কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়
ওহ, জ্বালিয়ে খেল তো, বাজন্ত ফোনটা কানে লাগিয়ে ভুরু কুঁচকে, মুখ ভেচকে খেঁকিয়ে উঠল লোকটা। এক হাত তুলে ইশারা করল আর সঙ্গে সঙ্গে হিসেবের খাতার ওপর পেনবাগানো মালিক, প্লাস্টিকের দুটো ভারি থলি হয়ে তুলতে থাকা পিঠবেঁকানো ছেলে, চা পাতার বাক্স হাতে মই বেয়ে নামতে থাকা আরেকটা ছেলে থেমে গেল। পুরো স্ট্যাচু।
পোস্ত? ওকে। হ্যাঁ হ্যাঁ আসছি, এখন ছাড়ো তো। একটা কল আসছে।
একজন পোস্তর একটা একশো গ্রামের প্যাকেট নিয়ে এসে পলিথিনে পুরতে যাবে, মালিক ধমকে উঠল। হাত বাড়িয়ে আড়াইশো গ্রামের পোস্তর প্যাকেট পুরে দিল পলিথিনের প্যাকেটে। চোরের মতো লোকটার দিকে তাকাল। কিন্তু লোকটা ততক্ষণে অন্য একটা ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ইংরিজিতে কথা বলছে, এখন পোস্তর মাপ নিয়ে ঝামেলা করবে না।
কচুশাক উজিয়ে থাকা থলে হাতে নারকেল দড়ির মতো বুড়োটা লোকটার কান বাঁচিয়ে “সালা” বলল। বুড়োটা হারামি আছে, একটু আগে আমাকে দেখে সরে দাঁড়াল। আমি ইচ্ছে করে অন্ধকার ঘেঁষে দাঁড়িয়েছি, যাতে ডান গালটায় আলো না পড়ে, তবু মালটার চোখ পড়েছে ঠিক। দু নম্বর ফোনটা আসার পর একজন রাগ দেখিয়ে অন্য দোকানে চলে গেছে। প্রথম ফোনটা এসেছিল যখন দুটো পলিথিন ভর্তি হওয়ার পর লোকটা পকেট থেকে মানিব্যাগ বার করার সময়। কী যেন লিস্টে লেখা হয়নি, নুন না চিনি, সেটা আনতে হবে। সে সব নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে লোকটা রওনা দেয় দেয়, আবার ফোন। দু লিটারের থামস আপ, বড় চিপসের প্যাকেট। না না আরও বড়। ওইটুকুতে কী হবে। আর চা পাতা।
তিননম্বর এই পোস্তর ফোন।
অন্যদিন হলে আমিও রাগ করতাম হয়তো, আজ আমার গায়ে জোর নেই। মাসিকের দ্বিতীয় দিন। ব্যথার ধাত চিরকালই ছিল, গত কয়েকমাস ধরে অসহ্য হয়েছে। ছুটি নিয়েছিলাম। বৌদি ফোন করল দুপুরবেলা। কারা যেন আসবে বিকেলে। “ঘণ্টাখানেকের জন্য আয় কল্পনা, লুচি ভেজে দিয়ে যা।” লুচি কি আর শুধু লুচি থাকে? মটন কষাও, বাসন মাজো, একশো কাপ চা বানাও, চিপস বাড়ো, কাপ কুড়োও, বাসন মাজো। এমনকি গ্যাসটা পর্যন্ত বৌদি পুঁছতে পারবে না। সারা সন্ধে বকবক করে নাকি মাথা ফেটে যাচ্ছে। অতিথি বিদেয় হতে না হতে সব সারতে সারতে সাড়ে নটা বাজল। পা ভেঙে আসছে, ঘুমে চোখ ভারি। গলার ভেতর খুসখুসে কাশি। দু কানে, চোখের পাতায় গরম ভাপ।
হাতে ধরা নোটটা সমান করতে করতে ঠাকুরকে ডাকছিলাম। যেন লোকটা, বা লোকটাকে যে বারবার ফোন করছে, আর কিছু না ভোলে।
এত ভুলে যায় কী করে লোকে? বৌদি বলে, তোরা একটা জিনিস বুঝিস না, তোদের কাজ গায়েগতরের কাজ। হুড়ুমদুড়ুম খাটলি, হয়ে গেল। আর আমাদের, তোর দাদাদের, হচ্ছে গিয়ে মাথার কাজ। দেখলে মনে হবে চেয়ারে বসে আছি সারাদিন, কিন্তু মাথা খাটছে চব্বিশ ঘণ্টা। ও চাপ নিতে আলাদা ক্যালি লাগে।
সেই জন্যই হয়তো মনে থাকে না কিছু। এই যে আমার মাথা ঘুরছে, পা কাঁপছে, আলতো করে থামস আপের কাঁচের আলমারিটা ধরে রেখেছি পাছে পড়ে যাই, অথচ আমার দিব্যি মনে আছে বাড়িতে কী কী নেই। চাল, ডাল, আটা, খই, চিনি, আখের গুড়, সাবান, তেল, লিটিল হার্ট। মাসখানেক সাপ্লাই ছিল না, আবার এসেছে। দোকানের সামনে র্যাকে ঠাসাঠাসি লাল পেটমোটা প্যাকেটের ভেতর ছোট ছোট হার্ট শেপের বিস্কুট, চিনির গুঁড়ো ছড়ানো। একদিন বাড়ির ফেরার পথে একটা প্যাকেট কিনে পার্কে বসে খাব। এ সময় কয়েকটা মাতাল নিমগাছটার ছায়ায় ঘন অন্ধকার বেঞ্চটায় বসে গজল্লা করে। দলে একটা কেউ আছে হেবি ভালো গায়। বিশেষ করে কিশোরের দুঃখের গানগুলো। কুছ তো লোগ কহেঙ্গে, লোগো কা কাম হ্যায় কহেনা। গান শুনতে শুনতে আমি একটা গোটা প্যাকেটের সবগুলো হার্ট অল্প অল্প কামড়ে, চেটে চেটে খাব। কাউকে দেব না। একলা খাব। কোনও কুকুর যদি আসে, পায়ের কাছে গুটিয়ে বসে, হয়তো একটা ছুঁড়ে দেব ইচ্ছে হলে, ব্যস।
কিন্তু আপাতত আমার তেল দরকার। না হলে রান্না চড়বে না। লোকটা অবশেষে সরছে সামনে থেকে। সমান করা নোটটা এগিয়ে দিয়ে হাঁ করতে যাব এমন সময় পাশ থেকে তুমি বলে উঠলে, ম্যাকারনি এসেছে?
গলা শুনেই তোমাকে চিনতে পেরেছিলাম। শুধু আমি না। ও গলা গত ছ মাসে টিভিতে রেডিওতে সবাই শুনেছে। আশেপাশের সবাই ঘুরে তাকিয়েছিল।
আমার ঘাড় ঘোরানোর সাহস হয়নি। চোখের কোণা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়। কালো রঙের কামিজ, কাঁধের ব্যাগ। খোঁপা। আর ডান গালের বাঁকখানা। শ্যামলা, কিন্তু কী গ্লেজ। টিউবলাইটের আলো পিছলে যাচ্ছে।
চারদিকে সব থমকে গেল। দোকানি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। আসুন ম্যাডাম, আসুন। খদ্দেররা পায়ে পায়ে পিছোচ্ছে। কারও মুখে রা নেই, কিন্তু কনুইয়ের ঠেলা আর চোখের ইশারার চিৎকারে চৌচির হচ্ছে চারিদিক।
হতেই পারে না সে চিৎকার তোমার কানে ঢুকছে না। কিন্তু তুমি পাত্তাই দিচ্ছ না। ঘাড় সোজা করে তাকিয়ে আছ সামনের দিকে। তোমার পিছুপিছু দুটো ছেলেমেয়ে এসেছে, এমন করে তাকিয়ে আছে তোমার দিকে যেন তুমি ওদের জ্যান্ত দুগগাঠাকুর। ডি ব্লকের প্যান্ডেলের মহিষাসুরের বুকে ত্রিশূল গুঁজে সামনের দিকে হাসি হাসি মুখে তাকিয়ে থাকা থ্যাবড়ামুখো, ফ্যাটফেটে ফরসা দুগগা নয়। তোমার লম্বাটে মুখে উঁচোনো গালের হাড়। মা হলে বলত ঘোড়ামুখী। টেনে খোঁপা বেঁধে বেঁধে চওড়া কপাল আরও চওড়া হয়েছে। খোঁপার নিচে সটান ঘাড়। সোজা পিঠ।
দোকানের টিউবলাইটের নাগালের বাইরে সরে এলাম। তুমি যদি জানতে আমি কে, তাহলে আর কারও দিকে তাকাও না তাকাও, আমার দিকে একটু হলেও ঘুরে তাকাতে। তাকাতেই। না তাকিয়ে পারতেই না। কারণ সারা পৃথিবীর কাছে তুমি রোল মডেল হতে পার, কিন্তু আমার সঙ্গে তোমার সম্পর্ক আরও অনেক গভীর, অনেক কাছের।
*****
কবে থেকে জানো? যেদিন কাজে যাওয়ার পথে টোটোতে উঠে ডলি আঁতকে উঠল, কী হয়েছে তোর গালে?
বললাম, পড়ে গেছিলাম। ডলি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইল, তারপর বলল, খাদাড়ে কাল রাতে হেবি ঝামেলা হয়েছে নাকি।
তোমার গা ছুঁয়ে বলছি, বুক ধড়াস করে উঠেছিল। অথচ খাদাড়ে মারামারি নিয়ে কারও কোনও হেলদোল থাকার কথা নয়। কিছু না কিছু লেগেই আছে, দেখ না দেখ একটাদুটো লাশ পড়ছে ডেলি। কিন্তু আমি জানতাম, সেদিনের ঝামেলাটার সঙ্গে আমার কিছু একটা যোগাযোগ আছে। যা-ই ঘটে থাকুক না কেন, সেটা আমার জীবনকে বদলে দেবে। সেদিন সকাল থেকে আমার মনটা কু-ডাক ডাকছিল। তোমরা এ সব বিশ্বাস করবে না, কিন্তু এগুলো সত্যি। বাবা যেদিন ট্রেনে কাটা পড়েছিল, সকাল থেকে একটা কালো বেড়াল, কোনওদিনও দেখিনি আগে, বারান্দায় ঘুরঘুর করছিল। দুপুরে খেতে বসে মায়ের ভাতে কয়লার কুচি পড়ল। তারপর সন্ধে পুরোতে না পুরোতে ওই খবর।
ডলি যখন বলছিল, ঝামেলাটা একটা রেপ নিয়ে, একটু হলেও আশা জাগেনি বলব না। ও গুণ্ডাবদমাইশি মারামারিতে আছে জানতাম। তোলা তুলতে গিয়ে কবে কোথায় খোট্টা গুণ্ডাদের মেরে পাট করে এসেছে, এই নিয়ে কম জাঁক তো দেখাত না। ডলি ব্লাউজের ভেতর থেকে ভাড়া বার করতে করতে বলল, মেয়েছেলেটা খাদাড়ের না, বাইরের। মিস্তিরির বাচ্চাদের পড়াতে টরাতে যায়, সে নাকি মাঝরাত পড়িয়ে ফেরার সময় পার্কে ঢুকেছিল, ওখানেই কেসটা ঘটেছে।
তখনই আমি বুঝে গেছি। তোমার কথা আমাকে বলেছিল ও। কী বলেছিল সে আমি আর অক্ষরে অক্ষরে বলছি না, তবে তুমি যে কাউকে তোয়াক্কা না করে, পুরুষমানুষ ছাড়া রাতবিরেতে একা একা চলে বেড়াও সেটা ও সইতে পারত না। ওর মাথায় আগুন জ্বালিয়ে দিত। এটা অদ্ভুত জানো। আমি পোষা কুকুরের মতো যতক্ষণ কাছে পাই ওর দিকে জুলজুল করে চেয়ে থাকি। তাতেও রাগ! আর তুমি, তোমাদের মতো মেয়েরা যে ওদের দিকে ফিরেও তাকায় না, তাতেও জ্বলুনি। বলেছিল, এমনভাবে হাঁটে যেন রানি ভিক্টোরিয়া। এ সব বদচরিত্রের মেয়েকে চাবকে সিধে করে দেওয়া উচিত।
সেদিন একটা কিছু ঘটবে আমি জানতাম। কোথা থেকে মারধোর খেয়ে এসেছিল। ঠোঁটের কষে লেগে থাকা রক্ত মুছিয়ে দিতে গেলাম, উল্টে আমাকে থাবড়া মারল। মেঝেতে পড়ার সময় লোহার টুলটায় ডান গালটা ধাক্কা খেল। পিঠের ওপর বেল্ট এসে পড়ল সপাং সপাং সপাং । আমি মাটি কামড়ে পড়ে রইলাম। কল্পনা করলাম, যেমন প্রতিবারই করি, এই শেষবার। এর পরেরবার ঠিক চিৎকার করে উঠব, লাথি মেরে সরিয়ে দেব আমার শরীরের ওপর থেকে ওই থাবার মতো হাত, আমার ঘরের দরজা নিজে হাতে মুখের ওপর বন্ধ করে দেব। বলব, এটা আমার বাড়ি, আমার ঘর, আমার শরীর। তোমার কোনও অধিকার নেই। বেরিয়ে যাও। এই মুহূর্তে বেরিয়ে যাও।
আমার বলার দরকার হয়নি। জ্ঞান ফেরার পর দেখেছি, নিজেই ফিরে গেছে কখন।
ফিরতে গিয়েই তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, তাই না? তখনও নিশ্চয় শরীরে রাগ বাকি ছিল, তাই তোমার ওই দুর্গতি হল। নিজেকে অপরাধী লাগে। আমি যদি আরেকটু মার খেতে পারতাম তাহলে হয়তো তোমাকে ভুগতে হত না।
আমি যখন মেঝেতে পড়ে কাঁদছিলাম, ভাবছিলাম আর এ জীবন রেখে কী লাভ, কেন এক্ষুনি সব শেষ করে দিচ্ছি না, তখন তুমি রক্তাক্ত শরীরে উঠে দাঁড়াচ্ছিলে। ছেঁড়াখোঁড়া শরীর, ফালাফালা পোশাক নিয়ে অন্ধকার রাতে বাড়ি বাড়ির দরজা ধাক্কাচ্ছিলে। এক অটোওয়ালা অবস্থা দেখে হাসপাতাল নিয়ে যেতে চাওয়ায় বলেছিলে, হাসপাতাল নয়, থানায় নিয়ে চল আমাকে। তারপর সারা রাত থানায় বসে আরেকটা লড়াই শুরু হয়েছিল তোমার।
টিভির প্যান্টশার্ট পরা মেয়েটা তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিল,
আপনি অত রাতে ওই এরিয়ায়, পার্কের ভেতর কী করছিলেন?
ও যা করছিল তাই; ভয়ানক গরম লাগছিল বলে গাছের তলায় বসে হাওয়া খাচ্ছিলাম।
আপনি খুব অন্যরকম, ভীষণ সাহসিনী। বেশিরভাগ মেয়ে তো লজ্জায় মুখ লুকিয়ে বসে থাকত ধর্ষণের পর।
কী আশ্চর্য, আমি লজ্জা পেতে যাব কেন? লজ্জা যদি কারও পাওয়া উচিত তবে যে রেপ করেছে পাওয়া উচিত।
আপনি কি এর পরেও ও পাড়ায় পড়াতে যাবেন? আপনার ছাত্ররা আপনার কাছে পড়তে চাইবে?
কেন চাইবে না? আমার পড়ানোর ক্ষমতা তো লোপ পায়নি। তাছাড়া আমারই তো ছাত্রছাত্রী, আশা করি ওদের বেটার শিক্ষা দিয়েছি, ওরা চাইবে।
তবু, নিরাপত্তার জন্য আপনি কি মনে করেন না পড়ানোর টাইমটা বদলানোর দরকার আছে? দিনের আলো থাকতে থাকতে।।
আমার ছাত্রছাত্রীরা স্কুল থেকে, কাজ থেকে, খেলার মাঠ থেকে ফেরে সন্ধেবেলা। ফিরতে ফিরতে সন্ধে। তারপর হাতপা ধোবে, খাবে কিছু তারপর তো পড়তে বসবে। টাইম বদলালে চলবে কেমন করে? টাইম বদলালে ওরা অনেকে পড়তেই পারবে না। প্রশ্নই ওঠে না।
*****
কী সাহস, না? বলেছিলাম আমি।
মুখ উঁচু করে গলায় ঢেলে, বোতলের ছিপি আটকে, জল গিলে ডলি জবাব দিয়েছিল, সাহসের কী আছে। একটা কেস হয়ে গেছে, হয়ে গেছে। এখন আর ওর গায়ে কেউ হাত দেবে ভেবেছিস? পুলিসমন্ত্রী এমএলএ সব এখন ওর দলে। মেয়েছেলেটা খবরের কাগজে চাকরি করে। হেবি পাওয়ার। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন সব উঁচু পোস্টে বসে আছে। চারদিকে ধামাল মচিয়ে দিয়েছে। এখন ওকে চটানোর সাহস কারও নেই। ওর এফআইআর নিচ্ছিল না বলে পুলিস অফিসারের বদলি হয়ে গেছে, জানিস? ওই লোকটার ফাঁসি হবে দেখিস না, কেউ আটকাতে পারবে না।
মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলাম। ডলিকে আমি বলিনি। আন্দাজ করেছিল কি না জানি না। ওকে আমি লুকোই না কিছু। আমার আগের কেচ্ছাকেলেঙ্কারি, পালিয়ে গিয়ে বিয়ে, বিয়ে ভেঙে নাক কেটে বাড়ি আসা, যে সব এ পাড়ায় কেউ জানে না, ডলি জানে। কিন্তু এই ব্যাপারটা বলতে পারিনি। ওকে বিশ্বাস করি না বলে নয়। ওর বর, বিয়ের সাত বছর আর ডলির সঙ্গে তিনটে বাচ্চার পর, আরেকটা বউ করেছে। বর্ধমানে না কোথায়। ওখানেই থাকে। একটা বাচ্চাও হয়েছে শুনেছি। এখানে ছেলে মেয়ে শাশুড়িকে নিয়ে ডলির সংসার। বাড়িটা শাশুড়ির। বর যখনতখন বুক ফুলিয়ে এসে ঢোকে। টান মেরে নিজের মায়ের টাকা, চড় মেরে ডলির টাকা নিয়ে হাঁটা দেয়। বুড়ি তখন হেবি তড়পায় কিন্তু ডলিকে শাসিয়ে রেখেছে, আমার ছেলে যখন খুশি যেদিন খুশি আমার বাড়িতে ঢুকবে, কারও আপত্তি থাকলে যেন সে বেরিয়ে যায়। ডলি বরকে দেখতে পারে না, কিন্তু বরের নতুন বউকে ঘেন্না করে। ওই যে ওর বেঁকা বেঁকা কথা, কাঠ কাঠ হাসি, কিছুতেই কিছু যায় আসে না ভাব— সব ওই মেয়েটার নাম শুনলে ঘুচে যায়। তখন ওর মুখচোখ দেখলে ভয় লাগবে তোমার। খানকি রেন্ডি বলে গাল পাড়ে। সামনে পেলে টুঁটি ছিঁড়েও নিতে পারে। বলে, পুরুষমানুষ মারে তবু বুঝি। মেয়ে হয়ে মেয়ের সর্বনাশ যারা করে তারা মেয়ে নয়, ডাইনি।
আমিও তো তাই, বল? ডাইনি। যদিও বলেছিল ওর বিয়েটিয়ে হয়নি, আমি গোড়া থেকেই জানতাম সব বাজে কথা। খাদাড়ে বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে ওর ভরা সংসার। তবু আসতে বারণ করিনি। টাকার লোভ? মাঝেসাঝে সস্তা শাড়ি আর ঝুটো সিলভারের কানের দুলের লোভ? মাসে একদুটো রবিবার মটন খাওয়ার আর কাউকে রেঁধে খাওয়ানোর লোভ? হতে পারে। মিথ্যে বলব না, যদি তুমি ওর নামে নালিশ না করতে, মাঝরাতে জনমানুষহীন পার্কে বসে হাওয়া খাওয়ার খেয়াল তোমার যদি না চাপত, তাহলে হয়তো আজ আমার দু পলা তেল কেনার জন্য লাইনে দাঁড়াতে হত না। নিজের কাছে নিজে স্বীকার করতে লজ্জা হয়, কিন্তু তোমার সামনে লজ্জা করব না, হয়েছিল আমার লোভ। শাড়িদুলের লোভ নয় শুধু, তার থেকেও বেশি কিছুর। ডাইনি থেকে বউ হয়ে ওঠার। এখন হাসি পায়। বউ হয়েই বা কী হত? আরও পাঁচটা ডাইনি জুটে যেত নির্ঘাত। তাদের সঙ্গে শুয়ে বেড়াত। তাদের ঠেঙিয়ে পাট করত। আমাকেই বা কোন পুজোটা চড়াত?
প্যান্টপরা মেয়েটা জানতে চেয়েছিল, আচ্ছা, মাঝরাতে পার্কে বসে হাওয়া খাওয়ার জন্য না থাকুক, আপনার কি ঘটনাটা নিয়ে অন্য কোনও আফসোসও নেই?
আছে তো। আমি প্রতিরোধের জন্য প্রিপেয়ার্ড ছিলাম না। থাকলে ফাইটটা আরও ভালো দিতে পারতাম। তবে আমি স্টেপস নিয়েছি। ক্যারাটে ক্লাসে ভর্তি হয়েছি। পেপার স্প্রে ছাড়া বেরোই না।
এখন আসাযাওয়ার পথে দেখি বাজারের সামনের উঁচু বিরাট বোর্ডে তোমার ছবি। তোমাকে পাশে দাঁড় করিয়ে সমিতির চেয়ারম্যান হাসি হাসি মুখে ঘোষণা করেছে কোনও দুঃস্থ মহিলার যদি ক্যারাটে শেখার পয়সা না থাকে, সমিতি তাদের ফ্রিতে ক্যারাটের ক্লাস দেবে। ডলিকে বলেছিলাম, যাবি? ডলি এমন করে তাকিয়েছিল যেন আমার জায়গায় মরা মায়ের ভূত দেখছে। বলেছিল, এই বয়সে তুই বৌদির ছেলের সঙ্গে ঢোলা প্যান্ট পরে হাইসা হুইসা চেঁচাতে চেঁচাতে হাত পা ছুঁড়বি? ভাতে গাঁজা মেখে খাচ্ছিস নাকি আজকাল?
*****
তুমি বললে, বললে না, প্রায় চেঁচিয়ে উঠলে। ও মা! কতদিন পর! বলে হাত বাড়িয়ে লিটিল হার্টের পর পর দুটো প্যাকেট ছিঁড়ে নিলে। ছেলেটা কী যেন বলল, মেয়েটা হাসল।
তোমাদের বাজার হয়ে গেছে। নোটটা ভাঁজ করে ব্লাউজের ভেতর ঢুকিয়ে নিয়ে, পিছু পিছু বেরিয়ে এলাম। গুমোট ভাবটা কেটেছে। হাওয়া অনেকটা ঠান্ডা। তিনদিন বাদে পূর্ণিমা। মুশকো একখানা মেঘের কিনারে চাঁদের আলো লেগে আছে। কুকুরগুলো হাত পা ছড়িয়ে দখল নিয়েছে বাজারের। করুণাদি আর করুণাদির বর, মোমোর বাসনের থাক খুলে খুলে ব্যাগে পুরছে। মুচির বন্ধ ঝুপড়ির সামনে দাঁড় করানো লাল স্কুটারটায় চড়ল মেয়েটা। চাবি ঘুরিয়ে স্টার্ট দিল। ঝোলা কাঁধে ছেলেটা পেছনে বসে হেলমেট বাঁধতে বাঁধতে বলল, চেপেচুপে হয়ে যাবে তিনজনে। চল না মিতুলদি, ছেড়ে দিই?
আরে ধুর, এইটুকু তো রাস্তা, পার্কের ভেতর দিয়ে দশ মিনিটও লাগবে না। তাছাড়া কম্প্যানি আছে তো। লিটিল হার্টের প্যাকেটটা তুলে ধরে হাসলে তুমি।
কনুইয়ে গলিয়ে নিলে বাজারের পলিথিনখানা। বাঁ হাতে বিস্কুটের প্যাকেটখানা ধরে ডান হাত দিয়ে বিস্কুট তুলে মুখে পুরতে পুরতে হাঁটা লাগালে। আমি মাথা ঢেকে ভালো করে আঁচল জড়িয়ে নিলাম। হাওয়া লেগে জ্বর আসলেই চিত্তির। কাল কাজে বেরোতেই হবে।
রাস্তার লাস্ট ল্যাম্পপোস্টটা পার হয়ে গেল। আমার তোমার ছায়া চোখের সামনে লম্বা হতে হতে মিলিয়ে গেল। তুমি গুনগুনাচ্ছ। আরেকটু কাছে গেলে সুরটাও ধরতে পারব। তোমার পছন্দের গান, আমার পছন্দের হতে বাধ্য।
ফোনের আওয়াজটা চমকে দিল দুজনকেই। থেমে কাঁধের ব্যাগ হাতড়ে ফোন বার করলে। হাসি হাসি গলায় হ্যালো বললে। কাঁধ আর গাল; তোমার চকচকে, টিউবলাইট স্লিপ খাওয়ানো বাঁ গালের মাঝে ফোনখানা জাপটে ধরে হাঁটতে শুরু করলে।
পার্কের গেটের সামনের লাইটটা খারাপ হয়ে গেছে। চাঁদ এখনও মেঘের আড়ালে। চট করে চারদিক দেখে নিয়েছি। কোথাও বিড়ির আগুন টিমটিম করছে না। মাতালগুলো নেই আজ। গান নেই। কেউ নেই। দুপুরে বৌদির বাড়ি যাওয়ার পথে পরপর দুজোড়া শালিখ দেখেছিলাম। এর পরেও তুমি বলবে, এমনি এমনি? এ সবের কোনও মানে নেই?
পার্কটা বড় বেশি অন্ধকার। তোমার পরামর্শ মেনে থলির মধ্যে একটা ছুরি নিয়ে ঘুরি সবসময়। এই মুহূর্তে, এই অন্ধকার পার্কে যদি তোমার কোনও বিপদ হয় তাহলে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব। গত ছ মাস ধরে তোমার কথা শুনতে শুনতে, তোমার ছবি দেখতে দেখতে আমি বুঝতে পেরেছি, আমার শাড়ি তোমার জিনস, আমার ঝুগগি তোমার ফ্ল্যাট, আমার নুনভাত তোমার পাস্তা, তোমার সাহস আমার ভয়, আমার কান্না তোমার ফাইট— এ সব ওপরের ফারাক। আসলে আমি তুমি এক সুতোতে বাঁধা। একটুখানি যা অমিল, আমার গালের আর তোমার ডান গালের ওই চেরা দাগটায় রয়ে গেছে। কী হবে ওটুকু বাঁচিয়ে রেখে?
পা চালালাম।
‘রাস্তার লাস্ট ল্যাম্পপোস্টটা পার হয়ে গেল। আমার তোমার ছায়া চোখের সামনে লম্বা হতে হতে মিলিয়ে গেল। তুমি গুনগুনাচ্ছ। আরেকটু কাছে গেলে সুরটাও ধরতে পারব। তোমার পছন্দের গান, আমার পছন্দের হতে বাধ্য।’ গল্পটা পড়তে পড়তে ভাবছিলাম লেখক বা লেখিকা যাই বলি, ওঁর কোনও গল্প কেন আগে কোনও দিন পড়িনি? কী অসামান্য ট্রিটমেন্ট! কোনও ভাল লেখার জোর অনেক। এবার থেকে কুন্তলা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা না পড়ে ছাড়ব না।
Ekhane onar anek lekha paben. Shuru korle chharte parben na. http://abantor-prolaap.blogspot.com/2020/09/4-no-platform-role-model.html?m=1
শৈলেন, আপনার কমেন্ট পড়ে বুক ফুলিয়ে ঘুরছি এদিকওদিক। আর চন্দ্রচূড়, আপনাকে কিছু বলছি না। কী যেন বলে…। পুরোন চেনাদের মধ্যে কী সব ফরম্যালিটি যেন নিষেধ…
এটি আপনার প্রথম প্রকাশিত গল্প, জানতাম না। তা হলে বলব, আপনি যদি শান্ত ও সৎ ভাবে অর্থাৎ বড় হওয়ার জন্য তাড়াহুড়া না করে নিজের লেখা লিখে যতে পারেন, তবে বলা যায়, বাংলা সাহিত্য একজন শক্তিশালী লেখককে পেতে যাচ্ছে।
অসংখ্য ধন্যবাদ, শৈলেন। আপনার কথা মাথায় রাখলাম।