অনন্য অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়

অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় | বিজ্ঞানী

মানস প্রতিম দাস

 


লেখক বিজ্ঞান-বিষয়ক নিবন্ধকার ও সম্প্রচারক

 

 

 

 

অমলেন্দুবাবুর সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল রাজাবাজার সায়েন্স কলেজে, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের কাউন্সিল মিটিংয়ে। সেটা মাস কয়েক আগের কথা। কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি, মেঘনাদ সাহার হাতে গড়া এই সংস্থার বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে যুক্ত থেকেছেন জীবনের নানা সময়। মিটিংয়ে তাই তাঁর সরব উপস্থিতি দেখতে অভ্যস্ত আমরা। তর্কবিতর্কে সবসময় জড়িয়ে পড়ার মানুষ তিনি নন কিন্তু প্রয়োজন বুঝলে নিজের মতামত জানাতে দ্বিধা করতেন না। শেষ মিটিংয়ে দেখলাম, প্রায় নীরব থাকলেন। এমনকি  মিটিং শেষে বেশ উৎসাহের সঙ্গে তাঁর ‘থ্যাঙ্কস টু দ্য চেয়ার’ বলাটাও পেলাম না সেদিন। সংস্থার অন্যান্য  সদস্যের মত তাঁর সঙ্গে আবার দেখা হবে, এই আশা নিয়েই মিটিং ছেড়ে এলাম। সে আশা আর পূর্ণ হবে না, আক্ষেপ নিয়েই থাকব।

এদেশে জ্যোতির্বিজ্ঞানের জনপ্রিয়করণের সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে গিয়েছে অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম। সূর্যগ্রহণের সময় এগিয়ে এলে, সূর্যের উপর শুক্রের সরণের সময় উপস্থিত হলে আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে তাঁর বক্তব্য পড়ার বা শোনার অপেক্ষায় থাকতাম। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতের বহু নামী পত্রিকার পাতায় ছাপা হত তাঁর বিবৃতি, পূর্ণাঙ্গ প্রবন্ধ। সম্পাদকেরা আগেভাগে জানিয়ে রাখতেন তাঁদের দাবি। অবশ্য গণমাধ্যমে নিজেকে সীমিত রাখতেন না অমলেন্দুবাবু। স্লাইড শোয়ের যান্ত্রিক ব্যবস্থাটা বগলদাবা করে পৌঁছে যেতেন দূরদূরান্তে। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে বা আধা শহরের কমিউনিটি হলে তাঁর উপস্থাপন দেখতে জড়ো হত বাচ্চা থেকে বুড়ো, চাকুরে থেকে চাষি। সবাই কিছু না কিছু জ্ঞান নিয়ে ফিরে যেত সভা থেকে। গড়গড় করে শুকনো তথ্য পরিবেশন তাঁর স্টাইল ছিল না কোনওদিন। সামনে উপস্থিত দর্শকের মর্মে যেন কথাগুলো আঘাত করে সেভাবেই বলতেন তিনি। কণ্ঠ কখনও উঠছে, কখনও নামছে। পর্দায় দেখানো কোনও একটা মহাজাগতিক বস্তুকে নির্দেশ করতে তাঁর শরীর কখনও নুয়ে পড়ছে, কখনও বক্তব্য জোরালো করতে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ছেন তিনি। এক কিংবা দেড় ঘণ্টার উপস্থাপনের প্রত্যেকটা মুহূর্তে নাটকীয়তা। বিজ্ঞানকে মানুষের হৃদয়ে পৌঁছে দিতে প্রত্যেক বাক্যে বিপুল আবেদন। এখানেই তিনি অন্যদের থেকে পৃথক, এই শৈলীর জন্যই তিনি জনপ্রিয় হয়ে থেকেছেন সারা ভারত জুড়ে।

এ পৃথিবীতে চোখ মেলার সময় থেকেই মানুষ বিস্মিত হয়েছে মাথার উপরে আকাশের আচরণ দেখে। দিনের আকাশে সূর্যের চলন, গ্রহণের সময় সেই উজ্জ্বল শরীরের ঢাকা পড়া, রাতের আকাশে গ্রহ-নক্ষত্রদের গতিবিধি, চাঁদের অদ্ভুত নিয়মানুবর্তিতা, উল্কার অগ্নিময় শরীরের নড়াচড়া দেখে মানুষ কখনও কৌতূহলী হয়েছে, কখনও আবার ভয় পেয়ে গুটিয়ে নিয়েছে নিজেকে। আকাশের সদস্যদের এই চলাফেরার ব্যাখ্যা তৈরি করা হয়েছে সভ্যতার সব পর্বেই। সময় যত এগিয়েছে, বিজ্ঞানের ভিত্তি যত শক্ত হয়েছে, তত এই সব ব্যাখ্যার মধ্যে থেকে অলৌকিক উপাদান বাদ পড়েছে। তবে সমাজের একটা বড় অংশ চিরকালই আকাশের আচরণের সঙ্গে নিজেদের ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানকে যুক্ত করে রেখেছে। গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থানের উপর নির্ভর করে নিজেদের কাজকর্ম সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন এই অংশের নাগরিকরা, হাতের রেখা দেখিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ জানার কাজটা নিয়মিত করে চলেন এঁরা। জন্মের সময় অনুযায়ী কোষ্ঠীবিচার করাটাকেও এঁরা জীবনের আবশ্যিক অঙ্গ বলে মেনে এসেছেন। এই গোটা প্রক্রিয়ার পুরোহিত যিনি তাঁকে আমরা চিনি জ্যোতিষী নামে। জ্যোতিষশাস্ত্র তাঁর অধীত বিদ্যার নাম, সেটার শক্তি বোঝাতে তাঁর তৎপরতার শেষ নেই। আধুনিক বিজ্ঞান জ্যোতিষকে ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দিয়েছে। তাতে অবশ্য ভাগ্য ফেরাতে গ্রহরত্ন ধারণ বা তাগা-তাবিজ-মাদুলির জন্য অর্থব্যয়ে ভাঁটা পড়েনি। জ্যোতিষের ব্যবসাও চলছে রমরম করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের নতুন-নতুন আবিষ্কারের খবরে বিচলিত হন না জ্যোতিষ-নির্ভর জনগোষ্ঠী। ফলে তাঁদের বোঝানোর জন্য আলাদা উদ্যোগের প্রয়োজন। দীর্ঘ সময় ধরে এই উদ্যোগের পুরোভাগে থেকেছেন অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। এমন নয় যে এই কাজটা আর কেউ করেননি। কিন্তু ধারাবাহিকতার দিক থেকে চিরকালই শ্রদ্ধার আসনে থেকেছেন তিনি। ছোটবড় বহু বিজ্ঞান ক্লাব তাঁর দিকে তাকিয়ে থেকেছে নিজেদের এলাকায় জ্যোতিষ-বিরোধী প্রচারসভা সংগঠিত করতে। তাঁর লেখা সম্বল করে পুস্তিকা প্রকাশ করেছে এই সব সংগঠন। আবার জ্যোতিষের আজগুবি দাবির বিরুদ্ধে তাঁর নিজের লেখালেখি একটা গোটা বই হিসাবেও প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় ‘জ্যোতিষ কি আদৌ বিজ্ঞান?’, ইংরেজিতে ‘ইজ অ্যাস্ট্রোলজি আ সায়েন্স?’ এ প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেক আগের একটা ঘটনার কথা বারবার উল্লেখ করতেন তিনি। ১৯৯১ সালের কোনও একটা সময় কলকাতার ইংরেজি দৈনিকে লেখেন জ্যোতিষীদের বিরুদ্ধে। লেখা বেরোবার পর থেকেই তাঁকে ফোনে হুমকি দেওয়া হতে থাকে। এমনকি তাঁর স্ত্রীকেও ভয় দেখানো হয় যে বিধবা হতে হবে তাঁকে। এতে অবশ্য কাবু করা যায়নি তাঁকে। একইরকম উৎসাহের সঙ্গে তিনি প্রচার চালিয়ে গেছেন জ্যোতিষের বিরুদ্ধে। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার একবার যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে জ্যোতিষকে অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনার কথা জানাল তখনও নিরলসভাবে ভিত্তিহীন জ্যোতিষের বিরুদ্ধে স্লাইড সহ বক্তৃতা দিয়ে গিয়েছেন অমলেন্দুবাবু।

সারা জীবন ধরে এই কর্মোদ্যোমের রহস্য কী? জিজ্ঞাসা করলে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের কথায় ফিরে যেতেন তিনি। সেখান থেকেই ইন্টারমিডিয়েট, স্নাতক আর স্নাতকোত্তর পর্বের পড়াশোনা শেষ করেন হাওড়া জেলার বাগনান ব্লকের মুগকল্যাণ গ্রামের ছাত্রটি। এখানেই তাঁর পরিচয় হয় জ্যোতির্বিজ্ঞানের অসামান্য একজন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে। এমএসসি-তে স্পেশাল পেপার হিসাবে নিয়েছিলেন অ্যাস্ট্রোনমি আর সেটা পড়াতেন বিষ্ণু বাসুদেব নারলিকার। আজকের বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী জয়ন্ত বিষ্ণু নারলিকারের পিতা তিনি। ক্লাসে তাঁর পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ইত্যাদি পড়ানোতে যেমন আকৃষ্ট হত ছাত্ররা তেমনি তারা উপভাগ করত মাস্টারমশাইয়ের দেওয়া পপুলার লেকচারগুলো। বিষ্ণু বাসুদেব ছাত্রদের বলতেন, সাধারণ মানুষের কাছে জ্যোতির্বিজ্ঞান নিয়ে বলতে গেলে ভালো-ভালো ছবি নিয়ে যাওয়া দরকার। সে কথা আজীবন মনে রেখেছেন তাঁর ছাত্র অমলেন্দু।

পরিবারের আয়ের উৎস বলতে বাবার স্কুলশিক্ষকতা। গ্রামের স্কুলে মাসমাইনে সামান্য। গ্র্যাচুইটি, প্রভিডেন্ট ফান্ড বলতে কিছুই নেই। সংসারের হাল ফেরাতে সবাই তাকিয়ে জ্যেষ্ঠ সন্তান অমলেন্দুর দিকে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকিয়েই তাঁকে ঢুকতে হল চাকরিতে। বেনারসের ডিএভি কলেজে অঙ্কের লেকচারার হিসাবে তাঁর প্রবেশ। সেখানেও অবশ্য মাইনে খুব বেশি কিছু নয়, মাসের শেষে তিনি পেতেন একশো বিরানব্বই টাকা। বাড়ি ফিরলে মা বললেন শিক্ষকতা ছেড়ে অন্য কিছুর দিকে তাকাতে, ভারত সরকারের কোনও চাকরি খুঁজতে। মায়ের কথা মেনে ইউনিয়ন পাবলিক সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় বসলেন, নির্বাচিত হলেন ইন্ডিয়া মিটিওরোলজিক্যাল ডিপার্টমেন্টে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসাবে। ১৯৫৫ সালের ডিসেম্বর মাসে মেঘনাদ সাহা নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিট নামে ছোট একটা বিভাগ স্থাপন করলেন আলিপুরে মিটিওরোলজিক্যাল অফিসের মধ্যে। পরের বছর এখানে যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেন অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। বছরের নানা সময়ে গ্রহ-নক্ষত্রের অবস্থান নির্ণয় করে ইন্ডিয়ান অ্যস্ট্রোনমিক্যাল এফিমারিস নামে একখানা ভারী বই তৈরি করতে হত এই বিভাগকে। কিন্তু আলিপুর অফিসের অধিকর্তা এই বিভাগকে সুনজরে দেখতেন না। নানারকম বাধা তৈরি করতেন প্রতিদিন। এদিকে হঠাৎ করেই ডিব্রুগড় এয়ারপোর্টে বদলি হয়ে গেলেন অমলেন্দু, পাঁচ বছরের বেশি সেখানে কাজ করতে হল তাঁকে। ১৯৬২ সালে পদোন্নতি পেয়ে আবার আলিপুরের ইউনিটে ফিরলেন তিনি। মেঘনাদ সাহা তখন আর বেঁচে নেই, নটিক্যাল অ্যালম্যানাক ইউনিটের প্রতি সেই একই অবহেলার পালা চলছে। সাংসদ হীরেন মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে কেন্দ্রীয় সরকারের দ্বারস্থ হলেন অমলেন্দু। সরকার একটা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি তৈরি করেছিল যার কাজের মধ্যে অন্যতম ছিল এই নটিক্যাল অ্যালম্যানাকের কাজকে উন্নত করা। সেই কমিটিতে ডাক পড়ল তাঁর, চেয়ারম্যান রাজা রমান্নার কাছে তিনি ব্যাখ্যা করলেন পরিস্থিতিটা। কমিটি বিষয়টা উপলব্ধি করে অ্যালম্যানাকের কাজ আলিপুর অফিস থেকে সরানোর নির্দেশ দিল। এর অবশ্য অনেক পরে, ১৯৮০ সালে, এই বিভাগ পরিণত হল এক পূর্ণাঙ্গ প্রতিষ্ঠানে— পজিশনাল অ্যাস্ট্রোনমি সেন্টার। অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম অধিকর্তা। বর্তমানে সল্টলেকের সেক্টর ফাইভে এই সেন্টারের বিরাট অফিস। তখনকার সরকারি নিয়ম অনুযায়ী আটান্ন বছর বয়সে ১৯৮৮ সালে অবসর নেন তিনি। এর পর মন ঢেলে দিলেন লেখালেখি, সম্প্রচার এবং মানুষের কাছে গিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞান বোঝানোর কাজে।

এই সময়েই আবার নতুন করে কাজ শুরু করার আমন্ত্রণ এল কলকাতার বিড়লা প্ল্যানেটারিয়ামের কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে। ১৯৮৯ সালে তিনি যোগ দিলেন অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল রিসার্চের ইন-চার্জ হয়ে। সেখানে তখন রয়েছেন সমবয়স্ক আর এক বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী, রমাতোষ সরকার। এই দুজনের যৌথ প্রয়াসে প্রাণ পেল প্ল্যানেটারিয়ামের শিক্ষাদান আর গবেষণা। অমলেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্মরণ করতে গেলে এই অসামান্য সময়ের কথা বারবার ভেসে ওঠে মনে। বহু পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আলাদা করে উল্লেখ করতে হয় ১৯৯৫ সালে বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের জন্য ভারত সরকারের দেওয়া পুরস্কার এবং ২০১২ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া ‘জগত্তারিণী স্বর্ণপদক’। শেষে অবশ্য সেই চেনা কথাটাই বলতে হয়, এই সব পুরস্কারের ঊর্ধ্বে রয়েছে মানুষের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। চিরসবুজ থাক তাঁর স্মৃতি।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4643 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...