অনলাইন ক্লাস-বিষয়ক ছটি ছোটগল্প

শিমূল সেন

 


লেখক প্রাবন্ধিক, গদ্যকার

 

 

 

 

ভারতবর্ষ ক্রমে আমেরিকা হইয়া উঠিতেছে না কি? নইলে এ-ও কী করে সম্ভব, গরিব ট্রপিকাল দেশে অনলাইন পড়াশুনো-নামক বাবুয়ানি নিয়ে কোনও জোরালো, সংগঠিত বিরোধী কণ্ঠস্বর চোখে পড়বে না! আজ যাঁরা প্রস্তাবিত শিক্ষানীতি নিয়ে সরকারি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ব্যাকুল, সঙ্গত কারণেই চিন্তিত— তাঁদের কেউ, কেন এখনও এই মৌলিক প্রশ্নটা তুলছেন না, শিক্ষার অধিকার এই দেশে এখনও খাতায়কলমে একটি সর্বজনীন মৌলিক অধিকার, এবং এই দেশের সমস্ত শিশু জাতপাত, লিঙ্গ ও শ্রেণি-রহিত ভাবে, হ্যাঁ বাপ-মার পেশা ও টাকাপয়সা-নিরপেক্ষ ভাবেই, সর্বজনীন পড়াশুনোর অধিকারী? সংবিধান-স্বীকৃত এই আদর্শের বিপরীতে অনলাইন ক্লাস। হাজার লাখ টাকার ক্যাপিটেশন ফি আর ডোনেশন শিক্ষাক্ষেত্রে উন্নত সার্ভিস প্রোভাইডারের স্মারক হয়ে উঠেছে দীর্ঘ দিন হল। নির্দ্বিধায়, প্রতিবাদহীন এই বন্দোবস্ত বহু দিন হল মেনে নিয়েছেন, এমন কী, বামমনস্ক নাগরিক সমাজি লোকজনও৷ এখন মহামারিকে চাঁদমারি খাড়া করে সংগঠিত পরিকল্পনা চলছে একটা বড় অংশের পড়ুয়াকে বাদ দেওয়ার— যারা ভবিষ্যতে হয়ে উঠবে সম্ভাব্য অদরকারি শ্রেণি-প্রকল্পের দ্যোতক, এবং দাসপ্রতিম মজুরবিশেষ।

বিপর্যয় বা মন্দা বা অতিমারি-আকীর্ণ নিউ নর্মাল, সাধারণত, রাষ্ট্রকে একটি মোক্ষম সুযোগ দেয় বহুকালীন ইচ্ছে-সিদ্ধির। গোটা ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার নকশা এর ওপর টিকে রয়েছে, ওই কারণে ‘স্বাভাবিক’ সময়ে যে কাজ নামাতে ফতুর হয়ে যেত— এই আশু বিপদমুহূর্তে তা-ই চেহারা ন্যায় ‘ডিসাস্টার ক্যাপিটালিজম’-এর। যাঁরা চুপচাপ হাত গুটিয়ে ইউজিসির খামখেয়ালের তীব্র সমালোচনা করে চলেছেন, তাঁরা একটু ভাববেন, অনলাইন শিক্ষার নামে এ কী গভীর বৈষম্য— যা স্বাধীন ভারতে অদৃষ্টপূর্ব— যেখানে হাজারো পড়ুয়াকে বাদ দেওয়া হচ্ছে স্রেফ স্মার্টফোন আর ল্যাপটপ না-থাকার ছুতোয়। কস্মিন কালে শুনিনি, ভালো পড়াশুনোর জন্য ওইগুলি দরকার হয়। স্রেফ এই টালমাটাল সময়ে পড়াশুনো-বিহীন গতরওলা সস্তা শ্রমশক্তি তৈরির জন্য ব্যবস্থা চমৎকার সুযোগ করে দিচ্ছে— আর, গর্বিত ও দুনিয়া কাঁপানো প্রতিবাদীরা ফেসবুকে চাট্টি সংযত, নিয়মতান্ত্রিক কথা বলেই খালাস।

পড়াশুনোর জগতে এর চেয়ে বৈষম্যমূলক, অগণতান্ত্রিক কবে কী হয়েছে— যেখানে পড়ুয়ার সম্মতি ছাড়াই, ইলেকট্রনিক গ্যাজেট আর পারিবারিক সঙ্গতির কতগুলো উৎকট শর্তের ভিত্তিতে দিনের পর দিন ক্লাস চলছে। যাদের ভাঁড়ারে টাকা, তারাই যোগ্য মেধাবী— অহো, গণতান্ত্রিক দেশে কী আশ্চর্য জাস্টিস! খাস কলকাতার সাতমহলা সুরম্য স্কুলবাড়ি জুড়ে এখন নিস্তব্ধতার হাহাকার— তার বদলে, কী হাস্যকর, ডিজিটালি স-ইউনিফর্ম ক্লাস করছে মধ্যবিত্ত সন্তান। আমি পর পর গোটাছয়েক ঘটনার উল্লেখ করে দিচ্ছি কেবল– যাঁরা অস্বস্তিভয়ে কিংবা আয়নায় ধরা-পড়ার চোরা আশঙ্কায় এগুলো বেমালুম এড়িয়ে যাবেন— ভেবে দেখবেন, আপনাদের সুখী-সুখী, নিশ্চিন্ত, নিরাপদ প্লাস্টিকনির্মিত হাতেও এর দায় লেগে নেই কি?

ঘটনা এক। এই ঘটনা নিয়েই আমি প্রথম জানতে পেরেছিলাম। স্থান কেরলের মল্লপুরম। মেয়েটির বাবা দরিদ্র দিনমজুর। পড়ত ক্লাস টেনে। আপনাদের ভাষায় ‘মেধাবী’ ছাত্রী, সরকারি বৃত্তিপ্রাপ্ত। ঘরে টেলিভিশন সেট ছিল, কিন্তু স্মার্টফোনের ভাঁড়ে মা ভবানী। কেরোসিন খায়। সঙ্গে ছোট্ট সুইসাইড নোট: ‘আমি যাচ্ছি’।

ঘটনা দুই। সেই ক্লাস টেন৷ মেয়েটি থাকত বালিতে৷ বাবা বাস ড্রাইভার। খাস ভিটে বিহারে৷ স্মার্টফোন ছিল না। অগত্যা, এক দিন বাবা বাইরে জানলা থেকে দেখতে পান, মেয়েটি দরজায় ফাঁস লাগিয়েছে। ঝুলছে।

ঘটনা তিন-এ অসম। চিরাং। এ-ও ক্লাস টেন। বাবা বাস চালাতেন। মা কাজের খোঁজে বেঙ্গালুরু গেছিলেন (এই ভরা মহামারির সময়েও)। এরও অসুখ একই, নিদেন একখান স্মার্টফোন-বিহীনতা। অতঃপর গলায় ফাঁস।

চার: তামিলনাড়ুর নাগাপাত্তিনমের এই মেয়েটির বয়স কম, ১৪, কাজেও সফল হতে পারেনি। বাবা তেল-সংস্থায় কাজ করেন, মা একশো দিনের কাজ৷ মেয়েটি সিবিএসসি-অনুগৃহীত যে শিক্ষা-কোম্পানিটির গ্রাহক, তারা নিদান দিয়েছিল অমুক তারিখের মধ্যে টাকাপত্তর না মেটালে আর পড়তে পারবে না— ‘মৌলিক অধিকার’ বলে কথা না! ছোট্ট কিশোরীর মনে ঘনিয়ে ওঠে তীব্র হতাশা ও আত্মমর্যাদা।

পাঁচ নম্বর ঘটনা ত্রিপুরার সেপাহিজলা-র। ১৩ বছর মত বয়স মেয়েটির। লকডাউনে পরিবারের কোনও আর্থিক সঙ্গতি ছিল না যে মেয়েকে স্মার্টফোন কিনে দেওয়া যায়। অতঃপর, আত্মহত্যা।

ছ নম্বর তথা শেষ ঘটনাটা একটু আলো-আলো। হিমাচলের মানালির কথা। ক্লাস এইটের ছেলে যে অনলাইন ক্লাস করে শিক্ষার হদ্দমুদ্দ করবে— তো, স্মার্টফোন কই! গরুর দুধ বেচে ভদ্রলোক সংসার চালাতেন। বাধ্যত সিদ্ধান্ত নেন, যে গরুর দুধে ছ-হাজার টাকা মাসপ্রতি ঘরে ঢুকত, সেই গরুটিকেই বিদেয় করার। তার কমে আর স্মার্টফোন ছিল না।

গল্পের ইতি। বেশ সারভাইভাল-গন্ধী, না?

একঘেয়ে গল্পে পাঠকের বিরক্তি আর বাড়াব না। শুধু এটুকুই বলার: এ-হেন ঘোরতর অ-ন্যায় দিব্য বৈধ হয়ে যাচ্ছে, কেন-না, অনলাইন শিক্ষা ভোটের ইস্যু হয় না, খবর-কাগজে হেডলাইন হয় না, কোনও চমকপ্রদ ঘটনা নেই এতে, নেই একনাগাড় মিডিয়া-মন্থন, অতএব, নাগরিক সমাজও বিশেষ মুখটুখ খোলেন না। পাবলিক এডুকেশনের আদত কাঠামোটাই ভেঙেচুরে ছত্রখান, শিক্ষার্থীরও কোনও সায় নেই এতে— কেবল বাদ-দেওয়া আর বৃত্ত ছোট করে ফেলার নিদারুণ কৌশল। এই শিউরে-ওঠা অসমানতা, এই মর্মান্তিক অধিকারভেদ, এই তীব্র মেধাদ্যুতিময় বৈষম্য… এর পরেও ন্যায়ের কথা বলব?

রাষ্ট্র-পোষিত সম্ভাব্য শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে বা পক্ষে আওয়াজ তুলব? বক্তিমে, স্লোগান– কেন-না, ওটা অপেক্ষাকৃত সহজ বলে?

কোন মুখে?

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...