![suramita](https://i1.wp.com/www.4numberplatform.com/wp-content/uploads/2021/01/suramita.jpg?resize=678%2C381&ssl=1)
সুরমিতা কাঞ্জিলাল
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্রী, পেশায় শিক্ষক
‘স্বর্গ যদি কোথাও থাকে, তা এখানে….’— অনেকেই সেইমতো দেশের নানা স্থানে স্বর্গ খুঁজে পেয়ে থাকেন। তাতে দোষের কিছু নেই। তবে স্বর্গ থাকলে বোধহয় নরক থাকাও বাধ্যতামূলক। অন্তত সাম্প্রতিক বেশকিছু তথ্য একথাই জানান দিচ্ছে, নরকও হেথায় উপস্থিত। নইলে প্রতিটি শ্বাসগ্রহণে এত বিষ আসে কোত্থেকে! না, শুধু ভারতবর্ষ অবশ্য নয়। বিষবায়ু ছড়িয়ে আছে সমস্ত দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে। মূলত ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশে। মহান মিলন যাকে বলে আর কি।
২০২০ সালে ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী ভারত এবং গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় বিষাক্ত বায়ুর ফলে মৃত্যুর হার সীমাহীন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এমনিতে ২০২০ সালে লকডাউন শুরু হওয়ার পরপর অনেকেরই হয়তো মনে হয়েছিল, দূষণ কমে গিয়েছে। প্রকৃতি তার ছন্দে ফিরছে এতদিন পরে। শহরের শুনশান রাজপথে নানান লুপ্তপ্রায় প্রাণীর আনাগোনা বেশ আনন্দ দিয়েছিল অনেককেই। ঝকঝকে আকাশ দেখা যাচ্ছিল। কাছেই কাঞ্চনজঙ্ঘা। সে এক স্বর্গীয় আনন্দই বটে৷ কিন্তু হারানো সম্পদ এত সহজে যে পুনরুদ্ধার হয় না, কিছুদিন পরেই দূষণের হার দেখে তা বোঝা গেল। লকডাউন যে প্রকৃতির ক্ষতচিহ্নে সামান্য প্রলেপও তৈরি করতে পারেনি, সেকথা প্রমাণিত। আশা করি, জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহেই বসন্তর প্রাদুর্ভাবে তা আরওই স্পষ্ট।
আপাতত কতগুলি তথ্যে মনোনিবেশ করা যাক। প্রতিবছর ভারতবর্ষ পাকিস্তান বাংলাদেশে নাকি প্রায় সাড়ে তিনলক্ষ গর্ভপাত বা মৃতশিশু প্রসবের ঘটনা ঘটে বায়ুদূষণের কারণে। ২০০০ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে যতগুলি গর্ভপাত ঘটেছে, তার সাত শতাংশই নাকি ঘটেছে বায়ুদূষণের জন্যে। একটি সমীক্ষায় মোট ৩৪,১৯৭ জন মহিলার একটি পরিসংখ্যান পাওয়া যাচ্ছে। যাদের অবশ্যই একবার অন্তত গর্ভপাত হয়েছে। আর সুস্থ সন্তানের জন্মও যারা দিয়েছেন। তাদের এই গর্ভপাতের কারণ হিসেবে বায়ুদূষণকেই দায়ী করা হচ্ছে। সেখানে দেখা গিয়েছে, ২৬,২৮২ জন ভারতের, ৪,২২৮ জন পাকিস্তানের আর ৩,৬৮৭ জন বাংলাদেশের।
এর মধ্যে অবশ্য উত্তরভারত ও উত্তরপাকিস্তানে গর্ভপাতের হার বেশি। মোদ্দায় বোঝাই যাচ্ছে, বায়ুদূষণ কীভাবে জনজীবনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শুরু করেছে। ‘দূষণ’কে সাধারণভাবে আমরা দূরের বিষয় বলেই ভেবে থাকি। দূষণ আছে, মারাত্মকভাবে আছে— তবু যেন তাকে অবিশ্বাস করতে পারলে ভালো। অথচ বায়ুতে বিষাক্ত ধূলিকণার মাত্রা এমনই মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছল, যে শিশুর জন্মই তা আটকে দিল বিস্তৃতভাবে।
এখানেই শেষ নয়। গর্ভপাত বা মৃতশিশুতে গিয়েই বায়ুদূষণের কৃতকর্ম বন্ধ হচ্ছে না। বায়ুদূষণের কারণে গত বেশকিছু বছরে মৃত্যুর হারও বেড়েছে অবিশ্বাস্য মাত্রায়। ল্যানসেট প্ল্যানেটারির জার্নালেই প্রকাশ শুধুমাত্র ২০১৯ সালেই, ১৬.৭ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে বায়ুদূষণের জন্যে। যা সামগ্রিক মৃত্যুর প্রায় আঠেরো শতাংশ। বায়ুদূষণ থেকে ফুসফুস ও হৃৎপিণ্ডের রোগসমূহ বাড়ছে তো বটেই। বাড়ছে নানান অক্ষমতাও।
ভারতের চারটি রাজ্যে বায়ুদূষণের মাত্রা সর্বাধিক— উত্তরপ্রদেশ, বিহার, মহারাষ্ট্র এবং পশ্চিমবঙ্গ। মুম্বাই বা কলকাতা, দিল্লি— এই শহরগুলিতেও ক্রমাগত মানুষ বায়ুদূষণের শিকার হচ্ছে, মৃত্যুর হারও এখানে কম নয়। আর এই মৃত্যু, এই ক্ষতি অবশ্যই প্রভাব ফেলে চলেছে অর্থনীতিতেও। বায়ুদূষণে মৃত্যুর এই ক্রমবর্ধমান তালিকা আর্থিক মন্দাকে যথেষ্ট ইন্ধন দিয়ে চলেছে। ল্যানসেটের রিপোর্ট অনুযায়ী, এই বহুল পরিমাণ মৃত্যু ২.৬ লক্ষ কোটির অর্থনৈতিক ক্ষতিতে দেশকে পৌঁছে দিয়েছে, যা ১.৪ শতাংশ জিডিপি হ্রাসের সমতুল। উত্তর ও মধ্যভারতে বায়ুদূষণে মৃত্যু ও আর্থিক ক্ষতির হার সবথেকে বেশি। সেই ক্ষতির নিরিখে এগিয়ে রয়েছে উত্তরপ্রদেশ। আর্থিক ক্ষতির হার সেখানে ২.২ শতাংশ। তারপরই আছে বিহার, সেখানে ক্ষতির হার প্রায় ২ শতাংশ।
ভারত ২০২৪ সালে নাকি পাঁচ লক্ষ কোটি ডলারের অর্থনীতির দেশ হবে। এমনটাই ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু এই বিপুল ক্ষয়ক্ষতি কীভাবেই বা দেশের আর্থিক মন্দার মোকাবিলা করবে? বায়ুদূষণকে হ্রাস করার পরিকল্পনা না নিলে মৃত্যু ঠেকানো প্রায় অসম্ভব। সেক্ষেত্রে গবেষকরা অনেকেই মনে করছেন, পরিবেশ সংক্রান্ত কোনও একটি নির্দিষ্ট নীতির আওতায় গোটা দেশকে এনে ফেলা সম্ভব হবে না। হয়তো একেকটি রাজ্যের জন্যে একেক ধরনের প্রক্রিয়া নিতে হতে পারে। কিন্তু যেভাবেই হোক, বায়ুদূষণ প্রতিরোধ করা আশু কর্তব্য।
প্রকৃতি-পরিবেশ নিয়ে আমাদের সচেতনতা বাস্তবিকই অতি দুর্বল। তারওপর লাগাম ছাড়া অত্যাচার তো আছেই। বনভূমি রক্ষার আইনকানুনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে অবাধেই লুঠ চলে। কিন্তু আর কতদিন?
অবশ্য, মৃত্যুর পরিসংখ্যান, ক্ষয়ক্ষতির হিসেবনিকেশ, তথ্য ইত্যাদি কোনও কিছুই আজকাল তেমন রেখাপাত করে না। অদ্ভুতুড়ে সামাজিক অবস্থা। একদিকে তীব্র অসহিষ্ণুতা, অন্যদিকে বায়ুদূষণ, অস্বাভাবিক হারে মৃত্যু, গর্ভপাত— এই সমস্ত বিষয়েই আমরা বেশ সহিষ্ণু, মেনেই নিয়েছি।
কোভিড ১৯-এর বিভীষিকা তো আছেই। কিন্তু দূষণে মৃত্যুও তো নেহাত কম নয়। তবু এই বিষয় নিয়ে আমরা বেশ অকুতোভয়ই। মিডিয়াও সুযোগ বুঝে এই তথ্যে তেমন গুরুত্ব দেয় না। লকডাউনের সময় প্রতিদিনই বিশেষজ্ঞদের গোলটেবিল বৈঠক হত বিভিন্ন সংবাদ-চ্যানেলে। পরিবেশ দূষণ কিন্তু ততটাই প্রয়োজনীয় একটি বিষয়, প্রতিদিনের আলোচনায় তাকে নিয়ে আসা একান্ত দরকার। নইলে আগামীদিনে ঘরবন্দি হয়েও বেঁচে থাকা সম্ভব হবে না। আমাদের ঘরের বায়ুও কোনওভাবেই আর বিশুদ্ধ নেই। নানান রাসায়নিকের দাপটে অনেক আগে থেকেই দূষিত। আর বায়ুদূষণের কিন্তু গবেষণাগার-লব্ধ কোনও ভ্যাক্সিন নেই। মুশকিল হল, পর্যাপ্ত দেরি হয়ে গেছে জেনেও দূষণকে ঘিরে সরকারি উদাসীনতা বহাল তবিয়তে বিদ্যমান। শোষণ ও লুঠও তার হাত ধরেই। ঠিক সেইরকমই আমাদের অবস্থানও। পরিবেশ দূষণকে ভুলে থাকাটাই স্বাভাবিক, নিউ-নর্মাল।
ঋণ:
- ডাউন টু আর্থ, কিরণ পাণ্ডে, ৭ জানুয়ারি, ২০২১
- স্ক্রোল স্টাফ, ২২ ডিসেম্বর, ২০২০