাংশ শেয়ারে বিনিয়োগ করে। বিশ্বের বৃহত্তম শুয়োর উৎপাদনকারী মার্কিন সংস্থা স্মিথফিল্ড ফুডস-কে কিনে নিয়েছে চিনের এই কোম্পানি। ৩০ কোটি ডলারের বিনিময়ে গোল্ডম্যান স্যাকস চিনের ফুজিয়ান আর হুনান প্রদেশের দশটি পোলট্রি ফার্মের মালিকানা সরাসরি দখল করে নিয়েছে। এই ফার্মগুলির কয়েকটি বনজ পণ্যের পশ্চাদভূমি এলাকায় অবস্থিত। ডয়েটশ ব্যাঙ্কের সহযোগিতায় ঐ একই প্রদেশের শুয়োর উৎপাদনকারী ফার্ম শুরু করার জন্যে এরা আরও ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। জেপি মর্গ্যান, ব্যাঙ্ক অফ আমেরিকা, সিটিগ্রুপ, ওয়েলস ফার্গো এন্ড কোং, আর মর্গ্যান স্ট্যানলি এই সব নামকরা বড় বড় বিনিয়োগকারী সংস্থা কৃষিজ, প্রাণিজ আর বনজ পণ্য উৎপাদনে বিনিয়োগ করে চলেছে।

যুদ্ধক্ষেত্রেই হোক, বা অর্থব্যবস্থাতেই হোক, এমনকি এই মহামারির সময়েও মৃত্যু আর বড় ক্ষতির সামনে পড়ে গেছে কিন্তু সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ। মহামারি যাতে না হয় তার জন্য যে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা সরকারের কর্তব্য ছিল তা সরকার করেনি। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যে পরিকাঠামো গড়ে তোলা প্রয়োজন ছিল তা হয়নি। যা হয়েছে তা হল উদারীকরণ-বেসরকারিকরণ-বিশ্বায়নের মাধ্যমে সরকার আর কর্পোরেট পুঁজি হাত ধরাধরি করে কর্পোরেট পুঁজির হাতে তুলে দিয়েছে মানুষ আর প্রকৃতিকে অবাধে শোষণ করার অধিকার।

আসলে এই বিশ্বব্যাপী বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারছি যে কোভিড-১৯-এর এই সংক্রমণ এসেছে বিশ্বপুঁজির হাত ধরেই। মুনাফা মুনাফা আরও মুনাফাএই তাগিদেই পুঁজি পৃথিবীর কোনও অঞ্চলকেই তার আওতার বাইরে থকতে দেবে না গভীর বনাঞ্চল আর মহানগর– তার মাঝে বিভিন্ন স্তরে উপনগর, শহর, গ্রাম, বনভূমি কাজ করে ‘বাফার জোন’ হিসাবে। মানুষ ও প্রকৃতির পারস্পরিক ঘাত-প্রতিঘাতের তীব্রতাকে ঠেকিয়ে রাখে– ক্রমশ সহনশীল হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু এখন বিশ্বপুঁজির আক্রমণের তীব্রতা এতই বেড়ে গেছে যে প্রকৃতির সঙ্গে তার সংঘর্ষ ধ্বংসের রূপ পরিগ্রহণ করছে। মুনাফার লালসায় পরিবেশ দূষণের মাত্রা সহনশীলতার এমন স্তরে গিয়ে পৌঁছচ্ছে যে মানুষের অস্তিত্বই বিপন্ন। সেই একই কারণ ঘটে চলেছে বনজ সম্পদ আর খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের প্রক্রিয়ায়।

মানুষ তার জ্ঞান, মেধা আর সৃস্টিশীলতা দিয়ে কোভিড-১৯-এর আক্রমণ রোধ করবেই এ বিশ্বাস আমাদের আছে। কিন্তু পৃথিবীর সব মানুষকে যাতে ভবিষ্যতে হাসপাতালের বিছানায় ভেন্টিলেটর নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করতে না হয় তার জন্যে মুনাফা সৃষ্টির লালসায় বিশ্বপুঁজির আগ্রাসনকে প্রতিরোধ করে নতুন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার কথা আমাদের চিন্তা করতে হবেই।

নান্যঃ পন্থা বিদ্যতে অয়নায়

 

[৯ এপ্রিল ২০২০]


[1] Kristian G. Andersen, Andrew Rambaut, W. Ian Lipkin, Edward C. Holmes, and Robert F. Garry, “The Proximal Origin of SARS-CoV-2,” Nature Medicine 2020
[2] Zoonoses and Marginalised Infectious Diseases of Poverty: Where Do We Stand?; David Molyneux et al., Parasites & Vectors 4, no. 106 (2011)

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...