![souranshu](https://i0.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2020/10/souranshu.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সৌরাংশু
নাম নেই
কফি খাচ্ছিলেন শিলাদিত্য, বান্দ্রা ব্যান্ডস্ট্যান্ডে বসে। এমন সময়ই মেয়েটা এসে জিজ্ঞাসা করল, “আপনি শিলাদিত্য না? এ যাবত কটা মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক হয়েছে আপনার?” পরিষ্কার বাংলা ভাষা। জড়তা নেই। ঋজু দৃপ্ত চলার ভঙ্গি। শিলাদিত্যর মুখ থেকে শুধু একটা কথাই বেরোল, “অ্যাঁ?”
মেয়েটি সপ্রতিভভাবে প্রশ্নটি আবার করল। “না মানে… সেটা বলতে গেলে হয়তো… কিন্তু আপনাকে বলব কেন?” “হয়নি!” নিশ্চিত শব্দে তোতলামি বন্ধ হয়ে গেল শিলাদিত্যর।
“আমাকে বলার দরকার নেই, তবে ছাইপাঁশ লেখার আগে একটু ভেবে দেখবেন যে যা লিখছেন তার কতটা খাঁটি আর কতটা গ্যাঁজা। ধরা পড়ে যাচ্ছেন তো! নাম ধাম হয়েছে, এসব করবেন না!
“যাই হোক, কফিটা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে, খেয়ে নিন। আমি চললাম।”
কিছু বোঝার আগেই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল মেয়েটি। সূর্য ডুবতে ডুবতে লাল হয়ে ফেটে পড়ল সমুদ্রে।
মাস পাঁচেক পর, রাজারহাট হাইরাইজের দোতলায় মাসির বাড়ির বারন্দা থেকে মেয়েটাকে আবার দেখল শিলাদিত্য। আজকে শাড়ি, কিন্তু ওই হাঁটাটা আজও ভুলতে পারেনি শিলাদিত্য। “এই যে শুনুন! শুনছেন? আপনি! হ্যাঁ আপনাকেই বলছি! কী নাম আপনার?”
মেয়েটি উপর দিকে তাকাল। তারপর হনহন করে গিয়ে দাঁড়াল সামনের ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটার কাছে। চুল আঁচড়ে একটা টিশার্ট চাপিয়ে নিচে নেমে দেখল মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে। কাছে যেতেই জিজ্ঞাসা করল, “নতুন লিখলেন কিছু? নাকি এখনও জঞ্জাল ঘেঁটেই চলেছেন?” “নতুন বলতে একটা পুজোসংখ্যার উপন্যাসে হাত দিয়েছি।”
“ওহ! ফরমায়েসি? আচ্ছা চলি তাহলে, আবার দেখা হবে! চিন্তা করবেন না, ভালো করে লিখুন! আমরা পাঠকরা তো রইলামই! ট্যাক্সি!” শেষের শব্দটা হাত তুলে আগত সাদা নীল অ্যাম্বাসাডরের উদ্দেশ্যে। “কিন্তু আপনি কে? নামটা? কী করেন? আমার পিছনে লেগেছেন কেন? আমি কী করেছি?” “সব প্রশ্নের উত্তর থাকতে নেই শিলাদিত্যবাবু! চললাম!” টিপটিপ করে বৃষ্টিটা এবারে শুরু হয়ে গেল। ট্যাক্সিটাকে ধাওয়া করতে গিয়ে শিলাদিত্য খেয়াল করল, শর্টসের পকেটে পার্স নেই।
অনেকখানি সময় কেটে গেছে। দশ মিনিট? তিন ঘণ্টা? তেরো দিন? ছয় মাস? নাকি পাঁচ বছর? নুঙ্গমবক্কমের মেছো কলোনির একটা দোআঁশলা ঘরে বসে বসে শিলাদিত্য সদ্য ফোটা ছবিগুলোকে সাজিয়ে সাজিয়ে রাখছিল। ঘরের এক কোণে ডাঁই করে রাখা প্রচুর জার্নাল। ল্যাপটপের নীল আলোটা ভোরবেলার কমলার সঙ্গে অদ্ভুত মিশে গিয়ে রামধনু তৈরি করেছে ঘরময়। এমন সময় দরজার উপর ঠকঠকঠক শব্দ বেজে উঠল। অন্যরকম, সম্পূর্ণ অন্যরকম একটা শব্দ। যা শিলাদিত্যকে সহজভাবে জাগিয়ে দিল। ঋজু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মনে মনে বলল, “লেখাটা এখনও তৈরি হয়নি যে! এখনও ভরসা হল না?” দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে ভেবে নিলেন, এবার নাম না জেনে ছাড়া যাবে না! নাম জেনেও না! ভোরের সূর্য আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ধীরে ধীরে জায়গা নিতে শুরু করেছে তখন।
পরকীয়া
–বাবা, পরকীয়া কাকে বলে?
–মারব টেনে এক থাপ্পড়— যত্ত পাকামো!
–যাচ্চলে! আমি তো কী বললাম? মা আমাকে তো প্রায়ই বলে, যে আমি নাকি এত পেকে গেছি যে ইহকাল পরকাল সব ঝরঝরে হয়ে গেছে। আমি ভাবলাম সেইরকম কিছু! কিন্তু মার খাওয়ার মত কী করলাম বাবা?
–যা তো বাজে বকিস না!
–আচ্ছা শোনো না! বলছি আজকে স্কুলে কী হয়েছে জানো?
–কী?
–রক্তিম আজকেও মিসকে নিয়ে বাজে কথা বলছিল! আমার রাগ হল কিন্তু… আরে তুমি শুনছ না তো!
–শুনছি শুনছি। বল যা বলার তাড়াতাড়ি বল!
–তাড়াতাড়ি কী করে বলব? আমি তো বলতেই পারলাম না! একবার ভেবেছিলাম মিসকে বলে দিই।
–কোন মিস?
–আরে আমাদের ক্লাস টিচার নির্মলা মিস! আরে উনি চুলটাকে একটু উঁচু করে বাঁধেন বলে… বাবা! শোনো না!
–পিথু! আমার রিপোর্টটা আজকেই কিন্তু শেষ করতে হবে!
–তুমি না বাবা! বাড়িতে এসেও খালি কাজ কাজ! তোমার একটুও সময় নেই! পরকীয়া মানেটাও বললে না! বলো না মানেটা কী?
–পিথু পাকামো মেরো না! মেলটা পাঠাতে দাও! যাও এখান থেকে!
–বাবা মা খেতে ডাকছিল!
–একটু পরে যাব! মাকে বল মেলগুলো করে নিয়ে যাব!
–বাবা! মাও আমায় মানে বলল না!
–কিসের?
–ওই যে পরকীয়া!
–বেশ করেছে! এখন আমাকে আর বিরক্ত করবে না! যাও খেয়ে নাও! পরে কথা বলবে!
–(মৃদু স্বরে) পরে তো কখনওই হবে না বাবা! তোমার সময়ই হবে না!
–বাবা! শুতে যাচ্ছি!
–হুঁ
–গুড নাইট বাবা!
–হুঁ রে বাবা!
–মানেটা বললে না তো বাবা!
–উফ যা তো! ডেঁপো ছেলে! স্কুল আছে কাল!
–তোমরা কেউ আসলে মানেটা জানো না! তাই বলতে পারছ না!
–জানি না যা! এবার আর একটা কথা বললে…
দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছেলেটা চলে গেল। মা খাবার টেবিলে বসে অপেক্ষায়! বাবার মুখের নীল আলো কিন্তু নেভার নামই নেই! দেওয়ালের অজন্তা ঘড়িটা তখনও ছন্দে ছন্দে দুলে দুলে বলে চলেছে, “পরকীয়া… পরকীয়া… পরকীয়া… পরকীয়া…”
পেলাস্টিক
গত তিন দিন ধরে মাছ কেন প্রায় কিছুই পেটে পড়েনি ফুলমণির। তিপ্পানোর বি বাড়ি থেকে যা রোজকার উচ্ছিষ্ট পেত তাতে পেট না ভরলেও মনকে চুপ করিয়ে রাখা যেত। কিন্তু তিন দিন ধরে ওরা নেই। সম্ভবত বিয়েবাড়ি গেছে। বাজারের যা আগুন দাম, গেরস্থের কলাটা মুলোটা যে পড়ে থাকবে তার জো নেই। অগত্যা ডাস্টবিন!
কিন্তু যেগুলো পড়ে আছে সেগুলো সব খাবার অযোগ্য! সত্যিই পেলাস্টিকের দৌরাত্ম্যে বাদবাকি কিছুই আর ডাস্টবিন সাজায় না। হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হতেই ঘোলাটে চোখ তুলে তাকাল ফুলমণি আওয়াজের দিকে।
গলি পেরিয়েই বড় রাস্তাটার মোড়ে কী যেন একটা পেলাস্টিকের মতো ঝুপ করে পড়ল। চোখ সরু করে দেখেই কেমন যেন একটা মনে হতে লাগল, পেলাস্টিকটা নড়ছে! আলো! আলো! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! মাছ না? হ্যাঁ মাছই তো! এখনও নড়ছে! ছুট লাগাল ফুলমণি, ওই ধ্বসে যাওয়া পাঁজর বের করা শরীর নিয়েই ছুট লাগাল ফুলমণি।
আহা মাগুর বা সিঙ্গি হবে! গদাইয়ের মা কালোজিরে কাঁচালঙ্কা দিয়ে একটা মাগুরের ঝোল বানাত! অমিত্তোর থেকে কম নয় সেটা! গদাইয়ের মা গেছে তা প্রায় ছ মাস হল! তার সঙ্গে মাগুরের ঝোলও চলে গেছে ফুলমণির।
আর চার কদম! রাস্তাটা এসেই গেল। চিলে ছোঁ মেরে নিলে, বা কুকুরে মুখে তুললে আর দেখতে হবে না! রাস্তাঘাটে ভিখিরির সংখ্যাও তো কম নয়! হেই ভগমান! আর পাঁচ সাত সেকেণ্ড যেন কেউ দেখতে না পায়! উত্তেজনায় হাঁপাতে হাঁপাতে পেলাস্টিকটাকেই পাখির চোখ করে বড় রাস্তায় ঝাঁপাল ফুলমণি!
একটা মোটরবাইক ডানদিক দিয়ে আর একটা ভ্যানরিক্সা বাঁদিক দিয়ে তেড়ে আসছিল। দেখতেও পায়নি ফুলমণি, শুনতেও পায়নি! কিন্তু কে কাকে ছাড়বে এই করতে গিয়ে দুজনেই জট পাকিয়ে গিয়ে তেড়ে গালাগাল লাগাল! ভ্যানের চাকাটা ডান হাঁটুর কাছটায় ঠুকল! লাগল বোধহয়, অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় পাস কাটিয়ে পড়ন্ত মোটবাইকের হ্যাণ্ডেলের উপর দিয়ে লাফ দিয়ে গিয়ে পৌঁছল প্যাকেটটার কাছে। খুব বাঁচান বেঁচে গেছে বোধহয়! কিন্তু সেসব দেখার সময় নেই তার। পেলাস্টিকটা তখনও খলবল করছে। পিছনে বাইকটা আর ভ্যানওলাটার গলা আর পাঁচটা জিজ্ঞাসু নজরের আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসে সবুজ রঙের পেলাস্টিকটাই সারসত্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য ফুলমণি পেলাস্টিকটা তুলতেই বুঝতে পারল মাছ নয় ইঁদুর। ইঁদুর? এ পাড়ায় ইঁদুর আছে নাকি? জানত না তো আগে! কিন্তু তাই সই। এ মাগ্যির বাজারে ইঁদুরই রাজভোগ। পেলাস্টিকটা তুলে ঘুরতেই সম্বিত ফিরে পেল! কোমরের কাছটায় অসম্ভব ব্যথা। অত ভ্রূক্ষেপ করলে কি চলে? খুব খুব জোর বাঁচান বেঁচেছে বটে! কিন্তু তাতে কী? ইঁদুরটাকে এক ঝটকায় মেরে পেলাস্টিকটা তুলে নিয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে গলির দিকে হাঁটা লাগাল ফুলমণি! বেড়ালদের যেন কটা জান থাকে?