আমার প্রতিটি কবিতাই আজ নিষিদ্ধ, জেলবন্দি

আমার প্রতিটি কবিতাই আজ নিষিদ্ধ, জেলবন্দি: দারিন তাতুর | তর্জমা: সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়, সোহেল ইসলাম

দারিন তাতুর

 

তর্জমা: সুদীপ্ত মুখোপাধ্যায়

আমি দারিন। বয়স ৩৭। প্যালেস্তাইনের মেয়ে আমি, যে দেশের মানুষ গত ১১ বছর ধরে ইজরায়েলি সেনা দ্বারা অবরুদ্ধ। যেখানে ইজরায়েলি স্নাইপারদের গুলিতে কোনও না কোনও প্যালেস্তিনীয়র মৃত্যু নিত্যদিনের ঘটনা। এমনকি তার জন্য নেই কোনও তদন্ত কমিশন। যেখানে সেনাবাহিনীর টহল, চেকিং, পাস-পারমিট, ইন্টারোগেশন, টিয়ার গ্যাসের সেল, টর্চার, বুলেট, ক্র্যাচ, হুইলচেয়ার, ট্রমা সেন্টার আর কান্নার সঙ্গেই প্রত্যেক প্যালেস্তাইন পরিবারের বাধ্যতার দিনযাপন। রেহাই নেই প্যালেস্তিনীয় শিশু-কিশোরদেরও। প্রতি রাতে ইজরায়েলি সেনারা কোনও না কোনও ঘুমন্ত শিশু-কিশোরকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে টেনে-হিচড়ে বিছানা থেকে নামিয়ে নিয়ে গিয়ে তোলে সদর দপ্তরে। যেখানে স্বাধীনতা চাওয়াটাই অপরাধ। যেখান আদালত কবিতাকে ‘ইনসিস্টিং ভায়োলেন্স’ হিসেবে চিহ্নিত করে। অপরাধী হিসেবে অভিযুক্ত করে। ২০১৮র মে থেকে সেপ্টেম্বর ৫ মাস জেলে কাটাতে হয় আমাকে।

আমার অপরাধ আমার কবিতা ‘জনগণের প্রতিরোধ, প্রতিরোধই স্বাধীনতা’। ২০১৫র অক্টোবরে কবিতাটির একটি ভিডিও ইউটিউব এবং ফেসবুকে প্রকাশ করেছিলাম আমি। কবিতার সঙ্গে যে ছবিগুলো ছিল, তার বিষয় ছিল প্যালেস্তিনীয়রা কীভাবে হিংস্র ইজরায়েলি সেনাদের রুখে দিচ্ছে, মোকাবিলা করছে। এছাড়াও ফেসবুকে আমি আরও তিনটে কবিতা প্রকাশ করেছিলাম। যার একটিতে ইসরা আবেদের ছবি ব্যবহার করেছিলাম। ইজরায়েলি সেনাদের গুলিতে বিদ্ধ অবস্থায় নাজারেথের সেই নারী পড়েছিলেন আফুল্লার সেন্ট্রাল বাস টার্মিনাসের মাটিতে, রক্তে ভেসে যাচ্ছিল চারধার। দ্বিতীয় কবিতাটির প্রোফাইল পিকচার ছিল আরবিতে লেখা একটি উক্তি ‘আমিই হলাম সেই পরবর্তী শহীদ’। তৃতীয় পোস্টটি ছিল ওয়েস্ট ব্যঙ্কে ইনতিফাদার জন্য ইসলামি জেহাদের ডাকা একটি উদ্ধৃতি৷

আমাকে যদি তোমরা জিজ্ঞেস করো, আর দশজন প্যালেস্তিনীয়র মতোই কি আমি উদ্বাস্তু? আমি বলব— না। কারণ প্যালেস্তাইনে ইহুদিরা আসার অনেক আগে থেকেই আমাদের পরিবার রেইনহ-র বাসিন্দা। সেক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠতে পারে তাহলে ১৯৪৮এ ইজরায়েলিরা প্যালেস্তিনীয়দের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল সে সম্পর্কে আমি জানলাম কীভাবে? বই পড়ে? তার সঙ্গে আমার কি কোনও সরাসরি যোগ রয়েছে? অবশ্যই রয়েছে, সে সব আমি জেনেছিলাম আমার দিদিমার কাছ থেকে। তিনি মাঝেমধ্যেই শোনাতেন কীভাবে তারা নির্বাসিত হয়েছিলেন তাদের গ্রাম ‘সাফসাফ’ থেকে। ‘সাফসাফ’ ছিল লেবানন সীমান্তের কাছে সাফেদের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত একটা ছোট্ট গ্রাম। দিনটা ছিল ২৯অক্টোবর, ১৯৪৮। ইজরায়েলি সেনা গ্রামটা দখল নেওয়ার পর সমস্ত গ্রামবাসী আত্মসমপর্ণও করে। কিন্তু সমস্ত দেশের অত্যাচারী সেনাদের মতই ইজরায়েলি সেনারা সেদিন ৫০ জনের বেশি গ্রামবাসীকে পিছমোড়া করে বেঁধে গ্রামের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে এলোপাথারি গুলি চালায়। আর লাশগুলোকে একটা কুয়োর ভেতর ছুঁড়ে ফেলে। অনেকটা সেই ‘শিন্ডলার’স লিস্ট’ ছবিটার মতো। সেদিন তিনজন নারী সেনা দ্বারা ধর্ষিত হয়, যার মধ্যে একজন ১৪ বছরের কিশোরীও ছিল। সে সময় আমার ঠাকুমার বয়স ছিল ১৬, বিয়েও হয়ে গিয়েছিল পাশের গ্রাম আল-জেসের একজনের সঙ্গে। কিন্তু সেই দিনটিতে তিনি সাফসাফেই ছিলেন। আর নিজের চোখে দেখেছিলেন সেই নারকীয় হত্যাকাণ্ড।

সেই হত্যাকাণ্ডের পর সাফসাফের অন্যান্য গ্রামবাসীদের মতই আমার দিদিমার ভাইবোনেরা লেবানন এবং সিরিয়ার উদ্বাস্তু শিবিরে গিয়ে আশ্রয় নেয়। এবং গত ৭০ বছর ধরে শুধুমাত্র নিজের অস্তিত্বটুকু টিকিয়ে রাখবার জন্য তাদের এক অমানবিক জীবনসংগ্রাম চালিয়ে যেতে হচ্ছে। সেদিনের ঘটনার পর আমার দিদিমা আল-জেসে তার স্বামীর কাছে চলে যান। সেখানেই আমার মা জন্মান। আমি কখনও আমার দাদুকে দেখিনি। আর দেখবই বা কী করে? মা যখন খুব ছোট তখনই দাদু মারা যান। দিদিমার মুখেই শুনেছি তিনি ছিলেন ১৯৩৬-৩৯এর আরব বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী একজন বিপ্লবী। ব্রিটিশ সেনাদের বিরুদ্ধে প্যালেস্তিনীয় যোদ্ধাদের সে লড়াইয়ের মূল উদ্দেশ্যই ছিল ইহুদি উপনিবেশের জন্য ব্রিটিশরা যাতে কিছুতেই তাদের মাতৃভূমি দখল করতে না পারে।

আমার দিদিমার স্মৃতিচারণ… তার শৈশবের কথা, কৈশোরের কথা, উৎসবমুখর দিনের কথা, গ্রামের কথা, পথঘাট, আত্মীয়-পরিজনের কথা, তার জীবনের কথা বারবার শুনতে শুনতে একটা সময় উপলব্ধি করতে পারি তার পরিবারের উদ্বাস্তু হবার আগের যে জীবন, সে জীবনই ছিল তার কাছে স্বপ্নের… স্বর্গীয়। আর এটা শুধু আমার দিদিমার ক্ষেত্রেই নয়, সাফসাফ গ্রামের বাসিন্দা যাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল তাদের প্রত্যেকের কাছে ইজরায়েলি দখলদারির আগে যে জীবন ছিল সেটাই ছিল তাদের সবচেয়ে সুখের। আজও সেটা আঁকড়েই তারা বেঁচে রয়েছেন। আর সেই উপলব্ধি থেকেই হাইস্কুলের পাঠ শেষ করে আমি কবিতা লেখা ছাড়াও ইজরায়েলি আদালতে ঘোষিত আমার দ্বিতীয় সাংঘাতিক অপরাধমূলক কাজ উদ্বাস্তু প্যালেস্তায়িনীদের জীবনের তথ্যসংগ্রহের কাজ শুরু করি।

আমার অপরাধ, ১৯৪৮-এ ইজরায়েল ৫০০রও বেশি যে প্যালেস্তিনীয় গ্রাম এবং শহরগুলোকে ধংস করেছিল আমি খুঁজতে শুরু করি সেইসব গ্রাম-শহর থেকে পালিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তু মানুষদের। শুরু করি তাদের সাক্ষাৎকার নিতে, সেইসব ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামে তাদের সাথে গিয়ে সময় কাটাতে শুরু করি, ছবি তুলতে শুরু করি। বেশকিছু তথ্যচিত্রও তৈরি করি। আর সেগুলো ইউটিউব, ফেসবুক পেজ, ব্লগে পোস্ট করার পাশাপাশি ‘ফিরে দেখা প্যালেস্তাইন’ নামে একটা ওয়েবসাইটেও কিছু ফুটেজ ওপেন করে দিই। আমার অপরাধ, ‘ওয়াটার স্প্রিং’ নামে একটা ওয়েবসাইট চালু করা। যেটাকে আমার সংগ্রহ করা সমস্ত তথ্যের গুদামঘরও বলা যেতে পারে। এই সাইটটার মাধ্যমে ইজরায়েল অধিকৃত প্যালেস্তাইনের ভেতরের উদ্বাস্তু প্যালেস্তিনীয় এবং সীমান্তের ওপরের উদ্বাস্তু প্যালেস্তিনীয়দের মধ্যে একটা সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা করি আমি। যাতে করে আমরা প্যালেস্তিনীয়রা নিজেকে, নিজের শেকড়কে খুঁজে পাবার একটা নতুন পথ পাই। আমার অপরাধ, প্যালেস্তিনীয় উদ্বাস্তুরা যাতে সাইটের মাধ্যমে তাদের ফেলে যাওয়া গ্রাম, বাড়ি-ঘরের ছবি পাওয়ার জন্য স্থানীয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারেন এবং আন্দোলনকারীরা আবার সেইসব ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামে গিয়ে ছবি তুলে তা তাদের পাঠাতে পারেন তেমন একটা ব্যবস্থাপনা তৈরি করা, যাতে তারা প্রিয় স্মৃতিগুলো রোমন্থন করতে পারেন। তাছাড়া স্কাইপের সাহায্যে উদ্বাস্তু শিবিরের মানুষজনের স্মৃতির যে অমূল্য ভাণ্ডার তা আমি সংগ্রহ করেছিলাম তাদের সঙ্গে কথা বলে। আমার অপরাধ, ইউরোপের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উদ্বাস্তুরা যাতে তাদের ধ্বংস হয়ে যাওয়া গ্রামগুলো দেখবার জন্য আসতে পারেন তার জন্য ইউরোপিয়ান পাসপোর্টের ব্যবস্থা করা। আল-দামুন, আল-বিরহ, তিরাত-হাইফা তিনটি বিধ্বস্ত প্যালেস্তিনীয় গ্রামের ‘ফিরে দেখা’ নিয়ে তিনটি তথ্যচিত্র নির্মাণ করাটাই আমার অপরাধ। আমার অপরাধ, ‘বলো, কেমন আছে আমার গ্রাম’ শিরোনামে গত কয়েক বছর ধরে গ্রেট মার্চের সময় কেন আমি তাঁবু জুড়ে বিধ্বস্ত শহর ও গ্রামের ৫০০রও বেশি ছবি টাঙিয়ে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নিয়েছি।

গৃহবন্দি হবার পর থেকে কোর্ট অবশ্য আমার ইন্টারনেট ব্যবহারের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। আমার ওয়েবসাইটের রেজিস্ট্রেশন পর্যন্ত আটকে দিয়েছে। সেটা আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না। আমি প্রচন্ড চিন্তিত, ভীতও বলা যেতে পারে কারণ ওয়েবসাইটে যত তথ্য আমি প্রকাশ করেছিলাম, সেগুলো বোধহয় চিরদিনের মত ওরা নষ্ট করে দিয়েছে। তাছাড়া যে কম্পিউটারটির মধ্যে আমার তথ্যচিত্রের ফুটেজগুলো ছিল আমাকে গ্রেফতারের সময় সেটাও নিয়ে গেছে ওরা।

আজকাল প্রায়ই শুনি আমি নাকি একজন সন্ত্রাসবাদী। এই তো কদিন আগে জেল থাকে ছাড়া পাওয়ার পর পর জাফার সমুদ্র সৈকতে আমি হাঁটছিলাম। একজন পথচারী আমাকে চিনতে পেরে জিজ্ঞেস করলেন, আমিই কি দারিন? বললাম— হ্যাঁ। তার মানে তুমিই কবিতা লেখো, দ্রোহের কবিতা? আর যেতে যেতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, আমি সন্ত্রাসবাদী… আমার মৃত্যু অনিবার্য। কবিতা লেখার জন্য কেউ সন্ত্রাসবাদী হতে পারে ভাবলেও হাসি পায়। তেল আভিভেও একইরকম অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছিল আমাকে। একটা মিটিং-এ যাওয়ার উদ্দেশ্যে ওখানকার একটা ব্যস্ত রাস্তার ফুট ধরে হাঁটছি হঠাৎ দেখে একটা বাচ্চা ফুট ছেড়ে গাড়িভর্তি রাস্তার দিকে ছুটে যাচ্ছে। আমি দুবার কোনও কিছু না ভেবে ঝাপিয়ে পড়ে বাচ্চাটাকে কোলে তুলে নেই, তারপর ফিরিয়ে দিই তার বাবার কাছে। বাচ্চাটির বাবা আমাকে দেখে বলল, “আমি চিনি আপনাকে।” আমি বলি, ঠিক আছে, হতে পারে। সে বলে, “আপনি দারিন তাতুর, আপনিই তো সেই সন্ত্রাসবাদী.. তাই না?” আমি অবাক হয়ে তাকে বলেছিলাম, “কয়েকমুহূর্ত আগে আমিই কিন্তু আপনার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছি।” থতমত খেয়ে তিনি আমাকে টাকা দিতে চেয়েছিলেন। যাওয়ার আগে আমি শুধু বলেছিলাম, “আমার কিছু লাগবে না, তবে আপনি শুধু এটা মনে রাখবেন… যে একজন সন্ত্রাসবাদী আপনার ছেলের প্রাণ বাঁচিয়েছিল।” এটা ভাবতেই খারাপ লাগে মানুষজন আমাকে ভয় পায়। গ্রেফতার হবার আগে সম্পূর্ণ অন্য জীবন ছিল আমার। কিন্তু এখন যেখানেই যাই না কেন সকলে আমাকে সন্দেহের চোখে দেখে। শপিংমল বা এয়ারপোর্ট যেখানেই যাই না কেন আমার তল্লাশি নিশ্চিত। শপিংমলে অন্য সকলে কিন্তু সহজেই ঢুকতে বেরুতে পারে, কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তল্লাশি হবে, আই-কার্ড চাইবে, জিজ্ঞেস করবে কেন এসেছি? আমি বলি, “আর দশজনের মতই বাজার করতে এসেছি।”

মাঝে মাঝে ভাবি এই যে যারা আমাকে সন্ত্রাসবাদী ভাবেন তারা কি একবারের জন্যও খোঁজ রাখেন উদ্বাস্তু শিবিরে কেমন আছেন প্যালেস্তিনীয়রা? কখনও কি অনুভব করেন কেমন লাগে নিজের দেশেই বছরের পর বছর বন্দিজীবন কাটাতে, কেমন লাগে সেনাশাসন? তারা কি খোঁজ রাখেন… ২০০৮-এ ‘নাকবার’ ৬০ বর্ষপূর্তির দিনটিতে নাজারেথের উত্তর-পশ্চিমে বিধ্বস্ত শহর সাফুরিয়াতে পরিবারের সকলকে নিয়ে জড়ো হওয়া হাজার হাজার প্যালেস্তিনীয় দিনের শেষে যখন পার্কের দিকে এগোচ্ছিলেন ঠিক তখনই ইজরায়েলি পুলিশ এক দল সেটলারকে (ইজরায়েলি) পার্কের দিকে যাবার অনুমতি দেয়, এবং সেটলাররা পাথর ছুঁড়তে শুরু করে। প্রত্যুত্তরে প্যালেস্তিনীয় যুবকেরা বাধা দিলে পুলিশ, স্পেশাল ফোর্স, মাউটেন্ড পুলিশ সকলে মিলে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্যালেস্তিনীয়দের ওপর… টিয়ার গ্যাস, স্টান্ট গ্রেনেড ছোড়ার পাশাপাশি শুরু হয় লাঠিচার্জ। আচমকা এরকম একটা ঘটনায় হতভম্ব মানুষ যে যেদিকে পারে ছুটতে থাকেন। ধাক্কাধাক্কিতে অনেক শিশুই পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কাঁদতে শুরু করে। লাঠির আঘাতে অনেকেই মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকেন.. পুলিশ ইচ্ছে করেই তাদের ওপর বুট দিয়ে মাড়িয়ে চলে। হঠাৎই চোখে পড়ে দু লাইন পুলিশের মাঝে তিনটে শিশু, বাবা-মাকে হারিয়ে তারা বুঝতে পারছে না কোথায় লুকোবে। বিপদ থেকে ওদের উদ্ধার করার জন্য ছুটে যাই আমি, কিন্তু সেনারা আটকে দেয় আমাকে… আমাকেই ওরা ওদের হিংসার টার্গেট বানায়.. একটা গ্যাস ক্যানেস্টার সোজা এসে লাগে আমার পায়ে, আর একটা শক গ্রেনেড সোজা এসে লাগে আমার বুকে। সঙ্গে সঙ্গে মনে হয়েছিল বুকটা জ্বলে গেল, দম আটকে আসল, আমি জ্ঞান হারাই। যারা আমাকে সন্ত্রাসবাদী ভাবেন, তারা কি কখনও খোঁজ রাখেন ইজরায়েলি সেনার কারণে এই সন্ত্রাসবাদীকেও হাসপাতালের বেডে কাটাতে হয়েছে।

কখনও কখনও কেউ কেউ বলেন আমি তো অতি সহজেই ইজরায়েল ছেড়ে অন্য যে কোনও দেশে চলে যেতে পারি। কিন্তু সত্যিই কি পারি..পারা যায়? আমার জীবন, আমার অস্তিত্ব, আমার যন্ত্রণা, সবই তো এই দেশটার সঙ্গে জড়িয়ে। এখানে অনেক সমস্যা রয়েছে কিন্তু তারাই তো আমাকে শক্তি দেয়, প্রেরণা দেয়। আর জেলে যেতে হয়েছে বলে কি দেশ ছাড়ব? জেল সে তো আমার ভাবনাকে নতুন আকার দিয়েছে, এক ভিন্ন পরিচিতি দিয়েছে। দেশের মানুষকে অন্যায়ের এবং দখলদারির হাত থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য এখন আমি অনেক বেশি সমর্পিত। সকল প্যালেস্তিনীয়দের জন্য একটা দেশই আমার লক্ষ্য। ন্যায় এবং সাম্য হবে যার মূল মন্ত্র। আমার মনে হয় জেলে ঢোকার আগে আমি যে মানুষ ছিলাম, বেরুলাম এক অন্য মানুষ হয়ে। অনেক বেশি সমর্থ, অনেক বেশি কাব্যিক। জেলে যে মানুষগুলোর সঙ্গে আমি মিশেছি হলফ করে বলতে পারি তারাই আমার সম্পূর্ণ বদল ঘটিয়ে দিয়েছে। আমার সবচেয়ে বড়ে প্রাপ্তি জেলের বন্দি নারীরা। আমার মন, ভাবনা, অনুভব সব সময়ের জন্যই বন্দি নারীর সঙ্গে রয়েছে। আমি নিজেকে জেলবন্দি সেই সব নারীদের অধিকার পুনরুদ্ধারের জন্য নিয়োজিত করতে চাই এবং তাদের যন্ত্রণার কথা মানুষকে বলতে চাই। আমি জেলের প্রত্যেক বন্দির সঙ্গে মিশেছি এবং তাদের অমূল্য জীবনের কথা শুনেছি। এবং প্রত্যেকের গল্পে মানুষের জন্য একটা প্রয়োজনীয় বার্তা রয়েছে। জেলে যে ৪৫ জন প্যালেস্তিনীয় বন্দি ছিলেন তাদের প্রত্যেককে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনেছিলাম, জেনেছিলাম। তাদের সঙ্গে আমার আত্মিক সম্পর্ক এতটাই গড়ে উঠেছিল যে সেইসব স্মৃতি, অনুভূতি আমি কোনওদিনই ভুলতে পারব না। জেল থেকে ফেরার পর আমি ভেবেছি… আমি নিজেকে নারী আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত করব। আমি ভেবেছি প্যালেস্তিনীয় নারীদের নিয়ে একটা সংগঠন তৈরি করব যাদের কাজ হবে সারা পৃথিবীর নারীদের অধিকার সংগঠনের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করা। সবচেয়ে বড় কথা এই সময়ে আমি যতটা পরিচিতি পেয়েছি তা আমার নিজেকে মেলে ধরতে যথেষ্ট প্রেরণা দিয়েছে। জেলখানা আমাকে একটা খোলা আকাশের নিচে এনে দাঁড় করিয়েছে। আগে যে বিষয়ে লিখতাম না বিশেষত নারী বিষয়ে লিখতে শুরু করেছি। লিখতে শুরু করেছি প্যালেস্তিনীয়দের যন্ত্রণার পাশাপাশি সীমান্তের ওপারের নারীদের জীবন যন্ত্রণার কথা। তবে কি জেলখানা আমার কাছে খুব প্রিয়? আমি কি সেখানেই ফিরে যেতে চাই বারবার? না, জেলখানা জায়গাটা শুধু ভয়ঙ্করই নয় গোলমেলে। এখনও আমার কানের মধ্যে বাজে জেলখানার শেকলের আওয়াজ, লোহার দরজা বন্ধের, তালা বন্ধের আওয়াজ। একটু আকাশ দেখার জন্য ছটফট করতাম কিন্তু জেলঘরের একটা চৌকো ফুটো দিয়ে এক টুকরো ফালি জমি ছাড়া আর কিছুই দেখতে পেতাম না। এখন অবশ্য সব কিছুর জন্যেই প্রস্তুত আমি। মাঝে মাঝে মনে হয় সরকারি উকিল এবং মহামান্য আদালতের মুখোমুখি যদি বসতে পারতাম তবে বলতাম, তোমাদের কারণেই আমার সঙ্গে যথেষ্ট অবিচার হয়েছে। কিন্তু না, তারপরও আমি তোমাদের ঘৃণা করি না। কারণ তোমরা আমার মতোই নারী, আর আমার নীতি হল কখনওই একজন নারী হয়ে আমি অন্য এক নারীর বিরুদ্ধে দাঁড়ব না। কিন্তু কখনওই তোমাদের মত হতে পারব না। আমার যথেষ্ট রাগ হয়েছিল কিন্তু তোমাদের ঘৃণার চোখে দেখিনি, যেমনটা সরকারি অ্যাটর্নির চোখে ঘৃণা দেখেছিলাম আমার জন্য। এ সব নিয়ে তাদের অবশ্য একটা কবিতা উপহার দেব। যার নাম হবে “হ্যালুসিনেশন অব এ পোয়েট কনভিক্টেড অব টেরোরিজম”।

আমি মনে করি আমার দেশের প্রতিটি উদ্বাস্তু মানুষের জন্য, নির্যাতিত প্রতিটি প্যালেস্তিনীয়র জন্য আমার দায়িত্ব দিন দিন বাড়ছে। আমি জানি ইজরায়েলি সেনা আমাকে জেলখানায় পাঠাবার জন্য নিত্যনতুন ফন্দিফিকির করছে, অষ্টপ্রহর আমার ওপর নজরদারি চালাচ্ছে। কিন্তু আমি ‘গ্রেট মার্চে’ হাঁটবার অপেক্ষায় দিন কাটাই, তাঁবু জুড়ে ছবির প্রদর্শনী করবার অপেক্ষায় দিন কাটাই। ইজরায়েলিদের হানায় বিধ্বস্ত প্যালেস্তিনীয় গ্রামগুলোর কাছে ফেরবার অপেক্ষায় দিন কাটাই, সীমান্তের ওপারের আমার স্বজনদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার অপেক্ষায় দিন কাটাই। আর এ সব যদি অপরাধ হয়, তবে আমি চিৎকার করে বলব “আমাকে গ্রেফতার করো।”

দারিন তাতুরের কবিতা

 

অনুবাদ: সোহেল ইসলাম

জনগণের প্রতিরোধ, প্রতিরোধ-ই স্বাধীনতা

জাগো প্যালেস্টাইন
মিউ মিউ করে কোনও সুরাহা হয় না
চিৎকার করতে শেখো, চিৎকার…
জামার হাতায় রক্ত মুছে উঠে দাঁড়াও
ভেড়ার মতো মরে যাওয়াতে কোনও বীরত্ব নেই
পতাকাকে মাটিতে গড়াতে দিও না
যতক্ষণ না কুকুরগুলোকে তাড়াতে পারো

আমাদেরও সময় আসবে
জেরুজালেম ভেঙে পড়ছে
শহীদের সওয়ারি চলেছে
রুখে দাঁড়াও
পঙ্গু, অভিশপ্ত সংবিধানকে টুকরো টুকরো করো
আস্তাকুঁড়ে ফেলে দাও
অধিকার ছিনিয়ে নিতে গেলে
তোমাকেই এগিয়ে আসতে হবে

কাফেরদের কথা ভাবা বাদ দাও
ওরা ভাড়াটে খুনি
তোমাকে এবার প্রকাশ্য রাস্তায় নেমে আসতে হবে
এই তো সময় উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার

যারা এজেন্ট পাঠিয়ে আমাদের শান্ত করতে চাইছে
মিথ্যে আশ্বাসের ঘেরাটোপে পুরতে চাইছে
ত্রিসীমানায় ভিড়তে দিও না তাদের

এতদিনকার বদলা নিতে
জন্মভূমি ফেরত নিতে
কোথায় তোমার সেই ঝাঁঝ
হুঙ্কার ছাড়ো
নেমে আসো রাস্তায়
যদি কিছু না থাকে বিশ্বাস তুলে নাও হাতে
বিশ্বাসই তোমার হাতিয়ার

আল্লা ডাকছে তার বান্দাদের
চলো, চোখরাঙানির বিরুদ্ধে উঠে দাঁড়ানোদের এক অমর গাঁথা লিখি

 

কে আমি, কেন আমি

আন্ডা সেলের টর্চার থেকে বেরিয়ে আসার পর
আমার রাগ ল্যান্ড মাইনের মতোই বীভৎস আজ

আমার জীবন থেকে কান্না হারিয়ে গেছে
দুঃখকে জাহান্নামে পাঠিয়ে
আমি তোমার কাছে এসেছি নসিব—

এই নাও আমার জন্মতারিখ,
বলো: আমার বয়স কত?

হয়ত এখনও আমার বউপুতুল খেলার বয়স
কিন্তু দালালদের লুটে খাবার মতবল
আমাকে যুদ্ধের ময়দানে এনে দাঁড় করাল

মানুষের হিংস্ররূপ কিছুতেই মেনে নিতে পারছি না
ভেতর থেকে খোকলা করে দিল
অনাথ করে দিল আমাকে
নিজেকে এভাবে উলঙ্গ হতে দেখে
চোখগুলো জ্বলে যাচ্ছে আমার

আমি দারিন,
আর সবার মতই হতে চেয়েছিলাম
যখন খেলনা বন্দুক থেকে গুলি ছুটতে লাগল
খিদের সময়
ভিক্ষে করা ছাড়া কোনও উপায় রইল না

তখন আমার কী করার থাকতে পারে
বুক চিতিয়ে দাঁড়ানো ছাড়া
কাফেরদের টুঁটি চেপে ধরা ছাড়া?

 

আর কী চাই?

তোমার চাইছ
আমরা সবটা ভুলে যাই
হাঁ, সবটা ভুলে যাই

বুলেটের দাগ
বুকে বুটের সোলের আঘাত
মাথায় একে ৫৬ তাক করা

কথা দিচ্ছি
আমরা ভুলিয়ে দেব সব,
তোমরা ঠিক যেমনটা চাও

দেয়ালে লেখা যে পদ্য
তোমাদের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে
তাকেও মুছে দেব
যে গাছের শেকড়ে বসে
দিন বদলের গান বেঁধেছিলাম
তাকেও কেটে দেব

সব ইচ্ছে ধুয়ে মুছে সাফ করে দেব রাতারাতি
যেমনটা তোমরা চাও

আমাকে দেখা যাক বা না যাক
আমার কবিতার ভয় মুষড়ে দিয়েছে তোমাদের
আমার কবিতার ভয় দাপিয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে খুনীদের
আর কী চাই…?

ঘুরে দাঁড়ানো

লজ্জা করে না
আমার জন্য সই সংগ্রহে নেমেছ
আমাকেও কি বানাতে চাও
সিগারেটের প্যাকেটে লেখা ঠিকানার মত, যা হারাবেই

পালিয়ে যাওয়ার বান্দা আমি নই
কবিতা আমাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী বানিয়েছে
রাষ্ট্র বানাল অনুপ্রবেশকারী

আমি সব ছুঁড়ে ফেলে দেব
কলম কান্না ছুঁড়ে ফেলব কুয়োর জলে

যারা আমাকে,
আমার স্বপ্নকে ঠেলে ফেলল কবরে
তাদের বলি, শোনো
গুপ্তহত্যা করো
গৃহবন্দি করো
নয়ত আমার ইচ্ছেগুলোকে মেরে ফেল
আমি দুঃখে, প্রলাপে
হেরোর মতো জীবন কাটাতে পারব না

আবার যদি দেশের কথাই ওঠে
আমি চিৎকারে ফেটে পড়বই
কারও কোনও নিষেধ মানব না

আমি দারিন তাতুর,
আমি পালেস্তাইনের মেয়ে

 

আমি কোত্থাও পালিয়ে যাওয়ার নই

আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি
এবার ওরা আমাকে গারদে পুরবে
শুরু করবে অত্যাচার
লক-আপের অন্ধকারে ঝুলিয়ে রাখবে
যতক্ষণ না রক্ত ঝরে
যতক্ষণ না হাজার ওয়াটের আলোর নীচে
সিগারেটের ছেঁকায় দগ্ধ করতে পারে আমাকে

তারপর শুরু করবে তল্লাশি
টেররিস্ট খোঁজার মত করে
আমাকে লন্ডভন্ড করে উপড়ে আনবে হৃদপিণ্ড
খুবলে নেবে চোখ
তন্নতন্ন করে খুঁজবে
কোত্থেকে আসে, আমার কবিতার শব্দেরা

ফিলামেন্ট কাটা বাল্বের মত দপ করে নিভে যাওয়ার মেয়ে আমি নই
আমাকে ভয় পাওয়ানো অত সোজা না
যতই খুবলে নেওয়া চোখ দিয়ে কোলাজ বানানোর চেষ্টা করো
পৃথিবীর যাবতীয় শব্দের হদিশ পেতে হৃদপিণ্ডকে এফোঁড়-ওফোঁড় করে দাও
রিপোর্ট ফাইলে লিখে দাও:
তল্লাশিতে কিছুই মেলেনি
শুধু মাত্র একটা কবিতা ছাড়া

আমি দারিন তাতুর
আমাকে গায়েব করে দেওয়া

অত সোজা না

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

আপনার মতামত...