শিক্ষক-ছাত্র রসায়ন: একটি উপেক্ষিত ‘ক্লিশে’ মডেল

অভিষেক ঝা

 


লেখক গদ্যকার ও অনুবাদক, পেশায় শিক্ষক

 

 

 

শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কোনওদিনই খুব সরল নয়। এই সম্পর্কে হিংসা, হীনম্মন্যতাবোধ, ক্ষমতার দাপট, পক্ষপাত সবকিছুই রয়েছে শিক্ষাব্যবস্থার আদিকাল থেকেই। মিথমিশ্রিত ইতিহাস কিংবা সাহিত্যনির্ভর মিথের দিকে তাকালেই বোঝা যায় যে শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক কোনওদিনই প্রবৃত্তিকে অস্বীকার করে গড়ে ওঠেনি। গ্রিক সভ্যতায় পিথাগোরাস এবং পিথাগোরাসের অনুগত ছাত্রদের হাতে পিথাগোরাসের তাত্ত্বিক ধারণাকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া পিথাগোরাসের ছাত্র হিপাসাসের খুন হয়ে যাওয়া, আর আর্য সংস্কৃতিতে দ্রোণাচার্যের অর্জুনের প্রতি নির্লজ্জ পক্ষপাত একই কয়েনের দুই পিঠ। একটি আদর্শ শিক্ষাব্যবস্থা প্রবৃত্তিমুক্ত হওয়ার কথা বললেও, এটা মেনে নেওয়া ভালো যে প্রবৃত্তিকে বাদ দিয়ে মানুষ নিজের স্বাভাবিকতা অনেকাংশেই হারিয়ে ফেলে। আর স্বাভাবিকতা না থাকলে স্বকীয়তা এক অলীক কল্পনা। স্বকীয়তা বাদ দিলে শিক্ষার দুই প্রান্তে (এই দুটি প্রান্ত কোনওভাবেই ‘মেরু’ নয়, এই প্রান্তদুটি ক্রমাগত একে অপরের সঙ্গে প্রান্ত বদল করে) দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের ভিতর পড়ে থাকে কেবল কিছু শুখা তথ্যবিনিময়। এই তথ্যবিনিময়ের জায়গা হিসেবে ক্লাসরুমের চেয়ে অনেক বড় পরিসর ইন্টারনেট। তাই ক্লাসরুম (সেই ক্লাসরুম ইটপাথরের হোক, কি গাছতলা হোক, কি ভার্চুয়াল হোক) থাকলে শিক্ষার দুটি প্রান্তও থাকবে, থাকবে দুই প্রান্তের মানুষদের প্রবৃত্তিও।

প্রবৃত্তিকে ‘হীন’ ভাবার একটি ‘স্বাভাবিক অভ্যাস’ আমাদের রয়েছে যা অবশ্যই কয়েক হাজার বছরের আধুনিক মানবসভ্যতার নির্মাণ। এই ‘স্বাভাবিকতা’ হেতু আমরা নিজেদের প্রবৃত্তিকে হয় চেপেচুপে ঢেকে রাখার সাংঘাতিক চেষ্টা করি, নইলে, নিজেদের প্রবৃত্তিকে একটি ‘আইডিওলজি’র মোড়কে ঢাকা ‘অজুহাত’ হিসেবে ব্যবহার করতে চাই। আরও গভীরে শিকড় ছড়ালে প্রবৃত্তির গ্রহণযোগ্যতা নিজের কাছে তৈরি করতেই একজন মানুষ পছন্দসই ‘আইডিওলজি’ খুঁজে নেন, খুঁজে না পেলে তার প্রবৃত্তিকে গ্রহণযোগ্য করতে সুবিধাজনক হতে পারে এমন একটি ‘আইডিওলজি’কে বেছে নিয়ে সেটিকে বিকৃত করা, আংশিকভাবে নেওয়া, প্রেক্ষিত থেকে বাদ দিয়ে ব্যবহারের  চেষ্টা ইত্যাদি করতে থাকেন। শিক্ষা অবশ্যই এই কাজে একটি বড় হাতিয়ার হয়ে ওঠে। প্রবৃত্তিকে ‘হীন’ ভাবার বদভ্যাসটি থেকে মুক্ত হলে শিক্ষাকে প্রবৃত্তির জন্য ‘আইডিওলজি’ খুঁজে আনার সুকঠিন, দীর্ঘ, পুনরাবৃত্তীয় এবং বোগাস কাজটি থেকে মুক্তি দেওয়া যায়। প্রবৃত্তির সঙ্গে ‘আইডিওলজি’র অবস্থান বিপরীত মেরুতে। প্রবৃত্তি অসহায়ভাবে জৈবিক এবং ব্যক্তিগত। অপরপক্ষে ‘আইডিওলজি’ প্রতিটি ব্যক্তি স্বতন্ত্রভাবে অর্জন করে ‘কালেক্টিভ আইডিওলজি’তে পৌঁছায়। একজন শিক্ষিত ব্যক্তি নিজের সুতীব্র যৌনচাহিদাকে ‘সুতীব্র যৌনচাহিদা’ হিসেবেই চিহ্নিত করলে শিক্ষার পরিচয় ফুটে ওঠে। সেটিকে ‘প্রবল পৌরুষ’, ‘জিনের অসহায়তা’ কিংবা ‘উত্তুঙ্গ নারী স্বাধীনতার’ মেটাফোর হিসেবে দেখতে চাইলে এবং দেখাতে চাইলে নিজেকেই নিজের কাছে সহজে গ্রহণ করার অভাব স্পষ্ট হয়। শিক্ষার পরিসর যদি প্রবৃত্তিকে ‘অচ্ছুৎ’ না করে তার অস্তিত্ব মেনে নেয় এবং প্রবৃত্তিকে ‘হীন’ ভাবার কু-অভ্যাস থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করে তাহলে শিক্ষিত হয়ে ওঠার পথে সেটি একটি বড় পদক্ষেপ।

শিক্ষা মানুষের সহজ হয়ে ওঠার অন্যতম পথ। সহজ হলে শিক্ষার দুই প্রান্তে থাকা মানুষেরা নিজেদের ভিতর খুব সহজেই কথা বলতে পারে। সহজেই কেউ বলতে পারে, “আপনার/তোমার/তোর কথা শুনে খুব ভয় করে/ভালো লাগে/অপছন্দ হয় এই এই এই কারণে”, সহজেই কেউ বলতে পারে, “আপনি/তুমি/তুই এই এই কারণে আমার কথা সম্পর্কে হয়তো ঠিক, এই এই কারণে হয়তো ভুল”। এই সহজ হওয়াটি নিঃসন্দেহে ‘সরল’ ব্যাপার নয়; কিন্তু শিক্ষার ধারাবাহিক অনুশীলনের মাধ্যমে এই সহজ জায়গাটিতে পৌঁছানো দুই প্রান্তের মানুষদের কাছেই ‘জটিল’  কোনও ব্যাপারও নয়। ক্রমাগত নিজেদের ভিতর কথা বলে যাওয়া এবং অপরের কথা শোনা ছাড়া এইখানে  পৌঁছানোর আর কোনও পথই নেই। এই নির্ভার ডায়ালগ স্পেসটি তৈরি হলেই ‘ভয়’ নামক এক অজানা জুজু কেটে যায়। ‘ভয়’ কেটে গেলে ‘ভক্তি’ উবতে সময় নেয় না। ‘ভয়’ ও ‘ভক্তি’ এই দুটিই শিক্ষার পক্ষে প্রধান অন্তরায়। ‘ভয়’ ও ‘ভক্তি’ উবে গেলে শিক্ষার এক প্রান্তে থাকা ‘শিক্ষক’ নামক সত্তাটিকে ‘দেবতা’র মত এক ‘অলৌকিক’ কেউ বলে মনে হয় না। শিক্ষক সেই ‘ঈশ্বর’ থাকেন না যার ‘ব্যক্তি’ সঙ্গ পেলে শিক্ষার আরেক প্রান্তে থাকা ‘ছাত্র’ নামক সত্তাটি নিজেকে ‘ধন্য’ মনে করবে, কিংবা ‘ব্যক্তি’ সঙ্গ না পেলে নিজেকে ‘বঞ্চিত’ মনে করবে। এই ডায়ালগ স্পেসটি তৈরি না হলে ‘শিক্ষক’ এমনই এক সত্তা যার রাজনৈতিক, অ্যাকাডেমিক-রাজনৈতিক, সামাজিক ক্ষমতা থাকুক কিংবা না থাকুক, তার আশীর্বাদে ধন্য হতে চাওয়া, তার বরে লাভবান হতে চাওয়া কিংবা শাপকে ভয় পাওয়া ‘ছাত্র’ সত্তার পক্ষে খুবই স্বাভাবিক। আর আশীর্বাদধন্য হতে চাওয়া, বরপ্রাপ্ত হতে চাওয়া, শাপগ্রস্ত হতে ভয় পাওয়া কোনওটাই ‘ছাত্র’ সত্তাকে তার স্বাভাবিক আচরণ করতে দেবে না। তখন ‘ছাত্র’ না থেকে সে হয়ে উঠে সেই ‘ভক্ত’ যে বর পেলে ‘দেবতা’কে ধন্য করে, যে বর না পেলে ‘দেবতা’কে গালি দেয়, যে শাপগ্রস্ত হলে ‘দেবতা’কে অভিসম্পাতে মাতে। ‘শিক্ষক’ হয়ে ওঠে সেই ‘আরাধ্য’ যে ছাত্রদের মধ্যে ‘চোজেন পিপল’ নির্মাণ করে একদলকে বুকে জড়ান আরেক দলকে লাথি মারেন। এই অবস্থায় সেই ‘শিক্ষা চর্চা’ তাৎক্ষনিক ও আপেক্ষিক দুটি সততই পরিবর্তনশীল প্রান্ত তৈরি না করে, দুটি অপরিবর্তনীয় মেরুর জন্ম দেয়। আর এইসবের মাঝে শিক্ষা নামক এক মানবিক স্পেস অবলুপ্ত হতে থাকে যেখানে শিক্ষার দুই প্রান্তে থাকা মানুষেরা পরস্পরকে প্রশ্ন করতে পারে, পরস্পরকে সমালোচনা করতে পারে, পরস্পরকে জানতে পারে, পরস্পরের বন্ধু হতে পারে। এই সমস্ত চর্চা ও চর্যার ভিতর দিয়ে শিক্ষা ধীরে ধীরে ভালোবাসা হয়ে ওঠে। ভালোবাসার দুই প্রান্তে থাকা মানুষেরা পরস্পরের ক্ষতি করতে অপারগ। ভালোবাসাকে ‘প্রেম’ হিসেবে দেখতে চাইলে অসুবিধা রয়েছে কারণ ‘প্রেমে’র গঠনের অনেকগুলি তন্তুর ভিতর ভালোবাসা একটি তন্তু মাত্র। বাকি তন্তুগুলি ‘প্রেম’কে (‘বৈধ’, ‘অবৈধ’ যাই হোক না কেন) ‘পরিবার’, ‘বিয়ে’, ‘লিভ-ইন’ এর মতোই একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে যেখানে কাঠামোগতভাবেই ডায়ালগ-স্পেস সঙ্কুচিত হতে থাকে কারণ ‘পারস্পরিক প্রয়োজন’ এই প্রতিষ্ঠানগুলির ক্ষেত্রে একটি দৃঢ় ভিত্তি। মাথায় রাখতে হবে এইখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিধির ভিতরের কথা বলা হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা দুইটি মানুষের সম্পর্ক কী হবে, কতটুকু হবে, কতটুকু হবে না এই সমস্ত কিছুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতার বাইরে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আওতার ভিতরে শুধুমাত্র পড়াশুনা নয়, পরীক্ষাব্যবস্থা, ভর্তিপ্রক্রিয়া, গবেষণা সমস্ত কিছুই অন্তর্ভুক্ত। তাই এই ব্যবস্থাগুলিকে প্রভাবিত না করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাইরে নিজেদের ভিতর কী সম্পর্ক রাখবেন সেটা তাদের উপরেই ছাড়া উচিত।

এইবার আসে সেই অবধারিত প্রশ্ন: ইহা তাত্ত্বিকভাবে বোঝা গেলেও ‘বাস্তবে’ প্রয়োগ করা কী সম্ভব আদৌ?

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কখনওই ‘সামাজিক বাস্তবতা’ প্রতিফলনের পরিসর নয়। বহু সংস্কৃতির, বহু ধর্মের একটি জায়গায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে নিশ্চয় ‘নির্দিষ্ট’ ধরনের ছাত্ররা শিক্ষা নিতে আসেন না এখন। ‘বাস্তবে’ আপনি কয়জন ‘ঝা’-এর বাড়িতে কয়জন ‘কুজুর’কে একসাথে খাবার ভাগ করে খেতে দেখেন? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘বাস্তবে’ এইটা কিন্তু খুব স্বাভাবিক ঘটনা হয়ে উঠেছে অনেকটা এবং আস্তে আস্তে সেই পরিসর আরও বিস্তৃত হচ্ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাস্তবকে প্রতিফলনের জায়গা হলে ‘দামি পোশাক’, ‘গায়ের রং’ দিয়ে ছাত্রদের মাপা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অতি স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে ধরা হত। অতি উগ্র ধর্মান্ধ (ফলত ধর্মবিদ্বেষীও) ‘শিক্ষক’ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ‘বিকল্প বাস্তবের’ চাপে অন্য ধর্মের ‘ছাত্রদের’ সঙ্গে আপাত সহিষ্ণু আচরণ করে থাকেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘সামাজিক বাস্তব’কে শিক্ষাচর্চার মাধ্যমেই প্রশ্ন করে থাকে বারবার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ‘বিকল্প বাস্তব’কে প্রশ্রয় দেয়। প্রবৃত্তিকে ছেঁটে না ফেলে, ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কেবলই ‘দেওয়া নেওয়ার’ সম্পর্ক না করে ‘সামাজিক বাস্তব’কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার দুই প্রান্তে থাকা মানুষদের ভিতর একটি ভয়হীন, ভক্তিহীন ডায়ালগ স্পেস তৈরি হওয়া অলীক কিছু নয়। খানিক সদিচ্ছা আর অনেকখানি চর্চা ও চর্যা করলেই সম্ভব।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4661 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...