মৃত পাখিদের গান — ১৭শ পর্ব

অবিন সেন

 

পূর্ব প্রকাশিতের পর

পর্বদুই

পাঁচ

আরও দুদিন কেটে গিয়েছে। রুবি পালের কোনও হদিস করে উঠতে পারেনি পুলিশ। সকালেই সিপি সহেব ডেকে বেশ ধমক দিয়েছে অর্ককে। আল্টিমেটামই বলা যায়। নিজের চেম্বারে ফিরে এসে নিজের মনে মনে গজগজ করছিল সে। এদিকে আর্মস চোরাচালানেরও কোনও ব্রেক-থ্রু নেই। নিজেকে খুব অধৈর্য লাগছিল তার। রুবি পাল নিখোঁজ হবার পরে অর্কর উপরে বেশ ক্ষুব্ধ হয়েছে রুচিরা। গতকাল রাত্রে সে প্রায় রাগ করেই ফোন রেখে দিয়েছিল। রুচিরা যেন অর্কর অযোগ্যতা সম্পর্কে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে। তার কথায় অর্ক রেগে গিয়েছিল। রেগে গিয়ে ফোন রেখে দিয়েছিল অর্ক। নানারকম চিন্তায় রাতে তার ভালো ঘুম হয়নি। সকাল থেকেই তার তার মাথার ভিতরটা যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছিল।

সে অধীর গাঙ্গুলিকে ডাকতে বেয়ারাকে পাঠায়। বেয়ারা ফিরে এসে বলে ‘গাঙ্গুলি সাহেব ঘরে নেই, কোথাও বেরিয়েছেন।’

অর্ক বিরক্ত হল যেন। সে একবার প্রবালকে ফোন করল। প্রবালও ফোন ধরল না। প্রবাল কী কিছু করছে না! সে কিছু ভেবে উঠতে পারছে না। অগত্যা সে তন্ময় সামন্তকে একবার ফোন করল। সামন্তর সঙ্গে কথা বলে সে মোটেই খুশি হল না। সে ভেবে পাচ্ছিল না এখন তার কী করা উচিত! এমন অসহায় অবস্থায় সে কখনও পড়েনি। তখনি তার মোবাইলে একটা এসএমএস ঢুকল।

রুচিরা লিখেছে,

“গোয়িং টু টালিগঞ্জ স্টুডিও টু মিট সামওয়ান।”

অর্কর রাগ তখনও পড়েনি। সে শুধু টেক্সট করল,

“ওকে।”

আবার তার ফোনটা বেজে উঠল। অধীর ফোন করেছে,

স্যার, গুড নিউজ আছে একটা।

ওয়েল। কী সেটা?

কালীঘাটের রেড-লাইটেড এরিয়া থেকে বেশ কিছু চোরাই আর্মস উদ্ধার হয়েছে।

কোনও অ্যারেস্ট?

না স্যার। আপনি কি স্যার প্লিজ আসবেন একবার?

অর্ক তখনই রাজি হয়ে গেল। সে যেন এমনই কিছু চাইছিল। সে বাইরে বেরিয়ে এসে দেখল, আকাশ ছেয়ে দলে দলে মেঘ জুটেছে। অনেকদিন পরে দুপুরে এমন মেঘের দাপট দেখল সে। এখুনি বৃষ্টি আসবে বোধহয়। দুপুর যানজট কম থাকায় তাড়াতাড়িই পৌঁছে যেতে পারল সে। ছোট একতলা বাড়িটার সামনে পুলিশের জটলা। একটু তফাতে আরও কিছু মানুষজনের জটলা। অধীর ঘুরে ঘুরে দেখাচ্ছিল অর্ককে, কীভাবে কিচেনে চাল-ডালের ডাব্বার ভিতরে পিস্তলগুলো লুকানো ছিল।

কিছুক্ষণ পরে প্রবীর তাদের সঙ্গে এসে যোগ দিল। প্রবীর বলল,

আমরাও স্যার এই বাড়িটাকে আইডেনটিফাই করেছিলাম। এই বাড়িটাতে রুবি পাল সপ্তাহে দু দিন আসত। সন্ধ্যাবেলা।

অর্ক শুনে চমকে উঠল। তবে কী আর্মস চোরাচালান আর খুনগুলো কি একই রাস্তা ধরে চলেছে! কিন্তু কোথাও একটা ডেড এন্ড তাদের তদন্তকে থামিয়ে দিচ্ছে। সে বলল,

এই বাড়িটা কার জানা গেছে?

স্যার, হ্যামিলটন বলে এক টাউট এই বাড়িতে নিয়মিত আসা যাওয়া করত।

আর কেউ?

আরও লোক আসত। তবে এটাকে একটা বেশ্যাবাড়ি বলেই আশেপাশের লোকজন জানত। রুবি পাল আসত। তার সঙ্গে রাত কাটাতে আসত একটু হাই প্রোফাইলের কিছু লোকজন।

তাদেরকে ট্রেস করতে হবে তো?

আমরা করেছি স্যার। কয়েকজনকে। আজ রাতেই তাদের কাছে হানা দেব। তবে প্রমাণ নেই কোনও আমাদের হাতে।

আর হ্যামিলটন?

লোকটা যেন কোথাও উবে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে উদয় হয় তারপরে কোথায় হাওয়া হয়ে যায়। আমাদের হাতে কোনও ক্লু নেই। তার সম্ভাব্য একটা ছবি আছে। আমাদের সমস্ত সোর্সদের কাছে সেই ছবি ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

তাদের তদন্তের মাঝেই তুমুল বৃষ্টি নামল। এমনি প্রবল বৃষ্টি যেন সাপের বিষ ঝরে যাবে। সেই সঙ্গে মৃদু হাওয়া।

অর্কর হঠাৎ রুচিরার কথা মনে পড়ল। সে সেই বাড়িটার ভিতরে একটা ঘরে ঢুকল রুচিরাকে ফোন করবে বলে। ঘরটা ছোট একটা স্টোররুমের মতো। রুচিরাকে ফোন করে অর্ক অবাক হয়ে যায়। ফোন সুইচ অফ। তার তো ফোন সুইচ অফ থাকে না। অর্ক একটু অবাক হয়। অন্যমনস্কভাবে সে ঘরের চারপাশে তাকায়। একপাশে রাখা একটা বক্সের দিকে তার চোখ পড়ে যায়। এই বাক্সটা সে কোথায় দেখেছে? মোবাইল ফোনের ভিতর থেকে সে একটা ছবি বার করে বক্সটার সঙ্গে মিলিয়ে দ্যাখে। মনে মনে সে বলে, ঠিক তাই। একেবারে মিলে যাচ্ছে।

অর্ক বাক্সগুলো নেড়ে চেড়ে দেখল। বাক্সগুলোর গায়ে যেন মাটি লেগে আছে। গঙ্গার কাদা মাটি। তবে কি এই বাক্সগুলোও গঙ্গা পথে এসেছে! সে ফোন করে অধীরকে ডেকে দেখাল বাক্সগুলো। বাক্সগুলো নেড়েচেড়ে অধীর দেখল ভালো করে। বলল,

স্যার, গঙ্গার দিকটা আমাদের ভালো করে অনুসন্ধান করে দেখতে হবে। মনে হচ্ছে ওদিকেই কোথাও এই অস্ত্রপাচারের একটা ঘাঁটি আছে। সে মোবাইল ফোন বার করে গুগল ম্যাপে নিমতলা ঘাটের দিকে একটা এলাকা আঙুল দিয়ে দেখাল। ম্যাপটা দেখতে দেখতে অর্কর হঠাৎ চোখ আটকে গেল ম্যাপটার দিকে। সে বলল নিজের মনে,

গোলাবাড়ি গঙ্গার ঘাটের কাছেই তো রেখা দাশের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। তাই না!

অধীর ঘাড় নেড়ে সায় দিল।

অর্ক বলল,

আমার মনে হচ্ছে দুটো কেসের কোথাও একটা যোগসূত্র রয়েছে।

হ্যাঁ স্যার।

অধীর আপনি এক কাজ করুন, ওই দুটো খেয়াঘাটের এলাকায় থরো খোঁজখবর করা শুরু করে দিন। আজই। ইনফর্মারদের সবাইকে খবর দিয়ে দিন।

সে তন্ময় সামন্তকেও একই ইনস্ট্রাকশন দিয়ে দিল।

বাইরে তখন বৃষ্টি ধরে এসেছে। কিন্তু একবারে থেমে যায়নি। ঝিরঝির করে তখনও ঝরছিল। অর্ক গাড়িতে উঠতে উঠতে আবার একবার রুচিরার মোবাইলে ফোন করল। ফোন সুইচ অফ। সে অবাক হয়ে যায়। এমনটা তো হবার কথা ছিল না। কোনও দিন সে যা করে না এবার সে তাই করল। হেডকোয়ার্টারে ফোন করে সে রুচিরার নাম্বারটা ট্র্যাকিঙে দিতে বলল।

মনে মনে ভাবছিল, রুচিরা কি তার উপর রাগ করে ফোন সুইচ অফ করে দিয়েছে? এমনটা যদিও হয় তবুও সে রুচিরার প্রতি রাগ করতে পারবে না। পারবে কি? সে নিজের মনের কাছে বলল যেন— ‘না না, সে রাগ করে থাকতে পারবে না।’

হঠাৎ তার কী মনে হল, সে গাড়ি ঘুরিয়ে টালিগঞ্জের দিকে গাড়ি ছোটাতে বলল। রুচিরা তাকে তার বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিল একবার। কিন্তু কোনও দিন তার যাওয়া হয়নি। হয়ত রুচিরাও তাকে সেইভাবে যাবার কথা বলেনি। অর্ক ট্রাফিকের ওসিকে ফোন করে সঠিক লোকেশনটা জেনে নেয়।

বৃষ্টির পরে রাস্তায় বেশ জ্যাম। তার পৌঁছাতে বেশ দেরি হল। তখন বিকেল হয়ে গিয়েছে। তার উপরে আকাশ জুড়ে কালো মেঘের ডিক্রি জারি হয়েছে। বিকেলের ঝাপসা আলোয় সে প্রথমবার রুচিরার দ্বারে এসে পৌঁছল। ছিমছাম দোতলা বাড়ি। সামনে এক চিলতে বাহারি ফুলের বাগান। বাইরে “আবাদ”-এর একটা বোর্ড টাঙানো। একতলার সামনের দিকটা “আবাদ”-এর অফিস। বাড়িতে রুচিরা আর তার ঠাকুমা থাকেন। সারাক্ষণের কাজের লোক দু-জন। তা ছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময় “আবাদ”-এর মেয়েরা থাকে।

অর্ক নিজের পরিচয় দিতে তাকে সাজানোগোছানো একটা বাসার ঘরে বসতে বলল এক তরুণী। কয়েক মিনিট পরে রুচিরার ঠাকুমা ঘরে এসে প্রবেশ করলেন। বয়স হয়ে গেলেও সম্ভ্রম জাগানো চেহারা। অর্ক হাত জোড় করে উঠে দাঁড়াল। তার পরে এগিয়ে গিয়ে প্রণাম করল সে। ঠাকুমা বাধা দিলেন না। হাত তুলে আশীর্বাদের ভঙ্গি করে অর্ককে বসতে বললেন। কিন্তু তিনি যেন অবাক হয়েছেন একটু। রুচিরা তাকে সব কথা বলে। ফলে অর্কর বিষয়ে তিনি সবই জানেন। রুচিরা তো তাকে বলে গিয়েছিল “টালিগঞ্জে স্টুডিওপাড়ায় একটু কাজ সেরে সে একবার অর্কর সঙ্গে দেখা করতে যাবে।” অথচ অর্ক এসে হাজির। তিনি বললেন,

তোমাকে তুমি করেই বলি। রুচি তো তোমার ওখানেই যাবে বলেছিল। যায়নি।

কথাটা শুনে অর্কও অবাক হল। বলল,

কই না তো। আমাকে টেক্সট করেছিল টালিগঞ্জে যাবে বলে। অথচ দুপুরের পর থেকে তার ফোন বন্ধ আছে।

ঠাকুমাও অবাক হলেন।

সে কি ফোন সুইচ অফ কেন?

অর্ক বলল,

আমি সেই কারণেই খোঁজ নিতে এলাম।

এখন তো আমার ভাবনা হচ্ছে বাবা। “আবাদ”-এর কাজ করতে গিয়ে আমদের তো অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। এখন বড্ড ভয় করছে।

অর্ক অভয় দিয়ে বলল,

চিন্তার কিছু নেই। আমি তো আছি।

কিন্তু কথাটা বলার সময়ে নিজের ভিতরে যেন কোনও জোর পেল না সে।

তখন তার হাতের মোবাইলটা বেজে উঠল। হেডকোয়ার্টারের ফোন। সে একপাশে সরে গিয়ে ফোন ধরল। ফোনের ওপার বলল, রুচিরার মোবাইলটা ফোন শেষ ট্রাক হয়েছে ভাবনীপুরের কাছে। সেটা টালিগঞ্জ থেকে মুভ করে ভাবনীপুরে এসে সুইচ অফ হয়ে গিয়েছে। তার আগে ফোনটা টালিগঞ্জের এক জায়গায় অনেকক্ষণ নন-মুভ অবস্থায় ছিল।

অর্ক চুপ করে শুনে গেল। তার ভীষণ ভাবনা হচ্ছিল।

***

 

কেমন বাতাস কেটে কেটে বৃষ্টি নামছে। আহা এমন দিনে তারে বলা যায়। সে যেতে চেয়েছিল এক জায়গায়, কিন্তু চলে এসেছে এক জায়গায়। দুপুরে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে সে কড়া নাড়ল। একবার। দুবার। একবার আকাশ দেখল। অঢেল মেঘের সারি চুয়ে চুয়ে বৃষ্টি নামছে। তার মাথা মুখ ভিজে যাচ্ছে। সে জানে বৃষ্টিতে চোখের জল ধুয়ে যায়। ধুয়ে যেতে হয়। আরও একবার সে কড়া নাড়ল।

মাথার উপর আঁচলটা তুলে দিয়েছে। অঢেল চুল পিঠ বেয়ে ঝুলে আছে। কয়েকগুছি সামনের দিকে এসে বুকের কাছে লেপটে আছে। দরজা খুলে দিয়েছে, অথচ দরজা জুড়ে দাড়িয়ে আছে বনানী। সে কী করবে? সমস্ত পথ রুদ্ধ করে যেন দাঁড়িয়ে আছে বনানী। সে কি কলবে ‘বনানী তুমি দরজা ছাড়ো।’ কিন্তু সে তেমনি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। দরজার ওপাশে পথ জুড়ে বনানী। তাদের দুজনের সামনে অঝোর বৃষ্টির পর্দা কাঁপছে। তার মনে হল বনানী যেন বহু দূরের কোনও এক ধানের ক্ষেতে ক্রমশ মেঘের দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। দূরে চলে যাচ্ছে।

বনানী তাকে ঘরের ভিতরে আসতে বলল না। তেমনি পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকল। এমনই কি নিষ্ঠুর বনানী?

সে দরজার বাইরে থেকে ফিরে চলে আসে। সে বুঝতে পারে, তার পিছনে আস্তে আস্তে দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।

তার পরে সে আবার ভিজতে ভিজতে গাড়িতে ফিরে আসে। আনমনে সে বাড়ির পথ ধরে। একবার পিছনে ফিরে ব্যাকসিটে রাখা বড় বাক্সটার দিকে তাকিয়ে নেয়। কেমন এক কঠিন হয়ে আসে তার দু চোখ। বাড়িতে ফিরে দ্যাখে ডরোথি নেই। ডরোথি কখন আসে কখন চলে যায় সে যেন জানতেই পারে না। সে সটান নিজের ঘরে ফিরে যায়। চিৎকার কারে ডাকে “হ্যামিলটন, হ্যামিলটন”। সে জানে হ্যামিলটন আসবে। হ্যাঁ, আসবে। সে আয়নার সামনে বসে থাকে।

কতক্ষণ সে এভাবে বসে থাকে সে জানে না। বাইরে তখন বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কিন্তু আকাশে ভীষণ বাইসনের মতো মেঘ। সে মেঘের গর্জন সে মাঝে মাঝে শোনে। শুনতে শুনতে সে গাড়ি চালায়। হঠাৎ কী যেন তার মনে পড়ে যায়। তখনি ফোনটা তার বাজল। সে গাড়ি ঘুরিয়ে নেয়।

***

 

প্রবালকে দেখে চেনা যাচ্ছে না একেবারেই। ঘাড় পর্যন্ত লম্বা লম্বা চুল। ঝোলা গোঁফ। এক কানে একটা পাথর দেওয়া কান-পাশা। শাদা পাথরটা ঝলমল করে ওঠে একটু আলোর আবেশেই। পরণে একটা রিপড্ জিনস্ আর ‌একটা সস্তার প্রিন্টেড সার্ট। বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কিন্তু আকাশ মেঘলা। সারা আকাশে মেঘের শামিয়ানা খাটানো রয়েছে যেন।

প্রবাল শিস দিতে দিতে হাঁটছিল। রাস্তায় লোকের আনাগোনা কম। এইদিকের গলিগুলো যেন নির্জন, অথবা সকলকে বৃষ্টির আলসেমিতে পেয়ে বসেছে। গলিটা খুঁজে পেতে তার একটুও বেগ পেতে হল না। বকুলবাগান এলাকায় সে গতকালই এসেছিল।

বাড়িটা বড়। দোতলা। কিন্তু বহুকাল বাড়িটার কোনও রিপেয়ারের কাজ হয়নি। পুরানো হলুদ রং এখন ঝাপসা, তার উপরে এখন কালোর ছাপ পড়ে গিয়ে যেন সমস্ত বাড়িটাকে কলঙ্কিত করে দিয়েছে। কালো ছোপ পড়া সবুজ কাঠের দরজাটার পাশে একটা শাদা ফলকে বাড়ির নম্বরটা লেখা। লেখাটাও এখন ঝাপসা হয়ে গিয়েছে। প্রবাল বাড়িটার সামনে ক-মুহূর্ত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার পরে কড়া নাড়ে। একবার। দুবার।

দরজাটার পাল্লা দুটো একটু ফাঁক হয়। দরজার ফাঁকে জিজ্ঞাসু দুটি চোখ।

প্রবাল একটু অবাঙালির টানে কথা বলে,

দিগন্তদা আমাকে এখানে আসতে বলেছিলেন।

বনানী দরজাটা আর একটু ফাঁকা করে খুলে দাঁড়ায়। বলে,

উনি তো এখুনি চলে গেলেন।

তাই!

প্রবাল অবাক হবার ভান করে। বাঁহাতের কব্জি তুলে ঘড়িতে সময় দেখে।

কিন্তু দাদা যে সময়ে আসতে বলেছিলেন আমি তো সেই সময়ের আগেই এসেছি।

বনানী কিছু ভাবে যেন। সে বুঝে উঠতে পারছে না। দিগন্ত এই বাড়িতে কেন আসতে বলেছে। এখানে তো সে কাউকে আসতে বলে না কখনও।

প্রবাল বনানীর দিকে তাকিয়ে থাকে। কী এক আশ্চর্য আকর্ষণ আছে তার চেহারায়। তার বয়স বেড়ে গিয়েছে। বয়সের ছাপ পড়েছে মুখে চোখে। কিন্তু তবু তার সারা শরীর থেকে এক দুর্নিবার আকর্ষণের তরঙ্গ যেন তার সারা দেহের চারপাশে অনুরণিত হয়ে আছে। প্রবালের চোখ যেন অদ্ভুত আবেশে ভরে থাকে। কিন্তু বনানী কি তাকে ভিতরে আসতে বলবে? সে ঠিক ভেবে উঠতে পারছে না।

তাকে সেইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রবাল বলে,

আমি কি একটু ভিতরে এসে বসতে পারি?

বনানী যেন অনিচ্ছাসত্ত্বেও বলে,

আসুন।

প্রবাল বাইরের ঘরে গিয়ে বসে।

বনানী ভিতরে চলে যায়।

প্রবাল ভাবল, তার কি এখানে আসাটা ভুল হয়ে গেল! সে এখান থেকে কী জানতে চাইছে, এখন যেন সে তা বুঝে উঠতে পারছে না। কিন্তু তার একটা আকাঙ্খা ছিল, দিগঙ্গনার ছবির পিছনে লেখা অ্যাড্রেসটা কোথায় সেটা দেখার। কিন্তু এই পোড়ো বাড়ির অন্দরে কী রহস্য আছে, সে সেটা কী করে বার করবে? সে ভেবে উঠতে পারছে না। কিছুক্ষণ বসে থেকে সে বসার ঘর থেকে বেরিয়ে বাইরে উঁকি দেয়। একটা টানা দালান। আগেকার দিনে যেমন থাকত। সারা বাড়িটা শুনশান, কোথাও কোনোও শব্দ নেই। যেন একটা মৃত বাড়ি, মৃত সব ইট কাঠ পাথরের ফসিল একটা। দালানে বেরিয়ে সে এদিক ওদিক তাকায়। একপাশ থেকে সে যেন বাসন-পত্রের মৃদু শব্দ পেল। সে সেই শব্দ লক্ষ করে এগিয়ে যায়। এদিকে রান্নার ঘর। গ্যাসের উনুনটা মেঝেয় পাতা। সেই গনগনে নীল আগুনের সামনে বনানী বসে আছে। উনুনে কিছু রান্না হচ্ছে না। অথচ দাউ দাউ করে গ্যাসের নীল আগুন জ্বলছে। দরজার দিকে পিছন ফিরে বসে আছে বনানী। দীর্ঘ এলো কালো চুল মেঝে পর্যন্ত তার সমস্ত শরীরটাকে ঢেকে রেখেছে।

প্রবাল গলার ভিতরে একটা মৃদু শব্দ করে। বনানী ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায়। আগুনের তাপে তার সমস্ত মুখ যেন ঝলসে লাল হয়ে আছে।

প্রবাল বলল,

একটু খাবার জল পাওয়া যাবে?

বনানী ঘাড় ফিরিয়ে নেয়। দু হাত তুলে চুলটা জড়িয়ে একটা এলো খোঁপা বেঁধে নেয় সে। প্রবাল তার সেই ভঙ্গিটা দেখে। কী এক অপরূপ সে ভঙ্গি। প্রবালের যেন নেশা চেপে যাচ্ছে। কী এক দুর্নিবার নেশার ভিতরে সে যেন ডুবে যাচ্ছে।

বনানী মৃদু গলায় বলে,

আপনি ও ঘরে গিয়ে বসুন, আমি জল নিয়ে যাচ্ছি।

প্রবাল ফিরে এসে বসার ঘরে বসে।

অনেকক্ষণ সে বসে থাকে। বানানী আর আসে না। সে বসে বসে এই বাড়ির অসুস্থ আবহাওয়াটা টের পাচ্ছে। গতকাল সে যখন এই এলাকায় এসেছিল এমনি ছদ্মবেশে তখন সে বনানীর নাম জেনেছিল। এই বাড়ির ব্যর্থতার, দ্বগ্ধ হবার ইতিহাস তার জানা হয়ে গিয়েছে। কিন্তু তবু একবার বানানীর সঙ্গে দেখা করার লোভ হয়েছিল তার। এখন সে ভাবল, এমনটা না করলেই সে পারত। তার যা জানার তা তো জানা হয়ে গিয়েছে। আবার সে অনুভব করে, সবটা কি সে জানতে পেরেছে? এখানে এসে বনানীকে দেখে কোথাও যেন তার একটা খটকা লাগছে। কিন্তু কী সেটা? সে এতটাই ভাবনায় ডুবে গিয়েছিল যে সদর দরজায় কড়া নাড়ার শব্দটা সে খেয়াল করেনি। কিন্তু সদর দরজা বন্ধ হবার শব্দে সে একটু সচকিত হয়। এতক্ষণ হয়ে গেল, এখনো বনানী জল নিয়ে এল না। তার ব্যপারটা কেমন একটা ফিশি লাগছিল। সে উঠে পড়বে ভাবছিল। তখন একটা পিতলের রেকাবিতে কয়েকটা শুকনো মিষ্টি আর কাচের গ্লাসে জল নিয়ে বনানী বসার ঘরে ঢুকল। সদ্য সে স্নান করেছে। পাতলা শাদা শাড়ি। এলো চুলের কুচি কপালে গালের কাছে লগ্ন হয়ে আছে। কয়েকগুছি চুল কাঁধের পাস দিয়ে এসে বুকের উপরে পড়েছে। প্রবাল অদ্ভুত মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। সে যেন অসাড় হাত বাড়িয়ে জলের গ্লাসটা নেয়। তেমনি অসাড় হাতে জলের গ্লাস মুখের কাছে তুলে চুমুক দেয়। তার হাত থেকে ঠাস করে গ্লাসটা পড়ে যায়। চোখের পাতা দুটো ভারি হয়ে চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসে। সম্পূর্ণ চেতনার শেষ সীমায় পৌঁছে যাবার আগে সে বনানীর মুখ আবছা দেখতে পায়। বনানীর ঠোঁট জুড়ে মৃত প্রজাপতির মতো একটা হাসি।

***

 

স্যার, গাড়িটাকে ট্র্যাক করা গিয়েছে।

একজন সার্জেন্ট বলল।

লালবাজারে ট্রাফিক কন্ট্রোল রুমে বসে আছে তন্ময় সামন্ত। সকাল থেকে তার সঙ্গে প্রবালের আর যোগাযোগ হয়নি। প্রবাল তাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সে কিছুতেই প্রবালের সঙ্গে যোগাযোগ করে উঠতে পারছে না। প্রবালের ফোন বন্ধ।

অনেকক্ষণ তারা একটা গাড়িকে ট্র্যাক করার চেষ্টা করছিল। অবশেষে তার সন্ধান পেয়েছে তারা। সামন্ত বলল,

কোথায়?

গাড়িটা এখন রবীন্দ্র-সেতুর দিকে চলেছে।

সামন্ত চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল। বলল,

কুইক। ফোর্স রেডি করতে বলুন। আর গাড়িটাকে এখুনি ফলো করতে বলুন। আমাদেরও গাড়িটা যেখানে যাচ্ছে সেখানে যেতে হবে।

সামন্ত একজন এসআইকে নির্দেশ দেয়।

তারপর ছোট একটা দল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

 

আগামী সংখ্যায় সমাপ্য

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...