বছর কুড়ি পরে…

বছর কুড়ি পরে : পায়েল চ্যাটার্জি

পায়েল চ্যাটার্জি

 

মা: বছর কুড়ি আগে April was the cruelest month.

আবেশ: প্যান্ডেমিক নাকি প্যান্ডেমোনিক? কেমন ছিল সময়টা?

মা: জটায়ুর ভাষায় এক্বেবারে হরেন্ডাস।

আবেশ: থমকে যাওয়ার সময়ে সবচেয়ে বেশি কি বন্দি করেছিলে?

মা: তোর শৈশব।

আবেশ: সবটাই লেজার টাইম ছিল তাহলে?

মা: হ্যাঁ! বিশ্রামের ক্লান্তি।

আবেশ: আর কী উপলব্ধি করেছিলে?

মা: আতঙ্ক, প্যানিক শব্দগুলো যেন রোজকার ডালভাত। চারিদিকে মৃত্যু, শোক সব মিলিয়ে যেন কোনও দুঃস্বপ্নলোক।

আবেশ: শুনেই কেমন যেন যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ পাচ্ছি।

মা: যুদ্ধ তো বটেই, অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ। প্রতিপক্ষ ছিল একটা আণুবীক্ষণিক বীজাণু।

আবেশ: তোমাদের সভ্যতা তাহলে বড়সড় একটা ব্রেক নিয়েছিল?

মা: বিরতিই বটে। পৃথিবীর নিজেকে রিপেয়ার করার বিরতি। প্রকৃতির সেল্ফ আইসোলেশন ফ্রম দিস ক্রুয়েল ওয়ার্ল্ড। আসলে আমরা সবাই নিজের নিজের ভাগের বাতাসটাকে এতটাই দূষিত করেছিলাম যে প্রকৃতি আমাদের তালাবন্দি করে দিল।

আবেশ: লকডাউনে আকাশটা কি বেশিই নীল দেখাত? ছবি এঁকেছিলে?

মা: আকাশটা বেশ নীল ছিল। কিন্তু তার নিচে আশ্রয় নেওয়া পরিযায়ী শ্রমিকদের জীবনের রংটা বড্ড ধূসর ছিল। সব মিলিয়ে ছবিটা ডার্ক ব্ল্যাক।

আবেশ: হুম্। অঘোষিত তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধে তোমরা সবাই সৈনিক ছিলে তাহলে?

মা: আমরা যুদ্ধ করেছিলাম কোয়ারেন্টাইন গেম, আইসোলেশন চ্যালেঞ্জ, আর ডালগোনা কফি নিয়ে। আর ওরা! ৬ ঘণ্টা পিপিই স্যুটে বন্দি। সাদা এপ্রোন। গলায় স্টেথোস্কোপ। সঙ্গে জলতেষ্টা আর টয়লেট প্রেশার।

আবেশ: ভাইরাসটা তোমাদের একেবারে নাজেহাল করে দিয়েছিল বলো।

মা: আমরা? অনেকেই তখন জাস্ট কিচ্ছু ভালো লাগছে না ফেজে দুঃখবিলাস করছি। বাড়িতে বসে থাকার বোরডমটাকে কীভাবে ইন্টারেস্টিং বানানো যায় তার অপশনস খুঁজছি। ওরা তখন হাসপাতালগুলোতে যুদ্ধ করছে। বাড়ি ফেরার দিন গুনছে। সাদা পোশাকে বাড়ি থেকে বেরোনোর সময় কাছের মানুষের দুগ্গা দুগ্গা ডাকটা খুঁজছে।

আবেশ: আচ্ছা সে বছর দুর্গাপুজো হয়েছিল? থিম কী ছিল? কোভিড নাইনটিন!

মা: থিম? কতগুলো শীর্ণ হাত! ক্ষুধার্ত মুখ, চোখের কোণে কালি… পুজোর চাঁদার সবটাই দুঃস্থ মানুষদের দেওয়া হয়েছিল, লড়াই তো তখনও শেষ হয়নি।

আবেশ: উৎসব বন্ধ! তাহলে লাল নীল আলো! প্যান্ডেলে প্যান্ডেলে ফুচকা ঘুগনির স্টল! আইসক্রিম পার্লার! এগরোল বিরিয়ানির গন্ধ ছিল না?

মা: করোনা দৈত্য রুপোর কাঠি ছুঁইয়ে আমাদের পৃথিবীকে এক্কেবারে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল।

আবেশ: তবে বিশ্বজোড়া অতিমারির সংক্রমণ বৈষম্যহীন ছিল বলো।

মা: বৈষম্যহীন! সত্যিই কি? আমরা যখন কোয়ারেন্টাইন রেসিপি শেয়ার করছি, হোম আইসোলেশন সেলফি তুলছি, ওরা তখন বুনো আলু, কচুসেদ্ধ খাচ্ছে, শ্মশানে ভিড় করছে, মৃতদেহ সৎকারের জন্য নয়, খাবার খুঁজতে, রেললাইনে শুয়ে পড়ছে, না আত্মহত্যা করতে নয়, ঘুমোতে, একেবারে ঘুম। মুক্তির ঘুম।

আবেশ: বিভেদটা তো তাহলে বিভেদের জায়গাতেই ছিল!

মা: আসলে আমরা প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা নৌকোতে ছিলাম কিন্তু ঝড়টা একটাই ছিল।

আবেশ: চারিদিকে এত মৃত্যু, হতাশা, দেখতে দেখতে দম বন্ধ লাগত বলো?

মা: পজিটিভ ছিল শুধু কোভিড নাইনটিন রোগীর সংখ্যা। বাকি সব নেগেটিভ।

আবেশ: কিন্তু ব্যস্ত সময়ে এত্তটা ফ্যামিলি টাইম এর আগে কখনও পেয়েছিলে? লাইফ হ্যাড গিভেন ইউ সামথিং কনস্ট্রাক্টিভ।

মা: জানিস, সম্পর্ক বিষয়টা বড়ই জটিল। একইভাবে দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে পলেস্তারা খসে গিয়ে এবড়োখেবড়ো দেওয়ালের মত হয়ে যায়। তার ভাঙাচোরা রূপটা বেরিয়ে পড়ে। তবে তা একদিকে ভালোই। গড়ে নেওয়ার অবকাশ পাওয়া যায়।

আবেশ: রবি ঠাকুর পড়তে খুব সেসময়?

মা: নৌকাডুবি, ঘাটের কথা, গোরা, চোখের বালি কত্ত কী। খুব ইচ্ছে ছিল, প্রথমবার তোকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়াটা যেন হয় রবি ঠাকুরের দেশে, শান্তিনিকেতন। কিন্তু ক্যালেন্ডার বরাবর মাসগুলো এগিয়েছে আর জমা হয়েছে বুকচাপা দীর্ঘশ্বাস।

আবেশ: ট্রেন-বাস মানেই তো রিস্ক ফ্যাক্টর।

মা: মনে হচ্ছিল কেমন যেন অস্পৃশ্যতার যুগে বাস করছি। ছোঁয়াছুঁয়ির ভয়, সন্দেহ আর অদৃশ্য মুখোশের বাইরেও দৃশ্যমান একটা মুখোশ। মাস্ক।

আবেশ: আর তোমার ব্যস্ততাহীন তিলোত্তমা?

মা: ক্লান্ত তিলোত্তমা একরাশ অপেক্ষা বুকে নিয়ে জিরিয়ে নিচ্ছিল। ছিল না বই বাঁধাইয়ের গন্ধ। ছিল না ভিক্টোরিয়ার আলো। ঘোড়ার গাড়ি ছিল না। বিকেলের রাস্তার ঝালমুড়িও মিসিং। নিস্তব্ধ শহীদ মিনার। কোলাহলহীন নিউমার্কেট। বহুযুগ দেখা হয়নি প্রেমিক-প্রেমিকার।

আবেশ: নস্ট্যালজিয়া? তোমরা বড্ড নস্ট্যালজিক শহরটাকে নিয়ে।

মা: শহরটাও আমাদের নিয়ে। এ শহর আমাদের অনেক অনুভূতির সাক্ষী। ফ্লাইওভার, বিজ্ঞাপন, ক্যান্টিন, কফিহাউস, বইপাড়া। কোন জাদুকরের জাদুকাঠিতে সব ভ্যানিশ।

আবেশ: বই তো তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড! নিশ্চয়ই অনেকটা সময় দিয়েছিলে বেস্ট ফ্রেন্ডকে?

মা: ম্যাক্সিম গোর্কি, পাওলো কোয়েলহো, সত্যজিৎ রায়, শেক্সপিয়ার, হেমেন্দ্রকুমার রায়, শংকর।

আবেশ: লকডাউন তোমায় ঋদ্ধ করেছিল বলো তাহলে?

মা: তার সঙ্গে আতঙ্কিতও। নিউজ চ্যানেল, ওয়েবসাইটে হিসেবের ঘরগুলোতে বেড়ে যাওয়া মৃত্যুর সংখ্যা। বারবার মনে হচ্ছিল “জীবন এত নির্মম? পৃথিবী এত কঠিন?”

আবেশ: শংকরের চৌরঙ্গী! এত নৈরাশ্য?

মা: চাকরি খোয়ানোর ভয়। মধ্যবিত্তের সঞ্চয় কমছে। তোর তখন চার মাস। ঘুমানোর সময় তোর মুখে একটা অন্যরকম হাসি লেগে থাকত। সেই হাসিটা হারিয়ে ফেলার ভয়। রেড জোনের ভয়। টিকটিকির টিকটিক। রাতের অন্ধকারটা আতঙ্ককে আরও বাড়িয়ে দিত।

আবেশ: কোথাও কোনও আশার আলো ছিল না?

মা: ছিল তো! করোনা পজিটিভ মায়ের নেগেটিভ সন্তান। স্তন্যপান। ১৫ লিটার বুকের দুধ। অন্য মায়েরা দিয়েছিল। পরিযায়ী শ্রমিকরা গ্রামের ভাঙাচোরা স্কুল রং করে দিয়েছিল। কৃতজ্ঞতা। মেয়েটা ইস্কুলে পড়ত। টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে ১১০০ টাকা জমেছিল। সবটা দিয়ে দিল পৃথিবীকে সুস্থ করতে। একটা ক্লান্ত, অবসন্ন, দুর্বল হাত। ৮৫ বছরের বৃদ্ধ। ওরা ভাবল কিছু সাহায্য করতে হবে। কিন্তু সেই হাতে ছিল জীবনের সঞ্চয়। অসুখ সারাতে হাত বাড়িয়ে দিল।

আবেশ: সহমর্মিতার লকডাউন ছিল না বলো।

মা: ভালোবাসা, স্নেহের কি লকডাউন হয়? সে তো নদীর মত বইতেই থাকে। তাই তো সেই কঠিন সময়ে আমার সবটা জুড়ে শুধু তোর গন্ধ ছিল। আসলে একটা মানুষের ভিতরে আরও অনেকগুলো মানুষ থাকে। ভালো মন্দ মিশিয়ে। আমাদের তাকে খুঁজে পেতে হয়। কঠিন সময়টা কারও সেই ভালো মানুষটাকে খুঁজে দিয়েছিল, কারও আবার মন্দ মানুষটাকে।

আবেশ: আচ্ছা ধরো, টাইম মেশিনে চেপে যদি ওই সময়টাতে ফিরে যেতে হয়, কীসের জন্য ফেরত পেতে চাইবে সময়টা?

মা: তোর জন্য। তোর তখন চার মাস। তোর গলা জড়িয়ে আদর, অবাক চোখে নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা, বারান্দার সবুজ গাছগুলোকে ছোঁয়ার চেষ্টা, সূর্যের আলোয় চিকচিক করা গাল। তুই ছিলি বলেই ওরকম একটা বুকে পাথরচাপা কষ্টের মতো সময় একটু হলেও সহজে পেরোতে পেরেছিলাম।

আবেশ: তারপর! সোনার কাঠি কে ছোঁয়াল শেষে? কোনও জাদুকর এসেছিল?

মা: একজন নয়, সাদা পোশাক পরা হাজার হাজার জাদুকর। বিজ্ঞানকে মানুষের প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারা জাদুকর। সেবার জাদু। মাসের-পর-মাস বিনিদ্র রাত। অনেকগুলো সোনার কাঠির ছোঁয়া। সেরে উঠেছিল পৃথিবী। কিন্তু অনেক অসহায় প্রাণের বিনিময়ে, অভুক্ত, একবেলা না-খাওয়া দিনের বিনিময়ে, সন্তানকে দীর্ঘদিন না দেখার যন্ত্রণার বিনিময়ে, হারিয়ে যাওয়া খেলার মাঠের বিনিময়ে।

আবেশ: অনেক আঁধার পেরিয়ে আলোটা এসেছিল তাহলে…

মা: কিন্তু আলোটা বড্ড দামী ছিল। দপ করে নিভে যাওয়া পৃথিবীর আলো জ্বলতে সময় লেগেছিল। আসলে বোবা কষ্ট, যন্ত্রণাগুলো চাপচাপ রক্তের মতো জমে ছিল। অসুখ সারলেও সেই ক্ষতগুলো মিটতে অনেকটা সময় লেগেছিল।

আবেশ: মহামারির আগের পৃথিবী আর পরের পৃথিবী?

মা: আসলে এতগুলো চ্যালেঞ্জ ছিল আমাদের সামনে! অনেকদিন অন্ধকারে বন্দি থাকার পরে মুক্তি পেলেও আলোটা খুব অচেনা লাগে। তাকে আরেকবার আপন করে নিতে লাগে অনেকটা সময়। তবে সেই সময়টুকুর ওপারে  “Without the dark we’d never see the stars“।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4418 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...