মোহন মানি
লেখক বেঙ্গালুরুর ইন্ডিয়া ইউনিভার্সিটির ন্যাশনাল ল স্কুল-এর সেন্টার ফর লেবার স্টাডিজের ভিজিটিং ফেলো
লেখার শিরোনামে মার্কেজের সেই বিখ্যাত জাদুবাস্তব— যাকে অনায়াসেই বিগত শতকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকীর্তি বলা যায়— সেই ‘কলেরার দিনগুলিতে প্রেম’-এর একটা তুচ্ছ অনুকরণের চেষ্টা করা হল। এই বর্তমান কোভিড সঙ্কট কি জাদুবাস্তবের চেয়ে কম কোনও অংশে? দু-দুটো বিশ্বযুদ্ধ, তার পরবর্তীকালের বেশ কটি অর্থনৈতিক সঙ্কটও যা করতে পারেনি এই আণুবীক্ষণিক ভাইরাসটি তা-ই করে ছেড়েছে— পুঁজিবাদের দার্শনিক ভিত্তিকেই একেবারে মাটি ধরিয়ে ছেড়েছে। শেয়ার বাজারগুলি ধ্বসে পড়েছে, এই বিশ্বায়নের যুগে মানুষের চলাচলকে পুরো স্তব্ধ করে দিয়েছে, আর ফলশ্রুতিতে আমরা প্রত্যক্ষ করছি একের পর এক দেশের অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া। আইএমএফ-এর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী ২০২০তে বিশ্ব-অর্থনীতি ৩ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়ে যাবে।[1] এবং সেই একই সময়কালে ভারতের জিডিপি ৪.৫ শতাংশ হ্রাস পাবে বলে জানিয়েছে তারা।[2]
কাজের দুনিয়ায় এই অতিমারির প্রভাব সরাসরি নেতিবাচক। কাজের কথা, একটু ভেঙে বললে, কাঁচামাল উৎপাদন এবং সংগ্রহ, তা থেকে পণ্য উৎপাদন, সেই পণ্য পরিবহন, এবং শেষ অব্দি তাকে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া— এই পুরো প্রক্রিয়াতেই আদানপ্রদান প্রয়োজনীয়। অন্যদিকে এই অতিমারি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজন বিচ্ছিন্নতার। ফলত একটা সর্বব্যাপী লকডাউন যে বেকারত্বকে মাত্রাছাড়া করে দেবে তা খুব স্বাভাবিক। সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকনমি (সিএমআইই)-র হিসেব অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার চলতি বছরের জানুয়ারিতে ৭.২২ শতাংশ থেকে মে মাসে ২৩.৪৮ শতাংশে পৌঁছেছে।[3] অর্থাৎ মাত্র পাঁচ মাসে বৃদ্ধি পেয়েছে তিন গুণেরও বেশি। এবার প্রায় ৫০ কোটি কর্মপ্রার্থী মানুষ নিয়ে গঠিত ভারতের শ্রমবাজারে এই সংখ্যাগুলির অর্থ হল এই জুন মাসে আনলক ১.০-র শুরুতে আমরা এমন ১২ কোটি মানুষ পেলাম যাঁরা কাজ হারিয়েছেন। অর্থনৈতিক কাজকর্ম আবার শুরু হলে এই সংখ্যাটা হয়তো কমবে, কিন্তু পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হতে— অর্থাৎ একটা সুস্থিত অর্থনৈতিক অবস্থা, যেখানে বেকারত্বের হার দুই অঙ্কের নীচে থাকবে— যে আরও বেশ কিছুটা সময় লাগবে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। আমাদের এটা মাথায় রাখতে হবে যে ভাইরাসটি আরও অনেকদিন আমাদের সঙ্গে ঘর করবে, এবং অতিমারি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে মাঝেমধ্যেই স্থানীয় স্তরে কিছু লকডাউনের প্রয়োজন হবে। এর ফলে অর্থনীতিতে পর্যায়ক্রমে ধাক্কা আসতেই থাকবে। মানুষের উপার্জন এবং কাজের বাজার দুইই ব্যাহত হতে থাকবে।
অভিবাসী শ্রমিকদের কথা
এই অর্থনৈতিক স্থিতাবস্থা মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রের পদক্ষেপগুলিকে ভালো কথায় বললে মিশ্র বলা যেতে পারে, আর সোজা কথায় বিভ্রান্তিকর। এই বিভ্রান্তি সবচেয়ে বেশি লক্ষ করা গেছে অভিবাসী শ্রমিকদের বিষয়টিতে। কখনও তাঁদের শহর ছাড়তে বলা হচ্ছে, তো কখনও বলা হচ্ছে তাঁদের যাত্রা থামাতে। এই চূড়ান্ত অপরিকল্পনা এবং অবিবেচনার ফলে আমাদের দেশের অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ এবং স্পর্শকাতর এক বিরাট অংশের জনগণকে পথে নামতে হয়েছে— পথে নামতে হয়েছে প্রায় কপর্দকশূন্য অবস্থায়, হাঁটতে বাধ্য হতে হয়েছে মাইলের পর মাইল, পেছনে তাড়া করেছে সংক্রমণের আতঙ্ক। এই একদিকে ক্ষুধার্ত এবং অন্যদিকে চূড়ান্ত অসম্মানিত মানুষগুলির স্রোত এতটাই ব্যাপক ছিল যে স্থানীয় থেকে আন্তর্জাতিক সমস্ত মিডিয়া তো এ নিয়ে হইচই করেইছে, এমনকি সুপ্রিম কোর্টও বাধ্য হয়েছে বিষয়টিকে গোচরে এনে সরকারের সমালোচনা করতে।
কত শ্রমিক যে এইভাবে পথে নামতে বাধ্য হলেন তার সঠিক সংখ্যাটা কারও কাছেই নেই। বিশ্বব্যাঙ্ক বলছে, এদেশে লকডাউনের ফলে কমবেশি ৪ কোটি অভিবাসী শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।[4] এই অভিবাসী শ্রমিকদের আবার একটা বড় অংশই অসংগঠিত ক্ষেত্রে কাজ করেন। এই লকডাউন এবং তার পরবর্তীতে ঘরে ফেরার ভয়াবহ প্রক্রিয়া তাঁদের মনে যে ভয়াবহ আতঙ্কের জন্ম দিল, তাতে আবার ঠিক কবে, এবং তাঁদের কতজন যে আবার শহরে ফিরবেন তা পুরোটাই অনিশ্চিত। সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের অধ্যাপক ইরুদায়া রাজনের মতে যাঁরা গ্রামে ফিরে গেছেন তাঁদের অন্তত ৩০ শতাংশই আর শহরে ফিরবেন না।[5] এর অর্থ, দেশে মোট অভিবাসী শ্রমিকের সংখ্যা যদি ৪ কোটির আশেপাশে হয় এবং তার অর্ধেকও যদি গ্রামে ফিরে গিয়ে থাকেন, তবে অন্তত ৬০ লক্ষ মানুষ আর নিকট ভবিষ্যতে আগের কাজে ফিরবেন না। স্পষ্টতই এর প্রভাব পড়বে সামগ্রিকভাবে অর্থনৈতিক স্বাস্থ্যোদ্ধারের ওপর— অর্থনীতির নতুন কাজ সৃষ্টির ক্ষমতাও ব্যাহত হবে।
এখন, অভিবাসী শ্রমিকরা নিজেদের রাজ্যে ফিরে যাওয়ার পর সেসব জায়গায় কাজের খোঁজ বাড়বে। নির্দিষ্ট করে বললে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পেতে হবে, কারণ বেশিরভাগ অভিবাসী শ্রমিকরাই গ্রামের মানুষ। কিন্তু এই অতিমারি গ্রামীণ অর্থনীতি এবং কাজের বাজারকেও রেয়াত করেনি। সিএমআইই-র হিসেব অনুযায়ী ২০১৯-২০-তে গ্রামীণ ভারত গড়ে ২৭.৬ কোটি মানুষের কাজের ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু লকডাউনের পরে সেই সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে ১৯.৭ কোটিতে। অর্থাৎ গ্রামীণ কাজের বাজার ইতিমধ্যেই প্রায় তিরিশ শতাংশ সঙ্কুচিত।[6] কেন্দ্র সরকার যদিও তার প্যাকেজে এমজিএনআরইজিএ-তে বেশ কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছে, কিন্তু সেই অর্থ কাগজে কলমে গ্রামীণ কর্মসংস্থানে বড়জোর ১০ শতাংশ বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।[7] অতএব, একটা বড় ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে, এবং মনে রাখতে হবে, আমরা এ সবই আলোচনা করছি গ্রামে ফিরে যাওয়া শ্রমিকদের হিসাবে না রেখে।
শ্রম আইন সংস্কার
এই পরিস্থিতিতেই রাজ্য সরকারগুলি শ্রম আইন ‘সংস্কারে’ নেমেছে। বলছে, শ্রম আইনকে নাকি এখন যথেষ্ট লগ্নি-বান্ধব হতে হবে। উদাহরণস্বরূপ উত্তর প্রদেশের কথা ধরা যাক। সেখানে সরকার অর্ডিন্যান্স জারি করে প্রায় সমস্ত শ্রম আইনগুলিকে তিন বছরের জন্য রদ করেছে, দিনে ন্যূনতম কাজের সময় ১২ ঘণ্টা করে দিয়েছে।[8] এই দৈনিক ন্যূনতম ১২ ঘণ্টা এবং সাপ্তাহিক ৭২ ঘণ্টা কাজের ফরমান জারি করেছে মধ্য প্রদেশ, গুজরাট এবং হিমাচল প্রদেশ সরকারও। পাঞ্জাব, ওডিশা এবং মহারাষ্ট্র সরকারও শ্রমিকদের কাজের যাবতীয় আইনি রক্ষাকবচগুলিকে যথাসাধ্য লঘু করে এই ‘সংস্কার’ সাধনে নেমেছে। বোঝাই যাচ্ছে শ্রমিকদের এত বছরের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত অধিকারগুলিকে কেড়ে নেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারগুলিকে এই অতিমারি একটা সুবিধাজনক পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। কেন্দ্র সরকার চারটি শ্রম কোড এনে শ্রম আইন যতটুকু শিথিল করতে চাইছিল, এই রাজ্য সরকারগুলি তাকেও ছাপিয়ে বহু দূর এগিয়ে গেছে।
মনে রাখা যাক, ঐতিহাসিক মে-দিবসের আন্দোলনের মুখ্য দাবিটিই ছিল দৈনিক ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ নয়। আজ তার সোয়াশো বছরেরও বেশি পরে সরকার এবং মালিকশ্রেণি এই অতিমারিকে ঢাল করে শ্রমিকদের সেই অর্জন ছিনিয়ে নেওয়ার ষড়যন্ত্রে নেমেছে।
যাই হোক, অন্য সব কথার আগে এই কোভিডের কথাটাই বলে নেওয়া যাক। শ্রমিকরা যখন আবার কাজ শুরু করতে আসছেন তখন তাঁদের সংক্রমণ এবং তার পরবর্তী চিকিৎসার জন্য কতটা রক্ষাকবচ দেওয়া হচ্ছে? যখন শারীরিক দূরত্ব সহ স্বাস্থ্যবিধিগুলি কঠোরভাবে মানা প্রয়োজন তখন দৈনিক শ্রমসময়ের বাধ্যতামূলক বৃদ্ধি সেগুলি পালনে কতটা সহায়ক হবে? অতিরিক্ত কাজের বোঝা ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য তাঁদের শরীরে প্রয়োজনীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তুলবে নাকি বিনষ্ট করবে? মনে রাখতে হবে এগুলি কোনও ব্যক্তি-শ্রমিকের সমস্যা নয়, কারখানায় কাজ করা সমস্ত শ্রমিকের বিপদ, এবং তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যেখানে বসবাস করেন সেই সব এলাকার মানুষদেরও বিপদ।
লকডাউনের শুরুতেই, ২৯ মার্চ, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক একটি নোটিফিকেশন দিয়ে সমস্ত মালিকদের এই লকডাউনের সময়ে কর্মীদের পুরো মাইনে দিতে বলেছিল। কিন্তু বহু মালিকই এপ্রিল এবং মে মাসে কর্মীদের মাইনে দিতে অস্বীকার করেন। কারণ, অর্থের অভাব। তাঁরা উলটে সরকারকেই এই মাইনে দেওয়ার দায়িত্বটা নিতে বলেন, বা পুরো মাইনে না হলেও যেন কিছু ভর্তুকি এই বাবদ তাঁদের দেওয়া হয় সে আর্জি জানান। তাঁরা এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড (ইপিএফ) এবং এমপ্লয়িজ স্টেট ইন্সিওরেন্স কর্পোরেশন (ইএসআইসি)-কে এ ব্যাপারে দায়িত্ব নেওয়ার পরামর্শও দেন। ইপিএফ-এর টাকা কিন্তু শ্রমিক-কর্মচারীদেরই টাকা, এবং সেই টাকা থেকে শ্রমিকদের বেতন দেওয়ার অর্থ হল, এই লকডাউনের সময়ে শ্রমিকদের অস্তিত্বরক্ষার দায়টা পুরোপুরি তাঁদের ঘাড়েই চাপিয়ে দেওয়া। একইভাবে, ইএসআইসি-র ফান্ড ব্যবহারের প্রভাবও পড়বে সরাসরি শ্রমিক-কর্মচারীদেরই ওপর, তাঁদের ঠিকঠাক স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সম্ভাবনা বিনষ্ট হবে। ইএসআইসি-র আর্থিক সংস্থান ইতিমধ্যেই কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে রয়েছে। গত বছরের (২০১৯) জুলাই মাস থেকে মালিক এবং শ্রমিকদের এই খাতে দেয় অর্থ নির্দিষ্ট কর্মীটির বেসিক বেতনের ৬.৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৪ শতাংশ করে দেওয়া হয়েছে।[9] এবার অঙ্কটা করে দেখা যাক। ২০১৯-এর ৩১ মার্চের হিসাব অনুযায়ী ইএসআইসি-র নথিভুক্ত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৩.৬ কোটি।[10] এখন তাঁদের যদি মাসিক ১০০০০ টাকা করেও মাইনে ধরা যায়, তবে এই বেতনের বোঝা ইএসআইসি-র ঘাড়ে চাপলে তাদের খরচ হবে মাসিক ৩০০০০ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৬-১৭ আর্থিক বছরটিতে ইএসআইসি-র মোট যত খরচ হয়েছিল— শ্রমিক-কর্মচারীদের ওষুধ এবং চিকিৎসা বাবদ ব্যয় এবং নিজেদের কর্মচারীদের বেতন— এই উপরোক্ত সংখ্যাটি তার তিনগুণ।[11] এরই মধ্যে গত মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট একটি অন্তর্বর্তী রায়ে যে সমস্ত মালিক লকডাউন সময়কালে কর্মচারীদের মাইনে দেয়নি, তাদের বিরুদ্ধে কোনওরকম ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না বলে ফরমান দিয়েছে। অতএব, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের নোটিফিকেশনটি এখন স্রেফ একটি নখদন্তহীন বাজে কাগজ।
অসংগঠিত ক্ষেত্র
কর্মজগতে কোভিড সঙ্কটের প্রভাব সংক্রান্ত আলোচনার বেশিটাই আবর্তিত হয়েছে সংগঠিত ক্ষেত্রকে কেন্দ্র করে। কিন্তু অসংগঠিত ক্ষেত্রের চিত্র পুরোটাই আলাদা। এই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরাই কিন্তু শহুরে শ্রমশক্তির প্রায় ৯০ শতাংশ, এবং গ্রামীণ শ্রমশক্তির প্রায় পুরোটাই। ভারতের এই বিপুল অসংগঠিত ক্ষেত্রের কোভিড-পূর্ব অবস্থার ছবিটা কীরকম? নোটবন্দির ধাক্কা এখনও পুরোপুরি সামলে ওঠা যায়নি; তাড়াহুড়ো করে চালু করা জিএসটি একে বেসামাল করে দিয়েছে; আর এক সামগ্রিকভাবে ধুঁকতে থাকা অর্থনীতির বোঝা এর প্রায় শ্বাস রোধ করে এনেছে।
অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা সরকারের কোনও রক্ষাকবচও পান না। ফলে সরকার এখানে মালিকদের কাছে ‘ছাঁটাই করবেন না’ বা ‘পুরো মজুরি দেবেন’ জাতীয় কোনও নোটিফিকেশন জারি করতে সক্ষম নয়। ফলে এই শ্রমিকদের জন্য একমাত্র নিদান ছিল— যেমনভাবে পারো ভেসে থাকো, নইলে…।
এঁরাই কিন্তু আবার ছিলেন কোভিড সংক্রমণের সবচেয়ে সহজ লক্ষ্যবস্তু। ঘিঞ্জি বস্তি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, জল এবং নিকাশি ব্যবস্থা নিম্নমানের বললেও কম বলা হয়— এই হচ্ছে এঁদের বাসস্থানের স্বাভাবিক চিত্র। শারীরিক দূরত্ববিধি বজায় রাখা তো দূরস্থান, এঁদের নিয়মিত জীবাণুনাশক ব্যবহার করা বা হাত ধোয়াও সম্ভব হয় না। মুম্বাইয়ের ধারাভি বস্তির ঘটনা এই অতিমারিতে এঁরা কী ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে পারেন, তার একটা আদর্শ উদাহরণ। আক্রান্ত হলে নিরাপদ চিকিৎসার সুযোগ নেওয়ার কোনও উপায় তাঁদের সামনে খোলা নেই। তাঁরা পুরোপুরি ভিড়ের চাপে নাভিশ্বাস ওঠা সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থার দয়ার ওপর নির্ভরশীল।
আর কাজের কথা? পুরসভার চুক্তি-শ্রমিক এবং ‘আশা’ কর্মীদের কথা ধরা যাক। এঁরা শহর পরিষ্কার রেখেছেন, মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরীক্ষা করেছেন এবং নিয়মবিধি ঠিকমতো মানা হচ্ছে কিনা তা দেখভাল করেছেন। অর্থাৎ এই ভাইরাস সংক্রমণ যাতে নিয়ন্ত্রণের বাইরে না চলে যায় সে বিষয়ে এঁরাই প্রথম সারির যোদ্ধার ভূমিকা পালন করেছেন। এবং সেগুলি করতে গিয়ে এঁরা যে প্রায়ই জনরোষের শিকার হয়েছেন সে খবরও আমাদের অজানা নয়। তা ছেড়ে দিলেও মূল বিষয়টি হচ্ছে, এঁদের কাজ এবং স্বাস্থ্য কোনওটিরই যথেষ্ট সুরক্ষা নেই, এবং মজুরিও যৎসামান্য। ছোট ব্যবসায়ীদের কথা ধরা যাক। এঁরা নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সরবরাহ বজায় রেখে এই অতিমারির সময়ে নাগরিক জীবন সচল রেখে গেছেন। করোনার বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই সমস্ত সামনের সারির যোদ্ধাদের কিন্তু আমরা যথেষ্ট স্বীকৃতি দিইনি। এঁদের অনেকেই আবার লকডাউনের মধ্যেও কাজ করতে বাধ্য হয়েছেন— এরকম অনেক ঘটনাও শোনা গেছে যে গৃহপরিচারক-পরিচারিকাদের বলে দেওয়া হয়েছিল, কাজে না এলে মাইনে পাবে না। এঁরা বাধ্য হয়েছেন, কারণ এঁদের মধ্যে অনেকেই আছেন যাঁদের রেশন থেকে সরকারি খাবার কিনে খাওয়ারও ক্ষমতা ছিল না।
নারীদের ওপর প্রভাব
এই অতিমারির ফল বেশি মারাত্মকভাবে পড়েছে মহিলাদের ওপর। এমনিতে এটা চিরাচরিত বিষয় যে, যে কোনও সঙ্কটের সময়ে প্রথম কর্মহারা হন মহিলারা, এবং তাঁদের ফিরে যেতে হয় ঘরে। এবং ঘরে থাকা মানে কিন্তু কোনওভাবেই কাজের চাপ কমা নয়। বাড়ির পুরুষ সদস্য এবং শিশুরা বাড়িতে সর্বক্ষণ উপস্থিত থাকলে বাড়ির কাজ অনেক বেড়ে যায়, এবং একটি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে যা অনিবার্যভাবেই মুখ্যত মহিলাদের ঘাড়ে চাপে। কাউকে যদি বিশেষ সেবাযত্ন করতে হয়— তিনি কোভিড-পেশেন্টও হতে পারেন— সে-ও মূলত মহিলাদেরই দায়িত্ব। গরীব পরিবারগুলিতে তো মহিলাদের এগুলির সঙ্গে বাড়িতে বসে যেসব উপার্জন করা সম্ভব সেগুলিও করে যেতে হয়। এবার বাড়ির পুরুষ সদস্যটি কাজ এবং উপার্জন নিয়ে চরম অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। তাঁদের সেই উদ্বেগজনিত প্রতিক্রিয়ার ফল কারা ভুগবেন? বাড়ির মহিলারা। লকডাউনের শুরু থেকে গৃহ-হিংসার পরিমাণ যে তাৎপর্যপূর্ণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে, তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই![12]
অতএব, ভবিষ্যৎ
তো আগামী মাসগুলিতে আমরা কীরকম পরিস্থিতি আশা করতে পারি? নিওলিবারেল মতের প্রবক্তারা আমাদের বোঝাতে চাইবেন যে এটা নিছকই আরেকটি সঙ্কট, যা একটি ভ্যাক্সিন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গেই অন্তর্হিত হবে। কিন্তু বিশ্বজুড়েই চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, অতিমারি বা মহামারি ঘনঘনই আমাদের ঘরে হানা দেবে। গত ২৫ বছরের ইতিহাস বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অ্যাভিয়ান ফ্লু, সার্স, সোয়াইন ফ্লু, মার্স, ইবোলা এবং জিকা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের দেখিয়েছে।[13] বিশ্বায়ন এবং আন্তর্জাতিক চলাচলের প্রসারের ফলে এই অতিমারিগুলি ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পাবে। এবং, যেমন হয়ে থাকে, মহামারি বা অতিমারিতে সবচেয়ে বেশি ভুগবেন সমাজের দরিদ্রতম এবং দুর্বলতম অংশের মানুষেরাই।
কোভিড-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় উভয় স্তরেই সরবরাহ শৃঙ্খলগুলি সঙ্কুচিত হওয়ার প্রভূত সম্ভাবনা, কারণ কোম্পানিগুলি খরচ যত দূর সম্ভব কমিয়ে নির্বিঘ্নে কাজ সারতে সর্বতোভাবে চেষ্টা চালাবে। এর ফলে অর্থনৈতিক পিরামিডের নীচের তলায় কাজের সুযোগ কমবে, কাজ হারানোর সম্ভাবনা তৈরি হবে। ফলত কর্মীদের দরকষাকষির সুযোগও কমবে। বেঙ্গালুরুর বস্ত্র রপ্তানি ক্ষেত্র ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক অর্ডার কমে যাওয়ার আশঙ্কা করছে। আবার দেখুন, ভারতের বস্ত্র কোম্পানিগুলি এই সুযোগে কোম্পানি বন্ধ হয়ে যাওয়ার জুজু দেখিয়ে শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার বাধ্যতা তুলে দিচ্ছে এবং উদ্দেশ্যমূলকভাবে ট্রেড ইউনিয়নগুলিকে টার্গেট করছে। একটি বৃহৎ বস্ত্র উৎপাদক কোম্পানির কথা বলি— গোকলদাস এক্সপোর্টস— ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্টের বর্ম ব্যবহার করে একতরফাভাবে এবং কোনওরকম নোটিস জারি না করেই তাদের মাইসোরের কাছে একটি ফ্যাক্টরিতে লে-অফ ঘোষণা করেছে। উল্লেখ্য, এই ফ্যাক্টরিতে ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের কিছু দাবিদাওয়া নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে একটি সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছিল। এই দাবিদাওয়া নিয়ে মীমাংসার প্রক্রিয়া চলাকালে কর্নাটক শ্রম দপ্তর জানিয়েছিল যে, কোনও নোটিস ছাড়া লে-অফ ঘোষণা বেআইনি। কোম্পানিটি তা সত্ত্বেও নির্দ্বিধায় এই কাজটি করল।
অভিবাসী শ্রমিকদের বিদেশে কাজের সুযোগও কমার সম্ভাবনা। অতিমারির আতঙ্ক সরকারগুলিকে দিয়ে অভিবাসনের বিরুদ্ধে নানারকম শারীরিক এবং আইনি প্রাচীর তুলিয়েছে, ফলে বিশ্বজুড়েই অর্থনীতি এবং সঙ্গে সঙ্গে কাজের বাজারের অবস্থা বেহাল। অনেক অভিবাসী শ্রমিকই কাজ হারাবেন, এবং তার সঙ্গে তাঁদের তাড়া করবে ঘরে ফিরতে না পারা-জনিত আতঙ্ক— কারণ আন্তর্জাতিক চলাচল বর্তমানে অনেকাংশেই নিষিদ্ধ। ঘরে ফিরতে পারলেও যে দুর্ভোগ বন্ধ হবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। কেরলে প্রায় ৩০ লক্ষ এমন অভিবাসী শ্রমিক বিদেশ থেকে ফিরে এসেছেন। এঁদের জন্য যাতে ভাইরাস সংক্রমণ আরও ছড়িয়ে না পড়ে তার জন্য কেরল সরকার যথেষ্ট উদ্যোগী হয়েছে। কিন্তু শুধু সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া আটকানোই তো নয়, এবারের সমস্যাটা হল এঁদের আবার কীভাবে কাজে লাগানো যায়। অন্যান্য রাজ্য থেকে আসা অভিবাসী শ্রমিকরাই বা এঁদের কীভাবে নেবেন? কারণ, এখন তো তাঁরা এঁদের প্রতিযোগী হিসেবে দেখবেন!
এই পরিস্থিতিতে শ্রমিকদের দাবি কী হবে? অভিবাসী শ্রমিকরা নিশ্চিতভাবেই এখন আর বেশি দূর যেতে চাইবেন না। কারণ তাঁরা দেখেছেন একটা সঙ্কটের মুহূর্তে ঘর থেকে কয়েকশো কিলোমিটার দূরে ন্যূনতম সামাজিক সুরক্ষা ছাড়া পড়ে থাকলে কী ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়। উত্তর প্রদেশ, বিহার, ওডিশা, উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলি সহ আরও যে সমস্ত রাজ্য থেকে এই অভিবাসনের প্রবণতা বেশি, সেই সব রাজ্যের সরকারদের কাছে দাবি উঠবে রাজ্যের মধ্যেই যথেষ্ট কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করার। এর অর্থ যে প্রাইভেট পুঁজিকে যথেচ্ছ আবাহনের নামে শ্রমিকদের সুরক্ষাকে লঘু করা নয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে শ্রমিক আন্দোলনগুলিকে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান বৃদ্ধির দাবি উঠবে, যার মধ্যে এমজিএনআরইজিএ প্রকল্পের সীমা প্রসারণের দাবিও থাকবে, এবং শহরেও অনুরূপ কোনও কর্মসংস্থান নিশ্চয়তা প্রকল্পের দাবি উঠবে। এই অতিমারির ফলে গোটা বিশ্বজুড়েই একটি সর্বজনীন সরকার পরিচালিত স্বাস্থ্য পরিষেবা ব্যবস্থার দাবি উঠেছে। আয়ুষ্মান ভারত-এর মতো পাবলিক-প্রাইভেট-পার্টনারশিপের মডেল এই ধরনের সঙ্কট মোকাবিলা করার জন্য মোটেই কার্যকরী নয়। অসংগঠিত শ্রমিকদের ইউনিয়ন থেকে এবার এই দাবি উঠবে যে, অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদেরও ইএসআইসি-র স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। যদিও উত্তর প্রদেশ, বিহারের মতো গরীব রাজ্যে— যেখানে স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি— ইএসআইসি-র কভারেজ সবচেয়ে দুর্বল। এই সব সংস্কারগুলি করতে গেলে সরকারকে সামাজিক খাতে যথেষ্ট বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে হবে। এই দাবিগুলিই শেষ পর্যন্ত একটি সুষম সমাজের দাবিতে পরিণত হয়। যে সমাজে এলাকাভিত্তিক অসাম্য কমে যাবে— যার ফলে উত্তর প্রদেশ বা বিহার থেকে মানুষকে কাজের জন্য এগিয়ে থাকা দক্ষিণের রাজ্যগুলিতে ছুটতে হবে না; গ্রামীণ এবং শহুরে এলাকার মধ্যে অর্থনৈতিক সাম্য অনেক বেশি থাকবে; অনেক বেশি সমতা থাকবে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মধ্যে। কিন্তু নিও-লিবারেল দর্শন সরকারি ব্যয়ের বিরোধী— অবাধ বেসরকারি বিনিয়োগই নাকি উন্নতির চাবিকাঠি, এমনটাই দাবি তাদের। ফলে এই সংস্কারগুলি করতে গেলে প্রথমেই বদল আনতে হবে সেই নিও-লিবারেল দর্শনে।
এর মধ্যেই দেশে কোভিড সংক্রমণ অবাধে বেড়েই চলেছে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানই বলছে জুলাই থেকে নভেম্বরের মাঝে যে কোনও সময়ে এই সংক্রমণ সর্বোচ্চ সীমায় উঠবে। আর কতদিন যে আমাদের এই সংক্রমণের পরিমণ্ডলের কাটাতে হবে তা কেউই বলতে পারছেন না। একটি কার্যকরী ভ্যাক্সিনের আবিষ্কার এখনও কয়েক বছরের ব্যাপার— আর আবিষ্কারের পরে আসবে সেই প্রশ্ন যে এরকম একটা অসাম্যে জর্জরিত সমাজে সেই ভ্যাক্সিনের সুবিধা কারা পাবে! ফলে বিন্দুমাত্র নিশ্চয়তা সহকারে কোনওরকম ভবিষ্যদ্বাণীই এই মুহূর্তে করা সম্ভব নয়। একটা কথাই বলা যায় কোভিডের দিনগুলিতে কাজের দুনিয়া এই গোটা পর্যায় জুড়েই এরকম টালমাটাল চলবে।
[1] World Economic Outlook, এপ্রিল ২০২০: The Great Lockdown April 2020, World Economy Outlook Reports, IMF, https://www.imf.org/en/Publications/WEO/Issues/2020/04/14/weo-april-2020; ১৭ জুন ২০২০তে গৃহীত।
[2] The Hindu, ২৫ জুন, ২০২০
[3] CMIE (2020), Unemployment Rate in India, Centre for Monitoring Indian Economy, https://unemploymentinindia.cmie.com/. ১৭ জুন ২০২০তে গৃহীত।
[4] The Wire (2020), Lockdown in India has Impacted 40 Million Internal Migrants, Says World Bank, ২৩ এপ্রিল, ২০২০, https://thewire.in/health/lockdown-in-india-has-impacted-40-million-internal-migrants-says-world-bank
[5] Gupta S (2020), 30% of migrants will not return to cities: Irudaya Rajan, TNN, ১ জুন ২০২০, https://timesofindia.indiatimes.com/india/30-of-migrants-will-not-return-to-cities-irudaya-rajan/articleshow/76126701.cms
[6] Vyas M (2020), Hard Times Ahead, Centre for Monitoring Indian Economy, ১৯ মে, ২০২০, https://www.cmie.com/kommon/bin/sr.php?kall=warticle&dt=2020-05-19%2008:41:03&msec=086. ১৭ জুন ২০২০তে গৃহীত।
[7] ঐ
[8] Gopalakrishnan R (2020), Changes in Labour Laws Will Turn the Clock Back by Over a Century, The Wire, ২০ মে, ২০২০। লেখক এই অতিমারির ছলে বিভিন্ন রাজ্য সরকার যেভাবে শ্রম আইনগুলি লঘু করতে অর্ডিন্যান্স পাশ করিয়েছে সেগুলি নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন।
[9] Government of India (2020), Government Reduces the Rate of ESI Contribution from 6.5% to 4%, শ্রম এবং কর্ম মন্ত্রক; ১৩ জুন, ২০১৯, https://pib.gov.in/PressReleseDetail.aspx?PRID=1574520, ২৯ এপ্রিল ২০২০তে গৃহীত।
[10] ঐ
[11] Government of Karnataka (2017), Annual Report of the work and activities of the E.S.I. Scheme in Karnataka for the year 2016-2017, Directorate of the ESIS Medical Services, বেঙ্গালুরু, https://www.karnataka.gov.in › Annual_Report_2016_17_Annexure_I ২১ জুলাই ২০১৯এ গৃহীত।
[12] ILO (2020), COVID-19: G7 nations need to get gender equality right for a better future for women at work, ১৪ মে, ২০২০, https://www.ilo.org/global/about-the-ilo/newsroom/news/WCMS_744753/lang–en/index.htm ২২ মে, ২০২০তে গৃহীত
[13] Sreenivasan M (2020), No hard scientific evidence showing there are less virulent strains, The Hindu, ১৪ জুন, ২০২০। রিপোর্টটিতে হংকং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অফ পাবলিক হেলথ-এ ভাইরোলজির প্রধান স্বনামধন্য ড. মালিক পেরিসের একটি সাক্ষাৎকার দেওয়া হয়েছে।