![tapas@pranab](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/06/tapas@pranab.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
তাপস কুমার দাস
লেখক ভারত সরকারের পরমাণু গবেষণা দপ্তরে কর্মরত মহাকাশবিজ্ঞানের অধ্যাপক
বড় দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি।
বড় দীর্ঘদিন দীর্ঘবেলা।
জলের ভিতরে ক্রমে জমে-ওঠা শ্যাওলার সবুজ,
হাওয়া ভারী হয়ে আসে, স্রোত
থেমে যায়, ক্রমে
কুসুমের বুক থেকে ঝরে পড়ে নিহিত কুসুম।
দীর্ঘদিন বিজনে, একেলা।
কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের সাহিত্যসৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় ‘পরবাস’ শীর্ষক কবিতার এই অংশবিশেষ দিয়েই, কবিতাটি ‘এসো, হাত ধরো’ (প্রকাশকাল ডিসেম্বর ১৯৭৭ খ্রিস্টাব্দ) কাব্যগ্রন্থের। কিন্তু আমি তখনও ওঁর কোনও বই পড়িনি। সাহিত্যের ছাত্র নই, কবিতাও খুব যে কিছু পড়তাম সেই সময়, তেমনও নয়, ফলে ওঁর নামের সঙ্গে পরিচিতি ছিল এমন দাবি করা মিথ্যা হবে। কবিতাটি আমি প্রথম পড়ি বুদ্ধদেব গুহর মাধুকরী উপন্যাসে। বইয়ের ৪০০তম পৃষ্ঠায় কবির নামসহ কোট করা সেই কবিতায় প্রথম লাইনে ‘বড়’ কথাটি বাদ পড়ে গিয়েছিল, ছিল কেবল ‘দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি’। মজার কথা হল, এই মুদ্রণপ্রমাদের (আমি ধরে নিচ্ছি বুদ্ধদেব গুহ না জেনে ভুল করেননি) সূত্রেই প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়ের সূচনা। সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও একটি কবিতার গ্রুপে আমি কবিতাটি পোস্ট করি। ‘এসো, হাত ধরো’ ছিল না কাছে, ছিল মাধুকরী, সেটা দেখেই টাইপ করি। ওই গ্রূপে কবি নিজেই ছিলেন, আমি পোস্টটা দেওয়ার পরে, একটু বিরক্ত হয়েই, কমেন্ট করেন ‘বড় দীর্ঘদিন আমি এমন প্রবাসী হয়ে আছি— এই ছিল প্রথম লাইনের শুদ্ধ পাঠ! পাল্টাল কীভাবে কে জানে।’ আমি তৎক্ষণাৎ ওঁর কাছে মাপ চেয়ে পোস্টটা শুদ্ধ করে দি। উনি আমাকে ধন্যবাদ জানান।
সেটা ছিল ২০১৬র সতেরোই মে। সেই প্রথম আলাপ। কলেজ জীবনে মাধুকরীতে ওই কবিতা পড়ে মুগ্ধ হওয়ার পর থেকেই বহুবছর আমার ভারী শখ ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত হওয়ার। সাহিত্যের ছাত্র ছিলাম না, তায় মফস্বলী ছোঁড়া। কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে ওঠাবসার প্রশ্নই ছিল না, স্পর্ধা তো নয়ই। ফলে হয়ে ওঠেনি। ফেসবুক এসে এত বছর বাদে সেই সুযোগ হয়েছে, তা কি ছাড়া যায়? তাই প্রথমবার ভয়ে ভয়ে মেসেজ করেছিলাম ওঁকে, ওঁর ফোন নাম্বার চেয়ে। একে অত সিনিয়র মানুষ, তায় কৃত্তিবাসী! ভয় থাকা স্বাভাবিক। ফোন নাম্বার দিলেন, এবং কবি প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় কখন যেন প্রণবদা হয়ে গেলেন।
কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে থাকি। ফলে ফোনেই কথা হত। আলাপের পর প্রথম যেবার কলকাতা যাই অফিসের কাজে, ওঁর সঙ্গে দেখা করতে দৌড়োই যোধপুর পার্কে ইডিএফ হসপিটালের উল্টোদিকের রাস্তায় প্রণবদার বাড়িতে। সেটা সম্ভবত ২০১৬র পয়লা ডিসেম্বর। অত্যন্ত সুস্বাদু মাংসের ঘুঘনি করে খাওয়ালেন দিদি, যিনি প্রণবদার দেখাশোনা করতেন। তার সঙ্গে জিভে জল আনা, কলকাতার এক বিশেষ দোকানের নলেন গুড়ের রসগোল্লা। পাজামা পাঞ্জাবি আর সাধারণ একটা চাদর গায়ে, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, বর্ষীয়ান সেই মানুষটি যেভাবে আমাকে আপন করে নিলেন প্রথম দিনেই, মাটির কাছাকাছি থাকা সেই ব্যক্তিত্ব দেখে কে বলবে উনি একজন শ্রুতকীর্তি কৃত্তিবাসী, এবং পঞ্চাশের দশকের একজন গুরুত্বপূর্ণ কবি।
অধিকাংশ সাহিত্যবোদ্ধাদের মতে, আধুনিক বাংলা কবিতার সূচনাকাল হিসেবে তিরিশের দশককেই চিহ্নিত করা হয়। আর পঞ্চাশের দশকে উঠে আসেন এক ঝাঁক কবি, অধিকাংশই কৃত্তিবাস এবং শতভিষা পত্রিকার সূত্রে, যাঁরা কবিতা সংক্রান্ত চিন্তাভাবনা আমূল পাল্টে দিলেন। প্রণবদা সেই পঞ্চাশের কবি। কৃত্তিবাসেরও। কৃত্তিবাস পত্রিকার প্রথম প্রকাশ ১৯৫৩ সালে (১৩৬০এর শ্রাবণ, বঙ্গাব্দ অনুযায়ী), সুনীল গাঙ্গুলী, দীপক মজুমদার আর আনন্দ বাগচীর সম্পাদনায়, দীপক মজুমদারের পৈতৃক বাড়ি ১২/১ মহারানি হেমন্তকুমারী স্ট্রিট থেকে। পত্রিকার নাম ঠিক করে দিয়েছিলেন সিগনেট প্রেসের কর্ণধার দিলীপকুমার (ডিকে) গুপ্ত। প্রথম সংখ্যায় বেরোয় শঙ্খ ঘোষের দীর্ঘ কবিতা ‘দিনগুলি রাতগুলি’, প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতা হিসেবে। সমর সেন, জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র প্রমুখের প্রবন্ধও প্রকাশিত হয় প্রথম সংখ্যায়।
১৩৬১ বঙ্গাব্দের তৃতীয় সঙ্কলনে প্রথম কৃত্তিবাসে লেখেন প্রণবদা, কবিতার নাম ‘ভীরু পতঙ্গের গান’। ওই ১৩৬১ বঙ্গাব্দেই বেরোয় চতুর্থ-পঞ্চম যুগ্ম সঙ্কলন, সেখানেও লেখেন ‘অতলান্ত’ নামের কবিতা। তারপর বহু লেখা লিখেছেন সেখানে। নিজেকে কৃত্তিবাসী বলতে ভালোবাসতেন, কৃত্তিবাসের ওপরে এক ধরনের পোজেসিভনেসই ছিল বলা যায়, যে পোজেসিভনেস অবশ্যই আসে ভালোবাসা থেকেই একমাত্র। কৃত্তিবাসকে ঘিরে সাম্প্রতিক বিতর্ক পছন্দ করেননি, ‘ব্যতিক্রমী’ শিরোনামে এক কবিতায় ক্ষোভের সঙ্গে লেখেন:
এহো বাহ্য। ঘটেছে সম্প্রতি—
তাবৎ রেকর্ড ভেঙে অনন্য রেকর্ড বলা যায়—
এক ‘কৃত্তিবাস’ থাকতে আরও এক, ‘নতুন’ আখ্যায়!যেন এই পৃথিবীতে অন্য নাম খুঁজে পাওয়া দায়।।
জন্ম ১৯৩৭ সালে, মহালয়ার তিথিতে। নিজেকে বলতেন মহালয়ার জাতক। অত্যন্ত অল্পবয়সেই লেখালেখির শুরু। পনেরো বছর বয়েসে দেশ পত্রিকায় তাঁর কবিতা প্রকাশিত হয় ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দের ১৯ নভেম্বরের সংখ্যায়। দেশ তখন সাপ্তাহিক। কবিতার নাম ছিল ‘সকালের দেওঘর’। মাত্রই পনেরো বছর বয়সে দেশে কবিতা বেরোনো, এবং সেটাই তাঁর প্রথম প্রকাশিত কবিতা জীবনে। রীতিমতো সাড়া জাগিয়ে দৌড় শুরু প্রণবদার। প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘অতলান্ত’, প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৬১ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে। ১৩৫৯ বঙ্গাব্দ থেকে ১৩৬১ বঙ্গাব্দ এই পরিসরে লেখা পঁচিশটি কবিতা নিয়ে। প্রথম কবিতার শিরোনাম ‘সীমা-সুদূর’। অতলান্ত প্রকাশ করে কৃত্তিবাস প্রকাশনী, তখন তা দীপক মজুমদারের বাড়ি থেকে স্থানান্তরিত হয়েছে সুনীল গাঙ্গুলীর ২বি বৃন্দাবন পাল লেনে। দীপক মজুমদার এবং আনন্দ বাগচী আর সম্পাদনায় নেই, সুনীল একাই সম্পাদক কৃত্তিবাস পত্রিকার। প্রণবদার মোট বইয়ের সংখ্যা সাতটি, ‘অতলান্ত’, ‘এসো, হাত ধরো’ (আনন্দ পাবলিশার্স, ডিসেম্বর ১৯৭৭, পঞ্চান্নটি কবিতার সঙ্কলন), ‘অপেক্ষার রং’ (আনন্দ পাবলিশার্স, মে ১৯৯৩, চুয়ান্নটি কবিতার সঙ্কলন), ‘জল, তবু দগ্ধ-করা’ (প্রতিভাস, মে ২০০৫, পঁচিশে বৈশাখে, সাতচল্লিশটি কবিতার সঙ্কলন), ‘শো-কেসের ফুলবাবু’ (গাঙচিল, কলকাতা বইমেলা ২০০৭, চুয়ান্নটি কবিতার সঙ্কলন), ‘এত মায়া, এত মোহ’ (পত্রলেখা, অক্টোবর ২০০৭, মহালয়ার দিনে, পঞ্চাশটি কবিতার সঙ্কলন), ‘কেমন আছে এই পৃথিবী’ (সিগনেট প্রেস, জানুয়ারি ২০১৫, ঊনষাটটি কবিতার সঙ্কলন)। অজস্র অগ্রন্থিত লেখা বিভিন্ন জায়গায়। ২০১৭ সালের কৃত্তিবাস পত্রিকার সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত ‘সেই একজন’ পর্যন্ত প্রণবদার যাবতীয় কবিতা নিয়ে সিগনেট প্রেস থেকে ২০১৭র সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয় প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়ের কবিতা সমগ্র। তারপরেও লিখে গেছেন নিয়মিত, প্রায় মৃত্যুর আগের দিনগুলি পর্যন্তই বলা যায়।
এহেন কাব্যপ্রতিভার যতখানি প্রচারের আলোয় আসার কথা ছিল, ততটা আসেননি কেন প্রণবদা? আমি ওঁকে একদম সরাসরি এই প্রশ্ন রেখেছিলাম চাঁচাছোলা ভাষায়। তখন প্রণবদার সঙ্গে আমার সম্পর্ক বাড়ির লোকের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আমার নবমবর্ষীয়া কন্যা তাঁর বাড়ি গিয়ে ‘প্রণবদাদুর’ ওপরে অত্যাচার চালিয়ে আসে প্রায়ই। সম্পর্কের সেই অধিকারেই সরাসরি এই প্রশ্ন করা। খানিকক্ষণ গুম হয়ে বসে থেকে আপাত ঝাঁঝাঁলো সুরে তিনি বলেন “আমাকে ডেকে নিয়ে না গেলে আমি কোথাও যাই না!” সেই ঝাঁঝের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অভিমানী মানুষটিকে চিনে নিতে আমার দেরি হয় না। প্রণবদা এই দ্যাখনসর্বস্ব যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেননি আসলে। প্রণবদা খাঁটি মানুষ ছিলেন, গভীর মনের আত্মনিমগ্ন মানুষ। প্রচারক নন, সেলসপার্সন ছিলেন না। বেচতে পারেননি নিজেকে কোনওদিন সে অর্থে। ফলত, যা হওয়ার, তাইই হয়েছে।
…ডাক পড়ে না কবিতাসভাতে,
না পড়ুক, খেদ নেই তাতে।
ছক কেটে করলে ছোটাছুটি—
পুরস্কার জোটে একটি-দুটি।
কিন্তু নেই বিবেকের সায়,
কাঁহাতক নীচে নামা যায়!
দল নেই, বুঝি না কোটারি—
আমার বয়েই গেল ভারি!
কারও কাছে বাঁধা দিইনি টিকি,
নিজের ইচ্ছার জোরে লিখি।…
`আত্মপাঁচালি’ শীর্ষক কবিতায় সপাট লিখে গিয়েছিলেন প্রণবদা। ওটাই সম্ভবত তাঁকে জিগ্যেস করা আমার প্রশ্নের উত্তর। যিনি লিখে গেছেন:
আমি কি তোমার জন্য লিখি নাকি, বোকা সম্পাদক?
বিজ্ঞতার জোব্বা পরা তুমি দেখছি নিতান্ত বালক!(সম্পাদক সমীপেষু, শো-কেসের ফুলবাবু শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ)
তাঁর কপালে ফুলমালা আর উত্তরীয় জুটবে না হরঘড়ি, সে কথা কি আর আলাদা করে বলে দিতে হয়?
প্রণবদার কবিতা নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা করা এই প্রতিবেদনের উদ্দেশ্য নয়। এবং তা করা আমার বৌদ্ধিক ক্ষমতার বাইরে। তার জন্য সাহিত্যজগতের বিশিষ্টজনরা আছেন, তাঁরা নিশ্চয়ই আগামী দিনে প্রণবদার সাহিত্যকীর্তির প্রকৃত মূল্যায়ন করবেন। আমার এই লেখা মূলত সংক্ষিপ্ত স্মৃতিচারণ, কবি প্রণবদার নয়, মানুষ প্রণবদার। সেক্ষেত্রে একজন সাধারণ পাঠক হিসেবে বলা যেতে পারে, প্রণবদার কবিতায় যে বৈশিষ্ট্য খুঁজে পেয়েছি তা হল তাঁর লেখনীর মৃদু চলন। তাঁর কলমের যাত্রাপথ উচ্চকিত ছিল না কখনও। জীবন, সমাজ, মানবিক সম্পর্ক, এবং প্রকৃতি তাঁর লেখায় বার বার উঠে এসেছে অত্যন্ত পরিমিত রূপে। আত্মমগ্ন, কখনও বা ঈষৎ বিষণ্ণ তাঁর কলম সনেটধর্মী রচনায় সিদ্ধিলাভ করেছিল। বাস্তব জীবনেও প্রণবদা ছিলেন একজন দুঃখী মানুষ। তরুণী কন্যার অকালমৃত্যু, তারপর স্ত্রীর চলে যাওয়া তাঁকে প্রবলভাবে বিক্ষত করেছে।
কিন্তু প্রণবদার পরিমিতি বোধ, যা শুধু তাঁর লেখনীর নয়, জীবনেরও বড় সম্পদ, প্রণবদার বহিরঙ্গে বিষণ্ণতার ছাপ ফেলেনি। নিজের দুঃখগুলিকে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগতই রাখতেন তিনি। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ঈর্ষণীয়ভাবে সৃষ্টিশীল, খাদ্যরসিক, পানীয়রসিক, রমণীর সৌন্দর্যের প্রশংসাকারী প্রণবদা প্রকৃতই ছিলেন জীবনরসিক। বিশাল মাপের এক মানুষ। কিছু অভিমানী, তবে পরিহাসপ্রিয়ও বটে। রসিয়ে গল্প করতেন বিভিন্ন মানুষের সম্পর্কে।
জ্যোতির্ময় দত্তের ‘আমার নাই বা হল পারে যাওয়া’ পড়ছি তখন। প্রণবদার সঙ্গে আড্ডায় বলে ফেললাম:
“ও প্রণবদা, বইয়ের আর্টপ্লেটগুলো দেখেছেন?”
“আমি আর কী দেখব ভাই ছবিতে, সবাইকেই তো আমি চিনতাম।”
“আরে না না, নবনীতার ছবিটা দেখেছেন?” উত্তেজিত হয়ে বলি। বইয়ে নবনীতার জোড়া বেণী দোলানো এক আশ্চর্য সুন্দর ছবি আছে, ওই হাসি দেখে যে কোনও পুরুষ চিৎপাত হবেন। আমি আশৈশব নবনীতার অন্ধ ভক্ত, অপরিসীম শ্রদ্ধায় প্রণত থাকি তাঁর মনীষার কাছে। ব্যক্তিগতভাবে কখনও আলাপচারিতার সৌভাগ্য হয়নি, মাত্র একদিনই দেখেছিলাম বিশেষ একটি ক্যান্সার ক্লিনিকে, আমাকে নিজেকেও সেখানে যেতে হয়েছিল, সেই সময়।
“ও প্রণবদা, সত্যিই এরকমই সুন্দরী ছিলেন নাকি? এ তো আজকালকার ছোকরারাও প্রেমে পড়ে যাবে দেখলে!’ প্রণবদা মুচকি হেসে বললেন “তবে? অমর্ত্য কি এমনি এমনি মজেছিল ভাবছ?”
এই ছিলেন প্রণবদা।
মানুষটির জ্ঞানের সীমা আমাকে মুগ্ধ নয়, হতভম্ব করত। যেটা নিয়ে উনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করতেন পারতেন না (না, ইন্টারনেটে উইকিপিডিয়া দেখে দেখে নয়। স্মৃতি থেকে, মনন থেকে), এমন কোনও বিষয় আমি খুঁজে বার করতে পারিনি। “জর্জদা মাসে দশ টাকা করে নিতেন আমাকে শেখাতে”— এইসব কথা শুনলে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠত— মনে হত সামনে বসে আছেন এক প্রাচীন বটবৃক্ষ তাঁর অভূতপূর্ব স্মৃতির সম্পদ নিয়ে। ওঁর অনেক কবিতার শিরোনামে রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্তবক। কবিতার মধ্যেও বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীত-শিল্পীর (প্রায় প্রত্যেকেই ওঁর ব্যক্তিগত পরিচিত) নাম উঠে এসেছে। ‘সারাটা বিকেল আজ মোহরদির সঙ্গে গেলো কেটে/ফিরে শোনা অজস্র ক্যাসেটে’ (দিনলিপি থেকে: ৫ই এপ্রিল, ২০০০, ‘জল, তবু দগ্ধ করা’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ), ‘ও ডোরবেল, আর ডিংডং নয়। এবার থেকে বেজে ওঠো অর্ঘ্য সেনের গলায়’ (‘ও প্রযুক্তি, ও একুশ শতক’, ‘কেমন আছে এই পৃথিবী’ শীর্ষক কাব্যগ্রন্থ)— এইসব পংক্তি আজ স্মৃতিতে ঘুরে ঘুরে আসে। বস্তুত, রবীন্দ্রসঙ্গীত ছিল ওঁর প্রাণ। ‘রবীন্দ্রসঙ্গীত’ শীর্ষক কবিতায় (১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। অগ্রন্থিত।) তিনি লেখেন:
যদিও শতাব্দী এক রুদ্রচক্ষু চণ্ডাল, যদিও
অশুচি রৌদ্রের টেপে পুড়ে মরে সন্তান-সন্ততি—
অপ্রেম-সংশয়-ঘৃণা-বিরহদহন-মৃত্যু-শোকে,
তবুও স্পর্ধায় জ্বলি, কেননা, তুমি তো আছ প্রিয়
তমসার শেষ কূলে। হে আনন্দ, হে নির্মলজ্যোতি,
সুরের সোনার তরী পার করে দেবে অন্যলোকে।
প্রায় পলিম্যাথ ছিলেন। স্কুলের গণ্ডি পেরোনোর পরপরই প্রেমেনবাবুর আমন্ত্রণে আকাশবাণীতে স্বরচিত কবিতাপাঠ, বহু বইয়ের ফ্লায়ার ও ভূমিকা লেখা, দেশ পত্রিকায় নিয়মিতভাবে সঙ্গীত-সমালোচকের ভূমিকা পালন, বহু জনপ্রিয় সঙ্কলন-গ্রন্থের সম্পাদক (তার মধ্যে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা সমগ্রও রয়েছে)। ৭ই মে, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে শুরু হল কবিতা-ঘণ্টিকী। কবি সুশীল রায়ের কাঁকুলিয়ার বাড়ি থেকে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় বেরোবে নতুন নতুন কবিতা নিয়ে বুলেটিন। ভূ-ভারতে এমন উদ্যোগ সেই প্রথম, সম্ভবত সারা বিশ্বেও। সেখানেও সম্পাদকমণ্ডলীতে প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায় (বাকিরা ছিলেন আনন্দ বাগচী, শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, শান্তনু দাস ও সুশীল রায়)। সাহিত্য একাডেমির যুব পুরস্কার প্রদানের জুরি ও নির্বাচকের দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর।
“কী করেননি বলুন তো আপনি, ও প্রণবদা?”
“বাচ্চাদের খুব ভালো লাগে ভাই।” হেসে বলেছিলেন মানুষটি। তাইতো, ওই দিকটা তো ভুলেই গেছিলাম! আনন্দমেলা পত্রিকার প্রতি সংখ্যায় সত্যসন্ধ ছদ্মনামে ধাঁধা হেঁয়ালি, ‘মজারু’ নামে ছোটদের উপযোগী মজার খেলা নিয়ে লেখা, ‘স্মৃতিধর’ এবং ‘সাংখ্যায়ন’ ছদ্মনামে পড়াশুনার প্রস্তুতি নিয়ে লেখা। লিখেছেন অঙ্কের জটিল ধাঁধার বই (নিজে কিন্তু বাংলার ছাত্র ছিলেন! কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ পড়া অসমাপ্ত রেখে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষা দিয়ে রাইটার্স বিল্ডিঙে প্রশাসনিক পদে চাকরি নেন, এবং পাবলিক হেলথ ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ডেপুটি-সেক্রেটারি হিসেবে অবসরগ্রহণ করেন), এবং এমনকি ম্যাজিকের বইও!
স্পেশালাইজেশনের এই যুগে, বিশ্বায়নের বাজারে, পাকা কুইজজ্ঞ আর হাবা বিশ্বসুন্দরীদের অপ্রয়োজনীয় ভিড়ে, এই মাপের সার্বিক গভীরতার ব্যক্তিত্বের উপস্থিতি আমাদের জন্য ভারি জরুরি ছিল। যে কটি মানুষ ছিলেন আশেপাশে এই গোত্রের, প্রায় সবাই অস্তমিত হচ্ছেন এক এক করে। আমাদের, এবং অবশ্যই পরবর্তী প্রজন্মের, দুর্ভাগ্য বইকি।
চলে গেলেন। প্রায় সম্পূর্ণ নিঃশব্দেই। হয়তো অনেকটাই অভিমান নিয়েও।
অলৌকিক নামে একটি কবিতা আছে প্রণবদার। ওঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘অপেক্ষার রং’-এর তিন নম্বর কবিতা। আমার কাছে ওঁর লেখা সবথেকে প্রিয় কবিতা। চলে যাওয়া বন্ধুদের নিয়ে অমন বিষণ্ণ উচ্চারণ বাংলা সাহিত্য বেশি দেখেনি:
বিমল দাঁড়িয়ে ছিল ট্রামস্টপে, স্পষ্ট মনে আছে।
মেঘলা দুপুর ছিল, ছিল লাল ট্র্যাফিকের চোখ,
বাস থেমে ছিল, আর বিমল দাঁড়িয়ে ছিল, একা,
তেমনই উজ্জ্বল চোখে কৌতুক-মেশানো হাসি, ছিল
রঙিন পাঞ্জাবি, ছিল সটান তরুর মতো দেহ,
বিমল দাঁড়িয়ে ছিল, অবিকল বিমলের মতো।চলন্ত ট্যাক্সির থেকে অরুণ বাড়িয়েছিল মুখ,
তেমনই গভীর কণ্ঠ: কী খবর, কোথায় যাবেন?
ট্যাক্সির দরোজা খুলে অরুণ দাঁড়িয়ে ছিল পাশে,
খোলা বুক, ভরা গলা, উড়ো চুল উড়ছে হাওয়ায়,
পাথরে খোদাই-করা মূর্তি এক সুঠাম, পেশল,
অরুণ দাঁড়িয়ে ছিল, অবিকল অরুণের মতো।শেষ ট্রাম ফিরে গেছে, ট্যাক্সির মিটারে লাল শালু,
স্মৃতির ভিতরে তবু অলৌকিক এক ট্রামস্টপ,
মেঘলা দুপুরবেলা অচেনা ট্যাক্সির থেমে-থাকা,
বিমল দাঁড়িয়ে আছে, অরুণ বাড়িয়ে আছে মুখ।
প্রায় দ্বিগুণ বয়সী, এবং পাণ্ডিত্যের আর অভিজ্ঞতার বিচারে ব্রবডিংনাগ মানবেরই মতো, এই অধমের তুলনায়, তবুও বন্ধুই তো ছিলেন, বলুন প্রণবদা? বিমল আর অরুণের মতো আপনিও ভিতরে রয়ে গেলেন বিষণ্ণ স্মৃতির কুয়াশা মেখে।
তথ্যসূত্র:
১) কৃত্তিবাস পঞ্চাশ বছর নির্বাচিত সংকলন, প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড, সম্পাদনা: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, আনন্দ পাবলিশার্স, প্রথম সংস্করণ: আগস্ট ২০০৩, দ্বিতীয় মুদ্রণ: ফেব্রুয়ারি ২০১১।
২) কবিতা সমগ্র, প্রণবকুমার মুখোপাধ্যায়, সিগনেট প্রেস, প্রথম সংস্করণ: সেপ্টেম্বর ২০১৭।