তিষ্য দাশগুপ্ত
‘গল্প হলেও সত্যি’ সিনেমার একটা সিন মনে পড়ে? একটি অ্যাড কিংবা ডিজাইনার সংস্থার কর্ণধার রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত বলছেন, মানুষকে ধরে ধরে শক দিতে হবে, খাবার যতই পচা হোক না কেন যুগের হুজুগের চকচকে তবকে মোড়া থাকলে তাই বিকোবে চড়া দামে, শুধু বিকোতে জানতে হবে….সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে।
এক বৃষ্টিভেজা বুধবারে মঞ্চস্থ হতে চলেছে প্রখ্যাত নাট্যগোষ্ঠী নান্দীকারের নতুন নাটক– রানী কাদম্বিনী। কাদম্বিনী গঙ্গোপাধ্যায়….তৎকালীন ভারতবর্ষের “প্রথম ও একমাত্র” (কাদম্বিনী সমসাময়িক আরেক এবং একমাত্র মহিলা ভারতীয় ডাক্তার আনন্দীবাই গোপালরাও জোশী, যদিও তিনি ডিগ্রিলাভ করেন ইউ এস এ-তে, তবু একবার অন্তত নামোল্লেখ দাবি রাখে) মহিলা ডাক্তার, তাঁর জীবন ও কাহিনী। শ্রেষ্ঠ্যাংশে নটসম্রাট নটসূর্য বর্তমান বাংলার অন্যতম বলিষ্ঠ অভিনেতা, ‘হ্যাপি পেরেন্টস ডে’-খ্যাত, শ্রীযুক্ত দেবশঙ্কর হালদার, মোটা গোঁপআলা– অরবিন্দ ঘোষেরও অমন মোটা গোঁপ ছিল, আঠা দিয়ে লাগানো, সে গোঁপ খুব চুলকোতো, তাই উনি বোমা-টোমা বাঁধা বন্ধ করে গোঁপ কেটে ফেলে সন্ন্যিসি হয়ে যান, এবং ইডলি দোসা খাওয়া প্র্যাকটিস শুরু করেন– রেফারেন্স বাত্য বসু। যাকগে, এসব আট-ভাট কথা থাক, তো যা বলছিলুম, শ্রেষ্ঠ্যাংশে অরবিন্দ ঘোষ মোটা গোঁপআলা, আর শিবু-নন্দিতা মেলোড্রামা খ্যাত সাংঘাতিক স্টিরিওটাইপ নান্দীকারের ফিমেল রাহুল গান্ধী সপ্তর্ষি মৌলিকের ওয়াইফ সোহিনী সেনগুপ্ত (এককালে স্তব্ধ করে রাখতেন, চোখ সরানো যেত না, তা সে যাকগে যাক, এককালে কোলকাতাতে হাড়গিলেও ঘুরে বেড়াত… আর সোহিনী-দেবশঙ্কর-গৌতম-স্বাতীলেখা-রুদ্রপ্রসাদসমৃদ্ধ নান্দীকারও চোখধাঁধানো মনভুলোনো “থিয়েটার” করত), তিনি এ নাটকের নির্দেশকও বটেক। তো নান্দীকারের নতুন নাটক, এই চক্করে আনন্দবাজারের বিনোদন বিভাগের জনৈক সাংবাদিকও কাদম্বিনী গাঙ্গুলী, তাঁর স্বামী দ্বারকানাথ (সব দ্বারকাই ঠাকুর, এটা অত্যন্ত ভুল ধারণা) এবং পুরোনো কোলকাতা সম্পর্কে বেশ কিছুটা জেনে ফেললেন, বইপত্র ঘাঁটতে হল আর কি কিছু, সেই কোন ছোটোবেলায় পড়াশোনা করতে হত, এখন কি আর এসব পোষায়! আনন্দবাজার পড়ে তো পাম এভিনিউ-এর মিস্টার দত্ত অথবা নিউ আলিপুরের মিস্টার গাঙ্গুলি ড্রাইভারকে বলে দু’খানা টিকিট কিনে আনলেন সেকেন্ড রোয়ের, তিনশো টাকা করে (কি জানি ৪০০/- কিম্বা ৫০০/- ও হতে পারে, জাস্টিন বিবার ৩০,০০০/- হাঁকতে পারে, আর এখানে তিনশো টাকা খরচা করবে না, যতই অতীতের মিলিয়ে যাওয়া ছায়ামাত্র হোক, তবু তো নান্দীকার, অজিতেশের নান্দীকার, কেয়া চক্রবর্তীর নান্দীকার), ড্রাইভার নিয়ে গাড়ী হাঁকিয়ে চললেন ক্যাথিড্রাল রোড পানে, আগস্টের ১৬ তারিখ, বিকালবেলায়। তো যাই হোক, তিলধারণের জায়গা নেই হলে, হাউজফুল কাউন্টারেও এক সহৃদয় (নাকি দূরদ্রষ্টা, নিজেকে বাঁচিয়ে আমায় ফাঁসালেন, দু’শো টাকায় একপ্লেট আরসালান হয়ে যায়) ভদ্রলোকের বদান্যতায় একখানি প্রবেশপত্র জুটলো, জনসমুদ্র পেরিয়ে ঢোকা গেল হলে। ঠাণ্ডা এসি হলে একে তো উঠে দাঁড়িয়ে বাংলা গান হিন্দি ভাষায় গাওয়ার ঝঞ্ঝাট নেই, আর যতই হোক তাও তো নান্দীকার, ফলে দু’শো টাকার জ্বালাটা একটু জুড়োল। শুরু হল নাটক।
পরবর্তী ঘটনা নিয়ে বলার খুব বেশি নেই। একটি বায়োপিককে যে নিপুণ দক্ষতার সাথে যাত্রাপালা ও ভাঁড়ামোতে রূপান্তরিত করা যায় তার পৌনে দু’ঘন্টার ডেমন্স্ট্রেশন। তাও গল্পটা বলা যাক খানিক, গল্পের শুরুতেই কাদম্বিনী গাঙ্গুলী নেপালের রাজমাতার চিকিৎসা করতে যান, সেখানে ধিতাং ধিতাং নৃত্যগীতের মাধ্যমে তাঁকে স্বাগত জানানো হয়, এবং তিনি তাঁর ঐশ্বরিক ক্ষমতাবলে ভদ্রমহিলাকে সুস্থ করে তোলেন এবং আনন্দে আত্মহারা হয়ে শয্যাশায়ী রোগিনী উদ্বাহু নৃত্যে লিপ্ত হন। এইভাবেই কোলকাতা শহরে ফিরে এসে তিনি একের পর এক সাফল্যের পালক অর্জন করতে থাকেন, তার ফাঁকে ফাঁকে দ্বারকানাথ ঠাকুর থুড়ি গাঙ্গুলীর সাথে প্রেম, এবং যে জায়গাগুলো অভিনয় দিয়ে মেকআপ করার মতো ক্ষমতা বর্তমানে দলটির নেই, সেই জায়গাগুলো দলের ছেলেমেয়েরা প্রোজেক্টর চালিয়ে গ্যাটিজ দিয়ে চলেছে, সাথে ওই ভূতের নৃত্য – এই হলো মোটামুটি স্বাতীলেখা সেনগুপ্তের যুগান্তকারী স্ক্রিপ্ট, যা আগামী দু’এক বছরে বাজারে বেশ ভালো মাল কামাতে চলেছে। অভিনয় সম্পর্কে নান্দীকারের বর্তমান নয়নের মণি সপ্তর্ষি মৌলিকের কথা না বললেই নয়, অভিনয় তো পুজোতে আমরাও পাড়ায় করি, কিন্তু উনি “ঠোমরা হামাকে মারিঠে ফারো, কিন্তু হামি খোনো জবাব ঢিবে না” অ্যাকসেন্টে মেডিক্যাল কলেজের ইভিল প্রিন্সিপালের ভূমিকায় “ফাটিয়ে” অভিনয় করে (হায় রে উৎপল দত্ত, কবে টিনের তলোয়ারে এক বেচারা সাহেব ঝাড় খেয়েছিলো এই বিচিত্র অ্যাকসেন্টে কথা বলার জন্য। তা সে যাক গে ইতিহাস-ফিতিহাস, আমরাও পুজোর মাচায় দেখেছি নাটকে সাহেব-টাহেব গোছের রোলে একটু লাল চুল-টুল থাকলে, দু’বার হামি-ঠুমি এসব বললে পাব্লিক আমোদ পায় বেশ, ক্ল্যাপ-ট্যাপ হয়, ফলে আমাদের মোটা মাথায় যে ব্যাপারটা ঢোকে দীর্ঘদিনের “প্রোডাক্ট-বেচা” রুদ্রবাবু সেই লোপ্পা ক্যাচটা মিস করবেন তা কি হয়, অতএব) “এলেন, ছড়ালেন, জয় করলেন”। কাদম্বিনীর স্বামী দ্বারকাবাবু প্রগলভ ছিলেন কিনা জানা নেই, মনেও হয় না, আর থাকলেও ওরকম একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্রাম্ভারি চরিত্রে দেবশঙ্করবাবুকে দিয়ে ভাঁড়ামো করানো হবে, এটা মেনে নিতে সত্যিই কষ্ট হয় বটে, কিন্তু, লোকে কি খাচ্ছে? কাজেই আমি যতই সারিডন-এর প্রয়োজন অনুভব করি না কেন, দত্তগিন্নী আর দাশবাবু খুশ, প্রেক্ষাগৃহে মুহুর্মুহু করতালি। সামনের সারিতে বাংলার ব্লোহট ডিরেক্টর ডুও শিবু-নন্দিতা আপ্লুত, বক্স অফিসে হুল্লোড়- আগামী কয়েকটি শো-এর জন্য নিশ্চিন্তি। স্টেজ, আলো, বাকি অভিনেতা-অভিনেত্রী ইত্যাদি সম্পর্কে যত কম বলা যায় ততই ভালো, আর বাংলা থ্যাটারে এক নতুন ব্যামো এখন, প্রোজেকশান। তবে সেই চর্বিতচর্বণ, দিনের শেষে, খাবারের মোড়কটা কিসের? সোনার….ফলে গোটা হল জুড়ে হুঁশহাশ ফিসফাস আহা-উহু…ওই দেখুন স্বচক্ষে বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ঠ চরিত্রাভিনেতা…শ্রীযুক্ত দেবশঙ্কর হালদার।
অতএব, একটি নষ্ট দিনের অবসান, বৃষ্টিতে ভিজে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (এই নাটকটি অবশ্য দেখবেন পাঠক, ঠকবেন না) দেখার সমস্ত পাথেয় শেষ করে ফেলে ফিরে আসা মেট্রোপথে। তবে সব শেষে, ধন্যবাদ নান্দীকার, ছোটবেলাটাকে মায়ায় মুড়ে রাখার জন্য, অনেকদিনের সম্পর্ক, তাই শেষ করতে কষ্টই হয় বেশ।
এবার আপনারা নিশ্চিন্তে বেওসা করেন, ভালো থাকবেন।
কোনও বাণিজ্যিক পত্রিকায় নান্দীকারের মত বিগ হাউসকে নিয়ে এমন ঢিলছোঁড়া রিভিউ দেখিনি। চার নম্বর ও লেখককে ধন্যবাদ।
ধন্যবাদ 🙂