দেড়শো বছরের আলোয় বলেন্দ্রনাথ ঠাকুর: কবি ও প্রাবন্ধিক

লীনা বসু রায়চৌধুরী

 


লেখক প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

বলেন্দ্রনাথ ঠাকুরের (১৮৭০-১৮৯৯) বাংলা সাহিত্যে আবির্ভাব বিদ্যুৎ ঝলকের মতো ক্ষণকালের হলেও সাহিত্যে তার দীপ্তি সুদূরপ্রসারী, আজ দেড়শো বছর পরেও তাঁর সাহিত্যিক ভাবনা প্রাসঙ্গিক ও চিত্তাকর্ষক। সাহিত্যপ্রতিভায় সফলতার নিঃসন্দিগ্ধ আশ্বাস নিয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে বীরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও প্রফুল্লময়ী দেবী ঠাকুরের ঘর আলো করে তাঁর আগমন। পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথের হাতে গড়া সাহিত্য-শিষ্য বলেন্দ্রনাথ ছিলেন এক শক্তি-সম্ভাবিত লেখক। তাঁর পরিমিত রচনাগুলি তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর সাহিত্যিক ক্ষমতার পূর্ণতর দীপ্তির আভাস দান করে। তিনি এমন কিছু গদ্যসাহিত্য রচনা করেছেন যার মূল্য চিরকালীন।

বলেন্দ্রনাথ অতি অল্প বয়সেই সাহিত্য রচনায় ব্রতী হন। রবীন্দ্রনাথের ‘বালক’ পত্রিকায় তাঁর সাহিত্য রচনার হাতেখড়ি এবং রবীন্দ্রনাথের ‘সাধনা’ পত্রিকায় তাঁর পূর্ণ বিকাশ। বলেন্দ্রনাথের ওপর রবিঠাকুরের ভাব, ভাবনা ও রচনারীতির প্রভাব গভীর, তবে তাঁর স্বকীয়তাও অনস্বীকার্য।

একটি বিশেষ সাহিত্যিক প্রতিভা নিয়ে বলেন্দ্রনাথ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। যার ফলে দীর্ঘজীবী না হয়েও তিনি অনায়াসে পরিণতির কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করেছেন। তাঁর সাহিত্যজীবন আলোচনাকালে তাঁর মনের দ্রুত পরিণতি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁর স্বল্প প্রসারিত জীবনের এই সহজ ও স্বাভাবিক প্রৌঢ়ত্ব প্রসঙ্গে রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী যথাযথই বলেছেন— “বয়সে বালকত্ব অতিক্রম করিবার পূর্বেই তিনি প্রৌঢ়ের অন্তর্দৃষ্টি-ক্ষমতা লাভ করিয়াছিলেন।”

বলেন্দ্রনাথের রচনায় প্রভূত শ্রেণিগত বৈচিত্র্য বর্তমান, আর তাঁর বিচিত্র শ্রেণির রচনাসমূহ একটা মূল সুরের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। সৌন্দর্যরস পিপাসাই তাঁর সমগ্র সাহিত্যিক জীবনের মূল সুর। গদ্য এবং পদ্য উভয়ের মধ্যেই তিনি সৌন্দর্যের সন্ধান পেতে সচেষ্ট হয়েছেন। রামেন্দ্রসুন্দর এ প্রসঙ্গে বলেছেন— “সৌন্দর্য আবিষ্কারই তাঁহার প্রধান কার্য ছিল। যে সৌন্দর্য অন্যের চোখে প্রকাশ পাইত না, তিনি তাহা বাহির করিয়া আনিয়া দেখাইয়া দিতেন।” সৌন্দর্য দর্শনের অসাধারণ চোখ ও মনের অধিকারী ছিলেন বলেন্দ্রনাথ। বলেন্দ্রনাথের সৌন্দর্যদর্শন প্রসঙ্গে প্রমথনাথ বিশীর মন্তব্য উল্লেখযোগ্য: “কবির মনের কাছে জগত এবং সাহিত্য শিল্প ও চিত্রাদি অর্থাৎ প্রকৃতির সৃষ্টি ও মানুষের সৃষ্টি একই রূপ, একই সৌন্দর্যময় সত্তা উদ্ঘাটিত করিয়াছে। তিনি সৌন্দর্যভোগ করিয়াছেন এবং অপরের চোখে আঙুল দিয়া, কখনও বা তাহার উত্তরীয় টানিয়া তাহার মনোযোগ আকর্ষণ করিয়া তাহাকে সেই সৌন্দর্য দেখাইয়া দিয়াছেন। তাঁহার কবিমন অখণ্ডকে খণ্ডিত করিতে, সৌন্দর্য নিংড়াইয়া তত্ত্ব বাহির করিতে অত্যন্ত পীড়া বোধ করে। সৌন্দর্য জগত ব্যাপারের পরিণাম ও পরানিয়ম, ইহাই যেন তাঁহার ধারণা। সৌন্দর্যের বিশ্বরূপ দর্শনই মানবজীবনের মহৎ কর্তব্য, ইহাই যেন তিনি বলিতে চাহেন। সৌন্দর্য দর্শনের ও সৌন্দর্যভোগের এমন কীটসীয় দৃষ্টি ও মন লইয়া আর কোনও বাঙালি লেখক জন্মগ্রহণ করেন নাই।” বলেন্দ্রনাথ ঠিক কীটসের মতোই বলতে পারতেন— “I have loved the principle of beauty in all things.” এই সৌন্দর্যরসপ্রিয়তা তাঁর সমগ্র রচনার ওপর একটা আধ্যাত্মিক আবেশের সৃষ্টি করেছে।

বলেন্দ্রনাথ গদ্য ও পদ্য উভয়ই রচনা করেছেন। পদ্যের সংখ্যা অল্প, গদ্যের সংখ্যা অধিক ও বৈচিত্র্যময়। বলেন্দ্রনাথ রচিত কবিতাসমূহে তাঁর প্রতিভার যথার্থ অভিব্যক্তি না ঘটলেও সেগুলির সাহিত্যিক মূল্য অনস্বীকার্য। ‘মাধবিকা’ ও ‘শ্রাবণী’ এই দুখানি কবিতা পুস্তিকা তিনি প্রকাশ করেন, এছাড়াও তিনি কয়েকটি কবিতা লেখেন। কবিতাগুলির অধিকাংশই চতুর্দশপদী এবং প্রেমের কবিতা। সুন্দরী প্রিয়তমার প্রতি আকৃষ্ট কবির হৃদয়-বন্দনার সুর অনুরণিত হয়েছে এই কবিতাগুলিতে। ‘মাধবিকা’ বসন্তের কবিতা ও ‘শ্রাবণী’ বর্ষার কবিতা। ভারতীয় সাহিত্যে বসন্ত নারীসৌন্দর্যের এবং বর্ষা নারীপ্রেমের প্রতীক। এই কাব্য-যুগলে আমরা অত্যন্ত সংবেদনশীল ও অনুভূতিপ্রবণ কবি বলেন্দ্রনাথকে খুঁজে পাই। ‘মাধবিকা’-র শেষ কবিতাটি যেন কবির অকালে সাহিত্যলীলা শেষেরই ইঙ্গিত দেয়।

হে মোর সঙ্গীত তোর পতঙ্গের প্রাণ
এক বসন্তেই শুধু হল অবসান।
একবেলা নৃত্য শুধু একবেলা গান,
ছড়ায়ে রঙিন পাখা কুসুমে শয়ান।
একটুকু স্বর্ণরেণু, পুষ্প পরিমল,
একটুকু রবিকর, শিশিরের জল,
কিছুক্ষণ খেলাধূলা মুগ্ধ অভিনয়,
তারপর দিনশেষ আর বেশি নয়।

তাঁর কিছু কবিতায় সংস্কৃত অদ্ভুত-শ্লোকের আভাস মেলে। তবে বলেন্দ্রনাথের কবিতায় পরিণতির যথেষ্ট অভাব লক্ষিত হয়। হয়তো জগতের সম্পূর্ণ রূপটি তখনও তাঁর মনে ধরা পড়েনি, কিন্তু তাঁর গদ্য সম্পর্কে আমরা এমন কথা বলতে পারি না সেগুলির উৎকর্ষতার কারণে। প্রিয়নাথ সেন যথাযথই বলেছেন: “গদ্যে এবং পদ্যে উভয়েই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু গদ্যে তিনি যেরূপ উৎকর্ষ সাধন করিয়াছিলেন পদ্যে আজও তাহা পারেন নাই। আমার বক্তব্য এই যে গদ্যের সকল পর্দাই তাঁহার ক্ষমতার অধীন ছিল— গদ্যের এমন কোনও রহস্য বা ভঙ্গী নাই যাহা তাঁহার লেখনীর আয়ত্তে ছিল না। কিন্তু তাঁহার পদ্য সম্বন্ধে আমরা ঠিক একথা বলিতে পারি না।” রচনা পরিণতির দিক দিয়ে বিচার করলে এই মন্তব্যটি যথোপযুক্ত হলেও আমাদের স্মরণ করতে হবে যে বলেন্দ্রনাথের পদ্য ও গদ্যের স্বরূপধর্মের মধ্যে একটা আত্মিক যোগ বিদ্যমান।

একথা অনস্বীকার্য যে বলেন্দ্রনাথের সাহিত্যিক প্রতিভার পূর্ণতর স্ফুরণ ঘটেছে তাঁর গদ্যে। বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের জগতে তিনি একজন নির্জন প্রান্তের নির্জন অধিবাসী। তাঁর রচনাসমূহ সরস কণ্ঠের দীপ্ত প্রকাশে বাঙ্ময়। রূপমুগ্ধ শিল্পীমনের লাবণ্যবিলাসে স্নিগ্ধ মনোহর, প্রতিটি প্রবন্ধের অন্তরালে রয়েছে রূপতন্ময় লিরিকের সুকোমল সুরমূর্ছনা যা সুললিত ভাষায় গুঞ্জিত হয়েছে। বলেন্দ্রনাথের প্রতিটি প্রবন্ধ মৌলিক ও সৃজনশীল, আপনার ভাবনার দ্যুতিতে তা হীরকোজ্জ্বল। সৃষ্টির আবেগে রচিত হওয়ার কারণে তাঁর প্রবন্ধগুলি মর্মস্পর্শী, অথচ তিনি ভাবের আতিশয্যে ভেসে যাননি, নিজের ওপর তাঁর ছিল সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ। আজন্ম রচনা-রসিক বলেন্দ্রনাথের রচনাগুলি চিন্তা-ভাবনা ও ভাবাবেগ প্রকাশের অভিনবত্বে কবিতার মতো হৃদয়গ্রাহী। তাঁর রচনায় কল্পনার প্রকাশ ঘটেছে, কিন্তু কল্পনা কখনও বাস্তবের তটরেখা অতিক্রম করেনি। তাঁর প্রতিটি রচনায় বাস্তবের সঠিক ছবি চিত্রিত হয়েছে।

বলেন্দ্রনাথের প্রবন্ধগুলি বিষয়বস্তুর দিক থেকে বৈচিত্র্যময়, বিজ্ঞান ছাড়া আর সব বিষয়ের ওপর তিনি তাঁর সাহিত্যপ্রতিভার পরীক্ষানিরীক্ষা করে গেছেন। তাঁর প্রবন্ধের প্রধান বিষয় সামাজিক সাহিত্য ও সংস্কৃত সাহিত্য। এ ছাড়া দেবস্থান ও পীঠস্থানকেও তিনি তাঁর প্রবন্ধের বিষয় হিসেবে নির্বাচন করেছেন এবং আছে তাঁর কিছু ব্যক্তিগত প্রবন্ধ। ইংরেজি সাহিত্যের চরিত্র নিয়ে রচিত তাঁর একটি মাত্র প্রবন্ধ হল ‘রমলা’। তাঁর রচনার অধিকাংশ স্থান অধিকার করে রয়েছে তাঁর শিল্পসাহিত্য বিষয়ক রচনাসমূহ। বাংলা ভাষায় ‘আর্ট ক্রিটিসিজম’ শুরু করার কৃতিত্ব বলেন্দ্রনাথেরই প্রাপ্য।

বলেন্দ্রনাথের শিল্পসাহিত্য সমালোচনার একটা প্রধান অংশ গ্রহণ করেছে সংস্কৃত সাহিত্য। তাঁর সংস্কৃত সাহিত্য সমালোচনাগুলি তাঁর উচ্চাঙ্গ মননশীলতার পরিচয় দান করে। সংস্কৃত সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রতি তাঁর অসীম অনুরাগ ও গভীর শ্রদ্ধা ছিল, তিনি সংস্কৃত সাহিত্যের ভাবধারার সঙ্গে বাংলা সাহিত্যের মিশ্রণ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যকে আরও শ্রীমণ্ডিত করে তুলতে প্রয়াসী হয়েছিলেন। সংস্কৃত কাব্য ও নাটকের মাধ্যমে তিনি তাঁর সৌন্দর্য পিপাসাকে পরিতৃপ্ত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। সংস্কৃত সাহিত্য বিচারের ক্ষেত্রে বলেন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্রপন্থী। তাঁর প্রথম প্রকাশিত প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্য ও ললিতকলার সমালোচনা গ্রন্থটি হল ‘চিত্র ও কাব্য’। এই গ্রন্থটির কয়েকটি প্রবন্ধ “চিত্রধর্মিতা রঙ ও রেখার বর্ণাঢ্যতা, সুচিক্কণ কাব্যধর্মী বাণীবিন্যাস ও সৌন্দর্যচেতনা”— বলেন্দ্র গদ্যরীতির এইসব বৈশিষ্টের দ্বারা চিহ্নিত। ‘উত্তরচরিত্র’, ‘কালিদাসের চিত্রাঙ্কনী প্রতিভা’, ‘কাব্য প্রকৃতি’, ‘পশুপ্রীতি’, ‘মালবিকাগ্নিমিত্র’, ‘মেঘদূত’, ‘রত্নাবলী’, ‘ঋতুসংহার’ প্রভৃতি সংস্কৃত সাহিত্যের প্রখ্যাত কবি ও কাব্যের আলোচনায় বলেন্দ্রনাথের রসোপলব্ধির গূঢ় ক্ষমতার পরিচয় পাওয়া যায়। কালিদাসের কাব্য ও নাটক তাঁকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বলেন্দ্রনাথ তাঁর ‘মেঘদূত’, ‘ঋতুসংহার’, ‘দুষ্মন্ত’, ‘কালিদাসের চিত্রাঙ্কনী প্রতিভা’ ইত্যাদি প্রবন্ধে কালিদাসের কবিহৃদয়ের বৈশিষ্ট্যাবলি নিয়ে আলোচনা করেছেন। ‘মেঘদূত’ প্রবন্ধটিকে তিনি তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করে প্রতিটি শ্রেণিতে কাব্যটির ভিন্ন ভিন্ন প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই শ্রেণি নির্ণয় করতে গিয়ে লেখক অতি সংক্ষেপে এর গূঢ় প্রকৃতির পরিচয় দান করতে গিয়ে বলেছেন: “মেঘদূতের ঘটনার আর আবশ্যক নাই। কারণ ইহা নাটক অথবা উপন্যাস নহে যে বিরহ নিঃশ্বাসের মর্মস্পর্শীত্ব প্রকাশ করিবার জন্য অসংখ্য সখীর অশ্রুসিক্ত সান্ত্বনাবাক্যের সাহায্য লইতে হইবে। মেঘদূত গীতিকাব্য – কালিদাস ইহাতে বর্ষাকালে বিরহের প্রভাব দেখাইতেছেন।” বলেন্দ্রনাথ মেঘদূত কাব্যের ছন্দগাম্ভীর্য ও চিত্রসৌন্দর্যের প্রভূত প্রশংসা করেছেন। ‘ঋতুসংহার’-এ বলেন্দ্রনাথ কালিদাসের সাহিত্য প্রতিভার পরিচয় পেয়েও কাব্যটি তিনি অপরিণত এবং বর্ণনাময় বলে মত প্রকাশ করেছেন। ‘পশুপ্রীতি’ ও ‘কাব্য প্রকৃতি’ প্রবন্ধদ্বয়ে সংস্কৃত সাহিত্যে পশু এবং প্রকৃতি যে বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে আছে তাই বর্ণিত হয়েছে।

প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের এবং ললিতকলার সমালোচনায় লেখক তাঁর সূক্ষ্ম রসবোধের প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আলোচ্য বিষয়গুলির ওপর তিনি নতুনভাবে আলোকপাত করেছেন। তাঁর রচনাগুলি তাঁর নিজস্ব ভাবদৃষ্টির ফসল। ‘হিন্দুদেবদেবীর চিত্র’ সম্বন্ধে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “আমাদের সুখ-দুঃখ-বেদনা, আশা, সৌন্দর্য, প্রেম, মোহ, আকাঙ্খা সকলই এই দেবলোকে। যাহা কিছু মর্ত্য নিতান্তই ঐহিক – তাহাও আমরা মর্ত্যলোকে সাহস করিয়া রাখিতে পারি নাই; দেবতাকে দিয়া নিশ্চিত হইয়াছি।” ‘জয়দেব’ তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ একটি রচনা যেটিতে বলেন্দ্রনাথের সাহিত্যচিন্তার যথার্থ প্রতিফলন ঘটেছে। প্রবন্ধটিতে তিনি প্রেমের স্বরূপ বিষয়ে আলোচনা করেছেন এবং এ বিষয়ে তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলঃ “যে কেন্দ্রভূমি হইতে দৃষ্টিপাত করিলে এই শরীর, মন সম্ভোগ এবং প্রীতি, আলিঙ্গন এবং ধ্যান একটি সমগ্র সত্তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গরূপে প্রতিভাত হয়, সে কেন্দ্রভূমিতে এই সকল ভিন্ন মতাবলম্বী বিরোধীবর্গের কেহই উপনীত হয়েন নাই।” বৈষ্ণব সাহিত্যের বিষয়বস্তু নিয়ে রচিত তাঁর তিনটি প্রবন্ধ হল ‘বিদ্যাপতি ও চণ্ডীদাস’, ‘রাধা’ এবং ‘যশোদা’। রাধা চরিত্রের যে বিশেষ দিকটির প্রতি লেখক আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন তা হল, রাধা শুধু নারী— ‘নহ মাতা, নহ কন্যা, নহ বধূ’। রাধার দেহ সৌন্দর্য বর্ণনায় বলেন্দ্রনাথ যথেষ্ট কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। ‘যশোদা’ প্রবন্ধে যশোদা চরিত্র তাঁর লেখনীতে নতুনভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে; রাধা প্রণয়িনী, যশোদা স্নেহময়ী জননী মাত্র। এ ছাড়া তিনি ‘কৃত্তিবাস ও শশীদাস’, ‘ভারতচন্দ্র রায়’ প্রভৃতি প্রবন্ধ রচনা করেন। মধ্যযুগের অনেক স্বল্পখ্যাত সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করে এবং তিনি তাঁদের মহিমা কীর্তন করেছেন। তাঁর আলোচ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে সমালোচনার বেশ কয়েকটি সূত্রও। তিনি তাঁর রচিত ‘ইংরেজি বনাম বাংলা’, ‘জীবন ট্রাজেডি’, ‘স্বভাব ও সাহিত্য’ প্রবন্ধে সাহিত্যতত্ত্বের মনোজ্ঞ আলোচনা করেছেন। ‘কুন্দনন্দিনী ও সূর্যমুখী’ প্রবন্ধে তিনি ‘বিষবৃক্ষ’-এর দুই নায়িকার তুলনামূলক আলোচনা করার সঙ্গে সঙ্গে বিষয়বস্তুরও সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দান করেছেন।

সংস্কৃত সাহিত্য ও বাংলা সাহিত্যের সমালোচনা ছাড়া তিনি ললিতকলার সমালোচনাও করেছেন। তাঁর ‘দেয়ালের ছবি’ ও ‘দিল্লীর চিত্রশালিকা’ প্রবন্ধদ্বয় বিশুদ্ধ চিত্রসমালোচনা এবং বলেন্দ্রনাথের উৎকৃষ্ট রচনাগুলির অন্যতম। বলেন্দ্রনাথের রোমান্টিক মন তাঁকে প্রাচীনের প্রতি, সুদূর অতীতের প্রতি সহজাতভাবে আকৃষ্ট করেছিল। বলেন্দ্রনাথের কল্পনা অতীত ভারতের সাহিত্য, স্থাপত্য, ভাস্কর্য, চিত্রকলা সব কিছুর চারপাশে একটা শোভা ও সুষমার বলয় সৃষ্টি করেছে। ‘কণারক’, ‘খণ্ডগিরি’, ‘প্রাচীন উড়িষ্যা’, ‘বারাণসী’ প্রভৃতি প্রবন্ধ তাঁর ঐতিহ্যনিষ্ঠা ও সৌন্দর্যবোধের যথাযথ পরিচায়ক, বলেন্দ্রনাথের মনের রং ও তুলির টানে এগুলি সাহিত্যিক উৎকর্ষতা লাভ করেছে। উড়িষ্যার ঐতিহ্য, ভাস্কর্য, স্থাপত্য ইত্যাদি বলেন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে আকৃষ্ট করেছে। ‘কণারক’ এই জাতীয় রচনাগুলির মধ্যে শ্রেষ্ঠ। “উড়িষ্যার কণারক মন্দির বিষয়ে তাঁহার যে লেখা তাহা প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা হইয়া উঠিবার সম্ভাবনা ছিল সমধিক, কিন্তু একটি গভীর সহৃদয় দৃষ্টিতে ভাবনার ব্যাপ্তিতে এবং আন্তরিকতায়, প্রকাশের স্বাচ্ছন্দ্যে লেখাটি সাহিত্যিক রচনা হইয়া উঠিয়াছে।” তাঁর ‘খণ্ডগিরি’ প্রবন্ধে উড়িষ্যার ধর্মীয় জীবনের একটি অস্পষ্ট চিত্র মেলে।

বলেন্দ্রনাথের সামাজিক প্রবন্ধগুলিতেও তাঁর অতীত প্রীতির প্রকাশ ঘটেছে, তবে সেই অতীত প্রীতি কেবল রোমান্টিক কল্পনার ফল নয়, যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। তাঁর মধ্যে যে স্বদেশপ্রীতি ও স্বদেশাত্মক উপলব্ধি ছিল তা আমাদের গৃহবন্ধনে ও পারিবারিক জীবনের মধ্যেও একটা কল্যাণসুন্দর জীবনাদর্শের ছবিতে ফুটে উঠেছে। ‘প্রাচ্য প্রসাধনকলা’, ‘নিমন্ত্রণসভা’, ‘শ্রীহস্ত’, ‘শুভদৃষ্টি’, ‘কল্যাণমূর্তি’, ‘শুভ উৎসব’ প্রভৃতি রচনা আমাদের গৃহজীবনের আচার-আচরণে, উৎসব-লৌকিকতায়, রূপসজ্জার প্রসাধনে শিবসুন্দরের রূপ লাভ করেছে। বাঙালির অন্তঃপুরে, গৃহস্থালিতে, সামাজিক প্রথায় ও দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্মে যে সভ্য, সুন্দর ও মঙ্গল নিহিত রয়েছে তার মহিমা বলেন্দ্রনাথ অনুধাবন করেছেন। তাঁর এই জাতীয় রচনায় কোনও উপদেশ বা নীতিজ্ঞানের প্রকাশ নেই, আছে যথার্থ শিল্পীর দৃষ্টি যা দিয়ে তিনি আমাদের সামাজিক, পারিবারিক ও প্রাত্যহিক জীবনকে দেখেছেন, আর সে কারণেই এই প্রবন্ধগুলি সাহিত্যিক উৎকর্ষতা লাভ করেছে। দেশের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল সুগভীর। তাঁর পরিণত মন রূপের রংমহলে পরিতৃপ্তি খুঁজে পায়নি, বিশুদ্ধ সৌন্দর্যচর্চা তাঁকে অপূর্ণ রেখেছিল তাই তাঁর মধ্যে কর্মোদ্যোগ দেখা যায়। সৌন্দর্যের সঙ্গে শুভবোধকে অনুভব করেছেন বলেই তাঁকে পারিবারিক বা গৃহজীবনের অঙ্গনে পাওয়া যায়।

বলেন্দ্রনাথের বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ নিছক বর্ণনামূলক। ‘আষাঢ় ও শ্রাবণ’, ‘শরৎ ও বসন্ত’, ‘বোম্বাইয়ের রাজপথ’, ‘লাহোরের বর্ণনা’ প্রভৃতি প্রবন্ধ বর্ণনামূলক রচনার অন্তর্ভুক্ত। তবে তাঁর বর্ণনকৌশল অতি সাধারণ বস্তুকেও অসাধারণ করে তুলেছে। এই ধরনের প্রবন্ধগুলির চিত্রধর্মিতা পাঠককূলকে আকৃষ্ট করে। এই রচনাগুলি মূলত ব্যক্তিগত প্রবন্ধজাতীয়। বলেন্দ্রনাথ ব্যক্তিগত প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে বাংলা সাহিত্যে এক বিশেষ স্থানাধিকারী। ঋতু বর্ণনামূলক রচনাগুলিতে তাঁর ব্যক্তি মনের সুর শোনা যায়, চিত্ররীতি ও সঙ্গীতরীতির এক অপূর্ব সমন্বয় লক্ষিত হয়। ঋতু আশ্রয়ী ব্যক্তিগত প্রবন্ধগুলিতে বলেন্দ্রনাথের অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কবি মনের প্রকাশ ঘটেছে। তাঁর ঋতু আশ্রয়ী শ্রেষ্ঠ রচনা ‘শ্রাবণের বারিধারা’ যেখানে ভাবাবিষ্ট কবিমন শ্রাবনের গহন গভীরে অবগাহন করে উতলা: “তুমি শুধু ঝরিয়া যাও – তোমার ঝরঝরে বর্ষে বর্ষে এমনি নতুন কাব্য রচিত হোক। আমরা এই কাব্যের সৌন্দর্যে ডুবিয়া একটু আনন্দ উপভোগ করি।” ‘ঊষা ও সন্ধ্যা’, ‘গোধূলি ও সন্ধ্যা’, ‘সন্ধ্যা’, ‘ভাদ্র মাসের ভরা গঙ্গা’ প্রভৃতি রচনায় বলেন্দ্রনাথের ভাবুকতা, কল্পনাশক্তি ও কবিত্বশক্তির পূর্ণতা প্রকাশিত হয়েছে যা তাঁর গীতিকবিসত্তার প্রকাশ ঘটায়। বলেন্দ্রনাথের ‘দেয়ালের ছবি’ রচনাটিতে তাঁর কবিদৃষ্টির পরিচয় মেলে, দেশ-বিদেশের বিচিত্র জীবনধারার বৈচিত্র্যময় লীলা জীবন্ত হয়ে ধরা পড়েছে। ‘নীরবে’, ‘জানালার ধারে’, পুরাতন চিঠি’ ইত্যাদি রচনা আত্মনিষ্ঠ লিরিক রচনা; ‘চন্দ্রপুরের হাট’, ‘পুলের ধারে’, ‘বনপ্রান্ত’ প্রভৃতি বলেন্দ্রনাথের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিগত ও আত্মনিষ্ঠ রচনা। তাঁর ‘পুরাতন চিঠি’ রচনাটি বন্ধুজনের পুরনো চিঠির বিবর্ণ পত্রসমন্বয়। তুচ্ছ স্মৃতিবিজড়িত অতি যত্নে গচ্ছিত বস্তুগুলি লেখকের কাছে আজ অতি মূল্যবান—

আমি বর্তমানশ্রান্ত পথিক। মধ্যে মধ্যে এই পুরাতন স্নেহে শান্তিলাভ করিতে আসি। চুপিচুপি আমার শৈবালাচ্ছন্ন অতীতের সমাধি মন্দিরে গিয়া একা একা বসিয়া থাকি। একটি পেন্সিলে দাগ, দুইটি পুরাতন পরিচিত হাতের অক্ষরে সমস্ত পুরাতন – আমার সমস্ত অতীত।

রবীন্দ্রযুগে এবং রবীন্দ্র সমসাময়িকদের মধ্যে বাংলা গদ্যভাষার অভিনব বর্ণনের জন্য যাঁদের নাম উল্লেখযোগ্য তাঁরা হলেন— প্রমথ চৌধুরী, বলেন্দ্রনাথ ও অবনীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রপ্রভাবে পুষ্ট ও কবিগুরুর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পরিশীলিত হওয়ার কারণে বলেন্দ্রনাথের গদ্য পরিণত ও বিশেষ শিল্পগুণ বিশিষ্ট। তবে রবীন্দ্রপ্রভাব সত্ত্বেও তাঁর গদ্যের একটা নিজস্ব স্বকীয়তা ও স্টাইল আছে। অলঙ্করণ, আভিজাত্য, শব্দচয়ন নিপুণতা, ভাষার চিত্রধর্মিতা তাঁর রচনা সম্ভারকে বিশিষ্টতা দান করেছে, তাঁর গদ্যভাষায় বর্ণসম্পাত করেছে। আচার্য রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বলেন্দ্রনাথের গদ্যরীতিতে আকৃষ্ট হয়ে বলেছেন:

এই রচনাভঙ্গীই আমাকে প্রথম আকর্ষণ করিয়াছিল; এমন সযত্নে গাঁথা শব্দের মালা তাহার পূর্বে আমি দেখি নাই। শুনিয়াছি বলেন্দ্রনাথের ভাষা তাঁর সাধনার ফল, শিক্ষানবিশ অবস্থায় কাটিয়া ছাঁটিয়া পালিশ করিয়া তিনি ভাবের উপযোগী ভাষা গড়িয়া লইয়াছেন। ….. কাজেই তাঁহার ভাষা কারিগরের হাতের অপূর্ব কারুকার্য হইয়া দাঁড়াইয়াছিল।

বলেন্দ্রনাথের রচনারীতিকে তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম স্তরে, তাঁর বাল্যবয়সের গদ্যরীতিতে ব্যক্তিমনের প্রকাশের কোনও অবকাশ ছিল না, ভাষার বাঁধুনী তখনও তাঁর অনায়ত্ত। দ্বিতীয় স্তরের লেখা তাঁর প্রকাশধর্মী ‘চিত্র ও কাব্য’ গ্রন্থটির মধ্যে সীমিত। প্রাচীন সংস্কৃত ও ললিতকলার আলোচনায় তাঁর বিশিষ্ট স্টাইলটি ধরা পড়ে। তৃতীয় স্তরে গদ্য ও কবিতা উভয়ক্ষেত্রেই তাঁর পারদর্শিতা পরিলক্ষিত হয়। এই স্তরে তাঁর প্রতিভার পূর্ণতর স্ফুরণ ঘটে। বলেন্দ্রনাথ এই সময়েই বাংলা গদ্যের এক বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে মর্যাদা লাভ করেন। বাংলা গদ্যসাহিত্যের একজন সার্থক শিল্পী হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন। প্রমথনাথ বিশী যথার্থই বলেছেন:

বলেন্দ্রনাথ ভাষার সেই ধ্বনি আর ফিরিবে না, কিন্তু লোপও পাইবে না, কণারকের মন্দিরের অনুরূপ আর গঠিত হইবে না সত্য, কিন্তু সে ভগ্নাবশেষ যে অবলুপ্ত হবেই এমন সন্দেহ করিবারও কারণ নাই। বিস্তীর্ণ বালুশয্যা অতিক্রম করিয়া লোকে কণারকের শোভাসৌন্দর্য দেখিতে যাইবে; বলেন্দ্রনাথের ভাষায় ঐশ্বর্যভোগ করিবারও লোকের অভাব হইবে না।

বলেন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ সারাবছর ধরে আমরা বিভিন্নভাবে স্মরণ করে চলব, তবে তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভাকে যথার্থ সম্মান জানাতে আমাদের তাঁর সাহিত্যের পুনর্মূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে চেষ্টা করতে হবে তাঁর রচনাসম্ভারের প্রতি পাঠককুলকে নতুন করে আকৃষ্ট করতে, তাঁর পুস্তকসম্ভার পুনর্মুদ্রিত  করতে এবং সেগুলি বহু পঠিত হয়ে সাহিত্যরস পিপাসু মানুষের মন যাতে পরিতৃপ্ত করে তার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4659 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...