ভারতের বহু বিতর্কিত কৃষি আইন ২০২০

অনুপম পাল

 



কৃষিবিজ্ঞানী, কৃষি-আন্দোলনের কর্মী

 

 

 

 

কোভিড প্যানডেমিক পরিস্থিতিতে যখন সংসদ প্রায় অচল তখন ২০২০ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর কৃষি সংক্রান্ত আইন সংসদের রাজ্যসভায় ধ্বনিভোটে পাশ করানো হয়। সংসদে এই বিলটি নিয়ে আলোচনা হয়নি। তাই বলা হচ্ছে এটা অগণতান্ত্রিক। সরকারপক্ষের লোকজন বলছেন এক দেশ-এক কর ও এক দেশ-এক বাজার হলে ভালো।

২০২০ সালের এই কৃষি আইন নিয়ে গোটা ভারতে কৃষক সংগঠনগুলি তো বটেই, সাধারণ অকৃষক মানুষও এটার বিরুদ্ধে সোচ্চার। এর মধ্যে অল ইন্ডিয়া কিসান সংঘর্ষ কোঅর্ডিনেশন কমিটি উল্লেখ্য। কৃষকবিরোধী মানেই এক কথায় জনবিরোধী। কৃষি উৎপাদন ও বিপণনে কৃষকের সমস্য হলে সাধারণ অকৃষক ভোক্তাদেরও সমস্যা হবেই। ডিসেম্বর-জানুয়ারির শীত উপেক্ষা করে লক্ষ কৃষক দিল্লিতে হাজির হয়ে ওই আইন প্রত্যাহারের জন্য প্রতিবাদ জানাচ্ছেন, পরিবর্তন নয়। এখনও পর্যন্ত ৫০ জনের বেশি কৃষক মারা গিয়েছেন। আত্মহত্যার মত ঘটনাও ঘটেছে। অত্যন্ত হৃদয়বিদারক। সেই অন্নদাতাদের উপর জলকামান ও নানা দমনমূলক ব্যবস্থাও চালানো হয়েছে। তাঁদের দেশদ্রোহী ও বিচ্ছিন্নতাকামী বলা হচ্ছে। সমগ্র পৃথিবীতে এটাই সবচেয়ে বড় কৃষক প্রতিবাদসভা। সরকারের সঙ্গে আলোচনা চলছে। ফলপ্রসু হচ্ছে না। পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ হরিয়ানা পাঞ্জাবের অসংখ্য কৃষক প্রায় এক মাস ধরে দিল্লিতে গণ অবস্থানবিক্ষোভ করছেন এই শীতের মধ্যে। প্রশ্নটা হল পাঞ্জাব পশ্চিম উত্তরপ্রদেশ এই অঞ্চলের কৃষকরা এই দাবিটা নিয়ে সোচ্চার কেন। আসলে পাঞ্জাবে যে কিসান মান্ডিগুলো ছিল সবুজ বিপ্লবের সময় থেকেই সেগুলো খুব সক্রিয় এবং কিসান মান্ডিগুলোর জন্যই কৃষকরা এতদিন বেচাকেনা ঠিকঠাক করতে পেরেছেন।

আইন তিনটি হল:

  1. দি ফার্মার্স প্রডিউসার ট্রেড অ্যান্ড কমার্স (প্রমোশন অ্যান্ড ফেসিলিটেশন) আইন ২০২০, বাংলাতে কৃষিপণ্য বাণিজ্য আইন (প্রচার ও সুবিধাকার্য)।
  2. ফার্মার্স (এমপাওয়ারমেন্ট এন্ড প্রোটেকশান) এগ্রিমেন্ট অফ প্রাইস অ্যাসুরেন্স অ্যান্ড ফার্ম সার্ভিসেস আইন ২০২০বা কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তির মূল্য নিশ্চিত করণ ও খামার পরিষেবাদি আইন ২০২০।
  3. এসেনশিয়াল কমোডিটিস আইন (অ্যামেন্ডমেন্ট) ২০২০ অথবা অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন (সংশোধন) ২০২০।

আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই আইনগুলির ফলে কৃষকদের খুব সুবিধা হবে। সেই নিয়েই এই আল‌োচনা। ভারতবর্ষের কৃষকরা বহুকালই ধরেই নিজেদের নায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত। মুষ্টিমেয় ব্যাতিক্রমী কৃষক অবশ্যই আছেন। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে কৃষক বিদ্রোহ। ব্রিটিশ রাজত্ব এবং তারপরেও আমাদের দেশে বহু কৃষক বিদ্রোহ হয়েছে। সেই ট্র্যাডিশন আজও সমানে চলছে।

এই বিল পাশ করিয়ে আইন করার পিছনের ইতিহাসটা এবার একটু দেখে নেওয়া যাক। আপনারা জানেন যে ভারত সরকার বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তিতে সই করেছেন নব্বইয়ের দশকে। তখন কংগ্রেস সরকার কেন্দ্রে ক্ষমতায় ছিল। ওই চুক্তির এগ্রিমেন্ট অন এগ্রিকালচার (এওএ)-এ বলা আছে যে সরকারকে কৃষি বাণিজ্য ও বিপণনের উপর থেকে ক্রমশ হাত তুলে নিতে হবে। কৃষক নিজের সুবিধামত বিক্রি করবে এবং তাকে গোটা বিশ্বে বিক্রি করার সুযোগ দেওয়া হবে, যেখানে খুশি বিক্রি করার সুযোগ দেওয়া হবে, মোদ্দা কথা তার পণ্য রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে বিক্রি হবে। এটা শুনতে বেশ ভালো লাগে। কিন্তু বাস্তবে ভারতবর্ষের কৃষকরা এই অবস্থাতে নেই যে তারা সরাসরি বিশ্ববাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হতে পারবেন। এটা  অবাস্তব এবং অসম্ভব ঘটনা। অথচ এই সরকার খাতায়কলমে সেটাই দ্রুত কার্যকর করতে চাইছেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, ওই চুক্তির পর রাষ্ট্রের কল্যাণকর দিকগুলি সঙ্কুচিত হয়েছে। ওই চুক্তিতে আরও বলা ছিল, জমির উপর অন্তত ২০ শতাংশ কৃষকের নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। জমি ছেড়ে কৃষককে শহরমুখী হতে হবে, কারখানায় কাজ করতে হবে। এটাই হল নতুন ডিজাইন, তথাকথিত উন্নতির লক্ষণ। তাহলে কৃষির অবস্থা কী হবে?

ওই চুক্তিতে আরও বলা আছে উন্নত দেশগুলি কৃষিতে প্রচুর ভর্তুকি দিতে পারবে, অথচ তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ভর্তুকির পরিমাণ নিয়ে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ গরিব দেশ যেখানে কৃষকরা ফসল ফলিয়ে নিজেদের জীবনধারণ করেন— এমন অসংখ্য কৃষক ভারতবর্ষে রয়েছেন— তাঁদের উপর থেকে ভর্তুকি কমিয়ে দিতে হবে এবং ভারত সরকার সেই চুক্তিতে সই করেছে। এই ভর্তুকি কমানোর বিষয়টিকে বলা হয় অ্যাম্বার বক্স ভর্তুকি।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে যে কোনও ফসল চাষের মোট খরচের ১০ শতাংশের বেশি দেওয়া যাবে না এবং বেশি দিলে ভারত সরকারকে দোষী সাব্যস্ত করা হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা ভারত সরকারের এই এমএসপি-র উপরে খড়গহস্ত। তারা বলছেন এমএসপি-তে ফসল কিনলে সেটা বাণিজ্যের পক্ষে ঠিক হবে না। অর্থাৎ অন্য কথায়, ভারতে এইসব প্রথম বিশ্বের দেশগুলির বাণিজ্যের পক্ষে ঠিক হবে না। বলা হচ্ছে যে, ভর্তুকির ফলে বাণিজ্য বিকৃত হবে অর্থাৎ এককথায় এগুলি ট্রেড ডিস্টরটিং ভর্তুকি। এটাই নাকি তাদের কথায় বিশ্ব কৃষি সংস্কার। বিশ্ব বাণিজ্যে চুক্তি অনুযায়ী কৃষককে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য প্রদান করা অনৈতিক কাজ। অথচ উন্নত দেশগুলিতে কৃষককে গ্রিন বক্স ভর্তুকি দেওয়ার কোনও সীমা নেই। গড়ে একজন মার্কিন খামারমালিক বছরে ভারতীয় টাকার হিসেবে ৪৫ লক্ষ টাকা পায় আর একজন ভারতীয় কৃষক পায় প্রায় ২০ হাজার টাকা। ২০০৭ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে উন্নত দেশগুলির গ্রিন বক্স ভর্তুকি তুলে নেওয়া হলে কানাডা, ইওরোপ ও আমেরিকার রপ্তানি ৪০ শতাংশ কমে যাবে। ভারতের কৃষকদের যদি পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেওয়া হয় তাহলে ঋণের দায়ে আত্মহত্যাকারী কৃষকের সংখ্যা উদ্বেগজনক কেন?

প্রথম আইন— কৃষি পণ্য বাণিজ্য আইন (প্রচার ও সুবিধাকার্য) ২০২০। এই আইনের দ্বারা এপিএমসি-র (এগ্রিকালচারাল প্রডিউস মার্কেটিং কমিটি) আওতাভুক্ত কৃষক-বাজারের (মান্ডি) বাইরে ও রাজ্যের বাইরে পণ্য বিক্রি করা যাবে। রাজ্য সরকার এর থেকে আর ক‌োনও লেভি আদায় করতে পারবে না। কমিশন এজেন্টরা কোনও দালালি পাবেন না। তাহলে একদিকে রাজ্যের আয় কমল। এই রাজ্যে ২০১৭ সালে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করে মুক্ত বাণিজ্যের পক্ষে ওই আইনের সংশোধন করা হয়েছে। কিন্ত ৭০-এর দশকে এপিএমসি করা হয়েছিল সার্বিকভাবে কৃষকদের স্বার্থ দেখার জন্য, বড় ক্রেতাদের একচেটিয়া ক্ষমতাকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। নিলামের মাধ্যমে ফসল বিক্রি হত, চাষিরা নূন্যতম সহায়ক মূল্যও পেতেন। এখন তার আর কোনও প্রয়োজন থাকছে না। এখন নিলাম ছাড়াই বড় দালাল, বড় পুঁজির আড়তদাররা সহজেই পণ্য কিনে নেবেন নূন্যতম সহায়ক মূল্যের বাধ্যবাধকতা ছাড়াই। এই প্রক্রিয়ায় সরকারি কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। সবটাই বেসরকারি হাতে যাচ্ছে। অবশ্য নূন্যতম সহায়ক মূল্যের সুযোগ খুব কম কৃষকরাই পায়। বেশিরভাগ কৃষক পাঞ্জাব হরিয়ানা ও পশ্চিম উত্তরপ্রদেশেই মান্ডির সুযোগসুবিধা পেয়ে থাকেন, ভারতের অন্য রাজ্যে মান্ডি থেকে বিক্রি খুবই কম হয়। সরকারি তথ্যে জানানো হয়েছে মাত্র ৬ শতাংশ কৃষক ওই মান্ডিতে বিক্রির সুযোগ পায়। সেই সুযোগ যাতে বেশি পায় সেই ব্যবস্থা করা হল না। পাঞ্জাব ও সন্নিহিত অঞ্চলে ১২০০র বেশি কিসান মান্ডি আছে য়েখানে কৃষকরা ধান ও গম মূলত এমএসপিতে বিক্রি করে নিজ নামে। সাধারণত কোনও কালোবাজারি নেই। ওই রাজ্যে আমনে প্রায় ৮০ শতাংশ জমিতে ধান ও রবিতে ৮০ শতাংশ জমিতে গম হয়। কিন্ত পাঞ্জাবের বাসমতী ধানের জন্য কোনও এমএসপি নেই। কৃষকদের দাবি ওই ধানের জন্য এমএসপি চালু করতে হবে। সবটাই ওই মান্ডিতেই বিক্রি হয়। কমিশন এজেন্ট ফুড কর্পোরেশন দ্বারা নিয়োজিত। কৃষকদের থেকে ধান সংগ্রহ করা বাবদ কমিশন পান এবং এর জন্য কৃষকের থেকে কোনও অর্থ কাটা হয় না।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য বা এমএসপি মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইস। সত্তরের দশকে এই আইন চালু করা হয়েছিল বড় ব্যবসাদার এবং বড় দালালদের হাত থেকে কৃষককে রক্ষা করার জন্য। বাজারে তারা নিজের খুশিমতো কৃষকের থেকে পণ্য কিনতে পারবেন না। লক্ষ করে দেখুন একজন কৃষক যখন রাসায়নিক সার, বীজ, কীটনাশক একটা নির্দিষ্ট দামে কিনছেন, তারপরেও তিনি তাঁর নির্ধারিত দামে কৃষিপণ্য বিক্রি করতে পারছেন না। দাম নিয়ে প্রচুর জায়গায় গণ্ডগোল। সেই কারণে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করে দেয় যাতে কৃষকরা একটা রক্ষাকবচ পান। সেই দামের নিচে কেউ কিনতে চাইলে কৃষকরা প্রতিবাদ করতে পারেন— এইটা সরকারি দাম, এই দামেই কিনতে হবে। যদি খোলাবাজারে দাম পড়ে যায় তখন সরকার-প্রদত্ত এমএসপি রক্ষাকবচ হয়ে দাঁড়াবে।

এখন এই রক্ষাকবচটা আর থাকছে না। যার ফলে কৃষকরা আতঙ্কিত। যেভাবে তারা এতদিন কিসান মান্ডিতে তাদের ফসল বিক্রি করেছেন এখন সেটা হবে না। সরকার পক্ষের লোকজন বলছেন, না এমএসপি উঠে যাচ্ছে না। কৃষকরা দ্বিধাবিভক্ত। বিশ্ব বাণিজ্য চুক্তিতে বলা হয়েছে যে এমএসপি তুলে দিতে হবে।

আকাশছোঁয়া হবে ফসলের দাম, এখন যেকোনও পয়সাওয়ালা বেসরকারি কোম্পানি বা ফড়ে বাজারের সব পণ্য কিনে মজুত করতে পারবেন, কোনও ঊর্ধ্বসীমা নেই। বিশেষ কিছু গোষ্ঠী ও ক‌োম্পানি যেমন ওয়ালমার্ট, আদানি, রিলায়েন্স, পেপসিকো ইত্যাদির দিকে নির্দেশ করা হচ্ছে। সময়মত তিনি বাজারে বেশি দামে ছাড়তে পারেন। ফলে আমজনতার ট্যাঁকের পয়সায় টান পড়বে। চালের দাম বা আলুর ৮০ টাকা হওয়া অমূলক নয়। যারা ভাবছেন ওটা কৃষকদের ব্যাপার তারাও ভুগবেন। তাহলে এবার প্রশ্ন হল সরকারি এফসিআই-এর গোডাউনের কী হবে, রেশন ব্যবস্থার কী হবে। সরকার তো কিনছে না, মজুতও করছে না।

এমএসপি নির্ধারণ করা হয় কৃষকের শ্রমের দাম সহ উৎপাদন খরচ এবং তার সঙ্গে ৫০ শতাংশ যোগ করে। কিন্তু এটা সবসময় মেনে চলা হয় না। প্রত্যেক বছর কিছু না কিছু বাড়ানো হয়। তবে সেটা চাকুরিজীবিদের মাইনে বাড়ার অনুপাতে কিছুই নয়। ভারতে তেত্রিশটি ফসলের মধ্যে ২২টি ফসলের জন্য ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা করা হয়। এবছরও করা হয়েছে। যেমন ধানের দাম সর্বোচ্চ ১৮৮৮ টাকা।

২০২০ সালে কয়েকটি ফসলের কুইন্টাল প্রতি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (টাকায়)

ক্রমিক সংখ্যা ফসল সহায়ক মূল্য ক্রমিক সংখ্যা ফসল সহায়ক মূল্য
ধান ১৮৮৮ রাগি ৩২৯৫
গম ১৯২৫ অড়হর ৬০০০
ভুট্টা ১৮৫০ মুগ ৭১৯৫
তিল ৬৮৫৫ ১০ সরিষা ৪৪২৫
বাদাম ৫২৭৫ ১১ পাট ৩৯৫০
ছোলা ৪৮৭৫ ১২ বাজরা ২১৫০

কৃষি উৎপাদন বাজার কমিটি এপিএমসি-র বাইরেই এতদিন কৃষকের উৎপাদিত ফসল বিক্রি হত। কিন্তু দেখা গেছে যে বেশিরভাগ অড়হর ও ছোলা মূলত এই বাজারে বিক্রি হয়। আবার কেরল ও বিহার ইত্যাদি রাজ্যে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের ওপর আরও বেশি দাম নির্ধারণ করা হয়েছে যাতে কৃষকরা ন্যায্য মূল্য পান। যেমন কেরলে ধানের দাম ২৭৫০ টাকা কুইন্টাল। ধানের কিন্তু বিভিন্ন গ্রেড আছে যেমন কালো চাল সুগন্ধি, লাল চাল, সরু চাল, বাসমতী। সেই সব চালের কোনও এমএসপি নেই। আবার বাস্তবে বহু জায়গায় দেখা যাচ্ছে অনেক ক্ষেত্রে এক কুইন্টাল ধানের থেকে ৫ থেকে ১০ কেজি পরিমাণ কিসান মান্ডিতে বাদ দেওয়া হয় (ধলতা— ভিজে ধান, চিটে ধান ইত্যাদি অজুহাতে)। তাহলে কৃষকরা কিন্তু এক কুইন্টাল ধান দিয়ে ৯০ কেজি ধানের দাম পাচ্ছেন‌, অর্থাৎ ১৬৯২ টাকা। পাঞ্জাবে এই ধরনের ঘটনা বিরল। আবার ধান জমি থেকে মান্ডি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়ার ধকলও আছে। বাড়ি থেকেই বহু কৃষক ১২০০ টাকায় বা তার কম টাকায় ধান বেচে দিচ্ছেন। ক্যাশ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। মান্ডির ক্ষেত্রে বিক্রিত অর্থ অনলাইনের মাধ্যমে কৃষকের ব্যাঙ্কে পাঠানো হয়। তাতে দু-এক দিন থেকে মোটামুটি এক সপ্তাহ সময় লাগে। কোনও ক্ষেত্রে ধান কেনার তারিখও দেরিতে পড়ে। আবার পঞ্জাব থেকে আলু বিক্রি করে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফেরার সময় কিছু অসাধু আলুবীজ বিক্রেতারা ক্রেতা হয়ে ট্রাক ভর্তি করে কম দামে ধান কিনে নিয়ে পাঞ্জাবের মান্ডিতে এমএসপিতে বিক্রি করতে পারে। সেটা অন্য রাজ্যের ক্ষেত্রেও সম্ভব।

পশ্চিমবঙ্গে কালাভাত, বাদশাভোগ, তুলাইপাঞ্জি, কালোনুনিয়া ও গোবিন্দভোগের কুইন্টাল ৩০০০ টাকার বেশি যাচ্ছে। দুধের সরের দামও কুইন্টাল ২০০০ টাকা। এগুলি ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এবং বাইরের বাজারেই বিক্রি হচ্ছে কোনও কিসান মান্ডি থেকেও বিক্রি হচ্ছে না।

দ্বিতীয় আইন— কৃষকদের (ক্ষমতায়ন ও সুরক্ষা) চুক্তির মূল্য নিশ্চিতকরণ ও খামার পরিষেবাদি আইন ২০২০। মূলত এখানে চুক্তিচাষ নিয়ে কথা বলা হয়েছে। এটা অবশ্য নতুন নয়। বিভিন্ন ফসলে মৌখিক বা আলগা চুক্তিতে এখানে আলু ভাজার আলু, পোলট্রি ইত্যাদি চাষ হচ্ছে। কেউ জমি নিচ্ছেন না। এখানে চুক্তিচাষকে আইনি মান্যতা দেওয়া হল। ক্রেতার সঙ্গে যৌথ আল‌োচনার ভিত্তিতে লেখাপড়া করে ফসলের দামের চুক্তি হচ্ছে। বলা হচ্ছে কৃষকের না পোষালে তাঁকে বিক্রি নাও করতে পারেন। কোম্পানিরা পয়সার লোভ দেখিয়ে রপ্তানিযোগ্য ফসলেরও চাষ করাতে পারে। আশঙ্কা এই— খাদ্য ফসলের চাষ কমে গিয়ে খাদ্যাভাব দেখা না দেয়, যেমন হয়েছে আফ্রিকার দেশগুলোর। এই চুক্তি রূপায়ণ ঠিক না হলে, দাম নির্ধারণের বিষয়টি কীভাবে হবে, ফসল বিমা, কৃষকের আইনি সুরক্ষা ও রক্ষাকবচ ইত্যাদি নিয়েও সন্দেহ থাকছে। বর্গাদার ও ভাগচাষির কী অবস্থা হবে? চুক্তিচাষের আইনি সমস্যার নিষ্পত্তি করতে বলা হয়েছে জেলা ও মহকুমার শাসককে। কৃষকরা আদালতে যেতে পারবেন না। কৃষকদের আমলার উপর নির্ভর করতে হবে। এখানেও সন্দেহ, রায় কৃষকের বিপক্ষে যাবে না তো। কারণ ক‌োম্পানি অর্থ ও প্রভাব প্রতিপত্তি খাটাবেন এবং আমলাতন্ত্রকে নিজের পক্ষে নেবেন।

তৃতীয় আইন— অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন (সংশোধন) ২০২০। ১৯৫৫ সালের এই আইনের বলে চাল, গম, চিনি, ডাল, তেল ইত্যাদি নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য, কেউ ইচ্ছা করলে মজুত করতে পারতেন না, করলেও মজুত করার একটা নির্দিষ্ট সীমা বা পরিমাণ ছিল। এর জন্য ওই আইন মোতাবেক শাস্তির বিধান ছিল। এখন ২০টির বেশি অত্যাবশ্যকীয় পণ্যকে ওই তালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। সুতরাং ইচ্ছা করলেই বড় বেসরকারি ব্যবসায়ীরা যত ইচ্ছা খাবার মজুত করতে পারবেন। খোলা বাজারে খাবার ছাড়া এবং দাম তিনি বা তারাই নিয়ন্ত্রণ করবেন। শুধুমাত্র কৃষিপণ্যের দাম বাজার দামের দ্বিগুণ হলে, যুদ্ধ ও জরুরি অবস্থা ও দুর্ভিক্ষের সময় সরকার হস্তক্ষেপ করবে। অন্য সময় বেসরকারি দালালরা  নিজেদের মত করে কারবার করবে। এই কর্পোরেটমুখী বাজারব্যবস্থায় আমাদের আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে যে এই নতুন আইন বাজারকে অগ্নিমূল্য করে দেবে ও চাষিও উপযুক্ত দাম পাবেন না। অর্থাৎ জনগণের প্রতি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের কল্যাণকর দিক আর থাকছে না। ১২ জানুয়ারি সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপ করে ওই তিনটি আইন আপাতত কার্যকর না করতে বলেছেন। এই নিয়ে চার সদস্যের এক কমিটি গঠন করলেও ইতিমধ্যে তাঁদের একজন ইস্তফা দিয়েছেন এবং বলেছেন যে কৃষকদের স্বার্থের পরিপন্থী এমন কোনও কিছুর সঙ্গে তিনি যুক্ত হবেন না। অতএব তিনি পক্ষান্তরে স্বীকার করে নিলেন যে এই কমিটি কৃষকদের স্বার্থ দেখার জন্য তৈরি হয়নি। তাই অতি সঙ্গত কারণেই কৃষকরা তিনটি আইনকে বাতিল করার দাবি করছেন।

বাজারব্যবস্থা ভালো করতে হবে এবং এগুলির সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। এমএসপি সহ দরকার কৃষকদের জন্য ন্যূনতম নিশ্চিত আয় প্রকল্প ও শস্যবিমা। রাসায়নিক কৃষি উপকরণের ব্যবহার কমিয়ে জৈব আঞ্চলিক উপকরণের উপর জোর দিতে হবে। দেশজ উচ্চফলনশীল বীজ ব্যবহার, সমবায় ও কৃষক উৎপাদনগোষ্ঠী গঠন করতে হবে। উৎপাদন ব্যয় কমানো ও পরিবেশ সুরক্ষা, বিষমুক্ত খাবার ও জনস্বাস্থ্যের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। নিজের বীজ নিজে উৎপাদনের মত কাজের বাস্তবায়ন করতে হবে। রপ্তানিমুখী ও চুক্তিচাষ করতে গিয়ে দেশের খাদ্যসুরক্ষা যেন বিপন্ন না হয়। আশার কথা কৃষি কল্যাণে নানা জায়গায় ক্ষুদ্র উদ্যোগে হলেও জৈব কৃষি ও কৃষিবিমার মত কিছু ব্যবস্থা শুরু হয়েছে।

 

তথ্যসূত্র:

  1. The Gazette of India, Bill No 33, 34 and 35, Ministry of Law and Justice, June 5, 2020. (Farm Bills)
  2. কার স্বার্থে বিজেপির নতুন কৃষি আইন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, অক্টোবর ২০২০
  3. কৃষি বিল ২০২০, প্রচার লিফলেট, বিজেপি, ২০২০
  4. Farm Laws Led to Jump in April. Firms, Govt Data, Hindustan Times of India, Dec 19, 2020, New Delhi.
  5. Don’t Caught up in MSP battle, India Must Move to end inequality in WTO laws, The Print, Amiya Pratap Singh and Urvi Tembey, 15 Dec , 2020
  6. Explainer, Why are the Agriculture Bills being opposed, The Hindu, Sept 16, 2020
  7. Farmers need assured income, even rich nations pump massive subsidy into agriculture, Agri Expert Devinder Sharma, Anju Agnihotri Chaba, The Indian Express, December 30, 2020, Jalandhar

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4660 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...