প্রসঙ্গ কৃষক-আন্দোলন: প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর কে জানায়?

প্রতীক

 

 




লেখক স্বাধীন সাংবাদিক ও ব্লগার

 

 

 

 

দেশে একটা কৃষক-আন্দোলন চলছে। দেশে মানে ‘সন্ত্রাসবাদীদের জায়গা’ কাশ্মিরে নয়, ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নয়, এমনকি ‘দুর্বোধ্য’ ভাষায় কথা বলা তামিলনাডু, অন্ধ্র, তেলেঙ্গানা বা কেরলেও নয়। আন্দোলনটা চলছে খোদ রাজধানী দিল্লিকে ঘিরে। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে অনেকগুলো কৃষক সংগঠনের সদস্যরা দিল্লির এই হাঁড়-কাঁপানো শীতে পথে বসে আছেন সপরিবার। তাঁরা ভারত বন্‌ধ ডাকলেন, বিজেপি ছাড়া প্রায় সব রাজনৈতিক দল সমর্থন করল। এই আন্দোলনের দাবিগুলো কী কী? খুব লম্বা কোনও দাবি সনদ নেই। অতিমারির মওকায় বিনা আলোচনায় অর্ডিন্যান্স জারি করে, পরে সংসদে বুলডোজার চালিয়ে (রাজ্যসভায় ভোটাভুটি হতে না দিয়ে) পাশ করিয়ে নেওয়া কৃষি আইনগুলো বাতিল করতে হবে, আর প্রস্তাবিত বিদ্যুৎ আইন (সংশোধনী) বিল বাতিল করতে হবে— দাবি এটুকুই। দাবিগুলো কি ন্যায্য, না অন্যায্য? সরকার যে বলছে এই আইনগুলোতে কৃষকদের ভালই হবে— সে কি নেহাত বানানো কথা? মনে এসব প্রশ্ন জাগলে আপনি কোথায় যাবেন? খবরের কাগজ পড়বেন অথবা টিভি দেখবেন তো? কিন্তু সেখানে এসবের উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা কম।

প্রথমত, সর্বভারতীয় খবরের চ্যানেল আপনাকে অনেক বেশি করে দেখাবে চিনকে ভারত ‘কেমন দিল’ (যদিও চিনই প্রতিনিয়ত ভারতকে ‘দিয়ে চলেছে’ সীমান্তবর্তী এলাকায়। বদলে ভারত বিবৃতি ছাড়া বিশেষ কিছুই দিতে পারেনি এখনও পর্যন্ত); পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর একদা-ঘনিষ্ঠ নেতা শুভেন্দু অধিকারী তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেবেন কিনা, দিলে কবে দেবেন, আর কে-কে অপেক্ষমান যাত্রীর তালিকায় আছেন, ইত্যাদি। সর্বভারতীয় কাগজগুলোতে এসব খবরের পাশাপাশি ঢালাও লেখা থাকবে নরেন্দ্র মোদি ‘মন কি বাত’-এ কী বললেন। পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যমও তথৈবচ। টিভি খুলে বিজেপি আর তৃণমূলের প্রত্যেকটি গ্রামীণ ঝগড়ার পুঙ্খানুপুঙ্খও আপনি জেনে যাবেন, খবরের কাগজের প্রথম পাতায় থাকবেই রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের বহুবিলম্বিত ডিএ প্রাপ্তির ঘোষণা (যেন মহানুভব সরকারের দয়ার শরীর, তাই ওটা দিচ্ছেন)। বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে এলে যে ধরনের ঘোষণা দেশের সব সরকারই করে থাকে, সেগুলোও পাবে যথাযোগ্য মর্যাদা। কৃষক-আন্দোলনের ভাগ্যে শিকে ছিঁড়বে কেবল কোনও সংবাদসংস্থার প্রতিভাবান আলোকচিত্রী আন্দোলনকারীদের দৃষ্টিনন্দন ছবি তুলতে পারলে তবেই। সঙ্গে থাকবে দুই কি তিন কলমে ছড়ানো একটুকরো খবর (যা আন্দোলনের শুরুর কয়েকদিন ছবিহীন এক কলম বা দু কলমেই সীমাবদ্ধ ছিল)। ‘এরপর অমুক পাতায়’…

দ্বিতীয়ত, এটুকু খবরেও আপনাকে তথ্য দেওয়া হবে যৎসামান্য। ‘সরকারের ভাবনাচিন্তা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে’, ‘কৃষকরা বলছেন’-জাতীয় ধরি-মাছ-না-ছুঁই-পানি শব্দবন্ধে আপনাকে কেবল জানিয়ে দেওয়া হবে ব্যাপারটা খুব পুঁদিচ্চেরি (টেনিদার ভাষায়) এবং সত্বর মিটে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু কৃষকদের দাবিদাওয়া সম্বন্ধে আপনি তেমন কিছু জানতে পারবেন না, তার ভালমন্দ নিয়ে কোনও গভীর আলোচনা পাবেন না, আন্দোলনকারীদের সম্বন্ধে বা আন্দোলনের প্রধান নেতাদের মতামত কিংবা রাজনীতি নিয়ে প্রায় কিছুই জানতে পারবেন না।

তবুও তো আপনি জেনে যাচ্ছেন। কী করে জানতে পারছেন? ভেবে দেখুন, আপনি জানছেন মূলত সোশাল মিডিয়া থেকে। বিভিন্ন খবর ও মতামতের সাইটের লিঙ্ক শেয়ার হচ্ছে সোশাল মিডিয়ায়। কোনও-কোনও সাংবাদিক অকুস্থল থেকে সরাসরি টুইট করছেন। আপনি সেখান থেকেই জানতে পারছেন। কিন্তু ওভাবে জানার সমস্যা হল, যাঁরা এই আন্দোলনের পক্ষে, তাঁদের কাছে কৃষকদের বার্তা পৌঁছাচ্ছে, আর যাঁরা বিপক্ষে তাঁরা নির্বিবাদে ‘খালিস্তানি জুজু’ দেখে যাচ্ছেন। তথাকথিত স্বাধীন সংবাদমাধ্যমগুলো যে নিরপেক্ষতার কথা বলে অনবরত, ‘বোথ সাইডস অফ দ্য স্টোরি’ নামক যে জিনিসটার পোশাকি আলোচনা চলে, সেটাকে এইভাবে তারাই ধ্বংস করে দিচ্ছে।

কিন্তু এমন হচ্ছে কেন? এককথায় বিজেপি মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে বললে এর উত্তর হয় না। কারণ কৃষক বা শ্রমিক আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করা, তার পিছনে দুরভিসন্ধি আবিষ্কার করা ভারতের (প্রায় সব দেশেরই) সংবাদমাধ্যমের পুরনো অসুখ। তফাত এইটুকু যে, অতীতে কৃষক-শ্রমিক বিরোধী সরকারও আলোচনার প্রয়োজন স্বীকার করত, মোদি-সরকার বাধ্য হয়ে আলোচনায় বসেছে। ভেবেছিল, এর আগের আন্দোলনগুলোকে যেমন শহুরে নকশাল বা পাকিস্তানিদের আন্দোলন বলে দেগে দিয়ে দাঙ্গা আর দমননীতি দিয়ে চুপ করিয়ে দেওয়া গিয়েছিল— এ ক্ষেত্রেও তেমনটাই করা যাবে। তাহলে আর একটু তলিয়ে দেখা যাক, কেন এ হেন অবহেলা।

মূলধারার সংবাদমাধ্যম বলতে বোঝায় খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলগুলোকে। আমাদের দেশে বিরাট পুঁজি না থাকলে দৈনিক সংবাদপত্র বা টিভি চ্যানেল চালানো বরাবরই দুষ্কর। ফলে কাগজ আর চ্যানেলের মালিকরা সকলেই বড়-বড় শিল্পপতি। টাইমস গ্রুপের জৈনদের মতো অনেকের সংবাদ-ব্যবসাটাই মূল ব্যবসা। আবার ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস কাগজের মালিক গোয়েঙ্কারা বা হিন্দুস্তান টাইমসের বিড়লারা অন্য নানা ব্যবসাতে আছেন, আবার সংবাদের ব্যবসাতেও আছেন। সংবাদের ক্রেতা কারা? মূলত ভদ্রলোকেরা, চাষাভুষোরা নন। নব্বইয়ের দশকের অর্থনৈতিক উদারীকরণের ফলে নিশ্চয়ই মধ্যবিত্তের সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু তাতে সংবাদমাধ্যমের ক্রেতার চাহিদা বদলে যায়নি। যে পাঠক কাল কোনওমতে সংসার চালাতেন, তিনিও আজ হাতে কিছু বেশি টাকা পেয়ে বহু বছরের বড়লোকের মতোই শেয়ার বাজারের খবর চান, ব্যাঙ্কক বা ফুকেত বেড়াতে যান। কাল যে শ্রমিক কারখানায় ধর্মঘট করে দাবি আদায় করতে চাইতেন, আজ তাঁর আইটি এঞ্জিনিয়ার সন্তান ধর্মঘট করার অধিকার জরুরি বলে মনে করে না, ধর্মঘট কর্মনাশা বলেই মনে করে। তার সকালবেলার কাগজ তাকে তার পছন্দের কথাই পড়াতে চায়, তার প্রিয় চ্যানেল সে যা শুনতে চায় বা দেখতে চায় তা-ই দেখায়। নীল বিদ্রোহের যুগের হরিশ মুখার্জির কথা ভেবে লাভ নেই। বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের ভারতীয় প্রেসের কথা ভেবেও লাভ নেই। তখন পুঁজিপতি কাগজ মালিকদেরও লক্ষ ছিল স্বাধীনতা আন্দোলনকে শক্তিশালী করা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুঁজি যে পুঁজির নিয়মেই চলবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? শ্রমিক-কৃষকের আন্দোলনকে কেনই বা সে গুরুত্ব দিতে যাবে?

এ পর্যন্ত পড়ে অনেকেরই মন বিদ্রোহ করবে। আজকের ডিসটোপিয়া কি একেবারেই নতুন নয়? হ্যাঁ, নতুনত্ব নিশ্চয়ই আছে।

কৃষক-আন্দোলনের খবরকে প্রাপ্য গুরুত্ব না-দেওয়া এক জিনিস, আর আন্দোলনকে সরাসরি অতীতের এক বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া আরেক জিনিস। এটা নতুন, তবে এ-ও মনে রাখা ভাল যে, গত দশ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে দেগে দিয়েছে এই মিডিয়াই, ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলনকেও পাকিস্তানের চক্রান্ত বলে দেগে দিয়েছে এই মিডিয়াই। সেদিক থেকে এবারের আচরণটাও নতুন নয়।

আসলে লাভের কড়ি মূল কথা হলেও, দশ-পনেরো বছর আগে পর্যন্তও সংবাদমাধ্যমের মালিকরা মনে করতেন, কিছুটা সামাজিক দায়িত্ব তাঁদের আছে। এর পিছনে স্বাধীনতা আন্দোলনের স্মৃতি হয়তো একটা কারণ। অথবা হয়তো ভারতীয় মধ্যবিত্তের দুর্বলতর মানুষের প্রতি যে সহমর্মিতা ছিল, সেকথা মাথায় রেখে সংবাদমাধ্যম সবরকম লড়াই আন্দোলনকেই খবর হিসেবে দেখতে বাধ্য হত। এখন আর সে দায় নেই, কারণ মধ্যবিত্ত বদলে গেছে— ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে চলতি কৃষক-আন্দোলনের অন্যতম নেতা হান্নান মোল্লা সখেদে যা বলেছেন। হেতু যা-ই হোক, সংবাদমাধ্যমের মালিকরা আগে মনে করতেন সংবাদসংগ্রহ বিশেষজ্ঞের কাজ এবং সংবাদ পরিবেশন মানে আসলে, মোটের উপর, ক্ষমতার দোষত্রুটি প্রকাশ করা। সেই কারণেই দোর্দণ্ডপ্রতাপ ইন্দিরা গান্ধি জরুরি অবস্থা জারি করেও সংবাদমাধ্যমকে পোষা তোতাপাখি বানাতে পারেননি। বরুণ সেনগুপ্ত, গৌরকিশোর ঘোষ, কুলদীপ নায়ারের মতো সম্পাদকরা কারাবাস করে ফেরত এসে আবার কলম ধরতে পেরেছেন। অধুনা ক্ষমতার বিরুদ্ধে কলম ধরলে কারাবাস হয় পরে, আগে সাংবাদিকের চাকরি যায়। আজকের মালিক সংবাদসংগ্রহ চান না, চান মুনাফা বৃদ্ধির জন্য বিত্তবান ক্ষমতাশালীর অনুগ্রহ। যেমন দিল্লিতে, তেমনই রাজ্যে-রাজ্যে। এ কাজে বিশেষজ্ঞ লাগে না, লাগে যা-বলেন-তাই-লিখি বাহিনী। তাই চতুর্দিকে সাংবাদিক ছাঁটাই হচ্ছে, কাগজ বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে, চ্যানেল তুলে দেওয়া হচ্ছে এমন একটা সময়ে, যখন স্বাধীনতার পরে ভারতের অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপ, সামাজিক বিভাজন তুঙ্গে, বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে, মৌলিক সাংবিধানিক অধিকারগুলো নেহাত কথার কথা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। অর্থাৎ যখন আরও বেশিসংখ্যক এবং বেশি সমালোচক সাংবাদিক দরকার ছিল, সেই সময় সংবাদসংগ্রহের কাজটাই তুলে দেওয়া হচ্ছে। অজুহাত হিসেবে কয়েক মাস আগে ছিল কোভিড-১৯, এখন অর্থনৈতিক মন্দা। সিংঘুতে সংবাদসংগ্রহ করতে যাবে কে, লোক কোথায়? লোক যেন না থাকে সে ব্যবস্থাই তো করা হয়েছে সযত্নে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের মালিক রামনাথ গোয়েঙ্কাকে একবার এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন “আপনার অমুক রিপোর্টার খুব ভাল কাজ করছে।” রামনাথ তৎক্ষণাৎ সেই রিপোর্টারকে বরখাস্ত করেন। এখন যুগ বদলেছে। কোথায় কে কোন কাগজের সম্পাদক হবেন, অমুক চ্যানেলের তমুক জেলার সংবাদদাতা কে হবেন, তা-ও ঠিক করছেন মন্ত্রীরা। রবীশ কুমারের মতো কয়েকজন কথা শুনছেন না, ফলে দেখাই যাচ্ছে “ফিরিছে রাজার প্রহরী সদাই কাহার পিছু পিছু”। সুতরাং কোনটা খবর কোনটা নয়, কোনটা কত বড় খবর সেটাও যে মন্ত্রীসান্ত্রীরাই ঠিক করে দিচ্ছেন তা বোঝা কি খুব শক্ত?

আমরা যারা কাগজের পাঠক আর টিভির দর্শক, তারা না-বুঝলেও আন্দোলনকারী কৃষকরা বিলক্ষণ বোঝেন। তাই বেশকিছু চ্যানেলের সাংবাদিককে প্রোপাগান্ডা সংগ্রহে গিয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে।

 

তথ্যসূত্র

  1. https://theprint.in/theprint-essential/what-is-electricity-amendment-bill-2020-and-why-farmers-are-opposing-it/555186/
  2. https://indianexpress.com/article/india/hannan-mollah-idea-exchange-farmer-protests-farm-laws-7094428/
  3. https://www.firstpost.com/india/bad-journalism-makes-a-lot-more-noise-raj-kamal-jhas-speech-at-ramnath-goenka-awards-3088184.html
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4648 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...