লেনিন, মতাদর্শগত বিতর্ক ও রুশ বিপ্লব

সৌভিক ঘোষাল

 



লেখক প্রাবন্ধিক ও গদ্যকার। পেশায় শিক্ষক

 

 

 

 

“লেনিন সেবার শীতকালে/ ভালোবেসে ফুল জীবন্ত/ আনলেন মরা দিনকালে/ তোমারই জন্য বসন্ত”— শুধু রাশিয়ার মরা দিনকালেই নয়, দুনিয়াজোড়া মুষ্টিমেয় মানুষের শাসনের হিমশীতল কাঠামোতেই কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল রুশ বিপ্লব। দেশে দেশে গড়ে উঠেছিল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টি, যারা লড়াই শুরু করেছিল মেহনতি মানুষ এবং সমগ্র জাতি ও দেশের মুক্তির জন্য। একদিকে লড়াই এবং অন্যদিকে সেই লড়াইকে আটকানোর নানাবিধ প্রচেষ্টা— পরবর্তী প্রায় সাত দশক ধরে এটাই হয়ে থেকেছে বিশ্ব রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। লড়াই চলেছে কখনও সামরিক অস্ত্রসজ্জায়, কূটনীতিতে, কখনও সাংস্কৃতিক যুদ্ধে, আবার কখনও প্রচারাভিযানের মতো নানা বিচিত্র রাস্তায়। দুনিয়ায় ডান ও বাম রাজনীতির নানা ধরন এবং তাদের বিচিত্র মিশ্রণ আমরা লক্ষ করেছি। এমনকী সোভিয়েত ভাঙনের তিরিশ বছর পরেও তা বহমান।

অনেক বিশ্লেষক, রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন বুর্জোয়া রাজনীতির মধ্যে যে বিচিত্র দ্বন্দ্বসংঘাত এবং প্রাণস্পন্দন আছে, বাম রাজনীতি বিশেষত কমিউনিস্ট রাজনীতির মধ্যে তার বেশ অভাব। এখানে শ্রেণিসংগ্রামের একটি কেন্দ্রীয় বিষয়কে কেন্দ্র করেই যাবতীয় ডিসকোর্স আবর্তিত বলেই এমনটা হয়, একথাও বলার চেষ্টা করেছেন তাঁরা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল দুনিয়াজোড়া কমিউনিস্ট ও বাম আন্দোলনের বিচিত্র গতিপথকে এই তত্ত্ব একেবারেই মনোযোগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেনি। দেশে দেশে অর্থনীতি, রাজনৈতিক কাঠামো, সংস্কৃতি ইত্যাদির যে ভিন্নতা তাকে স্বীকার করেই কমিউনিস্ট আন্দোলন ও বাম আন্দোলন বহু বিচিত্র ধারায় বিকশিত হয়েছে। এমনকী দুনিয়াজোড়া যে সমাজতান্ত্রিক/নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবগুলি সম্পন্ন হয়েছে, তার গতিপথ ও চরিত্রে রয়েছে অনেক বৈচিত্র্য ও ভিন্নতা। রুশ বিপ্লব, চিন বিপ্লব, কিউবার বিপ্লব বা ভিয়েতনামের কথা স্মরণ করলেই আমরা এগুলো বুঝতে পারি।

রাশিয়ার বিপ্লব প্রচেষ্টা প্রসঙ্গেই লেনিন মার্কসবাদের সৃজনশীল দিকটির কথা তুলেছিলেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ রচনায় লেনিন লিখেছিলেন, “আমরা মার্কসের তত্ত্বকে পরিসমাপ্ত ও স্পর্শাতীত কিছু একটা বলে দেখি না। উল্টে আমরা বরং মনে করি যে তা একটা বিজ্ঞানের ভিত্তিপ্রস্তর তৈরি করেছে। জীবন থেকে পিছিয়ে পড়তে না চাইলে তাকে সব দিক থেকে আরও বিকশিত করতে হবে সমাজতন্ত্রীদের।” মার্কসীয় তত্ত্বের প্রতি এই ধরনের সৃজনমূলক মনোভাব রুশ বিপ্লবের সাফল্যের অন্যতম চাবিকাঠি ছিল। মার্কস এঙ্গেলস মনে করেছিলেন উন্নত ধনতান্ত্রিক দেশেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্ভব এবং একগুচ্ছ ধনতান্ত্রিক দেশে বিপ্লব না হলে তাকে রক্ষা করা কঠিন। লেনিনবাদ তার সৃজনীশক্তি দিয়ে রাশিয়ার মত তুলনামূলকভাবে পশ্চাদপদ একটি পুঁজিবাদী অর্থনীতির দেশ, যেখানে সামন্ততন্ত্রের প্রবল উপস্থিতি থেকে গিয়েছে, সেখানেও যে প্রলেতারিয়েতের নেতৃত্বে শ্রমিক ও গরীব কৃষকদের মধ্যে মৈত্রীর ভিত্তিতে বিপ্লব সফল করে তোলা যায়— তা দেখাল। সেইসঙ্গে অন্য কোনও সমাজতান্ত্রিক দেশের উপস্থিতি ছাড়াই কেবলমাত্র দেশের ভেতরের শ্রমিক, কৃষক, সেনাবাহিনী ও জনগণের ব্যাপকতম অংশের আস্থা জয় করে দেশের মধ্যেকার কুলাক ও প্রতিবিপ্লবী শক্তি এবং বাইরের বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সঙ্গে (আমেরিকা, জাপান, ফ্রান্স, ইংলন্ড, জার্মানি ইত্যাদি) লড়াই করে বিপ্লবকে টিঁকিয়ে রাখতে সক্ষম হল। ইউরোপীর রাশিয়া থেকে শুরু করে এশীয় রাশিয়ার কোণে কোণে তাকে ছড়িয়ে দিতে পারল। এই ব্যবহারিক অর্জনগুলি হয়ে উঠল নতুন তাত্ত্বিক শিক্ষা। লেনিনবাদের এই সৃজনী শক্তিই মার্কসবাদের বিকাশের ক্ষেত্রে, দেশে দেশে মেহনতি মানুষের জয়ের ক্ষেত্রে বারবার গুরূত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, চিন বিপ্লবের ক্ষেত্রে মাও সেতুং চিন্তাধারার মধ্যে যার এক ভিন্ন প্রকাশ আমরা দেখেছি। মূলত কৃষক সমাজকে ভিত্তি করে চিন বিপ্লবের যে অগ্রগতি তা মার্কসীয় বীক্ষায় নতুন সৃজনমূলক দিক ছিল লেনিনের পর।

এই লেখায় আমরা অবশ্য দুনিয়াজোড়া কমিউনিস্ট আন্দোলন বা বাম আন্দোলনের বৈচিত্র্য অনুসন্ধানের চেষ্টা করছি না। আমরা দেখতে চাইছি রুশ বিপ্লব কীভাবে বিভিন্ন মতাদর্শগত বিতর্কর মধ্যে দিয়ে এগিয়েছে। সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা জারতন্ত্রের উচ্ছেদের প্রশ্নে প্রথম বিতর্কে নামে নারদনিকদের সঙ্গে, যারা জনগণের বন্ধু নামে পরিচিত ছিল। এরপর সোশ্যাল ডেমোক্রাটরা নিজেদের মধ্যেই বিভিন্ন প্রশ্নে বিতর্কে অবতীর্ণ হয়, পার্টি প্রথমে বলশেভিক ও মেনশেভিক দুই গ্রুপে ও তারপর দুই আলাদা সংগঠনে বিভক্ত হয়ে যায়। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে বলশেভিকরা ইউরোপের বিভিন্ন সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টির সঙ্গে বিতর্কে নামে প্রলেতারিয়েতের ভূমিকা প্রসঙ্গে। শুধু বাইরের সংগঠনগুলির সঙ্গেই নয়, বলশেভিকদের নিজেদের মধ্যেই বিভিন্ন প্রশ্নে আন্তঃপার্টি সংগ্রাম চলেছে। মেনশেভিক ও অন্যান্য বিলোপবাদীদের বিরুদ্ধে বলশেভিকদের একাংশ যখন ড্যুমার প্রতিনিধিদের প্রত্যাহারের কথা বলছিল, তখন সেই অৎজোভিস্ট বা প্রত্যাহারপন্থীদের বিরুদ্ধে লেনিন মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়েছিলেন।

যে সমস্ত প্রশ্নে রুশ কমিউনিস্টরা বিপ্লব প্রচেষ্টার পর্বে অন্যদের সঙ্গে এবং নিজেদের মধ্যে বিতর্ক চালিয়েছেন, তার অনেকগুলি বিতর্ক আজও নতুন নতুন প্রেক্ষিতে নতুন কোনও কোনও চেহারায় আত্মপ্রকাশ করে। পার্টির চরিত্র, কারা হবেন পার্টির সদস্য সেই সমস্ত সাংগঠনিক প্রশ্নের পাশাপাশি বুর্জোয়া সংসদকে দেখার ধরন, সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বয়কটের প্রশ্ন, ট্রেড ইউনিয়ন কাজ ও শ্রমিকশ্রেণির বিপ্লবী কাজের মধ্যেকার সম্পর্ক, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা ও বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের সঙ্গে তার সম্পর্ক, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব ও সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের আন্তঃসম্পর্ক সহ একগুচ্ছ প্রশ্নে রুশ বিপ্লবের পথে অত্যন্ত জীবন্ত বিতর্ক আমরা দেখেছি।

 

জারতন্ত্রের উচ্ছেদ প্রসঙ্গে নারদনিকদের সঙ্গে বিতর্ক

রাশিয়ায় প্রায় পাঁচশো বছর ধরে, তৃতীয় ইভানের (১৪৪০-১৫০৫ সাল) আমল থেকেই চালু ছিল জারের শাসন। রাশিয়ান সম্রাটরাই জার নামে পরিচিত ছিলেন। দেশের অধিকাংশ ভূমি এবং সম্পদ জার, তার পরিবার ও অনুচরদের হাতে কেন্দ্রীভূত ছিল। আর কোটি কোটি জনসাধারণ বাস করত উপযুক্ত শিক্ষা চিকিৎসা বাসস্থান খাদ্য বিশ্রাম বিহীন অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টের মধ্যে। ইউরোপের অন্যান্য দেশের স্বৈরতন্ত্রগুলির চেয়েও রাশিয়ার অবস্থা ছিল খারাপ। ১৯০৫ সালের বিক্ষোভ আন্দোলন পর্বের আগে পর্যন্ত রাশিয়ায় কোনও সংবিধান বা (এমনকী রাজতন্ত্র নিয়ন্ত্রণাধীন) সংসদীয় ব্যবস্থার চিহ্নটুকু পর্যন্ত ছিল না। রাজনৈতিক ক্ষমতার পাশাপাশি ধর্মীয় বিষয়ের কর্তৃত্বও ছিল জারের হাতে। জার শাসনের কোনও কোনও পর্বে অবশ্য কিছু কিছু সংস্কার হয়। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে জার পিটার দ্য গ্রেট-এর আমল (১৬৮২ থেকে ১৭২৫) এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। পশ্চিম ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়া এইসময় সাংস্কৃতিকভাবে অনেকটা কাছাকাছি আসে। মস্কো থেকে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় সেন্ট পিটার্সবার্গে এবং নতুনভাবে একে গড়ে তোলা হয়। এই আমলে পুরনো মধ্যযুগীয় অনেক ধ্যানধারণাকে সরিয়ে দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানচিন্তার প্রসার হয়। এই সংস্কার অব্যাহত থাকে ক্যাথরিন দ্য গ্রেট-এর আমলেও (১৭৬২ থেকে ১৭৯৬)।

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের (১৮৫৫ থেকে ১৮৮১) আমলের প্রথম দিকে ক্রিমিয়ার যুদ্ধে (১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬) রাশিয়ার শোচনীয় পরাজয় ঘটে এবং ক্রমশ জনপ্রিয়তা হারাতে থাকা জার শাসন আরও অনেকটা বেআব্রু হয়ে যায়। তলা থেকে বিদ্রোহের সম্ভাবনাকে প্রশমিত করার জন্য ওপর থেকে কিছু সংস্কারের কথা ভাবা হয়। শুরু হয় বহু আলোচিত ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি (১৮৬১)। ভূমিদাস প্রথার বিলুপ্তি অবশ্য জনগণের জীবনের মূল সমস্যাগুলি সমাধান করতে ব্যর্থ হয়। ওপর থেকে লোকদেখানো সংস্কার সত্ত্বেও ভালো ভালো জমিগুলো সবই জমিদারদের হাতে থেকে যায়। কৃষকদের হাতে আসে সামান্য কিছু পতিত বা অনুর্বর জমি। এর সঙ্গেই ছিল চাষিদের জমিতে আবদ্ধ করে রাখার চেষ্টা। অনুমতি না নিয়ে চাষিরা এলাকা ত্যাগ করতে পারত না।

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারের আমলের আগে থেকেই রাশিয়া একের পর এক কৃষক বিদ্রোহে আলোড়িত হচ্ছিল। ১৮৫০ থেকে ১৮৬০-এর মধ্যে রাশিয়া জুড়ে প্রায় আটশো কৃষক বিদ্রোহ হয়। ১৮৩৫ থেকে ১৮৬১-র মধ্যে বিদ্রোহীরা দুশো তিরাশি জন জমিদার বা কুলাককে হত্যা করে। এই বিদ্রোহের পুরোভাগে ছিল নারদনিক বা জনগণের বন্ধুরা। রাশিয়ায় সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবক্ষয় দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু তার জায়গায় আধুনিক পুঁজিবাদ তখনও সেভাবে বিকশিত হয়ে ওঠেনি। ছাত্রযুব এবং জনগণের প্রগতিশীল অংশ সামন্ততন্ত্র এবং জার শাসনের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ছিল এবং তা প্রায়শই ব্যক্তিহত্যার পথ বেছে নিত। এরই চরম প্রকাশ দেখা যায় ১৮৮১ সালের ১লা মার্চ। সেন্ট পিটার্সবুর্গ এর রাস্তায় জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডারকে সেদিন বোমা ছুঁড়ে হত্যা করা হয়। ছ বছর বাদে একইভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয় জার তৃতীয় আলেকজান্ডারকে। সেই ব্যর্থ চেষ্টার শাস্তি হিসেবে দু মাস পর ফাঁসিতে প্রাণ বিসর্জন দেন আলেকজান্দার উলিয়ানভ, সম্পর্কে যিনি ছিলেন লেনিনের নিজের দাদা।

জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ ও ঘৃণার বাতাবরণে ভরা রাশিয়ায় লেনিন বেড়ে উঠছিলেন। লেনিন অবশ্য নারদনিকদের ব্যক্তিহত্যার পথ একেবারেই সমর্থন করেননি। তিনি মার্কসবাদের এক স্বতন্ত্র পথে জারতন্ত্রের অবসানের কথা ভেবেছিলেন, যা বলশেভিক মতবাদ হিসেবে বিখ্যাত। রাশিয়ায় জারবিরোধী আন্দোলনের সেই উত্তুঙ্গ পর্বে নানা মতবাদ পরস্পরের সঙ্গে বিতর্কের মধ্যে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। কখনও কখনও তারা পরস্পরের কাছাকাছি আসছিল, আবার তীক্ষ্ণ বিতর্ক কখনও কখনও তাদের পরস্পর থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছিল। ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় জারের নিয়ন্ত্রণাধীন পার্লামেন্ট বা দ্যুমা প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে রাশিয়ায়। এগুলির মধ্যে চরম জার সমর্থক বা জারিস্টরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল মধ্যপন্থী অক্টোব্রিস্টরা, বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক কাদেতরা। আর ছিল জার শাসনের বিরোধী নারদনিকদের উত্তরসূরি সোশ্যালিস্ট রিভোলিউশনারি (SR) এবং রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টি (RSDLP) যা কালক্রমে লেনিনের নেতৃত্বাধীন বলশেভিক ও মার্তভের নেতৃত্বাধীন মেনশেভিক এই দুভাগে ভাগ হয়ে যায়।

রাশিয়ায় ১৯১৭-র নভেম্বর বিপ্লবের বারো বছর আগে ১৯০৫ সালে যে বড়সড় বিপ্লব হয় এবং তার ফলেই রাশিয়ায় জার বাধ্য হন জনগণের ভোটাধিকারে নির্বাচিত প্রতিনিধিত্বমূলক একটি সংসদীয় ব্যবস্থা (রাশিয়ান দ্যুমা) প্রবর্তন করতে।

লেনিনের দাদা ব্যক্তিহত্যার নারদনিক পথ বেছে নিলেও লেনিন নিজে সেই নৈরাজ্যবাদের রাস্তায় হাঁটেননি। তিনি রাশিয়ায় মার্কসবাদীদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। রাশিয়ার প্রথম দিককার মার্কসবাদীদের অন্যতম প্লেখানভ তখন জারের নির্যাতন থেকে বাঁচতে আত্মগোপন করে ছিলেন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায়। সেখানে তিনি তৈরি করেন ‘শ্রমমুক্তি’ নামে প্রথম একটি রুশ মার্কসবাদী প্রবাসী সংগঠন। সেখান থেকে মার্কস এঙ্গেলসের বিভিন্ন লেখা তিনি ও সহযোগীরা অনুবাদ করে রাশিয়ায় পাঠাতেন। ১৮৮০-র দশক থেকে এগুলির পঠনপাঠনকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার অভ্যন্তরে বেশ কিছু মার্কসবাদী পাঠচক্র গড়ে উঠতে থাকে। ১৮৯২ সালে লেনিন সামারায় থাকাকালীন সময়ে তৈরি করেন একটি মার্কসবাদী অধ্যয়ন ও প্রচার গ্রুপ। অচিরেই সামারার বাইরেও তিনি তাঁর কাজকর্মকে ছড়িয়ে দেন কাজান, সারাতভ, সিজরান প্রভৃতি ভোলগা তীরবর্তী বিভিন্ন শহরগুলিতে। ১৮৯৩ সালে লেনিন সামারা থেকে রাশিয়ার তৎকালীন রাজধানী পিটার্সবুর্গে চলে আসেন। সেখানে তখন অনেকগুলি মার্কসবাদী অধ্যয়ন ও কার্যকালাপের গুপ্ত বিপ্লবী গ্রুপ ছিল, লেনিন তাঁর একটিতে যোগদান করেন। মাত্র তেইশ বছর বয়সী লেনিনের মার্কসবাদে পাণ্ডিত্য, অসামান্য বিশ্লেষণ ক্ষমতা ও বাগ্মিতা তাঁকে পিটার্সবার্গের মার্কসবাদীদের মধ্যে অত্যন্ত জনপ্রিয় করে তোলে এবং তিনি নেতার সম্মান পেতে থাকেন।

উনিশ শতকের নব্বইয়ের দশকে রাশিয়ায় একটা শিল্পোন্নয়ন দেখা যায় এবং সেই সঙ্গে সঙ্গেই পিটার্সবুর্গে ও অন্যত্র ব্যাপক শ্রমিক আন্দোলন দেখা যায়। পুঁজিপতিদের সঙ্গে সংগ্রামকে দৃঢ় করার জন্য একটি স্বাধীন বিপ্লবী শ্রমিক পার্টি গড়ে তোলার প্রয়োজন লেনিন ও মার্কসবাদীরা অনুভব করতে থাকেন। এই ধরনের পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে একটি সমস্যা ছিল নারদনিকদের প্রভাব। নারদনিকরা বলত রাশিয়ায় পুঁজিবাদ বিকশিত হতে পারবে না, অন্য সমস্ত দেশ থেকে স্বতন্ত্র কোনও একটা বিশেষ পথে সে এগোবে। শ্রমিকশ্রেণির ঐতিহাসিক ভূমিকাকে তারা অস্বীকার করত, কৃষকদেরই মনে করত মূল বিপ্লবী শক্তি, চেষ্টা করত স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে তাদেরই সংগ্রামে নামাতে। লেনিন ও মার্কসবাদীরা ব্যক্তিগতভাবে তাদের শ্রদ্ধা করেও তাদের রাজনৈতিক পথকে ভুল বলে চিহ্নিত করেছিলেন। পরের দিকে নারদনিকরা তাদের বিপ্লবী কর্মকাণ্ড থেকেও সরে আসে এবং সুবিধাবাদী আপসের পথে চলে যায়। ১৮৭০-এর চেয়ে ১৮৯০-এর নারদনিকরা ছিল অনেকটাই আলাদা। জার সরকার কর্তৃক নারদনায়া ভোলিয়া ছত্রভঙ্গ হবার পর স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই ছেড়ে তার সঙ্গে আপস করে। নয়া নারদনিকদের লেনিন বলেছিলেন উদারনৈতিক। শ্রমিকশ্রেণির স্বাধীন পার্টি গঠনের পদক্ষেপ হিসেবে এই উদারনৈতিক নারদনিকদের সঙ্গে খোলাখুলি বিতর্কে নামেন লেনিন এবং ১৮৯৪ সালে লেখেন তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য বই— “নারদনিকরা কী এবং কীভাবে তারা লড়ে সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের বিরুদ্ধে?” প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য মার্কসবাদীরা তখন রাশিয়ায় পরিচিত ছিল সোশ্যাল ডেমোক্রাট নামে। এই বইতে লেনিন বিশ্লেষণ করে দেখান নারদবাদ বিপ্লবী মতবাদ থেকে সরে এসেছে উদারনৈতিকতায়। জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবী সংগ্রাম তারা পরিহার করেছে এবং এখন তারা কেবল ছোটখাট সংস্কারের কথা বলছে। উদারনৈতিক নারদনিকেরা কুলাক বা ধনী কৃষকদের স্বার্থেই কাজ করছে। লেনিন লেখেন মেহনতিদের সত্যকার প্রতিনিধি নারদনিকেরা নয়, মার্কসবাদীরা।

রুশ বিপ্লবের কালক্রম অনুসরণ করতে করতে আমরা দেখি লেনিন বারবার অসংখ্য বিতর্কের মধ্যে দিয়ে বিপ্লবী মার্কসবাদী মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার সঙ্গেই শুধু নয়, মার্কসবাদীদের মধ্যেও চালাতে হয়েছে এই বিতর্ক। এই বিতর্ক একদিকে যেমন তাত্ত্বিক, দার্শনিক, তেমনি অন্যদিকে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে নির্দিষ্ট কার্যক্রম নেওয়ার সঙ্গেও বিশেষভাবে সংযুক্ত ছিল।

 

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসির মধ্যেকার বিতর্ক: বলশেভিক ও মেনশেভিক ধারা

বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টি গড়ার কাজ শ্রমিকদের সংগঠিত করার মধ্যে দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। বড় বড় কলকারখানার অগ্রণী শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এদের মধ্যে ছিলেন বাল্টিক জাহাজ নির্মাণ কারখানা, নেভা জাহাজ নির্মাণ ও মেকানিক্যাল কারখানা, আলেক্সান্দ্রভ মেকানিক্যাল কারখানার শ্রমিকেরা। ১৮৯৫ সালে লেনিন পিটার্সবুর্গের মার্কসবাদী গ্রুপগুলিকে সমন্বিত করেন একটি একক রাজনৈতিক সংগঠনে। এর নাম হয় “শ্রমিকশ্রেণির মুক্তি সংগ্রাম সঙ্ঘ।” এটি ছিল রাশিয়ায় বিপ্লবী মার্কসবাদী পার্টির প্রথম অঙ্কুর। ১৮৯৬ সালে সংগ্রাম সঙ্ঘের নেতৃত্বে পিটার্সবুর্গ শ্রমিকদের একটি বিখ্যাত ধর্মঘট হয়। এতে যোগ দেয় তিরিশ হাজারের বেশি নারী পুরুষ শ্রমিক। ধর্মঘটের মধ্যে দিয়ে পিটার্সবুর্গ সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের মধ্যে প্রতিষ্ঠা বাড়ে। কারণ তাদের নেতৃত্বের মধ্যে দিয়েই ধর্মঘটটি এতটা প্রসারিত হয় ও রাজনৈতিক গুরুত্ব অর্জন করে। পিটার্সবুর্গের বাইরে সংগ্রাম সঙ্ঘের প্রভাব ছড়াতে থাকে। মস্কো, কিয়েভ, ভ্লাদিমির, ইভানোভা সহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহর ও গুর্বেনিয়ার শ্রমিক গ্রুপগুলি সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক সঙ্ঘ ও গ্রুপে সমন্বিত হতে থাকে। সংগ্রাম সঙ্ঘের নেতৃত্ব এইসময় তাদের পত্রিকা ‘রাবওচেয়ে দেলো’ বা ‘শ্রমিক আদর্শ’র প্রথম সংখ্যাটি প্রকাশের উদ্যোগ নিচ্ছিল। সঙ্ঘের ক্রিয়াকলাপের ওপর জারের পুলিশ লক্ষ রাখছিল এবং পত্রিকা প্রকাশের মুখে লেনিন সহ সঙ্ঘের অন্যান্য নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয় ও পত্রিকার সবকিছু বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১৪ মাসের জন্য সলিটারি সেলে রাখা হয় লেনিনকে। নির্বাসনপর্বেই তিনি রাশিয়ায় পুঁজিবাদের বিকাশ বইটি লেখার কাজ শেষ করেন। রাশিয়ার অর্থনৈতিক বিকাশ নিয়ে এই অসামান্য গবেষণায় লেনিন দেখান যে রাশিয়ার পুঁজিবাদ শুধু শিল্পে নয়, কৃষিতেও জোরদার হচ্ছে। নারদবাদের তাত্ত্বিক পতনে এই বইটি একটি বড় ভূমিকা পালন করে। রাশিয়ার সাধারণ জনসংখ্যার মধ্যে শ্রমিকশ্রেণির সংখ্যাল্পতা সত্ত্বেও লেনিন তাদের মধ্যেই এক মহাশক্তিকে দেখতে পেয়েছিলেন। বিপ্লবী আন্দোলনে এই শ্রেণির নেতৃস্থানীয় ভূমিকাকে তিনি সামনে নিয়ে আসেন। একই সঙ্গে লেনিন প্রলেতারিয়েতের সঙ্গে কৃষক সম্প্রদায়ের ঐক্যের আবশ্যিকতার ওপর জোর দেন। কারণ তা ছাড়া আসন্ন বিপ্লবে জয়লাভ সম্ভব ছিল না।

১৯০২ সালে লেনিনের সুবিখ্যাত বই “হোয়াট ইজ টু বি ডান” বা “কী করিতে হইবে” প্রকাশিত হয়। এই বইতে লেনিন পার্টি গঠনের মূল নীতি সম্পর্কে আলোচনা করেন। সেই সময়ে মার্কসবাদীদের মধ্যে পার্টির চরিত্র নিয়ে বিতর্ক চলছিল। বিতর্ক ছিল স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ও বিপ্লবী তত্ত্বের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও। পশ্চিম ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিগুলির চেয়ে আলাদা ধরনের পার্টির প্রয়োজনীয়তাই লেনিন অনুভব করেছিলেন রাশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলনের অগ্রগতির জন্য। পশ্চিম ইউরোপের সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টিগুলি গড়ে উঠেছিল পুঁজিবাদের অপেক্ষাকৃত শান্তিপূর্ণ বিকাশের পরিস্থিতিতে। তাদের মধ্যে বিপ্লবী সংগ্রামের বদলে সুবিধাবাদ ও আপসের দিকে ঝোঁক ছিল। এই পার্টিগুলির সুবিধাবাদী ধারাগুলি বোঝাতে চাইত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ও প্রলেতারীয় একনায়কত্ব ছাড়াই শোষণের অবসান ও সমাজতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব। এর ফলে তারা শ্রমিকদের ঠেলে দিত নিষ্ক্রিয়তায় এবং নিজেরা হয়ে পড়ত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমর্থক। মার্কসবাদের পুনর্বিচার ও সংশোধন করত সুবিধাবাদীরা, তার বিপ্লবী সারটুকু ছেঁটে দিত। এই প্রবণতার বিপরীতে লেনিন চেয়েছিলেন খাঁটি বিপ্লবী প্রলেতারীয় পার্টি। এমন পার্টি যা জার স্বৈরাচার এবং পুঁজিবাদের ওপর ঝঞ্ঝাক্রমণে রাশিয়ার শ্রমিকশ্রেণিকে সংগঠিত ও পরিচালিত করতে সক্ষম। সেই সঙ্গেই লেনিন জোর দিয়েছিলেন বিপ্লবী তত্ত্বের ওপর। এজন্যই মার্কসীয় বিপ্লবী তত্ত্বের অপরিহার্যতার কথা বলেছিলেন তিনি। কারণ “বিপ্লবী তত্ত্ব ছাড়া বিপ্লবী আন্দোলন সম্ভব নয়।”

আরও বেশ কয়েকটু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রয়োজনীয় মতাদর্শগত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন লেনিন। সে সময় অনেক মার্কসবাদীর মধ্যে একটি অর্থনীতিবাদী ঝোঁক লক্ষ করা যাচ্ছিল। পিটার্সবুর্গ ধর্মঘটের সাফল্যের প্রেক্ষিতে এর জন্ম হয়েছিল। রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের একটা অংশ শ্রমিকদের বোঝাতে শুরু করে কেবল অর্থনৈতিক সংগ্রাম চালানোর জন্য। মজুরি বৃদ্ধি, শ্রমসময় কমানো, কাজের পরিবেশের উন্নয়নের জন্য আন্দোলন সংগঠনের ওপর জোর দেওয়া হতে থাকে। এই ধারাকে লেনিন আখ্যায়িত করেন ইকনমিজম বা অর্থনীতিবাদী বলে। লেনিন তাঁর সমালোচনায় বলেন অর্থনীতিবাদীরা শ্রমিকশ্রেণিকে ঠেলছিল বুর্জোয়াদের সঙ্গে আপসের অভিমুখে, তাদের বিপ্লবী ভূমিকাকে ছোট করে তুলছিল, রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকে তাদের বিচ্যুত করছিল। প্রলেতারিয়েতের স্বার্থকে এরা বুর্জোয়া স্বার্থের অধীন করে ফেলছে, এই মর্মে লেনিন অর্থনীতিবাদীদের সমালোচনা করেন।

পার্টির মধ্যেকার বিভিন্ন প্রবণতাকে একসূত্রে গাঁথা ও পার্টিকে বিপ্লবী দিশা দেওয়ার জন্য একটি পার্টি কংগ্রেসের প্রয়োজনীয়তা বিশেষভাবে লেনিন ও তাঁর সহযোগীরা অনুভব করেন। বহু চেষ্টার পর ১৯০৩ সালের জুলাই মাসে রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টির দ্বিতীয় কংগ্রেস আয়োজিত হয়। রাশিয়ায় সেই সময় এই কংগ্রেস আয়োজনের কোনও পরিস্থিতি ছিল না। ফলে প্রথমে তা বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে বসে। কিন্তু বেলজিয়াম পুলিশের হানার পর তা স্থানান্তরিত করতে হয় লন্ডনে। লেনিন এই কংগ্রেসে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন।

কংগ্রেসে বহু বিষয়ে বিতর্ক হয়। এর মধ্যে অন্যতম ছিল পার্টির গঠন ও পার্টি সদস্যপদের চরিত্র সংক্রান্ত। মার্তভের নেতৃত্বাধীন একদল চেয়েছিলেন যে পার্টি হোক ঢিলেঢালা। যারা পার্টিকে চাঁদা দেবে ও পার্টি নীতি সমর্থন করবে, তারাই হবে পার্টি সদস্য। এই মতকে লেনিন খারিজ করেন। তিনি বলেন পার্টি সভ্য সেই হতে পারবে যে পার্টি কর্মসূচি মানে, পার্টিকে চাঁদা দেয় এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই কোনও একটি পার্টি সংগঠনের অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার কাজে অংশ নেয়। লেনিনের এই সূত্রে পার্টিতে পার্টিতে অ-প্রলেতারীয় ও অদৃঢ় লোকের প্রবেশ কঠিন হয় এবং সুশৃঙ্খল ও সংগঠিত পার্টি গঠন সম্ভবপর হয়। ভোটামুটির মধ্যে দিয়ে এই বিতর্কের পরিসমাপ্তি হয়। লেনিনের মতটি কংগ্রেসের সাধারণ সদস্যদের ভোটে পরাজিত হয়। কংগ্রেসের সাধারণ সদস্যদের মধ্যে মার্তভ অনুগামীদের গরিষ্ঠতা থাকলেও কেন্দ্রীয় কমিটিতে এবং ইসক্রার সম্পাদকমণ্ডলীতে লেনিনের অনুগামীদেরই আধিপত্য ছিল। সংখ্যাধিক্যের দল হিসেবে তাদের পরিচয় হয়, যার রুশ পরিভাষা বলশেভিক। অন্যদিকে মার্তভের নেতৃত্বাধীন ঢিলেঢালা পার্টি গঠনপন্থীদের নাম হয় সংখ্যালঘুর দল বা মেনশেভিক।

মেনশেভিক মতবাদের বিপদের দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে লেনিন লেখেন “ওয়ান স্টেপ ফরওয়ার্ড টু স্টেপ ব্যাক” বা ‘এক কদম আগে, দু কদম পিছে’ নামে তাঁর অতি পরিচিত বইটি। প্রলেতারিয়েতের পার্টির ধরনধারন বিষয়ে লেনিন এই বইতে বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বললেন, “প্রলেতারিয়েতের সংগ্রাম পার্টি সাফল্যের সঙ্গে শুধু তখনই পরিচালনা করতে পারে যখন তার সমস্ত সভ্য একক বাহিনীতে ঐক্যবদ্ধ, একই সংকল্প, কর্ম ও শৃঙ্খলায় সংহত, যখন তা বৈপ্লবিক তত্ত্বে সশস্ত্র।” পার্টি পরিচালনার নিয়মনীতিকে লেনিন সুনির্দিষ্ট করে বলেন পার্টির সমস্ত সভ্যকে পার্টির নিয়মাবলি কঠোরভাবে মানতে হবে, একক পার্টি শৃঙ্খলা মানতে হবে, সংখ্যাগুরুর কাছে সংখ্যালঘু, উচ্চতর সংগঠনের কাছে নিম্নতর সংগঠন নত থাকবে। পার্টি সংস্থাগুলিতে নিয়মিত নির্বাচন করতে হবে, থাকবে কার্যকলাপ নিয়ে জবাবদিহির বাধ্যবাধকতা। পার্টি সদস্যদের সক্রিয়তা ও ব্যক্তিগত উদ্যোগ, সমালোচনার অধিকার ও আত্মসমালোচনার প্রয়োজনীয়তার ওপর লেনিন জোর দেন।

 

১৯০৫-এর বিপ্লবের চরিত্র এবং বুর্জোয়া বিপ্লবে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকা নিয়ে বিতর্ক

১৯০৩ সালে জার দ্বিতীয় নিকোলাসের সাম্রাজ্যবাদী অভীপ্সা রাশিয়ার সঙ্গে জাপানের যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। এই যুদ্ধে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং দেশের মধ্যে আর্থিক সঙ্কট প্রবল আকার ধারণ করে। মুদ্রাস্ফীতি তুঙ্গস্পর্শী হয়ে ওঠে। শ্রমিক আন্দোলন শুরু হয় রাশিয়ার বুকে। বলশেভিকদের বাকু কমিটির নেতৃত্বে ১৯০৪ সালে বাকু শহরে শ্রমিকদের এক বিরাট ও সুসংবদ্ধ ধর্মঘট হয়। ধর্মঘটে শ্রমিকেরা বিজয়ী হয়, তৈলখনিক মালিকেরা শ্রমিকদের সঙ্গে চুক্তি করতে বাধ্য হয়। রাশিয়ার ইতিহাসে এটিই ছিল এই ধরনের প্রথম চুক্তি। ১৯০৫ সালের জানুয়ারি মাসে সেন্ট পিটার্সবুর্গের সবচেয়ে বড় কারখানা পুটিলভে ধর্মঘট শুরু হয়। কয়েকজনের শ্রমিকের কর্মচ্যুতি ছিল এই ধর্মঘটের কারণ। শ্রমিক ধর্মঘট ক্রমশই সাধারণ ধর্মঘটের রূপ নেয়। এক লক্ষের বেশি শ্রমিক এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিল। শ্রমিক ও সমাজের বিভিন্ন অসন্তুষ্ট অংশের মানুষের এক শান্তিপূর্ণ মিছিল জারের প্রাসাদের দিকে তাদের জীবন জীবিকার সঙ্কট সমাধানের আবেদনপত্র নিয়ে রওনা হয়। আবেদনে কর্ণপাত না করে তাদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালানো হয়। শয়ে শয়ে নিরীহ নারীপুরুষের মৃত্যু ঘটে। রক্তাক্ত রবিবারের প্রতিবাদে সমস্ত রাজনৈতিক শক্তি মুখর হয়ে ওঠে। শ্রমিকদের বড় বড় ধর্মঘট কলকারখানা অচল করে দেয়। প্রবল হয়ে ওঠে জনগণের নির্বাচিত সংসদের দাবি। উপায়ান্তর না দেখে জার দ্বিতীয় নিকোলাস জনগণের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে রাশিয়ান সংসদ বা দ্যুমার প্রবর্তন করেন। সংসদ তৈরি হলেও তা ছিল জারের নিয়ন্ত্রণাধীন।

১৯০৫ সালের রক্তাক্ত রবিবারের পর রাশিয়ায় যখন ঝোড়ো পরিস্থিতি, তখন লন্ডনে এই সময় পার্টির কর্মধারা নির্ধারণের জন্য লন্ডনে তৃতীয় কংগ্রেস আয়োজিত হয়। আমন্ত্রণ সত্ত্বেও মেনশেভিকরা এই কংগ্রেসে হাজির হয় না। জেনেভায় তারা পৃথক সম্মেলন করে। লন্ডন এবং জেনেভায় দুটি আলাদা আলাদা পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে দিয়ে দুটি আলাদা দল— বলশেভিক ও মেনশেভিক-এ— রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রাটিক লেবার পার্টি বিভাজিত হয়ে যায়। এর পরেই লেনিন লেখেন ‘টু ট্যাকটিকস অব সোশ্যাল ডেমোক্রেসি’ বা ‘গণতান্ত্রিক বিপ্লবে সোশ্যাল ডেমোক্রেসির দুই কর্মকৌশল’ নামের বিখ্যাত বইটি। এতে তিনি দেখান ১৯০৫-এর উত্তুঙ্গ পরিস্থিতিকে বলশেভিক ও মেনশেভিকরা কীভাবে দেখছিল, কোথায় তাদের পার্থক্য।

১৯০৫-এর বিপ্লবকে লেনিন ও বলশেভিকরা চিহ্নিত করেছিলেন চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে। তার কর্তব্য হল ভূমিদাসপ্রথার জের বিলোপ, জারতন্ত্রের উচ্ছেদ এবং গণতান্ত্রিক অধিকার লাভ। তাঁরা মনে করেন প্রলেতারিয়েতের স্বার্থ হল বুর্জোয়া বিপ্লবের পরিপূর্ণ বিজয়, কারণ এর মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম সন্নিকট ও লঘুভার হবে। সেইসঙ্গে এও তাঁরা মনে করেছিলেন এটি চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব হলেও এর চালিকাশক্তি ও নেতা হতে হবে প্রলেতারিয়েতকেই। কারণ রাশিয়ার বুর্জোয়ারা ছিল প্রলেতারিয়েতের ভয়ে ভীত এবং সেই জায়গা থেকে জারতন্ত্রের সংরক্ষণের পক্ষে। বলশেভিকরা বললেন কৃষকদের সহযোগিতায় প্রলেতারিয়েতদের বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে এবং জনগণের কাছ থেকে বুর্জোয়াদের বিচ্ছিন্ন ও একঘরে করতে হবে। মর্মবস্তুর দিক থেকে এটি বুর্জোয়া বিপ্লব হলেও সংগ্রাম পদ্ধতির দিক থেকে এটি তাই প্রলেতারীয় নির্ভর। এই দ্বান্দ্বিকতাকে মেনশেভিকরা আয়ত্ত করতে পারেনি এবং তারা সরলভাবে মনে করেছিল যেহেতু এটি চরিত্রগতভাবে বুর্জোয়া বিপ্লব, তাই তার পুরোভাগে থাকবে বুর্জোয়ারাই। শ্রমিকশ্রেণির কর্তব্য কেবল বুর্জোয়াদের সাহায্য ও সমর্থন করা। লেনিন দেখান মেনশেভিকদের এই মূল্যায়ন প্রলেতারিয়েতের রাজনীতিকে বুর্জোয়াদের অধীনস্থ করে তুলছে এবং তা মার্কসবাদের বিপ্লবী চরিত্রকে বিকৃত করছে।

লেনিন একইসঙ্গে এও বলেছিলেন কৃষকদের সঙ্গে মৈত্রীর ভিত্তিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের কাজ সমাধা করেই প্রলেতারিয়েতের কাজ শেষ হয়ে যাবে না। সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে তার অর্জিত শক্তিকে ব্যবহার করে সে আঘাত হানবে পুঁজিবাদের ওপর। এইভাবে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এগিয়ে চলবে সমাজতান্ত্রিক বিজয়ের দিকে। টু ট্যাকটিকস অব সোশ্যাল ডেমোক্রেসি বইতে তিনি যে সূত্রায়ন করেন তা সারা বিশ্বে গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত সমস্ত মানুষের কাছেই এক অতি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

 

সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের চতুর্থ বা ঐক্য কংগ্রেস

১৯০৫-এর বিপ্লবের সাফল্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে ঐক্যের প্রস্তাব আসে উভয় দলের সদস্যদের মধ্যে থেকে। লেনিন ও বলশেভিকরা এই দাবিতে সাড়া দেন। ১৯০৬-এর এপ্রিলের গোড়ায় রাশিয়ায় রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক লেবার পার্টির চতুর্থ তথা ঐক্য কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয় সুইডেনের স্টকহোমে। শুধুমাত্র বলশেভিক বা মেনশেভিকরাই নয়, এই ঐক্য কংগ্রেসে রাশিয়ার বিভিন্ন অ-রুশ জাতিগোষ্ঠী— যেমন পোলিশ, লিথুয়ানীয়, লাতভীয় ও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর প্রতিনিধিরা হাজির ছিল। কংগ্রেসে বলশেভিক ও মেনশেভিকদের মধ্যে কৃষিনীতির প্রশ্নে ব্যাপক বিতর্ক হয়। তা সত্ত্বেও উভয় পক্ষই ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রীয় কমিটিতে সমন্বিত হয়। মেনশেভিকরাই ছিল এই কংগ্রেসে এবং নির্বাচিত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সংখ্যাধিক্য। পার্টির মুখপত্র “সোশ্যাল ডেমোক্রেসি” তাদের নিয়ন্ত্রণেই থাকে।

 

বিপ্লবের পিছু হটার পর্ব ও বিতর্কসমূহ

১৯০৫-এর ডিসেম্বরের পর থেকেই বিপ্লবী পরিস্থিতি বদলে যেতে থাকে। আসে স্থিতাবস্থা। বাড়তে থাকে জারের দমনমূলক পদক্ষেপ। বলশেভিক সংগঠনগুলি দমন ও অপ্রলেতারীয় বিভিন্ন ভাবনাচিন্তায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০০৬ থেকে ২০১০ অবধি একটা পিছু হটার পর্ব চলে। এই পর্বে পার্টি পরিচালনা সম্পর্কে লেনিন কীভাবে নেতৃত্ব দেন, তা স্থিতাবস্থাকালীন সময়ের কাজকর্ম সম্পর্কে এক সাধারণ শিক্ষা হিসেবে আজও আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ।

১৯০৬ সালের ঐক্য কংগ্রেসের সময়ে বলশেভিকরা দমনের মুখে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। এই কংগ্রেসে মেনশেভিকদেরই আধিপত্য ছিল। পরের বছর ১৯০৭ সালে লন্ডনে আরএসডিএলপি-র পঞ্চম কংগ্রেস বসে।

মেনশেভিকরা চেয়েছিল এই কংগ্রেসে সমস্ত দলের প্রতিনিধিদের ডেকে এক শ্রমিক কংগ্রেস ডাকা, যাতে সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট, নারদনিকদের উত্তরসূরি সোশ্যাল রেভোলিউশনারি, অ্যানার্কিস্ট প্রভৃতি সবাই হাজির থাকবে এবং একটি শ্রমিক পার্টি কংগ্রেসের মধ্যে দিয়ে তৈরি হবে। এটা প্রত্যাখ্যাত হয় কারণ এটা প্রলেতারিয়েত পার্টির বিলুপ্তি ঘটাত। এই কংগ্রেসে বিভিন্ন বুর্জোয়া পার্টির সম্পর্কে সম্পর্কের প্রশ্নে কংগ্রেস লেনিনের প্রস্তাব মেনে নেয়। লেনিন বলেন গণতান্ত্রিক বিপ্লবে নায়কের ভূমিকা পালন করতে হলে শ্রমিকশ্রেণিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করতে হবে। লেনিনের প্রস্তাবে কৃষ্ণশত পার্টি ও বৃহৎ জমিদার ও বুর্জোয়াদের পার্টির বিরুদ্ধে নির্মম সংগ্রাম প্রয়োজন। উদারনৈতিক বুর্জোয়াদের পার্টি কাদেতদের ভুয়ো গণতন্ত্রের উন্মোচনের কথা বলেন লেনিন। কৃষকদের যেন তারা বিভ্রান্ত করতে না পারে সেদিকে দৃষ্টি রাখার কথা বলা হয়। ছোট কৃষক ও পেটি বুর্জোয়াদের প্রতিনিধিত্বকারী ত্রুদভিদদের সঙ্গে জারবিরোধী লড়াইয়ে সমঝোতার সম্ভাবনা তিনি খোলা রাখেন। এই কংগ্রেসে লেনিন কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাচিত হন।

কংগ্রেসের পর বিপ্লবের মূল্যায়ন করে লেনিন বেশ কিছু লেখা লেখেন। মস্কো অভ্যুত্থানের শিক্ষা, ১৯০৫ সালের বিপ্লব প্রসঙ্গে বক্তৃতা, বিপ্লবের শিক্ষা প্রভৃতি এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিক্রিয়ার কঠিন সময়ে জার সরকারের ব্যাপক নির্যাতন নেমে আসে। হাজার হাজার বিপ্লবীর কারাবাস হয়। অনেককে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। পুলিশ শ্রমিক সংগঠনগুলি ভেঙে দিতে থাকে। ফলে পার্টির সভ্যসংখ্যা কমে যায়। সংগঠনগুলির আভ্যন্তরীণ যোগাযোগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। পার্টি পুরোপুরি আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যেতে বাধ্য হয়। বিপদ একদিকে যেমন জারের হামলার মধ্যে দিয়ে আসছিল, তেমনি আসছিল মতাদর্শগত হামলার মধ্যে দিয়ে। মেনিশেভিকরা এই পিছু হটার পর্বে নানারকম মতবাদ নিয়ে আসে যা পার্টিকর্মীদের ব্যবস্থার কাছে আত্মসমর্পণের পথ দেখায়, এমনকী সমগ্র সংগঠনের অস্তিত্বকেই বিপন্ন করে তোলে। লেনিন ও বলশেভিকরা বলেছিলেন হামলার মুখে পশ্চাদপসরণ করতে হলেও তা করা দরকার সুশৃঙখলভাবে, বাহিনী অটুট রেখে। বিপ্লবের জন্য তুচ্ছতম সব মামুলি কাজও গুরুত্বের সঙ্গে করে যাওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় দ্যুমা বা পার্লামেন্টে বক্তৃতা দেবার যে কোনও সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নিতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন, বিমা তহবিল, সমবায়, শ্রমিক ক্লাবগুলোতে নিয়মিত কাজ করা দরকার। লেনিন আইনি পদ্ধতিতে কাজ ও বেআইনি কাজের মধ্যে উপযুক্ত মেলবন্ধনের প্রয়োজনীয়তার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।

অন্যদিকে মেনশেভিকরা হাজির করে দমনের পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে পার্টির কর্মসূচি ও বৈপ্লবিক ধ্বনি পরিহার করার লাইন। বিপ্লবে আস্থা ছেড়ে বুর্জোয়াদের সঙ্গে আপস করে নেওয়ার কথা ছড়াতে থাকে তারা। এই প্রবণতাকে লেনিন চিহ্নিত করেন লিকুইডেশনিজম বা বিলোপবাদ বলে। অর্থাৎ প্রলেতারিয়েতের পার্টি সংগঠন ও আদর্শকেই বিলোপবাদীরা লুপ্ত করে দিতে চায়।

মেনশেভিকদের এই বিলোপবাদী লাইনের উল্টোদিকে বলশেভিকদের একাংশের মধ্যে পাল্টা উগ্রবাদ মাথাচাড়া দেয়। তারা প্রকাশ্য ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকলাপ সহ সমস্ত প্রকাশ্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। এমনকী দ্যুমা বা পার্লামেন্টে নির্বাচিত সোশ্যাল ডেমোক্রাটদের প্রত্যাহারের দাবি জানায়। এই অংশটিকে অৎজোভিস্ট বা প্রত্যাহারপন্থী আখ্যা দিয়ে লেনিন এদের কড়া সমালোচনা করেন। তিনি বলেন বৈধ কাজ বর্জন করলে পার্টি জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে, পরিণত হবে একটি রুদ্ধদ্বার সংগঠনে। নতুন বিপ্লবী জোয়ারের জন্য শক্তি সংগ্রহে সক্ষম হবে না। লেনিনের মত ছিল বিলোপবাদী এবং প্রত্যাহারপন্থীরা সত্যকারের বিপ্লবী নয়। প্রলেতারিয়েতের পেটিবুর্জোয়া সহযোগী মাত্র। প্রত্যাহারপন্থী তথা বৈধ কাজের সমালোচনাপন্থীদের বিরুদ্ধে খুব কঠোর সমালোচনা করে পরবর্তীকালে লেখা ‘ইনফ্যানটাইল ডিসঅর্ডার অব লেফট উইং কমিউনিজম’ বইতে লেনিন যে কথা লিখেছিলেন তা এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। “যারা বড় বড় বিপ্লবী বুলি আঁকড়ে থাকে অথচ প্রতিদিনকার মামুলি কাজটা চালাতে পারে না ও চালাতে চায় না, পার্টি তাদের দূর করে দেয়।” ধর্ম ও ভাববাদের দিক থেকেও মার্কসীয় মতাদর্শকে বিপথে চালিত করার বেশ কিছু প্রবণতা দেখা যায়। এমনকী মার্কসবাদকে ধর্মের একটা নতুন রূপ হিসেবে কল্পনা করে কোনও কোনও মহল থেকে লেখা হতে থাকে। এইসমস্ত বিতর্কের প্রেক্ষিতে বস্তুবাদী দর্শনিক প্রস্থানকে সবলে সামনে আনা ও কুহেলিকার জাল ছেঁড়ার প্রয়োজনে দর্শন শাস্ত্রের আঙিনায় পদার্পণ করেন লেনিন। প্রচুর পঠন, বিশ্লেষণ, অধ্যাবসায়ের ফল হিসেবে প্রকাশিত হয় “বস্তুবাদ ও প্রত্যক্ষ বিচারবাদ” নামে তাঁর একেবারে অন্য ধরনের একটি বই। ১৯০৯ সালে প্যারিসে আয়োজিত হয় রুশ সোশ্যাল ডেমোক্রেটিক লেবার পার্টির পঞ্চম কংগ্রেস। বিলোপবাদী ও প্রত্যাহারপন্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন লেনিন এবং সম্মেলনে এ অবস্থান স্বীকৃতি পায়।

স্থিতাবস্থার এই পর্বে লেনিন বলশেভিকদের কৃষি কর্মসূচির দিকটি নিয়ে বিশেষ পরিশ্রম করেন। ‘সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কৃষি কর্মসূচি’ বইটিতে তার প্রমাণ আছে। তিনি ব্যাখ্যা করে বোঝান কেন জমির ওপর পুঁজিপতি ও জমিদারদের মালিকানা থাকা উচিৎ নয়, জারতন্ত্রের উচ্ছেদের পর তা রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেওয়া উচিৎ বিনা খেসারতে কৃষকদের ব্যবহারের জন্য।

 

নতুন জোয়ারের পর্ব ও মতাদর্শগত সক্রিয়তার লক্ষ্যে বলশেভিক পার্টি স্কুলের আয়োজন

১৯১০ সাল থেকেই আবার বিক্ষোভ আন্দোলনের একটা পর্বের লক্ষণ দেখা যায় এবং স্থিতাবস্থা কাটতে আরম্ভ করে। রাশিয়ায় ফের শ্রমিক আন্দোলনের সজীবতা দেখা দেয়। পিটার্সবুর্গ, মস্কো ও অন্যান্য বড় শহরে ধর্মঘট, মিছিল, সভা ও অন্যান্য রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপ শুরু হয়ে যায়। নতুন জোয়ারের আসন্ন পর্বকে অনুমান করে লেনিন পার্টির অগ্রণী কমরেডদের তাত্ত্বিক প্রশিক্ষণের দিকে বিশেষ জোর দেন। ১৯১১-তে প্যারিসে পার্টি স্কুলের এক বড় আয়োজন ছিল গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক কাজ। পিটার্সবুর্গ, মস্কো, সরমোভো, বাকু, তিফলিস সহ রাশিয়ার অনেকগুলি শহরের অগ্রণী বলশেভিকরা এই পার্টি স্কুলে অংশগ্রহণ করেন। এই পার্টি স্কুলে লেনিন অর্থশাস্ত্র নিয়ে ২৯টি, কৃষি প্রশ্নে ১২টি, রাশিয়ায় সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব ও প্রয়োগ নিয়ে ১২টি বক্তৃতা দেন। লেনিনের বক্তৃতার বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল বোধগম্যতা ও প্রাঞ্জলতা। অর্থশাস্ত্র ও দর্শনের দুরূহতম প্রশ্নগুলিকেও লেনিন আলোচনা করতেন শ্রমিকদের আয়ত্তাধীন ও বোধগম্য রূপে। পাঠের চরিত্র প্রায়ই হত সজীব আলাপের মতো। উপস্থিত সকলেই তাতে যোগ দিতেন। পড়াশুনো হত অনেক এবং বেশ খাটাখাটনি করে প্রস্তুতি নিয়ে। স্কুলের কাজে লেনিন খুব খুশি ছিলেন। এই পার্টি স্কুলটি ছিল ভবিষ্যতের বলশেভিক পার্টি স্কুল কমিউনিস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্বসূরি। এর আগেই ১৯১০ সালের ডিসেম্বর থেকে প্রকাশিত হতে শুরু করেছিল দুটি সংবাদপত্র। পিটার্সবুর্গ থেকে ‘জভেজদা’ বা ‘তারকা’ এবং মস্কো থেকে ‘মিসল’ বা ‘ভাবনা’। জভেজদার পরিচালনার সঙ্গে লেনিন ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত ছিলেন এবং সেটি সংগ্রামী মার্কসবাদী সংবাদপত্র হিসেবেই জনপ্রিয় হয়। দুটি পত্রিকাতেই লেনিন নিয়মিত লিখতেন।

 

সংসদীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বয়কটকে কেন্দ্র করে বিতর্ক

১৯১২ সালে রাশিয়ায় চতুর্থ রাষ্ট্রীয় দ্যুমার নির্বাচন হয়। এর আগে তৃতীয় দ্যুমার নির্বাচনের সময়েই লেনিন নির্বাচন বয়কটের আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন। সেই সময় লেখা ‘এগেইনস্ট বয়কট’ প্রবন্ধেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও বয়কটের সিদ্ধান্ত কোন পরিস্থিতিতে কীভাবে নিতে হয় তার মূল নীতিমালা তিনি ব্যাখ্যা করেছিলেন। সেটি এই সংক্রান্ত বিতর্কে বিশেষভাবে মনে রাখার। কোনও প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানকে কমিউনিস্টদের সাধারণভাবে ব্যবহার করা উচিত, একথা ঠিক হলেও নির্দিষ্ট কোন পরিস্থিতিতে মার্কসবাদীরা এ ধরনের প্রচলিত প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই কাজের পক্ষে না দাঁড়িয়ে এরকম প্রতিষ্ঠানের আগমন সম্ভাবনার প্রতিরোধেও দাঁড়াতে পারে। কখন মার্কসবাদীরা এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থেকে লড়বে, আর কখন এর বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে? লেনিন নির্দিষ্টভাবে বলেছেন এই সিদ্ধান্ত এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের কার্যকরী হয়ে ওঠার নিশ্চয়তা অনিশ্চয়তার সম্ভাবনা বিচারের ওপর দাঁড়িয়ে থাকে, আর তাই বয়কটের প্রশ্নটি বারবার বিতর্ক তৈরি করে।

১৯০৫-এর বিপ্লবের পর রাশিয়ায় সাধারণ ধর্মঘট ও পোটেমকিন জাহাজে সেনা বিদ্রোহের মতো ঘটনার মধ্য দিয়ে প্রত্যক্ষ বিপ্লবী সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার মতো সম্ভাবনা ছিল। আর এই সংগ্রাম জয়যুক্ত হলে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের নয়া প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোকে ঠেকানো সম্ভব ছিল। এজন্যই বলশেভিকরা ১৯০৫-এর বিপ্লব পরবর্তী আন্দোলনের জোয়ারের মুখে দাঁড়িয়ে নির্বাচন বয়কট করে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথে এগিয়েছিল।

তৃতীয় দ্যুমার নির্বাচনের আগে রাশিয়ায় নাটকীয় কিছু পরিবর্তন হয়। ১৯০৫-এর বিপ্লবকে দমন করার সাফল্যর সূত্র ধরে পার্লামেন্ট ব্যবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেকাংশে বেশি প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। এই প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রকেই সামনে রেখে এসআররা নির্বাচন বয়কটের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন। লেনিনের সূত্রানুযায়ী স্পষ্টতই বয়কট ব্যাপারটা সংসদের প্রগতিশীল বা প্রতিক্রিয়াশীল চরিত্রের ওপর নির্ভর করছে না, আন্দোলনের বিশেষ অবস্থার ওপর নির্ভর করছে। কেন প্রথম ও দ্বিতীয় দ্যুমার নির্বাচনকে বলশেভিকরা বয়কট করেছিল, সে প্রসঙ্গে লেনিন জানিয়েছেন চূড়ান্ত বিপ্লবী পরিস্থিতির সামনেই এই বয়কটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তৃতীয় নির্বাচনের আগে সেই উত্তুঙ্গ বিপ্লবী পরিস্থিতি ছিল না। তাই তখন প্রত্যক্ষ বিপ্লবী সংগ্রামের পক্ষে না দাঁড়িয়ে লেনিন দ্যুমা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। কমিউনিস্টরা নিজেদের আন্দোলন সংগ্রামের শক্তি দুর্বলতার প্রেক্ষিত থেকেই কোনও প্রতিষ্ঠান বা লড়াই আন্দোলনকে দেখবে, সেই প্রতিষ্ঠানের চরিত্র বিচার তার সিদ্ধান্ত গ্রহণে তুলনায় গৌণ— এগেইনস্ট বয়কট এরকম একটা নির্দেশিকাই তুলে ধরে।

চতুর্থ দ্যুমার নির্বাচনে জোরদার প্রচারাভিযানের ওপর লেনিন জোর দেন। এর মধ্যে দিয়ে জনগণের সঙ্গে পার্টির সম্পর্ক বৃদ্ধি ও পার্টি সংগঠনগুলিকে চাঙ্গা করা সম্ভব হবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। লেনিন এও লেখেন, “নির্বাচনের ফলাফলের ওপর পার্টি নির্মাণের ব্যাপারটা অনেকটা নির্ভর করছে।” নির্বাচনে বলশেভিকরা তিনটি মূল দাবি হাজির করে। গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র, ৮ ঘণ্টা কর্মদিবস, জমিদারদের সমস্ত জমি বাজেয়াপ্তকরণ। নির্বাচনে শ্রমিক এলাকাগুলিতে সাফল্যও আসে। রাশিয়ার প্রলেতারিয়েতদের চার পঞ্চমাংশ যেখানে কেন্দ্রীভূত এমন ছয়টি শিল্প গুবের্নিকায় শ্রমিকদের যে প্রতিনিধিরা (শ্রমিক কুরিয়া বা শ্রমিক প্রতিনিধিদের জন্য নির্দিষ্ট আসন) রাষ্ট্রীয় দ্যুমায় নির্বাচিত হয়, তারা সবাই বলশেভিক। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্যুমার মঞ্চ প্রচারের কাজে ব্যবহারের বিষয়ে খুঁতিনাটি তালিম দিতেন লেনিন। বলশেভিক প্রতিনিধিরা ক্রাকভে লেনিনের কাছে নিয়মিত পরামর্শের জন্য আসতেন, লেনিন তাদের জন্য নিয়মিত নোট তৈরি করে পাঠাতেন। দ্যুমায় ছজন বলশেভিক প্রতিনিধি ছাড়াও ছিলেন সাতজন মেনশেভিক প্রতিনিধি এবং নানা বিষয়ে তাদের মধ্যে বিতর্ক হত। প্রাভদার পাতায় লেনিন বলশেভিকদের পক্ষ থেকে সেইসব বিতর্কের চরিত্র বিশ্লেষণ করতেন নিয়মিতভাবে। লেনিন লেখেন, “বলশেভিক প্রতিনিধিদের চমৎকারিত্ব কথার ফুলঝুরিতে নয়, বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবী বৈঠকখানায় হাজিরা দেওয়ায় নয়, বরং শ্রমিক জনগণের সঙ্গে সম্পর্কে, সেই জনগণের মধ্যে আত্মোৎসর্গী কর্মে, ‘অবৈধ’ প্রচারে, সংগঠকের মামুলি ‘অদৃশ্য’ গুরুভার করতালিহীন অতি বিপজ্জনক কাজ চালিয়ে যাওয়ার মধ্যে।”

 

বিশ্বযুদ্ধ এবং বলশেভিকদের বৈপ্লবিক প্রলেতারীয় অবস্থান নিয়ে অন্যান্য সমাজ-গণতন্ত্রীদের সঙ্গে বিতর্ক

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার পরেই প্রলেতারিয় আন্তর্জাতিকতার ক্ষেত্রে পিছু হটার একটা পর্ব শুরু হয়। ইউরোপের বিভিন্ন সমাজ গণতান্ত্রিক দলগুলো নিজ নিজ দেশের যুদ্ধস্বার্থ তথা জাতীয় বুর্জোয়াদের লেজুড়বৃত্তি শুরু করে। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ভেঙে যায় কেননা শ্রমিকশ্রেণির বিভিন্ন দল নিজ নিজ দেশের পুঁজির স্বার্থে পরস্পরের শত্রু শিবিরে দাঁড়িয়ে যায়। ফ্রান্স, ইংলন্ড এবং বেলজিয়ামে সোশালিস্টরা সরাসরি সরকারে যোগ দেয়। জার্মানিতে সরকারে যোগ না দিলেও যুদ্ধ চালানোর জন্য ব্যয়বরাদ্দের পক্ষে ভোট দেয়। তারা প্রচার করে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম, সমস্ত দেশের শ্রমিকদের শ্রেণিঐক্য, তাদের আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ হল শান্তিকালীন সময়ের ব্যাপার। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কথা তাদের ভুলতে হবে। সব কিছুকে হতে হবে যুদ্ধের অধীন। রাশিয়ায় প্লেখানভের মতো সম্মানীয় মার্কসবাদীও এই ভুল পথ নেন। বলশেভিক পার্টি ও তার নেতা লেনিনের নেতৃত্ব এই নিরিখে সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হয়ে উঠেছিল। লেনিন ও বলশেভিকরা যুদ্ধের প্রথম থেকেই দ্বিধাহীনভাবে এই যুদ্ধকে সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বলে বর্ণনা করেন ও এটা স্পষ্ট করে দেন যে শ্রমিকদের কাজ নয় জাতীয়তাবাদের নামে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থকে মদত দেওয়া। দেশ বিদেশের প্রতিকুল স্রোত এবং অজস্র ধরপাকড় অত্যাচার নির্যাতনের মুখে দাঁড়িয়েও বলশেভিকরা তাদের যুদ্ধবিরোধী অবস্থানে অটুট থাকে। লেনিনের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল যুদ্ধের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করো। তিনি বললেন অপর দেশের যে সমস্ত মজুরিদাসেরা আমাদের ভাই তাদের বিরুদ্ধে নয়, অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরতে হবে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া সরকারের বিরুদ্ধে। যুদ্ধের সময়েও প্রলেতারীয় বিপ্লবের আহ্বানকে ভুলে যাওয়া চলে না। লেনিন আহ্বান রাখলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধে পরিণত করার পক্ষে, যা সংগঠিত হবে নিজ নিজ দেশের বুর্জোয়াদের বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি ও মেহনতি জনতার বিদ্রোহের মধ্যে দিয়ে। ‘ইউরোপীয় যুদ্ধে বিপ্লবী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির কর্তব্য’, ‘সমাজতন্ত্র ও যুদ্ধ’ প্রভৃতি বইতে লেনিনের এই সমস্ত চিন্তা স্পষ্টভাবে প্রকাশিত হয়েছে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন সময়ে দুনিয়া প্রবেশ করল তাকে অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে লেনিন লেখেন ‘ইম্পিরিয়ালইজম: দ্য হায়েস্ট স্টেজ অব ক্যাপিটালিজম’ (সাম্রাজ্যবাদ: পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়) নামক ক্লাসিকটি। এই বইতে লেনিন দেখান সাম্রাজ্যবাদের আমলে দেখা দেয় বড় বড় একচেটিয়া কারবার ও পুঁজিপতিদের জোট। এই সাম্রাজ্যবাদকে তাই লেনিন বলেন একচেটিয়া পুঁজিবাদ। বিশ্বের কাঁচামালের উৎস, পণ্যোৎপাদন ও বাজারের একটা বৃহৎ অংশ দখল করে নেয় একচেটিয়া মালিকেরা। বুর্জোয়া রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রভুত্ব করতে থাকে তারা, সরকারগুলির ওপর নিজেদের অভিপ্রায়কে চাপিয়ে দেয়। মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশ নিজেদের মধ্যে বন্তন করে নেয় প্রায় সারা বিশ্বকে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিকাশের অসমতা বৃদ্ধি পায়। মুনাফার তাড়নায় সাম্রাজ্যবাদীরা শ্রমিক ও সমস্ত মেহনতিদের শোষণ বাড়িয়ে তোলে, তাদের অবস্থা হয়ে ওঠে অসহ্য। বিপ্লবের আবশ্যিকতা বুঝতে শুরু করে প্রলেতারিয়েত। সেই সঙ্গে মুষ্টিমেয় সাম্রাজ্যবাদী দেশের দ্বারা নিপীড়িত যে উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে কোটি কোটি লোকের বাস তাদের সঙ্গে বিরোধ প্রখর হয় সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির। লেনিন দেখান কীভাবে পুঁজিবাদ ক্রমশ হয়ে উঠেছে প্রতিক্রিয়াশীল, সমাজের বিকাশের পথে এক মহা বিঘ্ন। মানবসমাজের সামনে অত্যাবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে সমাজতন্ত্রের পথে হাঁটা অথবা উপনিবেশ, একচেটিয়াদের বিশেষ সুবিধা, সব ধরনের জাতীয় পীড়নে অভ্যস্ত হয়ে পড়া। সাম্রাজ্যবাদ মানবসমাজকে এক বিশেষ অর্থে সমাজতন্ত্রের কাছাকাছি নিয়ে আসে।

 

১৯১৭-র ফেব্রুয়ারি বিপ্লব ও তার চরিত্র নিয়ে বিতর্ক

বলশেভিকরা যুদ্ধ শুরুর সময় থেকেই দৃঢ়ভাবে এই সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরোধিতা করে যে শান্তির আহ্বান রাখে তা রাশিয়ার বুকে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। যুদ্ধের ফ্রন্টে পরাজয়, ধ্বংস ও দুর্ভিক্ষের প্রেক্ষিতে উদঘাটিত হয়ে উঠল জারতন্ত্রের পচন। ১৯১৭-র প্রথম থেকেই পরিস্থিতি নাটকীয় মোড় নেয়। ১৯০৫-এর ৯ জানুয়ারি রক্তাক্ত রবিবারের বার্ষিকী পালনের দিনটিতে পেত্রোগাদ, মস্কো, বাকু, নিজনি সহ রাশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে বিরাট বিরাট মিছিল হয়। দিন দিন বেড়ে উঠতে থাকে শ্রমিকদের বিক্ষোভ আন্দোলন।

১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বলশেভিক পার্টির আহ্বানে রাশিয়ার শ্রমিকেরা একটি রাজনৈতিক সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এই আহ্বান অভূতপূর্ব সাফল্যলাভ করে এবং এতে যোগ দেয় দুই লক্ষের বেশি শ্রমিক নারীপুরুষ। ধর্মঘট বেড়ে ওঠে এক পরাক্রান্ত রাজনৈতিক শোভাযাত্রায়। ‘স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হোক। যুদ্ধ শেষ হোক। রুটি চাই।’– এই স্লোগান নিয়ে রাজধানীর শ্রমিকেরা পথে নামে। ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভকে সৈন্য দিয়ে দমনের চেষ্টা করে জার সরকার, কিন্তু তার আর সে সাধ্য ছিল না। উত্থিত শ্রমিকদের সঙ্গে যোগ দেয় সৈন্যরা, তাদের সঙ্গে একত্রে দাঁড়ায় জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে। বিপ্লব আসন্ন— লেনিনের এই ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তব সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। পেত্রোগাদ শ্রমিক ও সৈন্যদের বিপ্লবী উদ্যোগকে সমর্থন করে মস্কো ও অন্যান্য শহরের সৈনিকেরা। ১৫ মার্চ ১৯১৭ রাষ্ট্রীয় দ্যুমার সাময়িক কমিটির প্রতিনিধিরা জারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সিংহাসন ত্যাগ করতে বলে। জার স্বৈরতন্ত্রের পতন হয়। রাশিয়ায় সম্পন্ন হয় বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব। জারতন্ত্রের উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয় সাময়িক বিপ্লবী সরকার গঠন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, আট ঘণ্টার কর্মদিবসের প্রবর্তন, জমিদারদের জমি বাজেয়াপ্তকরণ ও যুদ্ধ বন্ধের আহ্বান জানিয়ে ঘোষণাপত্র প্রকাশ করে বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি।

বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে দেখা দেয় শ্রমিক ও সৈনিক প্রতিনিধিদের সোভিয়েতগুলি। এই সোভিয়েতগুলিতে মেনশেভিক এবং এসআর বা সোশালিস্ট রিভোলিউশনারারিরাও ছিল। তাদের অবস্থানগত দৌর্বল্যের সুযোগে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার দখল নিতে পারে বুর্জোয়ারাই। রাশিয়ায় এক দ্বৈত ক্ষমতার সৃষ্টি হয়। সাময়িক কেন্দ্রীয় সরকারের বুর্জোয়া আধিপত্য এবং এলাকায় এলাকায় সোভিয়েতগুলির ক্ষমতার মধ্যে দিয়ে প্রলেতারিয়েত ও কৃষকদের বিপ্লবী গণতান্ত্রিক শক্তির আধিপত্য। বিপ্লবের ফলে দেশে নতুন পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। স্বৈরতন্ত্রের অবসান হল। ঘোষিত হল রাজনৈতিক স্বাধীনতা, বাকস্বাধীনতা, সংবাদপত্র প্রকাশ, সভা সমাবেশ ইত্যাদির স্বাধীনতা।

 

বুর্জোয়া সরকারের চরিত্র নিয়ে বিতর্ক

জারতন্ত্রের পতনের পর যে বুর্জোয়া সরকার ক্ষমতায় আসীন হয় তা বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য গণতান্ত্রিক পদক্ষেপ নিলেও যুদ্ধ বন্ধ করার পক্ষপাতী ছিল না। অক্টোব্রিস্ট এবং কাদেতদের সরকারের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে সোশ্যাল রিভোলিউশনারি ও মেনশেভিকরাও। তারা তখনও সমাজতন্ত্রের দিকে হাঁটতে রাজি ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল জারতন্ত্রের পতনের পর বুর্জোয়া গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা দরকার, কারণ রাশিয়া তখনও সমাজতন্ত্রের জন্য প্রস্তুত নয়। লেনিন এই পরিস্থিতিতে বলশেভিকদের কার্যপ্রণালী নির্ধারণের জন্য বিকশিত ও বিকাশমান দিকগুলির বিশ্লেষণ করেন। তিনি বলেন বিপ্লবের প্রথম পর্যায়টিই কেবল সমাপ্ত হয়েছে এবং তার মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা গেছে বুর্জোয়াদের হাতে। তিনি স্লোগান তুললেন সোভিয়েতগুলির হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়ার জন্য। বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তকে কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য লেনিন দীর্ঘদিন পর অনেক ঝুঁকি নিয়ে চলে এলেন রাশিয়ায়। পেত্রোগাদে তাঁকে ১৬ এপ্রিল ১৯১৭-তে অভ্যর্থনা জানাল হাজার হাজার শ্রমিক। এর পরের দিনই লেনিন বলশেভিকদের সভায় প্রলেতারিয়েতের কর্তব্য নির্দেশ করে একটি বক্তৃতা দেন। এটি ‘এপ্রিল থিসিস’ নামে বিখ্যাত। নতুন পরিস্থিতির বিশ্লেষণ ও কার্যাবলি নির্ধারণে এই থিসিসের গুরুত্ব ছিল বিরাট। এখানে বুর্জোয়াদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছে যে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব তা থেকে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য সংগ্রামের প্রত্যক্ষ ও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা হাজির করলেন লেনিন। বললেন ক্ষমতা যাওয়া চাই শ্রমিকশ্রেণি ও গরীব কৃষকের হাতে। সব ক্ষমতা চাই সোভিয়েতের হাতে, সাময়িক সরকারকে কোনও সমর্থন নয়— এই রণধ্বনি তিনি স্থির করেন। তিনি বোঝালেন কেবল সোভিয়েতগুলির রাজই পারে জনগণের জন্য শান্তি, কৃষকদের জমি এবং ক্ষুধিতদের রুটি দিতে। সেইসঙ্গে তিনি এও সতর্ক করে দিলেন এখনই সাময়িক সরকারকে উচ্ছেদের ডাক না দিতে, কারণ তাদের সমর্থন করছে সোভিয়েতগুলি, আর তাদের বিশ্বাস করে জনগণ। লেগে থেকে ধৈর্য সহকারে মেহনতিদের স্বপক্ষে টানতে হবে বলশেভিকদের, সোভিয়েতগুলিতে সংখ্যাধিক্য অর্জন করে সেগুলিকে বলশেভিক সোভিয়েত করে তুলতে হবে।

লেনিন প্রস্তাব দেন বলশেভিকদের নতুন পার্টি কংগ্রেস ডাকার জন্য, কেননা পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন হয়েছিল। পার্টি কর্মসূচির সংশোধন দরকার ছিল, কেননা এর আগের মূল দাবি জারতন্ত্রের উচ্ছেদ এর মধ্যেই সম্পন্ন হয়েছিল। লেনিনের প্রস্তাব ছিল পার্টির নতুন নাম হোক কমিউনিস্ট পার্টি। সারা পৃথিবীর বিপ্লবী কমিউনিস্টদের সামনে নতুন তৃতীয় আন্তর্জাতিক গঠনের প্রয়োজনিয়তা হাজির করার কথাও বলেন লেনিন।

জুন মাসের শুরুতে কৃষক প্রতিনিধিদের সারা রাশিয়া কংগ্রেসে বক্তৃতা দেন লেনিন। সেখানে তিনি জমিদারদের জমি দখলের আহ্বান জানান, ক্ষেতমজদুর ও গরীব কৃষকদের স্বাধীন সংগঠন গড়ার আবশ্যিকতা ব্যাখ্যা করেন। সভা সমিতিতে, বক্তৃতায়, পত্রিকার প্রবন্ধে সাময়িক সরকারের বিভিন্ন প্রতিবিপ্লবী নীতিকে তুলে ধরেন লেনিন, তাদের সঙ্গে সোশ্যালিস্ট রেভেলিউশনারি ও মেনশেভিকদের সমঝোতার স্বরূপ উদঘাটন করেন।

পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে ১৬ জুলাই পেট্রোগ্রাদের রাস্তায় শ্রমিক সৈনিকেরা সোভিয়েতের হাতে পূর্ণ ক্ষমতা অর্পণের দাবি নিয়ে রাস্তায় নামলে। কেরেনেস্কির নেতৃত্বাধীন সরকার সশস্ত্রভাবে এই মিছিলের মোকাবিলা করে ও রাজপথকে রক্তাক্ত করে তোলে। বলশেভিক পার্টি ও শ্রমিক সংগঠনগুলির ওপর আক্রমণ শুরু হয়। ১৮ জুলাই প্রাভদার অফিসে হামলা হয়। হামলার ঠিক আধ ঘণ্টা আগেই লেনিন হাজির ছিলেন সেখানে। অল্পের জন্য তিনি হামলার হাত থেকে রক্ষা পান। বহু বলশেভিককে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। এর মধ্যে দিয়ে দ্বৈত ক্ষমতার অবসান হল। সমস্ত ক্ষমতা চলে গেল বুর্জোয়াদের হাতে। কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্তক্রমে আত্মগোপন করেন লেনিন। সাড়ে তিন মাস সময় সাময়িক সরকারের হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি নিয়েই রাশিয়ায় থেকে তিনি গোপনে কাজ চালিয়ে যান। আগস্ট মাসের শুরুতে আধা গোপনে পেট্রোগ্রাদে পার্টির কংগ্রেস আয়োজিত হয়। লেনিন সরাসরি উপস্থিত না হলেও সম্মেলনকে আড়াল থেকে পরিচালনা করেন। কংগ্রেস সিদ্ধান্ত নেয় লেনিন সাময়িক সরকারের শমন মেনে আদালতে হাজিরা দেবেন না। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার আহ্বান রাখে পার্টি কংগ্রেস, কারণ বিকাশমান পরিস্থিতিতে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা দখল করা আর সম্ভব ছিল না বলেই মনে করা হয়।

সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ডাক দেওয়ার পর বুর্জোয়া রাষ্ট্রের প্রতি পার্টির মনোভাব কী হবে এবং প্রলেতারিয়েতের হাতে ক্ষমতা এলে কী ধরনের রাষ্ট্র গঠিত হবে— সেই সময়ের এই সব জ্বলন্ত প্রশ্নকে কেন্দ্র করে লেনিন লেখেন ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’ বা ‘স্টেট অ্যান্ড রেভেলিউশন’ নামে তার বিখ্যাত বইটি। এখানে লেনিন সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজমকে বিকাশের দুই পর্যায় হিসেবে গণ্য করেন ও সে সংক্রান্ত বিস্তারিত আলোচনা করেন।

 

বলশেভিকরা ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে কিনা সেই সংক্রান্ত বিতর্ক

সেপ্টেম্বর থেকে পরিস্থিতির চাকা আবার উল্টোদিকে ঘুরতে থাকে। জেনারেল কার্নিলভ বলশেভিকদের চূর্ণ করার লক্ষ্য নিয়ে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন পেত্রোগ্রাদ অভিমুখে। এর আগেই তিনি সোভিয়েতগুলিকে চূর্ণ করে, বিপ্লব ধ্বংস করে প্রতিবিপ্লবী নগ্ন সামরিক একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেন এবং সরকারের প্রতিক্রিয়াশীল অংশের মদত পেয়ে যান। তিনি ব্যাঙ্কার, শিল্পপতি, ও প্রতিবিপ্লবী পার্টিগুলির নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। মার্কিন, ব্রিটিশ ও ফরাসি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা কার্নিলভকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দেন। কার্নিলভ আশা করেছিলেন সেনাবাহিনী দ্রুত পেত্রোগ্রাদ দখল করে শ্রমিক ও বিপ্লবী গ্যারিসনের সেনাদের নিরস্ত্র করবে এবং বলশেভিকদের গ্রেপ্তার করবে। লেনিন এই ষড়যন্ত্র ও তার পরিসরের এক যথাযথ ও সম্পূর্ণ চিত্র উপস্থাপিত করেন। বলশেভিক পত্রিকায় তার লেখা অনেকগুলি প্রবন্ধ পরপর ছাপা হয়। কার্নিলভের ফৌজ আক্রমণ শুরু করলে প্রলেতারিয়েতদের সংগ্রামের পরিকল্পনা তিনি সেগুলিতে উপস্থিত করেন। কেরেনেস্কি সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শিথিল না করেও মূল লক্ষ্যবস্তু করা হয় কার্নিলভের প্রতিবিপ্লবী ক্যু প্রচেষ্টার ওপর। ৯ সেপ্টেম্বর বলশেভিকদের কেন্দ্রীয় কমিটি, তার সামরিক সংগঠন, পেত্রোগ্রাদ কমিটি, শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েতদের প্রতিনিধিরা সমস্ত শ্রমজীবী জনগণ ও সৈনিকদের প্রতি এক সম্মিলিত আবেদন প্রচার করে বিপ্লবী রাজধানীকে রক্ষার আবেদন জানায়।

কার্নিলভের বিরুদ্ধে রাজধানীর প্রলেতারিয়েতদের সংগঠিত করার ক্ষেত্রে পেত্রোগ্রাদের জেলা সোভিয়েতগুলি বিশেষ অবদান রাখে। শ্রমিকদের নিজস্ব মিলেশিয়া গঠন করা হয় ও বিপ্লবী শ্রমিকদের অগ্রবাহিনীর তালিকা তৈরি হয়। অস্থায়ী সরকারের কমিসারদের জেলা সোভিয়েত সমূহের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণাধীনে আনা হয়। প্রতিবিপ্লবীদের আটক করার জন্য ভ্রাম্যমান স্কোয়াড তৈরি রাখা হয়।

পেত্রোগ্রাদে শ্রমিকদের এক লাল রক্ষীবাহিনী তৈরি হয় যার সংখ্যা ছিল পনেরো হাজার। বিভিন্ন জেলার কারখানাগুলিতে গঠিত হয় শ্রমিকদের অগ্রবাহিনী। শ্রমিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় কার্নিলভের বাহিনীর মোকাবিলা করার জন্য।

কার্নিলভের বাহিনীর বিরুদ্ধে শ্রমিক জনগণের সংগ্রামে বলশেভিকরা নেতৃত্ব দিল। কয়েকদিনের মধ্যেই কার্নিলভ বাহিনী বিধ্বস্ত হল। এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে জনগণের ব্যাপক অংশ সবেগে বাঁক নিতে শুরু করল বলশেভিকদের দিকে। সোভিয়েতগুলির পুনঃনির্বাচনে বলশেভিকরা পেতে থাকল অধিকাংশ ভোট। পেত্রোগ্রাদ, মস্কো সহ দেশের অধিকাংশ গুরূত্বপূর্ণ সোভিয়েত হয়ে উঠল বলশেভিক। ভয় পেয়ে বুর্জোয়ারা প্রচার করা শুরু করল ক্ষমতা দখল করলেও বলশেভিকরা তা দু সপ্তাহও ধরে রাখতে পারবে না। এর জবাবে লেনিন লিখলেন ‘বলশেভিকরা কি রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে রাখতে পারবে’ শীর্ষক প্রবন্ধ। তাতে তিনি বললেন সোভিয়েতগুলির ওপর নির্ভর করে বলশেভিকরা যে ক্ষমতা দখল করবে তা শুধু স্থায়ী হবে তাই নয়, একমাত্র তাই পারবে দেশের অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে পুনর্গঠন করতে। তার জন্য প্রয়োজনীয় সবকটি পূর্বশর্তই বর্তমান।

 

অভ্যুত্থান সংক্রান্ত বিতর্ক ও রুশ বিপ্লব

অক্টোবরের মাঝামাঝি লেনিন ফিনল্যান্ড থেকে পেত্রোগ্রাদে ফিরলেন। শুরু করলেন সশস্ত্র অভ্যুত্থানের নির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এরপর ঘটনা এগোতে লাগল ঝড়ের গতিতে। ২০ অক্টোবর তিনি চিঠি পাঠান বলশেভিকদের নগর সম্মেলনে। ২১ অক্টোবর উত্তরাঞ্চলের সোভিয়েতগুলির কংগ্রেসের অংশগ্রহণকারীদের কাছে লেখা চিঠিতে বিশেষ জোরের সঙ্গে তিনি বলেন চূড়ান্ত আঘাতের সময় এসে গেছে, বিলম্ব হবে মৃত্যুতুল্য। ২৩ অক্টোবর ১৯১৭ রুশ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক শ্রমিক পার্টির (বলশেভিক) কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনে অবিলম্বে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের প্রস্তুতির জন্য লেনিনের প্রস্তাব গৃহীত হল।

২৯ অক্টোবর শ্রমিক সংগঠনগুলির প্রতিনিধিসহ কেন্দ্রীয় কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে লেনিন ফের রিপোর্ট পেশ করেন এবং অভ্যুত্থান শুরুর জন্য দৃঢ়ভাবে দাবি করেন। রুদ্ধদ্বার অধিবেশনে অভ্যুত্থান পরিচালনার জন্য নির্বাচিত হয় সামরিক বিপ্লবী কেন্দ্র, যাতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন স্তালিন এবং আরও কয়েকজন। লেনিন ও পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পরিচালনায় অভ্যুত্থানের পরিকল্পিত প্রস্তুতি চলে দেশের সর্বত্র। প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়ে এলাকায় এলাকায় পৌঁছয় কেন্দ্রীয় কমিটির চিঠি ও নির্দেশনামা। পেত্রোগ্রাদ ও মস্কোর বলশেভিক সম্মেলনে অভ্যুত্থান শুরুর পক্ষেই ভোট পড়ে। অনুরূপ সিদ্ধান্ত নেয় দেশের একশোর বেশি প্রদেশ, জেলা, গুবের্নিয়া, আঞ্চলিক ও সামরিক পার্টি সম্মেলন। সোভিয়েতগুলির রাজের চূড়ান্ত সংগ্রামে প্রস্তুত হচ্ছিল পার্টি। সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আয়োজনে পার্টি সংগঠনগুলিকে সাহায্যের জন্য এলাকায় এলাকায় পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিনিধি। অবিরাম জনগণের গভীরে থাকার জন্য লক্ষ লক্ষ শ্রমিক, কৃষক ও সেনাকে একটি একক বিপ্লবী ফৌজে সংহত করতে পার্টি সক্ষম হয়। এইসময়েই জিনোভিয়েভ এবং কামেনেভ একটি পত্রিকায় কেন্দ্রীয় কমিটির অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্তের সঙ্গে তাদের ভিন্নমত লিখিত আকারে প্রকাশ করে দেন। এর ফলে সরকারের কাছে অভ্যুত্থান পরিকল্পনার খবর চলে যান। লেনিন তাদের পার্টি থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন। এইসময় ট্রটস্কি অভ্যুত্থান শুরুর সময়কে সোভিয়েতগুলির পরবর্তী কংগ্রেস পর্যন্ত মুলতুবি রাখার কথা বলেন, যা হওয়ার কথা ছিল ৭ নভেম্বর।

৬ নভেম্বর ১৯১৭ প্রাভদার ছাপাখানায় হামলার হুকুম দিল সাময়িক সরকার। পাল্টা বার্তা পাঠাল যুদ্ধ জাহাজ ‘অরোরা’, সাময়িক সরকারের রক্ষীদের পেত্রোগ্রাদে ঢুকতে দেবে না। বৈপ্লবিক সাঁজোয়া বাহিনীগুলো মিলিত হতে থাকল বিপ্লবের হেড কোয়ার্টার স্মোলনি ইন্সটিটিউটের কাছে। লেনিন চিঠি লিখলেন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অভ্যুত্থানে বিলম্ব মানে সত্যিই মৃত্যু। ৭ নভেম্বর সকালে অভ্যুত্থানকারীদের দখলে যায় টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ভবন, রেডিও স্টেশন। নেভার ওপরের সব রেলসেতু, রেল স্টেশন এবং রাজধানীর অতি গুরুত্বপূর্ণ সব প্রতিষ্ঠান। ৭-৮ নভেম্বর ১৯১৭ মধ্যরাত্রের পর অভ্যুত্থানীদের হাতে এল প্রধান ডাকঘর। নিকলায়ভস্কি স্টেশন আর বিদ্যুৎ স্টেশন। সকালে নৌবহরের নাবিকরা দখল করল রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্ক। ৮টায় দখল হল ওয়ারশ স্টেশন। যুদ্ধ জাহাজ ‘অরোরা’ এসে দাঁড়াল শীতপ্রাসাদে কামান দাগার আওতার মধ্যে। সকালের মধ্যেই শহর চলে এল অভ্যুত্থানকারীদের হাতে। ৮ নভেম্বর ১৯১৭ সকালে সামরিক বৈপ্লবিক কমিটি গ্রহণ করল লেনিনের আবেদন রাশিয়ার নাগরিকদের প্রতি— সেখানেই ঘোষিত হল সাময়িক সরকারের উচ্ছেদ ঘটেছে।

‘আরোরা’ থেকে শীতপ্রাসাদে গোলাবর্ষণ শুরু হল, সাময়িক সরকারের প্রধানমন্ত্রী কেরেনস্কির পালিয়ে গেলেন। রাত ১০টা ৪০ মিনিটে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের ভরা জোয়ারে স্মোলনিতে শ্রমিক ও সৈনিকদের দ্বিতীয় সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেসের উদ্বোধন হল। ৯ নভেম্বর ১৯১৭ রাত ২টা ১০ মিনিটে সাময়িক সরকারের মন্ত্রীরা গ্রেপ্তার হলেন। ১০ নভেম্বর ১৯১৭ ভোর ৫টা ১৫ মিনিটে শেষ হল সারা রুশ সোভিয়েত কংগ্রেস। ঘোষিত হল শান্তির ডিক্রি, ভূমির ডিক্রি, বলা হল— অবিলম্বে জমির ওপর জমিদারি মালিকানা উচ্ছেদ হবে। গঠিত হল বিশ্বের প্রথম শ্রমিক-কৃষকের সরকার, জন কমিশার পরিষদ। লেনিন নির্বাচিত হলেন তার প্রধান। জন্ম হল পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশের।

বিভিন্ন ডিক্রি জারি করে জনগণের দীর্ঘকালীন দাবিদাওয়াগুলির সমাধানের কাজ শুরু হয় সরকার প্রতিষ্ঠার দিন থেকেই। জমি, শান্তি ও রুটির শ্লোগানে বলশেভিকরা জনগণকে সংগঠিত করেছিল। নতুন সরকারের প্রথম পদক্ষেপ ছিল জমি ও শান্তির জন্য ডিক্রি জারি করা। ‘শান্তির ডিক্রি’র মাধ্যমে যুদ্ধের অবসান ঘটানোর জন্য অবিলম্বে শান্তি আলোচনা শুরুর ডাক দেওয়া হয়। ‘জমির ডিক্রি’র মাধ্যমে খোদ কৃষককে জমির ওপর অধিকার প্রদান করা হয়। এরপর একে একে জারি করা অন্যান্য ডিক্রিগুলো ছিল আট ঘণ্টা শ্রমসময়, শ্রমিকদের হাতে কারখানার নিয়ন্ত্রণ, শ্রেণিভেদ ও সামাজিক মর্যাদাভেদ নিষিদ্ধকরণ, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ, সেনাবাহিনীতে কর্মরত সমস্ত সেনার সমান অধিকার প্রদান, নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষা, অবৈতনিক চিকিত্সা ও স্বাস্থ্যরক্ষা এবং সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্রের নতুন ইউনিয়ন গঠন ইত্যাদি সম্পর্কিত।

রুশ বিপ্লব ছিল খাঁটি গণবিপ্লব। বুর্জোয়া ব্যবস্থার বিলোপ ঘটল এর মধ্য দিয়ে। মানব ইতিহাসে প্রথম প্রতিষ্ঠিত হল প্রলেতারিয়েতের একনায়কত্ব, স্থাপিত হল শ্রমিক কৃষকের রাষ্ট্র। নভেম্বর বিপ্লব শুধুমাত্র একটা রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলছিল না। রাশিয়ার জনগণের জীবনে এক গভীর সামাজিক অর্থনৈতিক রদবদল সূচিত করল এই বিপ্লব, শুরু হল দেশের বৈপ্লবিক পুনঃনির্মাণ— নতুন সমাজতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সূত্রপাত হল। আর বিপ্লবের পথচলার দিনগুলিতে বিভিন্ন বিষয়ে যে মতাদর্শগত বিতর্কগুলি হল তা আগামী দিনের কমিউনিস্ট ও বাম গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দিশারী হয়ে থাকল।


আকর:

  1. কালেক্টেড ওয়ার্কস – ভ্লাদিমির ইলিচ লেনিন
  2. লেনিন জীবনী – মার্কসীয় লেনিনীয় ইনস্টিটিউট, সোভিয়েত রাশিয়া প্রকাশিত
  3. সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস – প্রগতি প্রকাশন, মস্কো
  4. Bolshevism: Road to Revolution – Alan Wood (Aakar Books)
  5. Reconstruction Lenin: An intellectual Biography – Tamas Krausz
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4859 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...