![joydip](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydip.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
জয়দীপ চট্টোপাধ্যায়
জাতীয় সড়ক থেকে বাঁক নিয়ে গৌড় রোডে ঢুকতেই রাস্তাটা যেন ক্রমে সরু হয়ে যেতে থাকল। বুঝতে পারলাম, রাস্তার প্রস্থ যতটা কমেছে, তার থেকেও বেশি সরু লাগছে দু পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের কারণে। সামনে কোনও মালবাহী ট্রাক চললে আরও সময় লাগছে এগোতে। ওপাশ থেকে গাড়ি আসার সমস্যা হচ্ছে, বোঝাও যাচ্ছে না উলটোদিক থেকে কেমন গাড়ি আসছে… কীরকম গতিতে। ওভারটেক করার প্রশ্নই ওঠে না।
গাড়ির চালক আক্কাসদা জানালেন… সামনেই বাংলাদেশ বর্ডার।
দ্রষ্টব্য স্থাপত্যগুলি ম্যাপে দেখার সময়ে জেনেছিলাম কাছাকাছি বাংলাদেশ সীমান্ত… কিন্তু এই রাস্তায় এগোলে এত কাছে বর্ডার… বুঝতে পারিনি। আক্কাসদার কথাটা শুনে আবার ম্যাপ দেখলাম, সত্যিই লোটন মসজিদ থেকে সামান্য দূরেই বাংলাদেশ সীমান্ত। যার ওপারে গৌড়ের বাকি অংশ থেকে গেছে… শাহবাজপুর, চাঁপাই নবাবগঞ্জের মত অঞ্চলে (তারপরেই রাজশাহী)। রাস্তার ধারে এক জায়গায় কিছুটা জমি দেখে গাড়িটা দাঁড় করালাম, সেখান থেকে হেঁটেই এগোতে শুরু করলাম। আক্কাসদা বয়স্ক মানুষ, আসতে চাইলেন না সঙ্গে। বোঝাই যায় এই পথে তাঁর আসা-যাওয়া বহু বছর ধরে… আর নতুন কিছু দেখার ইচ্ছে বা আগ্রহ নেই। চারিদিক দেখতে দেখতে হাঁটতে ভালোই লাগছিল। টাউন ছেড়ে ততক্ষণে গ্রাম-বাংলার উঠোনে প্রবেশ করে ফেলেছি… দুধারে জমি, সেচের জল ধরে রাখা পুকুর, আমগাছ, চালাঘর দেখলেই বোঝা যায়।
গৌড়-মালদার স্থাপত্যগুলো দেখতেই মালদায় এসেছিলাম। মালদানিবাসী এক বন্ধু মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে— “যা আছে, দেখা যাও… ক বছর পরে হয়ত এও থাকবে না!” রাজ্য এবং ভারতীয় পুরাতত্ত্ব বিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকার পরেও এমন হতাশা কেন? ছোট-বড় অনেক কারণ, অভিযোগ… গিয়ে দেখলে কিছুটা অনুভব করা যায়। অনেক কাল ধরে শুনেছি গৌড়ের পতনের পর থেকেই গৌড়ীয় ইট পাচার হয়ে যায় (শুধু কি ইট?)। ছোট-বড় নির্মাণকার্যে নতুন করে ব্যবহার হয়েছে সেই ইট। সেই চুরি নাকি এখনও চলে, জনান্তিকে কানে আসে— এদিককার অনেক ঘরবাড়িতে এখনও গৌড়ীয় ইট ব্যবহার করে নেয়। প্রমাণ নাই… না থাকিলে, অভিযোগও করিতে নাই। অভিযোগ করলেও কাঁচকলা হবে… যাক গে। এরকম পুনর্ব্যবহার আগেও প্রচুর হয়েছে, অন্যত্রও হয়েছে। দিল্লিতে রহিমের সৌধ থেকে মহামূল্যবান শ্বেতপাথর উপড়ে নেওয়া হয়েছিল সফদর জং-এর সমাধি-সৌধ নির্মাণের সময়ে। এমনকি, গৌড়েরই অনেক মসজিদে যে কষ্টি-পাথরের স্তম্ভ, মিনার, খিলান, দেওয়াল… ইত্যাদি দেখা যায়… পুনর্ব্যবহার করা। তাতে কারুকার্যের শৈলী থেকেই চেনা যায়, তার উৎস। সম্ভবত পাল বংশের সময়কার স্থাপত্যের/মন্দিরের অবশেষ থেকে, বা সেগুলিকে… যাই হোক।
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@1.jpg?resize=627%2C471&ssl=1)
মাঘ মাস… শীতকাতুরে সকালের রোদ চমৎকার। চমৎকার লাগছিল লোটন মসজিদের ঠিক পেছনের ঝিলটা। ঝলমলে সোনালি রোদ্দুর, রাজহাঁস ভেসে বেড়াচ্ছে। পর্যটক বলতে একলা আমি। চারপাশে দেখছি… মালি বা অন্য কাউকে যদি দেখা যায়। বাগানের ঘাস যত্ন করেই ছাঁটা। মিঠে রোদে এখনও ঝলমল করার চেষ্টা করে লোটন মসজিদের ইটের ওপর রঙিন টালিগুলো… মানে, সেই রঙিন স্তরের সামান্য যতটুকুর অবশেষ এখনও টিকে আছে। বোঝা যায়, অঞ্চলের সব থেকে সাজানো, সব থেকে অলঙ্কৃত স্থাপত্য ছিল এটি। তাঁতিপাড়া মসজিদ বা চামকাটি মসজিদের থেকে বেশি যত্ন নিয়ে নির্মিত। খাস কাউকে উৎসর্গ করে। বাইরের দেওয়ালে এখনও সেই চমৎকার রঙিন টালিতে মিনা করে কাজের রেশ থেকে গেছে— নীল, সবুজ, হলুদ, সাদা! সাহেবরা নাকি বলত ‘পেইন্টেড মস্ক্’। মেঝেতেও তেমনই রঙিন টালির কাজ ছিল… যার কিছু অংশ এখনও দেখা যায়। এই লোটন মসজিদ বা লট্টন মসজিদের নামটি এমন কেন… তা নির্দিষ্টভাবে জানা যায় না।
![](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@2.jpg?resize=478%2C562&ssl=1)
আনুমানিক ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতান ইউসুফ শাহের আমলে নির্মিত এই মসজিদটি সম্বন্ধে শোনা যায়— এক বিশেষ বাইজির জন্য নির্মিত এই মসজিদ। মসজিদের বোর্ডে একটু গুছিয়ে লেখা ‘রাজ-গণিকা’ শব্দটি। ইংরেজিতে বললে ‘royal concubine’ (যেমন কুতব শাহের তারামতী, সিরাজের হীরাবাই, ওয়াজেদ আলি শাহের পরীমহলের পরীরা)। সুলতান বা সুলতানের পরিবারের কোনও বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গিনী। প্রিয় বাইজি, বা অঙ্কশায়িনীর জন্য মহল, বাগিচা, বাগান-বাড়ি… এইসব নির্মাণের নজির আছে। তবে এমন চমৎকার দর্শন মসজিদ সত্যিই এক বিস্মৃত ইতিহাসের ইঙ্গিত দেয়। একদা মসজিদ ছিল, আজ তো পরিত্যক্ত… ঐতিহাসিক স্থাপত্য-নিদর্শন। বাইরের রঙিন টালি দেখি, টেরাকোটার কাজ দেখি… প্রদক্ষিণ করতে করতে ভাবি— কেমন ছিল এই মসজিদ ১৪৭৫ খ্রিস্টাব্দে? কত বছর পর্যন্ত সক্রিয় ছিল এই মসজিদে নামাজ পড়ার ব্যবস্থা? কে কে আসতেন নামাজ পড়তে? শুধুই কি মহিলারা আসতেন? কে সেই রাজ-গণিকা? কী হল তাঁর মৃত্যুর পর?
মসজিদের রাজকীয় বড় গম্বুজের ওপর রোদের তেজ বাড়ে… সময়ের ক্ষয় সহ্য করা মিনারে রোদের তেজ বাড়ে। ক্যাঁচ করে গেটের শব্দ হতে দেখি লুঙ্গি আর ফুল-শার্ট পরে এক বৃদ্ধ মসজিদের বাগানে ঢুকছেন সাইকেল হাঁটিয়ে, সম্ভবত বাগানের দেখাশুনো করেন। ওঁর দিকে তাকাতে বললেন “দেখবেন না?”, জানালাম “হয়ে গেছে”। “হয়ে গেছে?”, শুধু এইটুকু বলেই উনি মসজিদের একটা দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। আমি ইতস্তত করতে করতে বেরিয়ে এলাম— মসজিদের এমন নাম আর রাজগণিকার পরিচয়ের কথা ভেবে… ইনি কি আর এত কিছু জানেন?
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@3.jpg?resize=529%2C389&ssl=1)
রাস্তায় এগোতে এগোতে বুঝতে পারলাম গুণমন্ত মসজিদ খানিকটা ভেতরে… গ্রামের ভেতর দিকে। হেঁটে যাওয়া-আসা করতে সময় যেতে পারে… আবার ম্যাপ ভরসা করে গ্রামের পথে এগোনো ঠিক হবে কি না, সেই বিষয়েও সংশয় ছিল। একটা টোটো ডেকে উঠে পড়লাম। গুণমন্ত মসজিদের নাম শুনেই বলল— ঠিক আছে। যেতে যেতে অন্য প্যাসেঞ্জার তুলে নিল। দুজন গ্রামের মহিলা। বড় রাস্তা ছেড়ে গ্রামের ভেতরে যেতেই যেন এক অন্য জগৎ! মাটির রাস্তা সরু হয়ে এল… দুপাশে পুকুর আর ভেরি রেখে এগিয়ে যাওয়া অসমতল পথ ধরে সাবধানে এগিয়ে যাচ্ছিল আমাদের টোটো। গুণমন্ত মসজিদে পৌঁছনোর আগে অবধি ওই পথ যেন নিজেই এক দর্শনীয় জায়গা। শহরের যান্ত্রিকতা কতটা একঘেয়ে এবং ক্লান্তিকর হয়ে চেপে বসেছে মাথার ওপর… বোঝা যায় এমন পরিবেশে এলে। কত রকম পাখির ডাক। হাঁস চড়ে বেড়াচ্ছে জলে। এমন গ্রামের পরিবেশে আগেও থেকেছি… তাও মনে হচ্ছিল এই যাত্রা আর একটু দীর্ঘ হোক। ছবি তুলতে ইচ্ছে করছিল না, ইচ্ছে করছিল সেই মুহূর্তটা উপভোগ করতে। কিছুদূর এগোনোর পর টোটোচালকের পাশে আরও একজন উঠে বসল, আর মহিলা সহযাত্রীদের একজন হঠাৎ আমার দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন— এদিকে কোথায় যাবেন?
আমি কিছু বলার আগে সেই টোটোচালক বলে উঠলেন “গুণমন্ত মসজিদ দেখতে।”
শুনে পাশের মহিলা একচিলতে হাসি নিয়ে জানতে চাইলেন— এখন মসজিদে কেন যাবে? কোথায় থাকো?
বললুম— কলকাতা থেকে এসেছি… এক পরিচিত থাকেন ইংলিশ বাজার অঞ্চলে। এইদিকে পুরনো আমলের মসজিদগুলো দেখে যাচ্ছি।
বলতে বলতেই খেয়াল করলাম, দুজন মহিলার হাতেই চটের ব্যাগ। শাকসবজি উঁকি দিচ্ছে। সম্ভবত কাছাকাছি কোথাও হাটবাজার আছে, সেখান থেকেই ফিরছেন। আমি পালটা কিছু প্রশ্ন করতে পারলাম না। দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন, মাঝে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসছিলেন। আমি চেষ্টা করছিলাম না শোনার। দুজনেরই শাড়ির আঁচলের অংশ বেশ আঁটো করে ঘোমটার মত মাথাটা ঢেকে রেখেছে— সাধারণত বাঙালি মুসলিম সমাজে মহিলাদের যেমন দেখা যায়।
একটি দৃশ্যত পুরনো স্থাপত্যের সামনে এসে টোটোটি দাঁড়াল। পাথরের ইমারত, গম্বুজগুলো দেখেই আন্দাজ করলাম… গুণমন্ত মসজিদের সামনে এসে পড়েছি। টোটো-চালক ইশারায় বুঝিয়ে দিলেন আমিও সাবধানে নেমে এলাম টোটো থেকে। টোটো এগিয়ে গেল, সেই দুই মহিলা একসঙ্গে একবার পেছন ফিরে আমার দিকে তাকালেন, তারপর আঁচল চাপা হাসি নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিলেন। তাদের মুখশ্রী আজ আর মনে পড়ে না, শুধু মনে পড়ে— একজনের চোখের তারার রং হালকা বাদামী।
গ্রামের নাম মহাদিপুর (হয়ত মেহদিপুর ছিল), একসময়ে নাকি এই গ্রামের খুব কাছ দিয়ে বয়ে যেত ভাগীরথী। গৌড়ের যে প্রধান গড়, তার দক্ষিণ দিকে এই অঞ্চলেই ১৪৮১ থেকে ১৪৮৬ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সুলতান জালালউদ্দিন ফতেহ শাহের আমলে নির্মাণ করা হয়েছিল এই গুণমন্ত মসজিদ। গ্রামের মাঝে হঠাৎ দেখলে মনে হয়ে এক পাথরের গুহা! হ্যাঁ, গৌড়-বাংলার এই দিকের অন্যান্য স্থাপত্য-নিদর্শন মসজিদগুলির থেকে গুণমন্ত মসজিদ আলাদা… এটি পাথরের তৈরি। অনেকটা জায়গা জুড়ে… প্রায় বড় সোনা মসজিদ বা আদিনা মসজিদের মতই প্ল্যান (সেরকম বর্নাঢ্য স্থাপত্য শৈলী ছিল বোঝা যায়) নিয়ে নির্মিত এই মসজিদ— সম্ভবত বাংলার প্রাচীনতম প্রস্তরনির্মিত মসজিদ; যা এখনও সক্রিয় উপসনাস্থল। চব্বিশটি গম্বুজবিশিষ্ট এই পাথরের মসজিদটির এক আলাদা ভাব-গম্ভীর উপস্থিতি চারপাশে এক অন্যরকম প্রভাব বিস্তার করে। যেন কোনও সাধক পীরের উপাসনাস্থল। গুহার ভেতরে গেলে তার দর্শন পাওয়া যাবে। অথচ এই পাথরের দেওয়াল, পাথরের মিনার/স্তম্ভ… এইসব কিছুর ওপরেও এক কালে মূল্যবান রঙিন টলি বসানো ছিল, অলঙ্কৃত ছিল নকশায়। আজ সেই আভরণ ত্যাগ করে ফকির হয়েছে গুণমন্ত, কাল অতিক্রম করে সিদ্ধ হয়েছে গুণমন্ত সাঁই।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@4.jpg?resize=600%2C431&ssl=1)
ভেতরে যাওয়ার জন্য এগোতেই গেটের কাছে উপস্থিত একজন বললেন— “জুতা খুলে ঢুকবেন। মসজিদে এখনও জুম্মাবারে নামাজ দেওয়া হয়।” এক পাশে জুতো খুলে এগিয়ে গেলাম, সঙ্কোচ ছিল ছবি তোলা নিয়েও হয়ত আপত্তি থাকতে পারে। মোবাইলটা বার করেও আবার পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম দেখে একজন বললেন “তোলেন তোলেন… ফটো তোলায় দোষ নাই।” স্তম্ভ আর আর্চ-ওয়েগুলো পার করে ভেতরে প্রবেশ করতেই মনে হল ভেতরের তাপমাত্রা বাইরের থেকে খানিকটা কম (হয়ত পাথরের গুণে)। হঠাৎ মনে হল চারপাশটা মেঘলা হয়ে এসেছে। একপাশে যেমন মসজিদের ঢালু ছাদ এখনো আছে, আবার একাংশের ছাদ নষ্টও হয়ে গেছে (সম্ভবত বজ্রাঘাতের মত প্রাকৃতিক দুর্যোগে), সেখানে আকাশ থেকে সূর্যের আলো এসে ভীষণ ফটোগ্রাফিক একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। একইভাবে আলো আসে মসজিদে ওপর দিকের একটা জানলা দিয়ে। একটা চালাঘরের মত ভল্ট, মসজিদের ওপর কেন এমন ভল্ট বা প্রকোষ্ঠের পরিকল্পনা করা হয়েছিল… কে জানে!
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@5.jpg?resize=593%2C435&ssl=1)
মসজিদের বাইরের ঘেরা জমিতে অনেকটা জুড়ে বাগান… যত্নের ছাপ স্পষ্ট। মসজিদের গম্বুজদের দিকে তাকালে বোঝা যায় একসময়ে খুবই উজ্জ্বল নকশা ছিল (তার সামান্যই আছে দেখা যায়), হারিয়ে গেছে স্তম্ভ এবং দেওয়াল আর খিলানের নকশা। বাগানটিকে দেখেও মনে হল… কোনও প্রাচীন গাছের অস্তিত্ব হয়ত কিছু ছবিকে পূর্ণতা দিত, কিন্তু সে আজ নেই।
গুণমন্ত মসজিদ থেকে বেরিয়ে বাগানের পথে আসতেই আবার আকাশের রোদ ঝলমল করে উঠল। ওই মেঘলা হয়ে আসা, আর প্রস্তর মসজিদের গাম্ভীর্য… গ্লুমি হয়ে ওঠা— যেন এক মোজেজা। আসলে বাইরে সব কিছুই এমন রোদ ঝলমলে ছিল।
বেরিয়ে এসে আর টোটো নিলাম না, ঐ সাবধানী-মেঠো পথে আসতে লেগেছিল পাঁচ মিনিটের কিছু বেশি… ফেরার পথে হেঁটে গেলে আর কতই বা বেশি সময় লাগবে? এই গ্রামের যে প্রকৃতি, যে শান্ত-করুণাঘন ছায়া… তারও মায়া কিছু কম নয়!
গৌড় রোডে ফিরে প্রথম টের পেলাম পিপাসা। সাময়িকভাবে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে গেলাম তাঁতিপাড়া মসজিদের দিকে। আসলে উপায় ছিল না, জলের বোতলে গাড়িতেই… আর গাড়িটাও ওই মসজিদের কাছাকাছি দাঁড় করানো। পাশ দিয়ে গা ঘেঁষে চলে যাচ্ছে টোটো আর বাইক। মাঝে মাঝে ট্রাকও যাচ্ছিল হর্ন বাজাতে বাজাতে হুঁশিয়ার করে। রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রাকের লাইনের পাশ দিয়ে হেঁটে এগিয়ে গেলাম গাড়ির দিকে। আক্কাসদা জিজ্ঞেস করলেন— দেখা হল? বললাম, হ্যাঁ। জিজ্ঞেস করলেন— চা খাবেন? আমি পালটা জানতে চাইলাম— আপনি খেয়েছেন? উনি বললেন— কদম রসুল গিয়ে খাব। এখনও কিন্তু অনেক কিছু বাকি!
বুঝতে পারলাম, সময়ের ব্যাপারে একটু সচেতন করছেন।
গলা ভিজিয়ে একটু জিরিয়ে নিলাম। গ্রামের ভেতরের সেই শান্তি এখানে নেই, এখানে উড়ছে সীমান্তবর্তী পাকা সড়কের ধুলো। সূর্য আর একটু কড়া… বেলা বাড়ছে।
তাঁতিপাড়া মসজিদ… তাঁতিপাড়া। গৌড়ের বস্ত্রশিল্পীদের মসলিন বস্ত্র, তাঁত বস্ত্র… এসবের এক কালে খুব কদর ছিল। রপ্তানি করার মত বাণিজ্যদ্রব্য। সেই তন্তুবায় সমাজের মানুষ যেখানে থাকতেন, সেই তাঁতিপাড়ার মসজিদ। সম্ভবত ইসলাম সম্প্রদায়ভুক্ত তাঁতিরাই আসতেন এখানে নামাজ পড়তে। তাঁদের জন্যেই নির্মিত এই মসজিদ। আনুমানিক ১৪৭৫ থেকে ১৪৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝে এই মসজিদটি নির্মিত হয় সুলতান শামসুদ্দিন ইউসুফ শাহের আমলে। কোনও সূত্রে বলে এই মসজিদ নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মির্শাদ খাঁয়ের নাম, কেউ বলে নির্মাণ করেছিলেন ওমর কাজি। তবে সেই রাজকীয় মসজিদের কেবল অবশেষই আজ রয়ে গেছে। মজবুত দেওয়াল এবং পাথরের স্তম্ভ টিকে গেলেও, একেবারেই ধ্বসে গেছে মসজিদের একদা দশ গম্বুজ-বিশিষ্ট ছাদ। পাঁচটি অলঙ্কৃত প্রবেশপথের এখন অবশিষ্ট আছে কেবল তিনটিই।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@6.jpg?resize=588%2C437&ssl=1)
প্রবেশ করার আগেই চোখে পড়ে বাঁদিকে পাশপাশি দুটি সমাধি। সমাধির চেহারা এবং উচ্চতা দেখে মনে হয় তৎকালীন কোনও বিশেষ ব্যক্তিদেরই সমাধিস্থ করা হয়েছিল; কিন্তু বিশেষজ্ঞদের কাছে তাদের পরিচয় অজ্ঞাতই থেকে গেছে। এবং তারপরেই চোখ যায় তাঁতিপাড়া মসজিদের প্রবেশদ্বার, আর তার চারপাশের টেরাকোটার কাজ করা দেওয়ালে।
![](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@7.jpg?resize=473%2C636&ssl=1)
শীতের রোদে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল লাল ইটের দেওয়াল আর টেরাকোটার নকশা। একটু ভালো করে দেখলে বোঝা যায়, অনেক অংশেই পুনর্নিমাণ বা রেস্টোরেশনের কাজ হয়েছে। সে যুগের মৌলিক সৌন্দর্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা আর ফেরানো যায়নি… টাচ-আপ করে ইমারতটিকে সুস্থ রাখার চেষ্টা করা হয়েছে। ছাদ না থাকায়, ঝকঝকে আকাশ থেকে সরাসরি এসে পড়ছিল রোদের আলো। পোড়ামাটির আভা প্রতিফলিত হচ্ছিল ভেতরে চতুর্দিকে। অদ্ভুত সুন্দর লাগছিল মসজিদের ভেতরের দেওয়ালের টেরাকোটার কাজগুলো। বেশিরভাগই আজ হারিয়েছে… তাও যা আছে, ঐতিহ্য। এক একটি অংশের সূক্ষ্ম কাজ ফটোগ্রাফিক প্লেট করে সংগ্রহে রেখে দিতে চাইবেন আগ্রহী আলোকিচত্র-শিল্পী।
![](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@8.jpg?resize=400%2C532&ssl=1)
গুণমন্ত মসজিদ বা লোটন মসজিদের বাইরের কাজ, টেরাকোটা সে অর্থে আর অবশিষ্ট নেই… সামান্যই পাওয়া যায়… কিন্তু সেদিক থেকে তাঁতিপাড়া মসজিদে টেরাকোটা কাজ অনেকটাই বর্তমান এবং এই গৌড় রোড অঞ্চলে সবচেয়ে উৎকৃষ্ট শিল্প-নিদর্শন। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া সত্ত্বেও, এখনও অনেক কিছুই দেখার আছে।
পর পর তিনটি ভিন্নধরনের স্থাপত্য দেখার পর চামকাটি মসজিদকে দেখতে খুবই ছিমছাম মনে হবে। গতে বাঁধা পর্যটকরা হয়ত স্কিপ করেই চলে যাবেন। কিন্তু সেটা করলে ভুল হবে। ভুল হবে এই ‘চামকাটি’ শব্দটিকে উপেক্ষা করে গেলে। নামের সাদৃশ্য থাকলেও কদম রসুলের কাছাকাছি চিকা মসজিদ বা চামকান মসজিদের সঙ্গে এর কোনও সম্পর্ক নেই। ‘চামকাটি’ এক বিশেষ মুসলিম শ্রেণি। একদিক থেকে বলা হয়, এই চামকাটি এক মুসলমান সম্প্রদায় যারা মহরমের মত ধর্মীয় শোকের দিনে নিজেকে আহত করে শরীরের চামড়া কেটে ফেলে। তাদের জন্যই নির্মিত ছিল এই মসজিদ, সেই সুলতানি শাসনের গৌড়ের ‘চামকাটি’ সম্প্রদায়ের বংশধররা নাকি এখনও মালদার পুরনো অঞ্চলে বসবাস করেন। আবার ভিন্নমতে… চামকাটি মানে যারা জীবিকার কারণে চামড়া কাটার কাজ করত। সম্ভবত চর্মশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। চামড়া কাটা এবং তার ট্যানিং-এর কাজ হয়ত এঁরাই করতেন। সে ক্ষেত্রেও বোঝা যায় যে এই শ্রেণির মানুষদের জন্য আলাদা মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিল… যার সম্ভাব্য কারণ দুটি—
১) এঁরা এই মসজিদের কাছাকাছিই থাকতেন।
২) অন্য মসজিদে এই শ্রেণির লোকজন হয়ত প্রবেশাধিকার পেতেন না বা যেতে চাইতেন না বলে আলাদা মসজিদ নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছিল।
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@9.jpg?resize=461%2C351&ssl=1)
আনুমানিক ১৪৭৫ (মানে সেই সুলতান ইউসুফ শাহের আমলেই) নির্মিত এই মসজিদটি এক গম্বুজ এবং তিনটি প্রবেশদ্বার বিশিষ্ট একটি ছিমছাম টেরাকোটার স্থাপত্য। নির্মাণে পাথরের ব্যবহারও দেখা যায়, দেখা যায় কিছু অংশে সূক্ষ্ম কাজ। তাঁতিপাড়া মসজিদের মত অতটা অলঙ্কৃত না হলেও, এই মসজিদের যে একটি আলগা সৌন্দর্য ছিল, তা আন্দাজ করা যায়।
![](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@10.jpg?resize=476%2C592&ssl=1)
মসজিদের চারদিকে মিনার ছিল বোঝা যায়… কিন্তু তার ওপরের অংশ ভেঙে পড়েছে বহুকাল আগে। নষ্ট হয়ে গেছে বাইরের দেওয়ালের অলঙ্করণও। ভেতরে সামান্য কিছু টেরাকোটার কাজ দেখা যায়। ওপরের একটি মাত্র বৃহৎ গম্বুজ এখনও ঠিক থাকলেও, এক পাশে ছাদের কিছু অংশ ধ্বসে পড়েছে।
![](https://i2.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/09/joydipin@11.jpg?resize=502%2C423&ssl=1)
কেউ বা কারা আসেন…, হয়ত দেখাশুনোর দায়িত্ব আছে তাঁদের ওপর। তাঁদের সাইকেল, বাইক এসব স্থাপত্যের সামনে বা ভেতরে থাকে। তেমন একটা বাইক আমার ছবিতেও থেকে গেল।
ছিমছাম অস্তিত্ব আর গৌড়ের সামাজিক শ্রেণিবিভাজনের এক ইতিহাস বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পরিত্যক্ত চামকাটি মসজিদ। ফলকের ওপর কিছু তথ্য, কিছুটা এই নির্মাণকে দেখে চেনা, আর বাকিটা দ্রষ্টার কল্পনা… কিন্তু ‘স্কিপ’ করার মত একেবারেই নয়। এই স্থাপত্যও সময় দাবী করে।