একটি একা হাতি ও রাষ্ট্র

চার্বাক মিত্র

 

লেখক সমাজ রাজনীতি পরিবেশ বিষয়ক ভাষ্যকার

মার্কিন গায়িকা শের একটি ঘটনা ঘটিয়ে দুনিয়াজুড়ে বাহবা কুড়োচ্ছেন। বিষয়টা একটু গোড়া থেকে বলা যাক। ১৯৮৫ সালে শ্রীলঙ্কার সরকার পাকিস্তান সরকারকে একটি হাতি উপহার দেয়, হাতিটির বয়স তখন ১। তারপর বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় রীতিমতো দুরবস্থায় বাড়তে থাকে হাতিটি, তার নাম দেওয়া হয় কাভান। বিগত ১৭টি বছর সে কাটিয়েছে একটি শেডে, ২০১২ সালে সঙ্গিনী সহেলি মারা যাওয়ার পর এই শেষ আটটি বছর তার মধ্যে একা কাটাতে হয়েছে তাকে। তকমা এঁটে গেছে তার গায়ে, ‘পৃথিবীর নিঃসঙ্গতম হাতি’‌। তার ওজন দাঁড়িয়েছিল এসে সাড়ে পাঁচ টনে। আর হ্যাঁ, ডিপ্রেশন মানুষের একচেটিয়া নয়। কাভান ছিল অ্যাকিউট ডিপ্রেশনের রোগী। সেই কারণেই ওবেসিটি বা অতিরিক্ত ওজনের সমস্যা। পাকিস্তান হাইকোর্টে কোনও পশুপ্রেমী মামলা করেন এই হাতিটির বিষয়ে। হাইকোর্ট রায় দেয়, স্থানান্তরিত করা হোক এই হাতিটিকে। এইসব দেখেশুনে বিচলিত হয়ে শের ঠিক করেন, উদ্ধার করবেন কাভানকে। একটি ইলিউশিন বিমানে চড়িয়ে কাভানকে তিনি নিয়ে যাবেন কাম্বোডিয়াতে। একটি স্মিথসোনিয়ান তথ্যচিত্রে তাদের এই যাত্রা তুলে ধরা হবে।

কাভান

 

ফ্রি কাভান ক্যাম্পেনিং-এ শের

এখানেই একটা প্রশ্ন উঠে আসে।

এজাতীয় পশুপ্রেম কি বিখ্যাত এবং পয়সাওলাদের একচেটিয়া? শের যদি পৃথিবীবিখ্যাত কোটিপতি গায়িকা না হতেন, বা পৃথিবীতে কোনও কোটিপতিই যদি কাভানের বিষয়ে আগ্রহী না হত, তাহলে কী দশা হত তার? মাথায় রাখবেন, কাভান কিন্তু ছিল একটি সরকারি আদানপ্রদান। যে রাষ্ট্র কাভানের দায়িত্ব তুলে নিয়েছিল নিজের কাঁধে— সেই রাষ্ট্র বেমালুম হাল ছেড়ে দিল! এবং এত বছর রাষ্ট্রীয় রক্ষণাবেক্ষণে থেকে এই দশা হল কাভানের! কিছু বৃহৎ পুঁজির মালিকের ব্যক্তিগত প্রয়াস ছাড়া কি কাভানকে বাঁচানোই যেত না?

শুধু শের নন, দুনিয়াজোড়া বহু সেলেব, কোটিপতি, বিলিওনৈয়াররা আবিশ্ব বহু চিড়িয়াখানায় পশুপাখিদের দত্তক নিয়ে রাখেন। সরকারি তত্ত্বাবধানে থাকা চিড়িয়াখানাতেও এই নিয়ম চালু। এদেশে যেমন শচীন তেন্ডুলকর-সহ অনেকেই বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় বেশ কিছু প্রাণীকে দত্তক নিয়েছেন। এই দত্তক নেওয়ার গালভারী নামটুকু শুধু রয়েছে, কিন্তু আদত বিষয়টা কী? চিড়িয়াখানাতেই থাকবে প্রাণীটি, শুধু তার ভরণপোষণের খরচ বহন করবেন দত্তক নেওয়া ব্যক্তি। শের অবশ্য সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিচ্ছেন কাভানের, কিন্তু সাধারণভাবে নিয়মটা এরকমই। বিখ্যাত সিটকম ‘বিগ ব্যাং থিওরি’-তে একটি এনআরআই চরিত্র বলে, সে একটি পেঙ্গুইনকে দত্তক নিয়েছে। অর্থাৎ, বিত্ত থাকলেই এমনভাবে দায়িত্ব নেওয়া যায় একটি প্রাণীর, মাসে মাসে কিছু টাকা পাঠিয়ে। এতে খানিক পোষ্য পোষ্য ভাবও থাকে, অর্থাৎ, একটা বাঘ পুষছি বা একটা জলহস্তী পুষছি ভেবে আনন্দ পাওয়া যায়, গর্ববোধ করা যায়— আবার বিশেষ কিছু দায়িত্ব কাঁধেও নিতে হয় না। অর্থাৎ, যে টাকা মাসে মাসে প্রাণীটির দেখভালের জন্য দেওয়া হচ্ছে, তা আদৌ সঠিক খাতে সঠিকভাবে খরচ হচ্ছে কি না— তা দেখার কোনও দায় থাকছে না।

আর এখানে রাষ্ট্রের ভূমিকা লক্ষ করে দেখুন। তাদেরই চিড়িয়াখানা, সেই চিড়িয়াখানার বাসিন্দা সমস্ত পশুপাখিদের সুস্থসবল রাখার দায়িত্ব কিন্তু রাষ্ট্রের। আরও একটু গভীরে যাওয়া যাক এই নিয়ে, চিড়িয়াখানার ভূমিকা আসলে কী? প্রাচীন ইজিপ্টে যাকে বলা হত ‘মিনেজারি’, অর্থাৎ যেখানে রাজারাজড়ারা সংগ্রহ করে রাখতেন পশুপাখি, তাই কিন্তু চিড়িয়াখানার আদি প্রকল্প। উনিশ শতকে এই রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ইউরোপে আধুনিক চিড়িয়াখানার জন্ম দেয়। দীপেশ চক্রবর্তী লিখেছেন তাঁর ‘প্রভিন্সিয়ালাইজিং‌ ইউরোপ’ বইয়ে, কীভাবে ইউরোপ তার ভাবধারার চিহ্ন ছড়িয়ে দিয়েছিল দুনিয়াজোড়া উপনিবেশে। সেভাবেই উপনিবেশ হজম করল চিড়িয়াখানার এই ধারণা। কিন্তু এই উনিশ শতকীয় ধারণার বিরুদ্ধে পশু অধিকারের পক্ষে আন্দোলনকারীরা রুখে দাঁড়াতে এখন কনজার্ভেশন পার্ক বা বায়ো পার্ক হয়ে উঠেছে চিড়িয়াখানার অন্য নাম। অর্থাৎ, এই একবিংশ শতকে যা হওয়া উচিত, সংরক্ষণের উদ্দেশ্যই চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্য। বিনোদন এবং প্রদর্শন তার একটা অংশমাত্র হতে পারে। ভারতীয়রা চিড়িয়াখানায় গিয়ে যে হারাকিরি করে পরিবেশ ন‍ষ্ট করে— সেসব নিয়ে আলোচনা থাক, কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে, চিড়িয়াখানাকে আরও বেশি পরিবেশবান্ধব করে তোলা, অভয়ারণ্যের বাইরেও অন্যতর সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা— এগুলো এই শতকে এসে অনুভূত হওয়াই উচিত। তাহলে রাষ্ট্রের সেই খাতে নিশ্চিত কোনও নির্দিষ্ট ধার্য থাকা উচিত। সেটা যদি রাষ্ট্র না পেরে ওঠে, তাহলে কয়েকটি পশুকে আলাদা করে একরকম ‘মিনেজারি’ ব্যবস্থার মতো ‘ইজারা’ দেওয়া কেন? বাকি পশুপাখি, যাদের পৃষ্ঠপোষক নেই, তাদের রক্ষণাবেক্ষণ কি তাহলে তুলনায় অপর্যাপ্ত হবে? আর এতটাই অপারগ যদি হয় রাষ্ট্র এইভাবে পশুপাখিদের দেখভালে, তাহলে চিড়িয়াখানার জৌলুস বাড়াতে এদেশ ওদেশ থেকে বিভিন্ন প্রজাতির পশুপাখির আমদানি না করে বরং খাঁচাবন্দি প্রাণীদের অভয়ারণ্যে ফেরত পাঠানো নিয়ে তো ভাবা যেতে পারে!

সুদানের চিড়িয়াখানার সেই সিংহটি

থাইল্যান্ডের টাইগার টেম্পলে গিয়ে বাঘের গায়ে হাত বুলিয়ে যে ন্যাকাপনা করতেন পর্যটকরা, তার বিরুদ্ধে কতটুকু কথা উঠেছিল? পরে দেখা গেল, সেই টাইগার টেম্পলে কী দুর্দশার মধ্যে ছিল বাঘগুলি! এই লকডাউনে বেশ কিছু চিড়িয়াখানার হদিশ পাওয়া গিয়েছে, যেখানে পশুপাখি প্রায় অনাহারে মরছে। তার মধ্যে সুদানের একটি চিড়িয়াখানার একটি রুগ্ন সিংহের ছবি চোখে লেগে আছে এখনও। সংরক্ষণ সম্ভব না হলে রাষ্ট্রের কি অধিকার আছে এই চিড়িয়াখানা ব্যবস্থাকে দিনের পর দিন চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার?

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4411 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...