কৃষক আন্দোলন: ‘অতি’ সংক্ষিপ্ত কিছু কথা

শুভার্থ মুখার্জ্জী

 


লেখক চিকিৎসাবিজ্ঞানের ছাত্র, ছাত্র-আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

সাতচল্লিশ সালের আগে তেভাগায় কৃষকবিদ্রোহের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল, সেই আন্দোলনের ধারা বাংলায় তথা ভারতবর্ষে নানান খাতে বয়ে চলেছে। কখনও স্তিমিত, কখনও সাময়িক জেগে উঠেছে, আবার কখনও সংস্কারবাদী রাজনৈতিক দলগুলোর কুক্ষিগত হয়ে রয়ে গেছে। জঙ্গি কৃষক আন্দোলনের ‘হেই সামালো ধান হো’, ফসলের তিনভাগের দুইভাগের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই এখন আর একইরকম চেহারায়, একই দাবিদাওয়া সম্বলিত আকারে খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। আন্দোলনের ইস্যু পাল্টেছে, কৃষিজমির চরিত্র ও বাজারের সঙ্গে সম্পর্কের ধরন পাল্টেছে। সেই অনুযায়ী পাল্টাতে থেকেছে চাষিদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ ও সীমাবদ্ধতাগুলিও। পরিস্থিতির সামগ্রিক মূল্যায়ন করতে গেলে বর্তমানের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক দশক পিছনে ফিরে দেখার প্রয়োজনও রয়েছে।

বিগত কয়েক বছরে বেশ কয়েকটি বড় কৃষক আন্দোলনের ছবি এসে হাজির হয়েছে। এর মূল কেন্দ্র উত্তর ভারতের পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো জায়গাগুলি। এখানকার মূল সংগঠক ও অংশগ্রহণকারী কৃষকরা প্রায় প্রত্যেকেই বড় জোতের মালিক। মহারাষ্ট্রে নাসিক থেকে মুম্বাই অব্দি কৃষক পদযাত্রা হয়েছিল। জনৈক চাষির ক্ষতবিক্ষত পায়ের ছবি দেশব্যপী সাড়া জাগিয়েছিল। এইসব আন্দো‌লনের মূল দাবীটিই ছিল ঋণ মকুব। চাষিদের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে, বা ঋণ নিয়ে চাষ করে ফলানো ফসল বিক্রি করে দাম পাওয়া যায়নি। ফলে দেনার দায়ে চাষিরা রাস্তায় নামতে বাধ্য হয়েছেন ঋণমকুবের দাবীতে। এই ঋণের সমস্তটাই প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ, অর্থাৎ ব্যাঙ্কঋণ, যা কেবলমাত্র দেশের সরকারই চাইলে মকুব করতে পারে। জনতার ট্যাক্সের টাকা থেকে কয়েক লক্ষ কোটি নিয়ে বৃহৎ শিল্পপতিদের ঋণ মকুব করা যায়, আর চাষি আত্মহত্যা করে দেনার দায়ে। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী ২০১৯ সালে সারা দেশে ৪২৪৮০ জন চাষি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। এহেন পরিস্থিতিতে দেশজোড়া আন্দোলনে নামা ছাড়া কোনও রাস্তাই খোলা ছিল না চাষিদের কাছে।

সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনটি ঘনীভূত হয়েছে মূলত তিনটি কৃষি বিল পাশ হওয়ার বিষয়কে কেন্দ্র করে। গত সেপ্টেম্বর মাসে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তিনটি কৃষি বিল পাশ করিয়েছে:

এক, কৃষিপণ্য ব্যবসাবাণিজ্য সংক্রান্ত বিল। এই বিলের বয়ান অনুযায়ী যেকোনও বড় ব্যবসায়ী সংস্থা, হোলসেলার, রিটেইলার চাষির কাছ থেকে সরাসরি ফসল কিনতে পারবে। এর জন্য কোনওরকম ‘ফী’, ‘সেস’ বা সেরকম কোনও লেভি দিতে হবে না।

এতদিন অব্দি কৃষকরা মান্ডিতে ফসল বিক্রি করতে পারতেন। সরকারি কিষাণ মান্ডিতে ফসলের একটি ‘ন্যূনতম সহায়ক মূল্য’ (MSP) দেওয়া হত, যাতে চাষির ফসল বিক্রি করে আর্থিক ক্ষতি হওয়ার ভয় ছিল না। সরকার নিজ দায়িত্বে মান্ডিতে এই ব্যবস্থা চালিয়ে কৃষকদের ফসলের ন্যায্য দাম পাওয়া সুনিশ্চিত করত। আর মান্ডির থেকে ফসল কিনে বাজারজাত করতে পারত কেবল লাইসেন্সপ্রাপ্ত ব্যবসায়ী, হোলসেলাররা। এর জন্যে কিছু দেয় দিতে হত সরকারকে। অর্থাৎ চাষিদের সুরক্ষার পাশাপাশি বাজারের উপরে নিয়ন্ত্রণে সরকার ভূমিকা রাখত।

এই আইন কাজের ক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের ‘ফ্রি হ্যান্ড’ দিয়েছে। মান্ডির মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর গুরুত্ব কমিয়ে চাষির ফসল বিক্রির দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে বাজারের হাতে। বাজারে ফসলের দামের ওঠানামায় ফসলের পর্যাপ্ত দাম পাওয়ার নিশ্চয়তা আর থাকল না। এই আইন করে ভবিষ্যতে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থাটিকেই তুলে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলেই মনে করছেন আন্দোলনরত চাষিরা।

দুই, মূল্যসুরক্ষা ও কৃষিপরিষেবা সংক্রান্ত চুক্তি (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) বিল: এই বিল অনুযায়ী চুক্তি চাষ আইনিভাবে ঘোষণা করা হল। অর্থাৎ কোনও বৃহৎ কর্পোরেট ফার্ম, এমনকি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলি পূর্বনির্ধারিত দামে চাষিকে দিয়ে চুক্তিভিত্তিক চাষ করাতে পারবে। আপাতভাবে ‘চুক্তি’ আছে শুনে বিষয়টি ভালো লাগলেও এরকম ঘটনা অদূর ইতিহাসে এমন বহু দেখানো যায় যেখানে পেপসিকোর মতো বড় কোম্পানি চুক্তির শর্ত ইচ্ছাকৃতভাবে লঙ্ঘন করেছে, বা চাষের খরচ অত্যন্ত বেশি হওয়ায় কৃষক নির্ধারিত দামেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছেন। কোর্টে বিচার চাইতে গেলে কোটিপতি কোম্পানি মালিকের কাছে দরিদ্র চাষার ‘বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে’ কেঁদেছে। সরকারি উদ্যোগে মান্ডিতে ফসল তুললে যেভাবে এমএসপি দেওয়া হয় চাষীকে ক্ষতি থেকে বাঁচাতে, এই ব্যবসায়ী কোটিপতি হাঙরদের সে প্রশ্ন তো করাই যায় না, মানবিকতার খাতিরে সাহায্যের আশ্বাসের চিন্তা করাও বৃথা।

তিন, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিল: এই বিলে দানাশস্য, তৈলবীজ, আলু, পেঁয়াজের মতো ফসলকে ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্যে’র তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলা হল। অর্থাৎ সোজা বাংলায়, এগুলো দেশের মানুষের জন্য এতটাও প্রয়োজনীয় নয়, যে এগুলোর ব্যবসা, মজুতের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে। বলা হল ভয়ঙ্কর বিপর্যস্ত পরিস্থিতি, যেখানে এইসব পণ্যের দাম পঞ্চাশ শতাংশ অব্দি না বাড়লে, এইসব পণ্যের দাম নির্ধারণ ও কালোবাজারির উপরে কোনওরকম সরকারি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না!

বাংলা ভোলেনি পঞ্চাশের মন্বন্তর, সাধারণ মানুষের দুবেলার খাবার কেনার পয়সা ছিল না, কিন্তু আড়তদারের গুদামে জমানো চাল উপচে পড়ছে, ফসল পচে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। সেই কালোবাজারির দিনগুলো নতুন চেহারায় মনে করিয়ে দিচ্ছে এই কালা আইন।

এই সামগ্রিক বিল (প্রথমে অর্ডিন্যান্স হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছিল) ওয়ার্ল্ড ট্রেড অর্গানাইজেশন (WTO)-এর নিদান মেনেই নামানো হয়েছে। কৃষি সংক্রান্ত সমঝোতায় স্পষ্ট বলা হয়েছিল কৃষিপণ্যের বাজারের উপর সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও ভর্তুকির কারণে জমিকে মুক্তবাজারের সঙ্গে জুড়ে ফেলার বাধা তৈরি হচ্ছে। তাই অবিলম্বে যাবতীয় ভর্তুকি (যেমন এমএসপি) কমিয়ে আনতে হবে, উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে পাঁচ শতাংশ, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সর্বোচ্চ দশ শতাংশ। সঙ্গে কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ যাতে আসে, তার জন্য ফসলের বাজারদামের উপরে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলে নিতে হবে। WTO-র টোটকা মেনে তৈরি হচ্ছে আমাদের দেশের এই আইন। যাঁরা চাষ করে ফসল ফলান, তাঁদের চেয়ে আইনের চোখে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল বিনিয়োগকারী কোম্পানিগুলোর স্বার্থ।

তাই এর প্রতিক্রিয়াও স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেখা গেছে কৃষকসমাজের মধ্যে। হিমাচল প্রদেশের উপমুখ্যমন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে বিক্ষোভ হয়েছে। এই উপমুখ্যমন্ত্রীই তিনবছর আগে মোটর ভেহিকেলস অ্যাক্টের বিরুদ্ধে চাষিদের বিক্ষোভের সমর্থনে ট্রাক্টরে চেপে পার্লামেন্ট ভবন গেছিলেন। সেই আইনে ট্রাক্টরকে কৃষিসম্পর্কিত বাহনের মর্যাদা থেকে স্রেফ ‘মোটর ভেহিকেল’ তকমা দেওয়া হয়েছিল। ফলে ট্রাক্টরের দাম বাড়া, রাস্তায় টোল ট্যাক্সে খরচের বোঝা চাষির ঘাড়ে চাপার পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছিল। এই নিয়ে চাষিরা প্রতিবাদ করেন। সাম্প্রতিক পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলন ক্রমশ বিস্তৃতি নিচ্ছে। বিক্ষোভকারী চাষিরা রেললাইন অবরোধ করেছেন। সতেরোটি টোল গেটে অবস্থান শুরু করেছেন, কোনও গাড়িকে যাতায়াতের জন্য টোল ট্যাক্স নিতে দেওয়া হবে না। আন্দোলনের চাপে রাজ্য সরকার বাধ্য হয়েছে পার্লামেন্টে বিশেষ অধিবেশনে এই তিনটি আইনের বিরোধিতামূলক প্রস্তাব আনতে।

এই আন্দোলনের চরিত্র ও বিস্তৃতি বুঝতে গেলে ইতিহাস কিছুটা খতিয়ে দেখার দরকার আছে। ভারতের কৃষিব্যবস্থায় দীর্ঘদিন সামন্তবাদ, জমিদার-জোতদারদের প্রভুত্ব ছিল। সাতচল্লিশে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ভারতের অর্থনীতিতে বহুল পরিবর্তন আনার চেষ্টা করা হয়। ‘নেহরুভিয়ান সোশালিজম’-এর নামে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র ও ব্যক্তিগত ব্যবসার সংমিশ্রণে এক মিশ্র অর্থনীতি চালু করার দিকে এগিয়ে যায় কংগ্রেস সরকার। ক্রমবর্ধমান কৃষকবিদ্রোহ ও জঙ্গি শ্রমিক আন্দোলনের চাপে এবং বিশ্ব-অর্থনীতির সমকালীন ব্যবস্থার প্রভাবে ‘জনকল্যাণকামী রাষ্ট্র’ ধারণার পত্তন ঘটে। সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চাশের দশকের শুরুতে জমিদারি প্রথার বিলোপ ও ব্যাপক ভূমিসংস্কারের কর্মসূচি নেওয়া হয়। আপাতভাবে দেখলে এই সিদ্ধান্ত চাষি-ক্ষেতমজুরদের স্বার্থে করা হয়েছিল বলেই মনে হবে। বাস্তবে এই সমস্ত প্রক্রিয়া কোনওদিনই আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে, শুধু আইন পাশ করিয়ে করা যায় না। তার জন্য কৃষক-ক্ষেতমজুরদের সংগঠিত করার প্রয়োজন হয়, দরকার হয় তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগের। আইনের বহু ফাঁক থেকে যায়, যার জোরে বিহার, উত্তরপ্রদেশ, ওডিশা ও পশ্চিমবঙ্গের বেশ কিছু জায়গায় জমিদারি বহাল তবিয়তেই থেকে গেছিল। ল্যান্ড সিলিং আইন (মাথাপিছু সর্বোচ্চ কত পরিমাণ জমি ভোগ করতে পারে) পরিবারভিত্তিক ছিল না, ফলে দেবত্র সম্পত্তি, পিতৃপুরুষের নামে সম্পত্তি, যে শিশু এখনও জন্মায়নি, তার নামে সম্পত্তি, এমনকি পোষা কুকুর-বিড়ালের নামেও জমি রাখা হত। জমিদারি প্রথার অবসানের জন্য যে উত্তাল কৃষক আন্দোলনের প্রয়োজন ছিল, তা দেশে তখনও গড়ে ওঠেনি।

নতুন ভারত সরকার কৃষিক্ষেত্রের উন্নতিতে চেষ্টা করেছিল। শোনা যায় নেহরু আফশোস করতেন, বৈদিক যুগে যে লাঙলের ব্যবহার শুরু হয়েছিল, তা এখনও ব্যবহার হচ্ছে। যে হাতিয়ারের থাকার কথা ছিল জাদুঘরে, এখনও সেটাই ব্যবহার করা হচ্ছে চাষের জন্য, ভারতের কৃষির প্রযুক্তিগত কোনও উন্নতিই হয়নি।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার বরাদ্দ অর্থের প্রায় ৩৫ শতাংশ ব্যয় হয়েছিল কৃষির উন্নতিসাধনে। জলসেচ, ট্রাক্টরের জন্য ঋণ ও অন্যান্য ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আশানুরূপ ফল মেলেনি। কৃষি-উৎপাদন যতটা আশা করা হয়েছিল, তার থেকে যথেষ্টই কম বেড়েছিল। কৃষকরা আগের মতোই সামন্ততান্ত্রিক শৃঙ্খলে বাঁধা, উৎপাদন বাড়ানোর কোনও আকাঙ্খাও তৈরি হয়নি স্বাভাবিকভাবেই।

১৯৬৬-৬৭ সালে ভারত সরকার কৃষিতে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগের রাস্তা খুলে দেওয়ার লক্ষ্যে হাঁটা শুরু করল। আমেরিকার ফোর্ড ও রকফেলার ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে এই উদ্যোগের নাম দেওয়া হল সবুজ বিপ্লব। অর্থাৎ এখন যেরকম WTO-র নিদান মেনে সরকার তিনটি কৃষি বিল পাশ করাল, ঠিক সেভাবেই তখনও আমেরিকার বড় কোম্পানিগুলোর পরামর্শে ভারতের কৃষিনীতি তৈরি হয়েছিল। কৃষিক্ষেত্রে আমদানি হতে থাকল HYV অর্থাৎ উচ্চফলনশীল জাতের ফসলের বীজ। এগুলোর উচ্চফলন অনেক দেশীয় ভ্যারাইটির ফসলকে কার্যত শিকেয় তুলে দেয়। বাজারের প্রতিযোগিতায় টিঁকে থাকতে চাষিরা এই বীজ ব্যবহারে বাধ্য হয়।

আবার এই বীজ থেকে তৈরি গাছকে টিঁকিয়ে রাখতে জৈবসার যথেষ্ট হয় না। দরকার হয় দামী রাসায়নিক সার। দরকার হয় বিষাক্ত কীটনাশক। প্রয়োজন হয় ট্রাক্টর, সিড ড্রিল, আরও নানাবিধ কৃষিযন্ত্রপাতির। ১৯৬৬-৭১ সালের চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বিদেশ থেকে এইসব সামগ্রী আমদানি করতে ২.৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করা হয়েছিল। চাষের স্বার্থে চাষিদের এসবও কিনতেও হয়েছে। ফলে উৎপাদন খরচ গেছে বেড়ে। যতদিন এভাবে অনিয়ন্ত্রিত প্রযুক্তির ব্যবহার সত্ত্বেও কৃষিফলন হু হু করে বাড়ছিল, ততদিন ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খরচ মিটিয়ে নিতে অসুবিধা হত না চাষিদের। লক্ষ্যণীয়, এই সবুজ বিপ্লব প্রজেক্টের পাখির চোখ ছিল পাঞ্জাব, হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ।

সমস্যা দেখা যায় মাত্র এক দশকের মধ্যেই। প্রাথমিক উচ্চফলনের জোয়ার থেমে আসে। ১৯৮০-র দশকের শুরুতেই পাঞ্জাবের ফলনবৃদ্ধি ২ শতাংশেরও নীচে নেমে যায়। একদিকে প্রযুক্তির পিছনে লাগাতার খরচ, অন্যদিকে উৎপাদনবৃদ্ধির হ্রাস, এই দুয়ে মিলে চাষিদের ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ার সঙ্কট আসতে থাকে। এমতাবস্থায় ১৯৯৪ সালে ভারত সরকার ‘গ্যাট চুক্তি’তে স্বাক্ষর করে দেশের কৃষিজমিকে কার্যত বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর মুক্তক্ষেত্রে পরিণত করতে উদ্যমী হয়েছিল। এবার আর শুধু সঙ্কর প্রজাতির বীজ নয়, ‘জিনপরিবর্তিত বীজ’ আমদানি করা হতে থাকে। এগুলো শরীরের পক্ষে, পরিবেশের পক্ষে কতদূর ক্ষতিকারক, তার চেয়ে বেশি নজর দেওয়া হয় যেনতেনপ্রকারেণ উৎপাদন বাড়ানোর জন্যে। এই জিএমও (Genetically Modified Organism) ফসলগুলির বিশেষত্বই হল, এগুলো মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতায় ফলে না। প্রচুর পরিমাণ রাসায়নিক সার দিতে হয়। আবার এদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা খুবই কম, ফলে প্রতিটি রোগের জন্য আলাদা আলাদা কীটনাশক লাগে। প্রতিটি কীটনাশক বছরে কয়েকবার ব্যবহার করার পর কীটনাশকগুলি রোগপোকার উপরে আর কাজ করে না। ফলে নতুন, আরও দামী কীটনাশকের দরকার হয়। একইভাবে সারও পাল্টাতে থাকে। দরকার হয় প্রচুর জল। ডিপ বোরিং, পাম্পসেট কিনতে হয়। উৎপন্ন ফসল বেশিদিন ভালো থাকে না। ফলে দরকার হয় কোল্ড স্টোরেজ।

এভাবে উৎপাদন সাময়িকভাবে বাড়লেও চাষির খরচ বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ১৯৯৬ থেকে ২০০৩-৪-এর মধ্যে সারা দেশে চাষের কাজে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের ব্যবহার, কৃষিযন্ত্রপাতির কেনাকাটা, জল ও বিদ্যুতের খরচ ৪০-১০০ গুণ অব্দি বেড়ে যায়। ফলে যতদিন ফসল উৎপাদন শুরুতে বছর বছর হু হু করে বাড়ছিল, তখন সামাল দেওয়া যাচ্ছিল। যখনই সেই বৃদ্ধি স্তিমিত হয়ে আসে, ঋণের সাঁড়াশি চাষির গলা টিপে ধরে।

আরও পরিবর্তন আসতে থাকে, চাষের কাজে প্রবর্তন করা হতে থাকে ‘টার্মিনেটর সিড’। এই বীজ একবার ফসল ওঠানোর পর বন্ধ্যা হয়ে যায়, কোনও বীজ পাওয়া যায় না নতুন করে। পরের বছর চাষিকে আবার নতুন বীজ কিনতে হবে।

তবে বেশিরভাগ চাষিই পুরনো বীজ ব্যবহারের দিকেই ঝুঁকেছিলেন। ২০০৪ সালে আনা হল ‘সিড অ্যাক্ট’। এই আইন বলে চাষির বাড়িতে পুরনো ফসলের বীজ জমা করে রাখা ‘বেআইনি’। পরের বছর চাষের জন্য বিদেশ থেকে আমদানি করা নতুন বীজই কিনতে হবে। অর্থাৎ বীজ বোনা, চাষ, ফসল তোলা, বাজারে নিয়ে যাওয়া পুরো প্রক্রিয়াটিকেই ব্যবসায়ীদের স্বার্থে আইন প্রণয়ন করে কেন্দ্রীভূত উপায়ে বদলে ফেলা হতে থাকে।

আর এই পাহাড়প্রমাণ খরচের জাঁতাকলে পেষাই হতে থাকেন দেশের চাষিরা। এমনিতেই আমাদের দেশের ৮০ শতাংশ জমির চাষিরাই ছোট-মাঝারি জমির মালিক। প্রায় ৬৬ শতাংশ জমির আকার এরকমই। এই কৃষকদের গড়ে ৪৫ শতাংশই ভয়ানকভাবে ঋণগ্রস্ত।

২০০৪ সালে অর্জুন সেনগুপ্তর এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যাঁদের জমির পরিমাণ দুই হেক্টর বা তার কম, তাঁদের চাষ করে আয়ের তুলনায় ব্যয় অনেক বেশি, সঞ্চয় শূন্য। যাঁদের জমি ২-৪ হেক্টর, তাঁরা সামান্য কিছু সঞ্চয়ের মুখ দেখেন। যাঁদের জমির পরিমাণ ৪-১০ হেক্টর, কেবল তাঁরাই চাষ করে লাভের মুখ দেখেন। স্পষ্টতই দেশের আশি শতাংশ কৃষক যে ধরনের জমির মালিক, তাঁরা ঋণের জালে জড়িয়ে পড়েছেন।

কৃষি এতটাই অলাভজনক হয়ে পড়েছে, যে এমনকি ধনী চাষিরাও চাষের কাজে মূলধন বিনিয়োগ করতে রাজি হচ্ছেন না। বরং তাঁরা কোল্ড স্টোরেজ, পাম্পসেটের ব্যবসায় বেশি আগ্রহী। জমিতে বিনিয়োগ না হওয়ায় জমির কেন্দ্রীভবনও হয়নি, ছোট-মাঝারি জোতই প্রধান রয়ে গেছে।

যেখানে ধনী চাষিদের এই অবস্থা, ছোট মাঝারিদের করুণ অবস্থাটা সহজেই অনুমান করা যায়। বেশিরভাগই জমি বেচে শহরে বা গ্রামেই অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমে যোগ দিচ্ছেন। জমির সঙ্গে বন্ধন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।

এই ইতিহাসের প্রেক্ষাপটেই দেখতে হবে এখনকার কৃষক আন্দোলনগুলোকে। ক্ষুদ্রচাষিরা ইতিমধ্যেই চাষের কাজ থেকে হয় সরে পড়েছেন, নয়তো প্রান্তিক। তাই মুখ্যত পাঞ্জাব-হরিয়ানার মতো জায়গাগুলোতে, যেখানে সবুজ বিপ্লবের চারা জন্মেছিল, চাষের কাজে যাঁরা টিঁকে আছেন তাঁরা মূলত ধনী কৃষক, বড় জোতের মালিক। তা সত্ত্বেও তাঁদেরকে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে। সার-বীজ-কীটনাশক কোম্পানিগুলোর স্বার্থে জনবিরোধী সবুজ বিপ্লবের বিষময় ফলে চাষে লাভ করে ওঠা দুঃসাধ্য হয়ে উঠছে। যে দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ কৃষিকাজের উপরে নির্ভরশীল, সেই কৃষি দেশের জিডিপিতে অবদান রাখতে পারে মাত্র ১৫ শতাংশ! এই সঙ্কট বড় জমির চাষিদেরও ছাড়েনি। আইন করে মান্ডিব্যবস্থাকে দুর্বল ও এমএসপি তুলে দেবার চেষ্টা হওয়ামাত্র ক্ষতির ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে উঠেছেন তাঁরা। বাজারে চাষের ফসলের দামের মারাত্মক ওঠাপড়ার চাপে তাঁরাও টিঁকতে পারবেন না সরকারি সাহায্য, এপিএমসিগুলো না থাকলে। চুক্তিচাষ শুধু গরীব চাষি নয়, তাঁদেরও কলজে ছিঁড়ে নেবে।

ফলে তাঁরা নেমে এসেছেন রাস্তায়। ঐতিহাসিক ফলশ্রুতিতেই আন্দোলন প্রথমে দানা বেঁধেছে পাঞ্জাব-হরিয়ানায়। প্রাথমিকভাবে অল ইন্ডিয়া কিষাণ সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটির নেতৃত্বে আন্দোলন চলছে। মুখ্যত সংস্কারপন্থী দলগুলোই এর কাণ্ডারি। বিপ্লবী শক্তিগুলি এখনও ততটাও শক্তিশালী হয়ে ওঠেনি যাতে এই আন্দোলনকে ভবিষ্যতের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায়। দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতিও সেভাবে পেকে ওঠেনি এখনও।

তবু ভরসা জাগায়, দেশের এই আকালে চাষিরা জেগে উঠছেন। গোটা দেশ জুড়ে হিন্দুত্বের ভ্রান্ত রাজনীতি যখন ঢেউ তুলছে,পাঞ্জাবের চাষিরা লড়ে যাচ্ছেন অর্থনৈতিক দাবী আদায়ের লক্ষ্যে, আঙুল তুলেছেন তথাকথিত অনুষ্ঠানিক গণতন্ত্রের সংসদে পাশ হওয়া আইনের দিকে। প্রকৃত অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক মুক্তি এই সংগ্রামে না এলেও প্রতিস্পর্ধী এই লড়াইকে দেশবাসীর তরফে কুর্নিশ জানাই। আগামীদিনে এই লড়াই আরও বিকশিত হোক, সঠিক বিপ্লবী পন্থায় পরিচালিত হোক। খেটেখাওয়া সংগঠিত মজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ক্রান্তির দিশা দেখুক ভারতবর্ষ।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4593 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

আপনার মতামত...