অদেখা বন্ধু, অজানা শত্রু: পেট আর পেটের জীবাণু

অদেখা বন্ধু, অজানা শত্রু: পেট আর পেটের জীবাণু -- স্বপন ভট্টাচার্য

স্বপন ভট্টাচার্য

 


লেখক অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, প্রাবন্ধিক

 

 

 

 

কথায় বলে মনের আঁকাবাঁকা পথ আসলে গিয়েছে পেটের ভিতর দিয়ে। কথাটা খুব উড়িয়ে দেবার মত মোটেই নয়, খেয়ে খাইয়ে সর্বস্বান্ত প্রেমিক মাত্রেই সে কথা মানবেন। মনোবিকলনের অন্তরালেও পেটের যে একটা ভূমিকা থাকতে পারে তা প্রমাণের জন্য আমার মত ক্রনিক আমাশায় ভোগা বাঙালি জাতির প্রতিনিধিকে খুব বেশি দৌড়ঝাঁপ করতে হবে না বলেই মনে হয়। মানুষের পেটের মধ্যে থাকা অণুজীবদের মহাজগত, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অপরিহার্য ব্যাক অফিস, তা যে পরমায়ুও ঠিক করে দেবার ক্ষমতা রাখে তা অ্যান্টিবায়োটিক যুগের আগের রাজপুরুষ থেকে যোগী, মহাযোগী অনেকেই জীবন দিয়ে বুঝে গিয়েছিলেন।   বুদ্ধিশুদ্ধি, ব্যবহার এমনকি যৌনতাও যে পেটের প্রভাবে প্রভাবিত হয় তা বুঝতে উদাহরণের খুব একটা প্রয়োজন পড়বে বলে মনে হয় না। এক পা এগিয়ে আধুনিক গবেষণা বলছে পেটের মধ্যে থাকা জীবাণুজগত অনেকাংশে ঠিক করে দেয় শিশু স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠবে ভবিষ্যতে নাকি বাঁচবে মানসিক প্রতিবন্ধকতা নিয়ে? তা ঠিক করে দেয় শিশু শর্করা বিপাকের সমস্যায় ভুগে ডায়াবেটিসের শিকার হয়ে পড়বে কি না, এমন কি তার দেহের রোগজীবাণু প্রতিরোধক্ষমতার শিকার তার নিজের দেহটাই হয়ে পড়বে কি না?

প্রতিটি মানুষের শরীর হল লক্ষ কোটি জীবাণুর স্বাভাবিক আবাসস্থল। বিশেষত চামড়ায়, মুখগহ্বরে, নাসারন্ধ্রে, জননাঙ্গে এবং অন্ত্রে তাদের সংখ্যা অপরিমেয় আর বৈচিত্রও প্রবল। মানুষের দেহের সঙ্গে এদের এই সম্পর্ক যে সব সময় সখ্যের তা নয়, তবু সখা ও শত্রু সবরকম দেহবাসী জীবাণু নিয়েই গড়ে উঠেছে আমাদের দেহনির্ভর এক আশ্চর্য জীবাণুজগত— মাইক্রোবায়োটা যার নাম। লেডারবার্গ[1] মাইক্রোবায়োটার সংজ্ঞা দিয়েছেন: “the ecological community of commensal, symbiotic,and pathogenic microorganisms that share our body space”— আমাদের শরীরে জায়গা ভাগাভাগি করে বসবাস করা সহজীবী, মিথোজীবী এবং রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুদের নিয়ে গড়া বাস্তুতন্ত্র। সাম্প্রতিক গবেষণা জানাচ্ছে দেহের জীবাণুজগতের ধরনটা কেমন হবে তার সূচনা হয়ে যায় গর্ভাবস্থায়। আগে ধারণা ছিল মাতৃগর্ভ হল স্টেরাইল— নির্বীজ। কিন্তু গর্ভের তরলে, গর্ভনাড়ীতে, ভ্রূণের আবরণীতে ব্যাকটেরিয়ার ডিএনএ-র উপস্থিতি সে ধারণা ভেঙে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, এও জানা যাচ্ছে যে নবজাত শিশুর দেহের জীবাণুজগত ঠিক কেমন হবে তা নির্ভর করবে কিভাবে সে ভূমিষ্ঠ হল তার উপর। দেখা যাচ্ছে, স্বাভাবিক ডেলিভারির বাচ্চার দেহের জীবাণুতন্ত্র সিজারিয়ান ডেলিভারির বাচ্চার তুলনায় অন্য রকম হয়। স্বাভাবিক ডেলিভারির বাচ্চার দেহে মায়ের পৌষ্টিকতন্ত্রে বাসা বাঁধা জীবাণুরই আধিক্য থাকে, কিন্তু সি-সেকশন ডেলিভারির বাচ্চার দেহে থাকে মায়ের চামড়ার উপর নির্ভরশীল জীবাণুর আধিক্য। বড় হয়ে যাবার পরে বা বড় হয়ে যাবার পথে বাচ্চার শরীরের এই জীবাণুতন্ত্র বদলে যায়। মাতৃদুগ্ধ ছেড়ে শক্ত খাবার খেতে শুরু করার পর বাচ্চার জীবাণুতন্ত্র, বিশেষত পৌষ্টিক জীবানুজগতের ধরনটা নির্ভর করে খাবারের প্রকৃতি, তার শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এবং সে ঠিক কোন কোন ধরনের রোগজীবাণু দিয়ে আক্রান্ত হল তার উপর। মুখবিবর থেকে শুরু করে পায়ুছিদ্র পর্যন্ত দীর্ঘ পৌষ্টিক তন্ত্রটির সব জায়গায় কিন্তু একই সংখ্যায় বা একই প্রকৃতির অণুজীব বসবাস করে না। মুখবিবর প্রায় ২০০টি ভিন্ন ভিন্ন রকমের জীবাণুর আবাসস্থল, কিন্তু পাকস্থলীতে অত্যন্ত উঁচুমাত্রার অ্যাসিডবিধৌত পরিবেশে তাদের সংখ্যা প্রায় নগণ্য। এদের সংখ্যা ও প্রকৃতি ক্রমশ বাড়তে থাকে অন্ত্রে এবং বৃহদন্ত্রে তা গিয়ে সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়। একজন স্বাভাবিক পূর্ণবয়স্ক মানুষের বৃহদান্ত্রে অন্তত ৫০০ বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। বৃহদন্ত্রের ভিতরকার পরিবেশ সেখানে এক বিশেষ ধরনের জীবাণুতন্ত্র নির্মানের সহায়ক যা খুব বেশি বাইরের প্রভাব বিনা বিপর্যস্ত হয় না। মানুষের বৃহদন্ত্রের মূল উপাদান হল খাদ্য হিসাবে গৃহীত উপাদানগুলির অপাচ্য বর্জ্য— সাদা কথায় মল। স্বাভাবিক মানুষের প্রতি গ্রাম বর্জ্যে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা কম করেও ১ এর পরে বারোটি শূন্য বসালে যত হয় তত। প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের শরীরে কোষের সংখ্যা যা, সেই শরীরের মধ্যে বাসা বাঁধা ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা তার অন্তত দশ গুণ বেশি। তাদের সব চেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখতে পাওয়া যায় এই বৃহদান্ত্রে, ওজন করলে বৃহদান্ত্র থেকে পাওয়া কেবল ব্যাকটেরিয়ার ওজনই হবে এক কিলোগ্রাম। তবে এরা বিশেষ ধরনের। বৃহদান্ত্রের পরিবেশে অক্সিজেন ছাড়াই এরা বাঁচে ও বৃদ্ধি পায়। এদের মধ্যে দুটি গোষ্ঠীর ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি মানুষের অন্ত্রে প্রায় সার্বজনীন— BacteroidetesFirmicutes । মানুষের অন্ত্রে এদের উপস্থিতি মানুষ ও ব্যাকটেরিয়া দু’য়ের পক্ষেই জরুরী এবং উপকারী। খাদ্য হিসাবে আমরা যা যা খাই তার অনেকটাই হজম করবার ক্ষমতা আমাদের নেই। বিশেষ করে উদ্ভিজ্জ খাবারের মধ্যে থাকা উদ্ভিদকোষের কোষপ্রাচীর হল অতি জটিল কার্বোহাইড্রেট যা আমাদের দেহের হজম ক্ষমতার বাইরে। গরু-বাছুরের তা হজম হয় তাদের অন্ত্রে থাকা বিশেষ জীবাণুদের সহায়তায়, আমাদেরও মোটামুটিভাবে তাই। পেটের মধ্যে থাকা জীবাণুদের জীনতন্ত্রে এই দুষ্পাচ্য উদ্ভিজ্জ পদার্থ ভেঙে সরল করার খবর থাকে। সেই খবর তাদের প্রণোদিত করে এমন সব উৎসেচক তৈরি করতে যা আমাদের দেহ পারে না। ব্যাকটেরিয়া ভেঙে সরল করে তার নিজের তাগিদে, তা না করলে সে বেঁচে থাকার মত শক্তি পাবে কোথায়? ফলে আমরাও পেয়ে যাই কিছু ব্যবহারযোগ্য পুষ্টি উপাদান। কতটা পুষ্টি এই অন্ত্রের ব্যাকটেরিয়ার ক্রিয়াকলাপ থেকে পাই আমরা বা পায় স্তন্যপায়ী প্রাণী তা দেখার জন্য ব্যাকটেরিয়াবিহীন ইঁদুরের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গিয়েছিল যে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি বজায় রাখার জন্য খাদ্যে ক্যালোরি চাহিদা ছিল অন্তত ৩০ শতাংশ বেশি। আবার তাদের পৌষ্টিকতন্ত্রের জীবাণুবৈচিত্র বাইরে থেকে স্বাভাবিক করে দিলে সে চাহিদাও স্বাভাবিক স্তরে নেমে এসেছিল। বলা দরকার, ইঁদুর আর মানুষের পেটের ভিতরকার জীবাণুতন্ত্রে রীতিমত মিল আছে, সম্ভবত একই উৎস বিবর্তিত হয়েছে তারা।[2]

এছাড়া একান্তভাবে আমাদের কাজে লাগে অথচ আমাদের দেহের সৃষ্টি ক্ষমতার আয়ত্তাধীন নয় এমন কিছু ভিটামিন, অ্যামাইনো অ্যাসিড ওই বৃহদান্ত্রেই তারা তৈরি করে। গবেষণাগারে ব্যাকটেরিয়াবিহীন ইঁদুরছানাদের বাইরে থেকে ভিটামিন-K এবং কিছু ভিটামিন B12 যেমন, ফোলিক অ্যাসিড, বায়োটিন ইত্যাদি না জোগান দিলে তাদের স্বাভাবিক বৃদ্ধি হতে পারে না। অন্ত্রের ভিতরে থাকা ব্যাকটেরিয়া যে কত বিচিত্র রকমের পদার্থ আমাদের খাবারের অপাচিত তৈজসপত্র থেকে বানিয়ে ফেলতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। অন্ত্রের যে সব কোষ তাদের বিপাকজাত এইসব পদার্থ শোষণ করার জন্য মুখিয়ে থাকে তাদের সঙ্গে এই সব ব্যাকটেরিয়ার সম্পর্ক সখ্যের। এই সখ্য অন্ত্রের কোষগুলোকে বাড়তে সাহায্য করে এবং ক্ষতিকারক জীবাণুকে অন্ত্রের কোষস্তরে বাসা বাঁধতে বাধা দেয় অনবরত। সুতরাং আমরা শুরুতেই যে দেহনির্ভর জীবাণুতন্ত্রের বা মাইক্রোবায়োটার কথা উল্লেখ করেছি তার একটা স্থিতাবস্থা দেহের পক্ষে প্রয়োজন। পেটের জন্য তো তা আরও সত্যি। পেটে খেলে পিঠে সইলেও সইতে পারে কিন্তু মনেও যে সইবে তার কোন মানে নেই। আধুনিক গবেষণা বলছে পেটের মধ্যে থাকা ব্যাকটেরিয়া কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের গঠন ও বিকাশে, দেহের অনাক্রম্যতা বা ইমিউনিটির ধরণ- ধারন নির্ধারণ করতে, শৈশব থেকে বয়ঃসন্ধি, বয়ঃসন্ধি থেকে যৌবনপ্রাপ্তি, যৌবন থেকে প্রৌঢ়ত্ব ও বার্ধক্যে পৌঁছানোর বিভিন্ন ধাপকে স্বাভাবিকভাবে অতিক্রম করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেয়। পেটের মাইক্রোবায়োটা শুধু যে পেটেই কাজ করে তা নয়, বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে স্বাভাবিকভাবে গড়ে তুলতেও তাদের ভূমিকা প্রমাণিত হয়েছে।[3]

পেটের জন্য নানারকমভাবে বেইজ্জত হইনি, বাঙালি পুরুষ হয়ে এমন কথা বলি কী করে? আসলে দোষ কারও নয় গো মা, দোষ যে পেটের মধ্যে থাকা ভিনদেশি অতিথিদের তা তো এমনি এমনি বোঝবার উপায় নেই। ভিনদেশি অতিথি কথাটা বুঝেশুনেই ব্যবহার করলুম, কারন মাইক্রোবায়োটা স্থিতাবস্থাকে বিপর্যস্ত করে দিতে পারে খাদ্য বা খাদ্যের ছদ্মবেশে কুখাদ্যের মধ্যে থাকা অবাঞ্ছিত ব্যাকটেরিয়া ও অন্য জীবাণু।  ফ্যাটপ্রধান খাবার খেলে হয়ত পেটের দখল নিল Bacteroides জাতীয় ব্যাকটেরিয়া, তো ফাইবার প্রধান খাবার থেকে পেটে আধিক্য দাঁড়াল Prevotella নামের অন্য ব্যাকটেরিয়া। এরা মানুষের পেটের বন্ধুই এমনিতে, কিন্তু আপনার পেটের স্বাভাবিক জীবাণুতন্ত্রের সঙ্গে তাদের ঠিক মিলমিশ হল কিনা তা বোঝা তো সহজ নয়। হতেও পারে, তারা খাপ খাচ্ছে না পেটের স্থায়ী বাসিন্দাদের সঙ্গে, এবং এরাই ক্রমশ দখল নিচ্ছে পেটের। এই অবস্থাকে বলে ডিসবায়োসিস বা জৈবিক অব্যবস্থা। বহু বহু উদাহরণ আছে এই ডিসবায়োসিসজনিত বিকলতার। টাইপ I এবং টাইপ II ডায়াবেটিস, কোলন এবং রেকটাল ক্যান্সারের এবং ইনফ্ল্যামেটরি বাওয়েল ডিসিসের (IBD) মত বেশ কয়েকরকম রোগলক্ষণের। বিপর্যস্ত জীবাণুসাম্য ডেকে আনে হাজারো বিপদ।  সাদা, হলুদ, সবুজ, লাল, কালো বা জলের মত— হরেকরকম আমাশার বিবরণ শুনতে শুনতে বেড়ে উঠেছে বাঙালি শিশুকাল থেকেই। এ লেখাকে সে সব আন্ত্রিক সমস্যার বিবরণ দিয়ে ভারাক্রান্ত করব না, বরং দেখে নেওয়া যাক মানুষের পেট মানুষকে পেটের বাইরে কোন কোন সমস্যায় ফেলতে পারে।

 

ইমিউনিটি ও পেট

তথ্য বলছে অনেকগুলো অটোইমিউন ডিসঅর্ডারের সঙ্গে পেটের জীবাণুসাম্যের ভালোরকম সম্পর্ক আছে। অটোইমিউন ডিসঅর্ডার মানে শরীরের সেই অবস্থা যাতে আপনার শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা আপনার শরীরের কোষ-কলাকেই শত্রু ভেবে বসবে। সুস্থ স্বাভাবিক শরীরকে বাইরে থেকে আসা জীবাণু বা ভাইরাসের বিরুদ্ধে  প্রতিরোধক্ষমতা দেয় প্রধানত দুটি জিনিস— রক্তের প্লাজমায় পরিবাহিত অ্যান্টিবডি আর T-লিম্ফোসাইট নামক রক্তকোষ। প্রাণিমডেলের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেখা গেছে পেটের মাইক্রোবায়োটা পারে T-লিম্ফোসাইট পরিণত হবার পদ্ধতিকে সরাসরি প্রভাবিত করতে। অপাচিত কার্বোহাইড্রেট থেকে অন্ত্রের মধ্যে জীবাণুরা তৈরি করে অ্যাসিটিক অ্যাসিড, প্রোপিওনিক অ্যাসিড ও বিউটাইরিক অ্যাসিড। এরা কাজেও লাগে। প্রথম দুটি যেমন অন্ত্রে পুনরায় শোষিত হয়ে লিভারে যায় আর পুষ্টির কাজেই ব্যবহৃত হয় সেখানে বিউটাইরিক অ্যাসিড কাজে লাগে অন্ত্রের শোষণকারী কোষগুলোর বৃদ্ধিতেই। এদের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে যা হতে পারে তা হল T- লিম্ফোসাইটের হাইপাররেগুলেশন- অতিবৃদ্ধি। এর ফল যা হবার তাই হয়, আসল শত্রু না থাকলেও জীবাণু-প্রতিরোধকারী কোষগুলো শরীরটাকেই টার্গেট করে যুদ্ধে নেমে বসে। দেখা গেছে  অন্ত্রের স্বাভাবিক জীবাণু Bacteroides এর বদলে যদি Helicobacter বা Yersinia জাতের ব্যাকটেরিয়া বেড়ে যায় তাহলে থাইরয়েড গ্রন্থির সক্রিয়তা অতিমাত্রায় বাড়ে অবাঞ্ছিত অ্যান্টিবডি উৎপাদনের কারণে। এই রোগকে বলে গ্রীভসের রোগ (Greaves’s disease)।

প্রায় একইরকমের আর একটি রোগ হল হাশিমোতোর থাইরয়েডাইটিস (Hashimoto’s Thyroiditis)। এ রোগ হয় যখন থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত থাইরোগ্লোবিউলিনের বিরুদ্ধে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। হবার কথা নয়, কেন না  থাইরোগ্লোবিউলিন তো কোন জীবাণু নয়, বহিরাগতও নয়, তবু হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, হাশিমোতোর রোগে ভোগা বাচ্চাদের শরীরে দুধের উপাদানের বিরুদ্ধেও অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়। দুধের প্রোটিন হল কেসিন। খাদ্যে কেসিনের মাত্রা ১০ শতাংশ হলে ল্যাবরেটারিতে রোগমুক্ত ইঁদুরেরও এই রোগ হয়, সঙ্গে ডায়াবেটিস। দেখা যায় রোগাক্রান্ত বাচ্চা বা ইঁদুর- উভয় ক্ষেত্রেই  পেটের একটা জরুরী ব্যাকটেরিয়া Biofidobacterium অতিমাত্রায় কমে গেছে। তাহলে দেখা যাচ্ছে, দুধ খেলেই ভালো ছেলে হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই যদি পেটের ব্যাকটেরিয়ার প্রকৃতি বদলে যায়।

মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস: কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের রোগ মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস (MS) হয় যখন নিজের স্নায়ুকোষের প্রোটিনের বিরুদ্ধে  নিজের শরীর দরকার না থাকলেও প্রতিরোধ গড়ে তোলে। গবেষণা বলছে, এই রোগীদের পেটের জীবাণুতন্ত্র স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় বেশ অন্যরকম এবং ডায়েট বদলে তা সংশোধন করে দেওয়া যায়। যেমন Sutterella নামের একটা ব্যাকটেরিয়া এদের ক্ষেত্রে খুব উপকারি হতে পারে। Bacteroides fragilis নামের অন্ত্রের জীবাণুও অনেকটা স্বাভাবিকতা ফিরিয়ে দিতে পারে এই মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস রোগীদের ক্ষেত্রে। আসলে ওই বিশেষ ব্যাকটেরিয়া অন্ত্রে এক বিশেষ লিপিড তৈরি করে যার নাম L-654 এবং MS রোগীদের রক্তে ওই ভালো লিপিড তুলনামূলকভাবে কম। অর্থাৎ পেটের জীবাণুসাম্য যে কোন ভাবেই হোক, ব্যহত হয়েছে। আর একটা গুরুত্বপুর্ণ গবেষণা জানাচ্ছে, অবাঞ্ছিত জীবাণু Clostridium perfringens  যখন  স্বাভাবিক জীবাণুদের সরিয়ে পেটের দখল নেয় তখন মাল্টিপল স্ক্লেরোসিস হতে পারে। ইঁদুর মডেলে এই জীবাণুদের একটা বিষাক্ত প্রোটিন তৈরি করতেও দেখা যাচ্ছে যা স্নায়ুকোষের মায়েলিন পর্দাকে বিনষ্ট করে এই রোগ ডেকে আনতে পারে।

 

পেটের জীবাণু ও ত্বকের সমস্যা

ছুলি বা সোরিয়াসিস ত্বকের একটা মামুলি সমস্যা বলেই দেখে থাকি আমরা। কিন্তু এর সঙ্গে অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক আছে এবং তার থেকেও বড় কথা ছুলি থাকলে আর একটা অটোইমিউনিটিঘটিত রোগ ক্রন’স ডিজিজ (Crohn’s Disease) হবার সম্ভাবনা রীতিমত বেশি। ক্রন সাহেবের রোগে আমাদের পৌষ্টিক নালীর গায়ের আবরণী ফুলে যায়, ফলে পেটে ‘ক্রনিক’ ব্যাথা অনুভূত হয়। পেটের মধ্যে Akkermansia, Ruminococcus –এই সব ভালো ব্যাকটেরিয়া যখন কমে যায় তখন ক্রন সাহেবের রোগ তো হতেই পারে আর তারই প্রতিফলন চামড়ায়-ছুলি। সুতরাং ছুলির সাথে যদি পেটে ব্যাথার উপসর্গ থাকে তাহলে বুঝতে হবে রোগীর পেটের স্বাভাবিক জীবাণুতন্ত্র আপাতত বিপর্যস্ত। এছাড়া স্ক্লেরোডার্মা রোগ, যা হলে চামড়া ও চামড়ার তলার মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায় এবং ভিটিলিগো রোগ, যে রোগে চামড়ার জায়গায় জায়গায় বর্ণহীনতা চলে আসে- তাদের সঙ্গে পেটের জীবাণুর যোগ ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। বলাই বাহুল্য, আমাদের চামড়ায় বসবাসকারী স্বাভাবিক বন্ধু ব্যাকটেরিয়ার সাম্যও এসব ক্ষেত্রে সমান গুরুত্বের। ছুলিতে চামড়ায়  ইস্টের আধিক্য থাকলে বন্ধু Actinobacteria যে কমে আসে তা গবেষণায় প্রমাণিত।

 

পেট ও মনোরোগ

ফার্স্ট এপিসোড সাইকোসিস অর্থাৎ মানসিক অস্থিতাবস্থার লক্ষণ প্রথমবার দেখা যাচ্ছে এমন রোগীদের জন্য বিশেষভাবে দেখা হয়েছে খাদ্যাভাস ও পেটের ডিসবায়োসিস বা জীবাণুঅসাম্য। দেখা গেছে এদের অন্ত্রে Lactobacillus এবং Bifidobacterium –এই দুটো ব্যাকটেরিয়ার স্বাভাবিকের তুলনায় অবাঞ্ছিত আধিক্য আছে। এই পেট থেকে মাথার যে সরলরৈখিক চ্যানেল তাতে সংযোগকারীর ভুমিকা নেয়  ভেগাস নার্ভ। গবেষণাগারের ইঁদুরের ভেগাস নার্ভ কেটে দিলে তাদের ব্যবহার সম্পুর্ণ এলোমেলো হয়ে যায়। আবার খাবারে যথাযথ ব্যাকটেরিয়া যোগ করে তা কিছুটা সামালও দিতে পারা যায়। তাদের নিয়ে  অন্য একটি পরীক্ষায় অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দেখা গেছে তারা রীতিমতো ডিপ্রেসনে ভুগছে কেননা দেখা গেল ওদের পেটে বন্ধু ব্যাকটেরিয়া কমে গেছে এবং তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল অবাঞ্ছিত Actinobacteria আর Proteobacteria অনুপাতে অনেক বেড়ে গেছে। একই ঘটনা দেখা গেছে মানুষেও এবং মনের রোগীদের পেটে সুস্থ রোগীর পেট থেকে মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সফার করে উপসর্গ কমিয়ে দেবার নজিরও আছে। অর্গ্যান ট্রান্সফারের মত মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সফার  ভবিষ্যতে চিকিৎসার অঙ্গ হয়ে উঠলে অবাক হবেন না। পেটের রোগের সঙ্গে শুধু ডিপ্রেশন নয়, অটিজম এবং সিৎজোফ্রেনিয়ার মত মানসিক অবস্থারও সম্পর্ক আছে। এগুলো সবই হল কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের সমস্যাজনিত দশা। কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের ক্রিয়াকলাপ পেটের জীবাণুতন্ত্র দ্বারা যে ভীষণভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে তা কি আর বদহজমের রোগী হলে বুঝতে বাকি থাকে? ক্রনিক পেটের রোগের চিকিৎসা করেন এমন ডাক্তার বন্ধুকে জিগ্যেস করে জবাব পেলাম— তাদের ডিপ্রেশন নাকি সংক্রামক আর তা নাকি চিকিৎসককেও ডিপ্রেসড করে দিতে পারে। বোঝো! তাহলে পেটের জন্য বিয়ে ভেঙে যাওয়া কি আদৌ অস্বাভাবিক? মোটেই নয় তবে এর পিছনে বেচারির পেটের থেকে পেটের মধ্যে বাসা বাঁধা ব্যাকটেরিয়ারাই যে বেশি দোষী তা তো জজসাহেব বুঝবেন না! ৭ থেকে ১৬ বছর বয়সী বাচ্চাদের মধ্যে কথা বলা, যোগাযোগ স্থাপনে সমস্যা আছে যাদের, তাদের মাইক্রোবায়োটা ট্রান্সফার করে উল্লেখযোগ্য ফল মিলেছে। ৫ থেকে ৯ বছর বয়সী এমন বাচ্চাদের বাইরে থেকে (প্রোবায়োটিক) কেবল দু রকম ব্যাকটেরিয়া- BifidobacteriumLactobacillus  দিয়ে ব্যবহারগত সমস্যা অনেকটাই শুধরে দেওয়া গেছে।

 

জীবাণু ও মধুমেহ

খাবারের সঙ্গে মধুমেহ বা ডায়বেটিসের সম্পর্ক নিয়ে বলবার মত জ্ঞান যোগী থেকে ভোগী প্রত্যেকের আছে। যে কোন জায়গায় প্রসঙ্গটা তুলে দেখুন,দশ মিনিটে আপনার একশোটা খাদ্যতালিকা তৈরি হয়ে যাবে, কিন্তু গোলমালটা যে খাদ্যের না হয়ে পেটের জীবাণুদের কারণেও হতে পারে তা মনে রাখবেন এর পর থেকে। টিন এজারদের মধ্যে হওয়া  সবচেয়ে বেশি অটোইমিউনিটিঘটিত রোগ হল টাইপ I ডায়বেটিস ( TID) । নিজের শরীরের জীবাণুপ্রতিরোধী অস্ত্র T- লিম্ফোসাইটগুলো এই রোগে শর্করা হজম করার জন্য দরকারী প্রত্যঙ্গ প্যানক্রিয়াসের কোষগুলোকে আক্রমন করে বসে। ইনসুলিনকেই তারা শত্রু ভেবে বসে, ফলে শর্করা পাচনে সেটি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রক্তে অবাঞ্ছিতভাবে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায়। অন্তত ৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এর কারণ জেনেটিক অর্থাৎ বংশগতির ধারায় অবাঞ্ছিত জিনের প্রভাব। বাকি ৪০ শতাংশ ক্ষেত্রে TID হতে পারে পরিবেশগত কারণে অথবা শিশুর জন্মের ধরনে- স্বাভাবিক না সিজারিয়ান এবং ডায়েটের কারণে। পেটের জীবাণুতন্ত্রের প্রভাব এক্ষেত্রে বহু গবেষকের নজর কেড়েছে। এই রোগের পুর্বসুরী হিসেবে  অন্ত্রের মধ্যে জোনিউলিন (Zonulin) নামক একটা প্রোটিনের ক্ষরণ বাড়তে থাকে যা অন্ত্রের ভেদ্যতা বাড়িয়ে দেয়। ভেদ্যতা বাড়লে অন্ত্রে একটা প্রদাহ সৃষ্টি হয় যা আদতে নিজের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতায় নিজেই কাহিল হবার সামিল। দেখা গেছে TID উপসর্গে ভোগা বাচ্চাদের অন্ত্রে কিছু কিছু প্রতিযোগী ব্যাকটেরিয়া সংখ্যায় মাত্রাতিরিক্তভাবে বেড়ে গেছে। ইটালিতে টাইপ ওয়ান ডায়বেটিসে ভোগা বাচ্চাদের মধ্যে বড়সড় সমীক্ষা চালিয়ে বলা হয়েছে যে তিনটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়ার আধিক্য এই উপসর্গের সঙ্গে যুক্ত। এরা হল যথাক্রমে,  Dialister invisus, Globicatella sanguinis এবং Bifidobacterium longum। বলা হচ্ছে মলে এদের প্রাধান্য অবশ্যই একটা সূচক হিসাবে কাজ করতে পারে যা দেখে শিশুর বা কিশোরের এই রোগে আক্রান্ত হবার প্রবণতা সম্পর্কে একটা আন্দাজ পাওয়া যায়।

অন্ত্রের জীবাণুতন্ত্রের সঙ্গে সুস্থতার যে একটা সম্পর্ক আছে তা আমরা সবাই জানি। সে সুস্থতা যে কেবল গড়পড়তা পেটের রোগ নয় তাও না হয় বোঝা গেল কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে এটা হয় কেন? কেন একজনের অন্ত্রের স্বাভাবিক জীবাণুকে হটিয়ে দিয়ে বহিরাগতরা দখল নেয় পেটের? শুরুতেই বলেছি বাচ্চা ডেলিভারির ধরণ থেকে শুরু করে মায়ের পেটের মাইক্রোবায়োটা অনেক কিছুই সদ্যোজাতের মাইক্রোবায়োটা গরে তোলে। বিপত্তির শুরু সেখান থেকেই হতে পারে। বড় হবার পরে বাচ্চা যখন কঠিন খাবার খেতে শুরু করে তখন এই বিপত্তি কেটেও যেতে পারে। কিন্তু এই অ্যান্টিবায়োটিক যুগে তা নতুন বিপত্তির সূচনাও করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক যেমন রোগসৃষ্টিকারী জীবাণুকে মারে তেমনি ভালো ব্যাকটেরিয়াগুলোকেও মারতে পারে। এর থেকেই শুরু হতে পারে মাইক্রোবায়োটা পরিবর্তনের। আর খারাপ ও সুযোগসন্ধানী কিছু ব্যাকটেরিয়া যদি অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী বা রেসিস্ট্যান্ট হয়ে যায় তাহলে তো কোন কথাই নেই, তারা জমি খালি পেয়ে জমিয়ে বসবে। একই সমস্যা হতে পারে খাবার থেকে। পেটে যারা অভিবাসী তাদেরও তো খাদ্যে অখাদ্যে পছন্দ অপছন্দ আছে। সব খাবার সবার মাইক্রোবায়োটার পক্ষে যে অনুকূল নয় তাও তো আমরা দেখলাম এই নিবন্ধে। তবে প্রয়োজনে প্রোবায়োটিক ব্যবহারের সুফল তো আছেই। শুধু পেট নয়, মনের জন্যও তা উপকারী হতে পারে। সুতরাং খাওয়া দাওয়া ছাড়বেন না বরং মুড়ী মুড়কির মত অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া ছাড়ুন। যেদেশে অ্যান্টিবায়োটিক কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগে না সে দেশে আপনি ওষুধ কিনে পাগলও হতে পারেন সেটা মনে রাখবেন।


[1] Lederberg, J., M. A. (2001). ‘Ome sweet’ omics – a genealogical treasury of words. Scientist 15:8
[2] https://www.ncbi.nlm.nih.gov/pmc/articles/PMC4411945/#R9
[3] Rook, G., Backhed, F., Levin, B. R., McFall-Ngai, M. J., and McLean, A. R. (2017). Evolution, human-microbe interactions, and life history plasticity. Lancet 390, 521–530. doi: 10.1016/S0140-6736(17)30566-4

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4853 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

2 Comments

  1. খুব সহজ সুন্দর ভাবে মনোগ্রাহী আর প্রাণবন্ত লেখা। যে কোনো মানুষের কাছে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সমৃদ্ধ সাবলীল রচনা।লেখকের বাংলায় বিজ্ঞান বিষয়ক লেখার বিশেষ ভক্ত বনে গেলাম। আন্তরিক অভিনন্দন।

  2. একটি সমসাময়িক অতি গুরুত্বপূর্ণ দলিল যা আপনার লেখনী তে আরো উপভোগ্য হয়ে উঠেছে। খুব ভালো লাগলো স্যার। প্রণাম নেবেন।

আপনার মতামত...