নাজিশ ব্রোহি
অনুবাদ : সাগরিকা শূর
নাজিশ ব্রোহি পাকিস্তানের সোশ্যাল সেক্টর কনসাল্ট্যান্ট। লেখক। ডন, হেরাল্ড, জং প্রমুখ সংবাদপত্রে নিয়মিত লেখেন। ভারতের ডেকান ক্রনিকলেও নাজিশের লেখা নিয়মিত প্রকাশিত হয়। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক একজন বিশ্বখ্যাত বিদ্বজ্জন, সাহিত্য-তত্ত্ববিদ ও দার্শনিক। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের পদে তিনিই প্রথম অশ্বেতকায় মহিলা। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্সটিটিউট অফ কম্পারেটিভ লিটারেচার অ্যান্ড সোসাইটি প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি তিনি ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়, স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্টিনের টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্টা ক্রুজ ও দিল্লীর জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়েও অধ্যাপনায় নিযুক্ত ছিলেন। তিনি এগারোটি বই ও বেশ কিছু সাহিত্যমূলক প্রবন্ধ রচনা করেছেন। জটিল তত্ত্বসমূহকে ছোট ছোট শব্দবন্ধে পরিণত করার ক্ষেত্রে স্পিভাকের দক্ষতা অসাধারণ এবং সেই সমস্ত শব্দবন্ধ বিভিন্ন সময় সার্বজনীন অধ্যয়ন পরিভাষার অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ও অসংখ্য তত্ত্বালোচনারও জন্ম দিয়েছে। কিন্তু স্পিভাক কখনোই একজন গজদন্তমিনারে বসবাসকারী অধ্যাপিকা নন। তিনি পশ্চিমবঙ্গে ছোটদের জন্য বেশ কিছু স্কুল তৈরী করেছেন যেখানে তিনি নিজে নিয়মিত পড়ান। বিভিন্ন বই ও তিনি অনুবাদ করেছেন - 'অফ গ্র্যামাটোলজি' বইটির অনুবাদের মাধ্যমে তিনি ফরাসী দার্শনিক, বিনির্মাণ বা 'ডিকন্সট্রাকশন' তত্ত্বের জনক জাঁক দেরিদাকে ইংরাজি-ভাষী বিশ্বের দরবারে জনপ্রিয় করে তোলেন, অন্যদিকে অন্যতম বাংলা সাহিত্যিক ও কর্মী মহাশ্বেতা দেবীকেও পৌঁছে দেন বৃহত্তর সাহিত্যমহলে। স্পিভাকের প্রথম ডিগ্রী সংগীতে। "আমি নাচের ক্লাস থেকে পালিয়ে যেতাম, কারণ আমার ইন্সট্রাক্টর আমায় তবলার হাতুড়ি দিয়ে মারতেন। কিন্তু আমি প্রশিক্ষিত গায়িকা।" শিক্ষামহলে স্পিভাকের পরিচিতিও বিবিধ। তিনি 'রক স্টার গডেস অফ পোস্ট কলোনিয়াল স্টাডিজ', 'সেলেব্রিটি মার্ক্সিস্ট ফেমিনিস্ট স্কলার' এবং 'ওয়ার্ল্ড'স প্রি-এমিনেন্ট থিঙ্কার' প্রভৃতি অভিধায় ভূষিত। অন্যদিকে তাঁর সমালোচকরা বলেন তিনি দুর্বোধ্য, এমনকি তিনি অস্পষ্টতার ভান করেন এবং কয়েকটি ক্ষেত্রে তিনি স্বৈরাচারীও বটেন। কিন্তু স্পিভাক দু'পক্ষের বক্তব্যই অস্বীকার করেন।এই স্তাবকতাকে তিনি পূর্বসূরিদের আরাধনা করার অভ্যাস বলে ব্যাখ্যা করেছেন - যা আসলে "ইমি তাসিয়ো ক্রিস্তি" বা "খৃষ্টের অনুকৃতির"-ই নামান্তর। তাঁর জটিল, শক্তিশালী লেখনীর বিষয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করা হলে তাঁর উত্তর - মানুষ যখন সহজ ভাষা দাবী করে, তখন আসলে তারা সরল চিন্তা প্রত্যাশা করে। কঠিন শব্দপ্রয়োগের জন্য অভিযোগের উত্তরে তিনি আমায় 'শব্দার্থগত' শব্দটা নিয়ে প্রশ্ন করেন। “আপনি 'শব্দের মধ্যে পার্থক্য' না বলে 'শব্দার্থগত পার্থক্য' বললেন কেন? আপনি সেরকম মানুষ যারা 'বই' (book) এর বদলে 'পাঠ' (text) কথাটা ব্যবহার করেন”। স্পিভাককে বোঝানো খুব কঠিন, আর সেটা শুধুমাত্র ওঁর নিজের বিষয়গুলোর ক্ষেত্রেই নয়। উনি একজন নাস্তিক। আঘাত করে বা উত্তেজিত হয়ে কথা বলাই ওঁর স্বভাব, তবু ছাপার আগে তিনি এই সাক্ষাৎকারের প্রতিলিপি দেখতে চান, পাছে তিনি যা বলেছেন তাঁর জন্য পরে তাঁর অনুশোচনা হয়। উনি ক্যাম্পাসে চলাফেরা করেন শাড়ির সঙ্গে কম্ব্যাট বুট পরে। “গ্রামের লোকেরা (পশ্চিমবঙ্গের) আমার চুল দেখে বিধবার ছাঁট মনে করে, তাই ও নিয়ে কোনও সমস্যাই নেই”, তিনি বলেন। গায়ত্রী পরে ছিলেন মোনালিসার মাথাপট্টি বাঁধা, প্রাচ্যরূপ দেওয়ার ছবি-সম্বলিত একটা টি-শার্ট। কিন্তু পোশাকের ব্যাপারে ওনার খুব মাথাব্যথা না থাকলেও আমার সাথে ওনার যখন দেখা হয় উনি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে যান। “এটা (শার্ট) একেবারে বাজে। এখানে কোনও একজন আমাকে এটা উপহার দিয়েছিল। জিমে পরে যাওয়ার মতো আর কিছু নেই বলে এটাই পরতে হল” - খুব উত্তেজিত হয়ে উনি বললেন। হোটেল লবিতে বসে ডিপ-ফ্রায়েড প্রণ খেতে খেতে আর জিমে যাওয়ার গুরুতর দরকারটা বোঝাতে বোঝাতে অপ্রতিরোধ্য প্রতিভা, শ্লেষ, দুর্দান্ত আকর্ষণ, আর হঠাত আত্মবিরোধিতা কিংবা উত্তেজনা নিয়ে তাঁর সাবলীল বাচনভঙ্গিতে প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলেন স্পিভাক। এখানে রইল তারই কিছু অংশ ।
নাজিশ ব্রোহি – পাকিস্তানের সাধারণ পাঠক আপনার অ্যাকাডেমিক কাজকর্ম সম্পর্কে খুব একটা ওয়াকিবহাল নন। তাঁরা প্রথমে আপনার ব্যক্তিসত্তাকে চিনবেন, না আপনার রাজনৈতিক সত্তাকে?
স্পিভাক – দু’টোর মধ্যে খুব তফাৎ নেই। আমার কাজকর্ম সবই আমার পড়ানো আর লেখার মধ্যে দিয়েই। এগুলোই আমার জীবনকে গড়ে তুলেছে।
ব্রোহি – ধীরে ধীরে এই যে হয়ে-ওঠা, এ-নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতাগুলো যদি আমাদের সঙ্গে শেয়ার করেন…
স্পিভাক – আমার সত্তর বছর বয়স হয়ে গেছে, কিন্তু আমার নির্মাণ সম্পূর্ণ হয়ে গেছে এই কথা বলা মুশকিল। আমি সবসময় শিখি। এখনও শিখছি। আমার প্রথম স্মৃতি বাংলার ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের। একটা শিশু হিসেবে ওটা আমার কাছে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল। ওই সময় রেশনের যে খাবার আমরা পেতাম তাও ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। আমার এখনও মনে আছে, কঙ্কালসার কিছু মানুষ কোনোরকমে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনের দরজায় এসে দাঁড়াত আর ফেলে দেওয়া ভাতের মাড় চাইতো। মানুষ মরছিল প্রায় সর্বত্র।
এর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর – আমি তখন ক্যালিফোর্নিয়ায় – দৌড়তে গিয়ে আমার স্ট্রেস ফ্র্যাকচার হয়। ডাক্তারবাবু এক্স-রে দেখে আমায় জিজ্ঞেস করেন আমি কোথায়, কবে জন্মেছি। আমি যখন ওনাকে বলি, উনি ওনার ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশনের হ্যান্ডবুক খোঁজেন, তারপর শুধু বলেন, “দুর্বল হাড়।” অর্থাৎ, সেই ছোটবেলার খাওয়াদাওয়া-সংক্রান্ত সমস্যার জের, এতদিন পরেও। এমনই ভয়াবহ ছিল এই দুর্ভিক্ষ, যে শুধু গরীব মানুষই নন, অপুষ্টির শিকার হয়েছিল মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েরাও।
এরপর দেশভাগ। ১৯৪৬ সাল, আমি তখন স্কুলে। স্কুল হঠাত বন্ধ হয়ে গেল। আমাদের বাড়ির কিছু পর থেকেই ছিল মুসলিম মহল্লা।
আমার মনে আছে প্রায় সারারাত ধরে আমি ‘হরিবোল হরি’ আর ‘আল্লাহু-আকবর’ বলে চিৎকার শুনতে পেয়েছি। আমার বাবা সমস্ত ভেদাভেদের বিরুদ্ধে গিয়ে মুসলিমদের আমাদের বাড়িতে আশ্রয় দেন। ওঁর মুসলিম ছাত্ররা ওঁকে সতর্ক করত – কখন বাড়ি থেকে বেরোনোর ঠিক সময়, কোন ফোনটা ধরা চলবে না – এই সমস্ত ব্যাপারে। উনি শান্তিপ্রিয় মানুষ ছিলেন, ঠিক আমার মায়ের উল্টো, কারণ আমার মা ওঁর প্রজন্মের মহিলাদের মতোই সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাস করতেন, যদিও উনি নিজে ছিলেন অহিংস।
আমি হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে কিছু বিভেদজনিত উন্মত্ততা দেখেছি। আর ঠিক সেইজন্যই ধর্মকে রাজনীতির মধ্যে ঢোকানো কিংবা ধর্মবিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা কার্যকলাপ আমার এতো অদ্ভুত লাগে।
ব্যাচেলর ডিগ্রির পর আমি অ্যামেরিকায় যাওয়ার জন্য টাকা জোগাড় করতে শুরু করি, কারণ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরাজি পড়ানোর ধরণ নিয়ে আমার যথেষ্ট সংশয় ছিল। আমার নিজের ওপর যথেষ্ট আস্থা ছিল যে আমি যা চাইব তাই করতে পারব। আজ যখন আমি পিছনে ফিরে তাকাই, নিজেকে দেখেই আমি অবাক হয়ে যাই। ১৯৬৭ তে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে আমি যখন ফরাসী থেকে ইংরাজিতে দেরিদা অনুবাদ করতে শুরু করি তখন দেখেছিলাম উনি আমার মতোই অচেনা। আমি খুব বেশী ফরাসী বা দেরিদা কোনটাই তখন জানতাম না।
ব্রোহি – এদেশের পাট উঠিয়ে বিদেশে পাড়ি দেওয়া কি খুব নাড়িয়ে দেওয়ার মতন অভিজ্ঞতা আপনার কাছে? আপনি বলেছেন যে আপনি যৌন হেনস্থার স্বীকার হন।
স্পিভাক – ‘যৌন হেনস্থা’ কথাটা নিয়ে আমাদের বিশেষভাবে ভাবা প্রয়োজন। যেমন, আমি মনে করিনা বাবা-মাদের যে কোনও শাস্তিমূলক আচরণকেই শিশু নিগ্রহ বলে ব্যাখ্যা করা যায়। এটাকে একটা স্ট্যাটিসটিক্যাল অ্যাবাসার্ডিটিও বলতে পারি। কলকাতায় যা হত সেটা লোলুপ কামতাড়িত নজরের বেশী কিছু নয়, এবং সেটা একটা সেক্সুয়ালি ডিপ্রাইভড মধ্যবিত্ত সংস্কৃতির মধ্যে অনভিপ্রেত হলেও অস্বাভাবিক নয়।
এটাকে হেনস্তা বলা যায় না। দেশে থাকতে আমি কোনোদিন কোনও শিক্ষক বা কর্তৃপক্ষস্থানীয় কোনও ব্যক্তির কাছ থেকে এমন কোনও আচরণ পাইনি, যদিও অ্যামেরিকায় গিয়ে আমি কিছু প্রফেসরের কাছ থেকে এমন আচরণের সম্মুখীন হই।
ব্রোহি – আপনার জাতিসত্তা কি আপনার কাছে কখনো সংকটের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল? দক্ষিণ এশিয়ার ডায়াস্পোরিক লিটারেচার এখন ভীষণভাবে প্রবাসীদের উদ্বেগ, আশঙ্কার কথা বলে। আপনার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কি এরকমই কিছু ছিল?
স্পিভাক – আমি এই ধরনের লেখার ব্যাপারে একেবারেই আগ্রহী নই। আর শুধু যে আগ্রহী নই তাই নয়, এই ধরনের সাহিত্যের রমরমাটাও আমার মোটেই পছন্দ নয়। একঘেয়ে…এই নিজের প্রবাসজীবন বা সেই সংক্রান্ত সমস্যার ওপর পুরোপুরি ফোকাস করাটা ভীষণ সংকীর্ণ মনের পরিচয় বলে মনে হয় আমার।
ব্রোহি – কিন্তু আপনিও তো নিজের লেখায় ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বা ঘটনার অনেক কিছুই ব্যবহার করেছেন।
স্পিভাক – আমার লেখার ধরণটা ওবসেসিভ। অনেক সময় একটা ছোট ঘটনা এমন একটা ছবি তুলে ধরে যার জন্য আমি ঘটনাটা উল্লেখ করি। অ্যামেরিকার অ্যাকাডেমিক ফেমিনিজমকে আমি যেমন সমালোচনা করেছি বা করছি, তেমনই এর দ্বারা আমি ভীষণভাবে ইনফ্লুয়েন্সডও হয়েছি। এই নারীবাদ মনে করে ‘দ্য পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’। এক্সপেরিয়েনশিয়ালের বর্ণনার কিছুটা ওইখান থেকে আসে।
ব্রোহি – এই ব্যাপারটা আমার বেশ অদ্ভুত আর ইনট্রিগিং লাগছে। তার একটা বড়ো কারণ হল এর মধ্যে থেকে যাওয়া শর্ট সার্কিটের সম্ভাবনা। নিউ ওয়েভ রাইটিং-এর ক্ষেত্রে যেমন এটা মনে করা হয়, যে ব্যক্তিগত বিষয়গুলোই শুধুমাত্র রাজনৈতিক, বাকি আর কিছুই যেন কিছু নয়। আবার দেখুন, পাকিস্তানে দক্ষিণপন্থী ধর্মীয় মৌলবাদীরা মনে করে মনে করে যা কিছু ব্যক্তিগত তা-ই রাজনৈতিক। অন্যদিকে, নারীবাদী আন্দোলন বলছে, না, যা ব্যক্তিগত সেটাই রাজনৈতিক নয়: আমাদের শোবার ঘরের থেকে দূর হটো, আমাদের আলমারির থেকে দূর হটো; আমাদের ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত তোমাদের রাজনৈতিক মন্তব্যের জন্য নয়। তাহলে ‘পার্সোনাল ইজ পলিটিকাল’ – এই কথাটা কোন ধর্মনিরপেক্ষ অনুষঙ্গের ওপর দাঁড়াচ্ছে?
স্পিভাক – যদি ব্যক্তিগতই শুধু রাজনৈতিক হয় তাহলে জিনিসটা খুবই অদ্ভুত আর খেলো হয়ে যায়। যে কোনোকিছুই একদিকে ওষুধ আর একদিকে বিষ। কোনোকিছুকেই আমি একমাত্রিকভাবে ঠিক বলতে পারিনা। ঠিক এই জন্যই আমি কৌশলগত অপরিহার্যতা বা ‘স্ট্র্যাটেজিক এসেনশিয়ালিজম’ এর ধারণাকে ফিরিয়ে নিয়েছি। কারণ, এর উদ্দেশ্য ছিল – যখন অন্তর্দলীয় বিভেদ যথেষ্ট, তখন কৌশলগতভাবে একটা সহজবোধ্য ‘এসেনশিয়ালাইজড’ দলীয় পরিচয়কে সামনে আনা জরুরী।
এই ধারণার থেকে আমি সরে আসি তার কারণ – এটা একটা ফর্মুলার মত হয়ে যায়, যা দিয়ে যে কোনো কিছুকেই সঠিক প্রমাণ করে দেওয়া যায়। এই কথা ঠিক, যে অনুষঙ্গটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। কে, কি কারণে এবং কি প্রসঙ্গে এর ব্যবহার করছে সেটা জানা অবশ্যই জরুরী। এই প্রশ্নগুলো অবশ্যই করা উচিত।
ব্রোহি – কয়েক দশক আগে, আপনি ‘ক্যান দ্য সাব-অল্টার্ন স্পিক?’ – এই নামের একটা গবেষণাপত্রে একটা প্রশ্ন রাখেন, আর সেই প্রশ্নটা পোস্টকলোনিয়াল তত্ত্বের সমগ্র ধারণাটাকেই বদলে দেয়।
[এই প্রবন্ধে স্পিভাক ‘অন্য’ সংস্কৃতিকে যেভাবে দেখা হয় তাকে প্রশ্ন করেছেন। এই প্রবন্ধটিতে সতী বা বিধবাদের আত্মহত্যার দুর্দশাকে বিশ্লেষণ করে প্রান্তিক মানুষদের কথা তুলে ধরা হয়েছে। এখানে দেখানো হয় – জ্ঞান নিরপেক্ষ নয়। জ্ঞানের পেছনে তার জন্মদাতাদের স্বার্থ নিহিত থাকে। এবং, নিপীড়িতদের অবস্থার কথা তুলে ধরার উদ্দেশ্যে তাদের চৌহদ্দির বাইরে থেকে যে চেষ্টাগুলো করা হয়, তারা সকলেই আসলে ‘epistemic violence’-দোষে দুষ্ট। সেই জন্যই নিপীড়িত, প্রান্তিক মানুষরা অন্যদের মাধ্যমে কথা বলতে পারে না, আবার নিজের মুখে নিজের কথাও বলতে পারে না।]
স্পিভাক – হ্যাঁ, তারপর প্রায় ত্রিশ বছর কেটে গেছে – ঠিক ঠিক বলতে হলে একত্রিশ বছর (প্রবন্ধটা প্রথম প্রকাশ পাবার পর থেকে)। তারপর আমি অনেকবারই প্রবন্ধটায় চোখ বুলিয়েছি। ‘আ ক্রিটিক অফ পোস্টকলোনিয়াল রিজন’ নামে ১৯৯৯-এ ওই লেখাটা নতুন করে বেরিয়েছে। ওই পেপারের বিশ বছর-পূর্তিতে আমার সহকর্মী রোসালিন্ড মরিস একটা আলোচনাসভার আয়োজন করেন। সেখানে উপস্থিত ছিলেন টনি মরিসনের মতো বিদ্বজ্জনেরা। এই কনফারেন্সের পর একটা অ্যান্থলজি তৈরী হয় যেখানে আমি ঠিক কোন জিনিসগুলো আমায় প্রবন্ধটা লিখতে সাহায্য করেছিল সেই কথাগুলো লিখি। এই কনফারেন্সের আলোচনা আর তার থেকে উঠে আসা ভাবনাগুলো এখনও আমাকে অধিকার করে আছে।
ব্রোহি – আপনি বলেছেন সতীর ক্ষেত্রে গড়ে ওঠা প্রতিরোধগুলোকে প্রতিরোধ হিসেবে চেনা যায় না, কারণ সেটা চেনার কোনও পদ্ধতি বা ব্যবস্থা ছিল না। এখানে আপনি ঠিক কি রকম ব্যবস্থার কথা বলতে চেয়েছেন?
স্পিভাক – সাব-অল্টার্নকে ভাষা জোগাবার চেষ্টাটার অভাব। ‘সাব-অল্টার্ন’ কথাটা সেনাবাহিনীর পরিভাষা থেকে ধার করা, যেটা প্রথম ব্যবহার করেন আন্তোনিও গ্রামশি (একজন ইতালিয়ান মার্ক্সিস্ট তাত্ত্বিক ও রাজনীতিবিদ) যখন তিনি তাঁর কারাগারের নিয়মকানুনের বিরুদ্ধে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আমি এই শব্দটা ব্যবহার করি কারণ শব্দটা ভীষণভাবে সময়োপযোগী। তবে কেউ বিভেদের শিকার হলেই এই শব্দটা তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অনুষঙ্গের সাথে শব্দটার যোগ থাকা প্রয়োজন। যেমন, আমার প্রবন্ধে অনুষঙ্গটা ছিল সেই দেওয়ালে পিঠ ঠেকার পরিস্থিতি যখন আত্মহত্যাই সমাজের কাছে বার্তা পৌঁছনোর একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়।
ব্রোহি – এটাই তো আমাদের কর্তৃত্ব বা এজেন্সির ধারণার কাছে নিয়ে যায়। একজন ফ্রি এজেন্টের সব কাজ কি মুক্তির দিকে নিয়ে যেতে পারে আমাদের? একটা অপরাজনৈতিক, মূল্যবোধহীন শূন্যতার মধ্যেও কি এই এজেন্সি থাকতে পারে? মহিলারা যেমন আজকাল মৌলবাদী ধর্মীয়-রাজনৈতিক দলে ঢুকছে।
স্পিভাক – আমার মনে হয় না ফ্রি এজেন্ট বলে কিছু হয়। এজেন্সির স্বাধীনতার ধারণাটাই অস্তিত্বগতভাবে জীর্ণ। আমরা যখন ভোট দিই তখন আমাদের মাথায় রাখা উচিত, ভোট মানে মত বা ধারণার গাণিতিক প্রকাশ এবং প্রতি নাগরিকের ভোট মাত্র একটাই।
তাই, ভোট দেওয়া ছাড়াও আমাদের খুব সতর্কভাবে পছন্দের স্বাধীনতা এবং মাধ্যমের স্বাধীনতার কথা ভাবা উচিত। তুমি যে কোনও প্রতিষ্ঠানে যোগ দিতে পার, আর সেইজন্য তুমি সেই প্রতিষ্ঠানের দালাল, কাউকে এটা বলা আসলে আমার মনে হয় শঠতা বা মূর্খামির পরিচয়। এজেন্সির ধারণাটাই প্রতিষ্ঠানের প্রত্যয়নের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সেইজন্য, সকলের আগে সেইসব প্রতিষ্ঠানের সমালোচনার দরকার, যারা এই প্রত্যয়নের আড়ালে থাকেন। সেইটাই একজন বুদ্ধিজীবীর কাজ।
ব্রোহি – শ্রেণীর প্রশ্ন কোথায়? প্রশ্নটা কোনো গভীর অতলে চলে গেছে বলে মনে হয় আজকাল।
স্পিভাক – লোকে যখন সামাজিক শ্রেণী নিয়ে কথা বলতো তখনও সবসময় এই প্রশ্নটা এড়িয়ে যাওয়া হতো। বোধ হয় এই বিষয়টাকেই সবচেয়ে বেশী করে অবজ্ঞা করা হয়েছে। সাস্টেইনেবল ডেভেলপমেন্টের নামে অনুন্নয়নকেই পালন করা হয়ে এসেছে। এইভাবেই পৃথিবী চলছে – জাতিসংকীর্ণতা এবং যৌনসংকীর্ণতার মধ্যে দিয়ে। বামপন্থীরা বলেছিলেন কোনো এক অগ্রদূতের কথা, যিনি মানুষের মধ্যে শ্রেণীচেতনা জাগিয়ে তুলবেন। সেটা নিজেই বেশ শ্রেনীবাদী বক্তব্য।
ব্রোহি – তাহলে, আপনি যাকে ইতিবাচক অন্তর্ঘাত বলেন সেটা কেউ কীভাবে ব্যবহার করতে পারে? এটা একটু ব্যাখ্যা করবেন? এটা কি বিশেষভাবে একটা সাম্রাজ্যবাদী প্রকরণ যেটা সমস্ত আধিপত্যবাদী প্রকরণকে ব্যর্থ করে, পাকিস্তানে যেটা ধর্মের ক্ষেত্রে হতে পারে? এটা কি আরসনিস্টদের শক্তির ওপর নির্ভর করে না কি এটা আসলে দুর্বলদের অস্ত্র?
স্পিভাক – আমি ‘অন্তর্ঘাত’ শব্দটা ব্যবহার করেছি ভেতর থেকে প্রভুত্বের যন্ত্রটা একটু একটু করে ভেঙে যাওয়াটাকে বোঝাতে। এর মানে আসলে একটু একটু করে এই প্রকরণটার ভেতরে ঢুকে পড়া যাতে পরিবর্তনটা ভেতর থেকে আনা যায়, কারণ কোথাও অন্তর্ঘাত গড়ে তোলার প্রধান উপাদান গভীরভাবে সেটা অনুধাবন করা। কারখানার মজুররা এটা প্রথম শুরু করে। আমি ওদের থেকেই এই ধারণাটা পাই। এটা শুধু যন্ত্রের ধ্বংসই নয়, যন্ত্রটাকে অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করাও। ১৯৯১ এ, যখন ইসলামিক স্যালভেশন ফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে তখন আলজিরিয়ান মহিলাদের মধ্যেও এই জিনিসটা দেখেছিলাম। গায়ে চাদর-জড়ানো মহিলা সাফাইকর্মীরা যে প্রতিরোধটা গড়ে তুলেছিলেন তার অতি অল্পই আমাদের সামনে এসেছে।
এই মহিলারা মিমিওগ্রাফ মেশিনটা ব্যবহার করা শুরু করেন। আমরা সেটাই ভাঙতে পারি যেটা আমরা খুব কাছ থেকে চিনি। এটা দুর্বলের অস্ত্র নয়; শক্তিশালীরাই একমাত্র এটা করতে পারে, কারণ দুর্বলের এতো সামাজিক সামর্থ্য নেই যে তারা এই প্রকরণে ঢুকবে।
ব্রোহি – কিন্তু এইভাবে একটা আধিপত্যবাদী প্রকরণে প্রবেশ করা কিন্তু একটু বিপজ্জনকও, কারণ, সেক্ষেত্রে প্রকরণের মাধ্যমেই সহযোজিত হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। নারীবাদী আন্দোলনের ক্ষেত্রে ধর্মকে স্বাগত জানানো বা না জানানোটা একটা দীর্ঘ অমীমাংসিত বিতর্ক।
স্পিভাক – এটা কোনও কথাই নয়। এটাই বিক্ষুব্ধ মানুষদের সমালোচনার বিষয়। অবশ্যই যে কোনও কিছুই সহযোজিত হতে পারে। কিন্তু সেজন্য তাকে স্বাগত না জানানো কোনও কারণ নয়। আমি কিন্তু বলেছি এটা সামর্থ্যের জায়গা থেকে হওয়া প্রয়োজন। যদি কারোর সামর্থ্য না থাকে, তাহলে সে এটা কোনোভাবেই করতে পারবে না।
ব্রোহি – আপনার লেখা পশ্চিমে যেভাবে পড়া হয়, আর দক্ষিণ এশিয়াতে, বিশেষতঃ ভারতে যেভাবে পড়া হয় তারমধ্যে কি খুব পার্থক্য আছে?
স্পিভাক – না, আমার সেরকম মনে হয় না। ভারতের প্রায় সমস্ত নামজাদা বিশ্ববিদ্যালয়ই পশ্চিমের মতোই, কিছু অলক্ষিত সাংস্কৃতিক বৈষম্য ছাড়া, সেটাও খুব সামান্যই, অবশ্যই ডায়াস্পোরিক গ্রুপগুলো এই অলক্ষিত সংস্কৃতির অংশ, কারণ সেখানে বিভিন্ন শ্রেণীর জন্য বিভিন্ন মূল্য রয়েছে। আমার মনে হয় না এরমধ্যে খুব পার্থক্য আছে, কিছু স্থানীয় ক্ষোভ ছাড়া। আর সেটা খুব স্বাভাবিক। আমি আলজিরিয়াতে কাজ করেছি, যেখানে দেরিদা জন্মেছিলেন, কিন্তু ওখানকার লোকেরা মনে করে যে দেরিদা তেমন বিখ্যাত কেউ নন, আর দেরিদাকে নিয়ে এত মাতামাতির কারণ কী সেটা ভেবেও ওরা অবাক হয়। যখন কেউ বিদেশে বিখ্যাত হয় তখন তাকে নিয়ে ক্ষোভ তৈরী হয়ই, আর মেয়েদের ক্ষেত্রে সেটা আরও বেশী হয়।
ব্রোহি – আপনি কী দক্ষিণ এশিয়ার নারী আন্দোলনের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পারেন? আপনি কী আন্তর্জাতিক মানব সমাজের ব্যাপারে কোনও উৎসাহ অনুভব করেন?
স্পিভাক – আমি খুব একটা ‘সলিডারিটি ট্যুরিস্ট’ নই। আমার আন্তর্জাতিক মানব সমাজ সম্পর্কেও কোনও আগ্রহ নেই। আমার মনে হয়, ভারতে বেশ একটা শক্তিশালী, মৌলিক, শহুরে নারী আন্দোলন আছে এবং এ ব্যাপারে আমি খুব খুশী। অথচ আমি কিন্তু এই আন্দোলনের খুব অন্তরঙ্গ অংশ নই। অবশ্যই, আমি ওদের সমর্থন করি, অথচ আন্দোলনটা কিন্তু মূলতঃ হিন্দি-ভাষীদের (আর আমি কিন্তু বাংলাভাষী)।
কোনও আন্দোলনের অংশ হওয়ার জন্য ভাষাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। আমার পশ্চিমবঙ্গের নারী আন্দোলনের ব্যাপারেও খুব একটা অভিজ্ঞতা নেই। তার একটা কারণ, ভারতের মার্ক্সিস্ট কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে যে সমস্ত মহিলারা আমার বন্ধু ছিলেন তাঁরা সবাই আদতে পার্টির কারণেই এই আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন।
এমনকি বাংলাদেশের আন্দোলনের সাথেও আমি জড়িত, কারণ এই আন্দোলন বাংলা-ভিত্তিক। সেখানে ফরিদা আখতার খুব শক্তিশালী বক্তা। উনি আমার খুব কাছের বন্ধু। ওনার সাথে কাজ করা মেয়েরা যখন ইউনাইটেড নেশনস-এ যায় আমি তাদের কিছু উপদেশ দিয়েছিলাম।
এই কাজটা খুব ছোট ছিল, আর পুরোটাই বাংলায়। তাই ওখানে ঘুরে বেড়ানো আমার পক্ষে খুব সহজ হয়েছিল, কিন্তু চূড়ান্ত বিশ্লেষণটা খুব একটা সহজ হয়নি, কারণ আমি বাংলাদেশের নাগরিক নই।
ব্রোহি – তাহলে একদম বুনিয়াদী স্তরের মেয়েদের সংস্থার ব্যাপারে আপনি কী বলবেন? আপনি নিজেকে একজন কর্মীও বলে থাকেন, সেজন্যই আমি জিজ্ঞেস করছি।
স্পিভাক – আমি একজন অধ্যাপিকা। আমি পড়াই, আর পড়ানোটাই আমার কাজ – যুক্তরাষ্ট্র কিংবা পশ্চিমবঙ্গ দু’ জায়গাতেই। ওটাই আমার পেশাও – দু-ক্ষেত্রেই। আমি সমস্যাটা বোঝানোর জন্য কিছু উদাহরণ দিতে পারি। আমি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এন.জি.ও (নন-গভর্নমেন্ট অর্গানাইজেশন) ঘুরেছি, আর সবজায়গাতেই আমি নারীবাদী দলের কথা জিজ্ঞেস করেছি। একটা জায়গায় আমি একটা ভিডিও দেখেছিলাম যেখানে কিছু মহিলা একটা গ্রামে গিয়ে ওদের পণপ্রথার বিরুদ্ধে বোঝাচ্ছে, এমনকি ওরা স্থানীয় মহিলাদের সাথে গান গাইছে কিংবা নাচ করছে। ওরা একটা গান বেঁধেছে, “আমরা পণ দেব না, আমরা পণ নেব না”।
ওই ভিডিওটা দেখার পর আমি ওই গ্রামটায় যাই। ওখানে গিয়ে ওদের সাথে গল্প করি, তারপর চা খেতে খেতে গল্পের ছলে একজন সদ্যবিবাহিত বৌ এর শাশুড়িকে জিজ্ঞেস করি উনি কত টাকা পণ নিয়েছেন, উনি জানান, “চল্লিশ হাজার।” ওরা কিন্তু ওই নাচ গান গুলোকে কাজে পরিণত করতে পারে নি, কারণ হাজার হাজার বছর ধরে ওদের বৌদ্ধিক শ্রম থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে।
সমাজের উচ্চশ্রেণীর মানুষরা মনে করে যে সবাই তাদের মতো, আর এটাকেই ওরা সাম্য বলে ভুল করে। আসলে গ্রামের মেয়েরা নাচ, গানটা খুব উপভোগ করে, আর কিছু মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়েরা ওদের সাথে কথা বলছে, মজা করছে এটা ওদের খুব ভালো লাগে। আমি এই বৌদ্ধিক শ্রমটাকেই জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করি। তোমাকে মানুষের ইচ্ছেটা জাগিয়ে তুলতে হবে। তারা যেটা চাইবে সেটা বদলাবেই। তারা যেটা করবে সেটা তখন অনুসৃত হবেই।
ঠিক এই জিনিসটাই আমি গত তিরিশ বছর ধরে করার চেষ্টা করছি – ওদের মধ্যে একটা গণতন্ত্রের অভ্যাস গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, এমনকি অনুষ্ঠানগুলোকে কীভাবে কাজে পরিণত করা যায় সেই চেষ্টা করছি, যেটা মধ্যবিত্ত ছেলেমেয়ে বা বাবা মায়েরা প্রশ্নাতীতভাবে ধরে নেয়।
ব্রোহি – আপনি বাংলার গ্রামে সাক্ষরতা প্রকল্প শুরু করেছেন। সাক্ষরতাই কী সব সমস্যার সমাধান?
স্পিভাক – আমার মনে হয় সাক্ষরতা একটা গুণ ছাড়া কিছু নয়। এটা একজনকে শুধুমাত্র রাস্তার ধারের চিহ্নগুলো ছাড়া আর কিছুই পড়তে সাহায্য করে না। সাক্ষরতা কখনোই কর্তৃপক্ষের ভয়ের কারণ নয়, কারণ তারা জানে সাক্ষরতা প্রকৃতপক্ষে কিছুই নয়। শিক্ষা এবং কাজে লাগানোর মতো কিছু তথ্য শেখার মধ্যে পার্থক্য আছে। শিক্ষাকে অবশ্যই গণতান্ত্রিক বিচারের উন্নয়ন ঘটাতে জানতে হবে এবং কল্পনাকে প্রশিক্ষণ করতে শিখতে হবে।
আমি কলকাতায় শিক্ষামন্ত্রীর সাথে কথা বলতে গেছিলাম যে আমরা স্কুলে পাঠ্যবই পাচ্ছিনা, আমি বলেছিলাম যে আমি জানি স্কুলে পড়ানোর পদগুলো বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর সেগুলো কারা কিনছে সেটাও আমি জানি।
মন্ত্রী বললেন, “আমাকে নামগুলো দিন, আমি এখুনি ওদের গ্রেপ্তার করার ব্যবস্থা করছি।” আমি ওনাকে বললাম যে গ্রেপ্তার নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। আমি শুধু এটা দেখতে চাই না যে আইন প্রণয়ন হয়েছে, বরং আমি এটা দেখতে চাই যে মানুষ পরিবর্তন চাইছে, আর সেটা সম্ভব একমাত্র চিন্তা বা ইচ্ছের পরিবর্ধন ঘটিয়ে।
ব্রোহি – আপনি কী এই ইচ্ছের পরিবর্ধনটা দেখতে পাচ্ছেন?
স্পিভাক – এটা কাজ করতেও পারে আবার নাও পারে। ওরা উপদেশ শোনে, কিন্তু ওরা নির্বোধ নয়। ২৮ বছর আগে আমি যখন কাজ করতে যাই আমাকে অনেক পরীক্ষা দিতে হয়, কারণ আমাকে তখন একজন উচ্চবিত্ত, উচ্চবর্ণের, ধনী মানুষ ভাবা হতো যে কিছু ভালো কাজ করতে এসেছে। আস্তে আস্তে ওরা আমাকে এমন একজন হিসেবে দেখতে শুরু করল যার টাকা বাঁচানো দরকার। আমি ওদের হাসিতে যোগ দিই আবার নিজেকেও হাসির খোরাক করে তুলি। ওরা আমাকে এরকম কথাও বলে, “আপনি আসার আগে আমরা অনেক একজোট ছিলাম, আপনি টাকা দিয়ে আমাদের আলাদা করে দিয়েছেন।” ওরা আমাকে এটা বলতেই পারে।
আমি এমন কোনও আধিদৈবিক মানুষ নই যে ওদের সাহায্য করার জন্য নেমে এসেছে। এখানে কোনও দূরত্ব নেই। তবু আমি ওদের একজন নই। ওরাও এটা জানে। আমি ওদের বলি যে আমি ওদের শত্রু। আমি এখানে আমার পূর্বপুরুষের ঋণ শোধ করতে এসেছি। আমি ১৯৮৬ তে কাজটা শুরু করি, এবং কদাচিৎ আমি তখন এসব নিয়ে কথা বলতাম, কারণ, এই প্রক্রিয়াটাই তখন খুব ঠুনকো ছিল, কিন্তু এখন আমি এসব নিয়ে অনেক বেশী কথা বলি। সেটার প্রথম কারণ, আমার হাতে সময় কম, এবং দ্বিতীয়ত: এখন কাজটা আগের থেকে অনেক বেশী স্থিতিশীল।
ব্রোহি – এটার প্রস্তুতিপর্ব থেকে কী অন্য এনজিও শিখতে পারবে?
স্পিভাক – বস্তুতঃ, আমার শিক্ষামূলক এনজিও দের ওপর কোনও ভরসাই নেই। ওরা কাজটার ধরনটাই জানেনা। আপনি যদি নিপীড়িত প্রান্তিক মানুষদের ওপর ঘটা অন্যায়ের কথা ভাবেন, কয়েক শতক ধরে ওদের ওপর এই অন্যায় হয়ে চলেছে। আপনার প্রকল্পের সময়সীমার মধ্যে আপনি এই অন্যায়ের নিস্তার কীভাবে করবেন?
একটু হলেও আপনাকে ইতিহাসটা জানতে হবে। এই প্রভাব মূল্যায়ন, দ্রুত মূল্যায়ন, এনজিওর সাজসরঞ্জাম যেসমস্ত নিয়ে শিক্ষিত লোকেরা কথা বলে এগুলো সব অর্থহীন। ওরা ভাবে ওরা জানে কীভাবে দীর্ঘ-মেয়াদী শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করতে হয়। আর ওরা আপাদমস্তক পার্থিব পরিবর্তনের কথাও ভাবে, পরিষ্কার জল, এইচআইভি-এইডস, এসবের কথা ভাবে, কিন্তু তার জন্য স্বল্প-মেয়াদী সংস্কারের পথ বেছে নেয়। আর তারপর ওরা সেই সমস্ত হাস্যকর প্রসঙ্গের কথা বলে, যেমন গরীব লোকেরা শৌচালয়ের থেকে সেল ফোন বেশী পছন্দ করে, বা আমরা ওখানে শৌচালয় বানিয়ে দেব, আর সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদকীয় বিভাগে সেগুলো নিয়ে মাতামাতি করা হয়।
সরকারী প্রাথমিক স্কুলগুলোর পাশেই অনেক বছর ধরে ওখানে শৌচালয়গুলো তালাবন্ধ পড়ে আছে, কেউ ওগুলো ব্যবহার করে না। আমি একটা ঘটনার কথা বলছি। রাত দু’টোর সময় আমার টয়লেটে যাওয়ার দরকার হয়। তাই আমাকে আর আমার দলকে ওই মাঝরাতে গ্রামের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয়, আর সবকটা কুকুর মাথা তুলে আমাদের দিকে চিৎকার করতে শুরু করে, আর গ্রামের সবাই আমাদের দেখে বলতে শুরু করে, “ও, বোন পায়খানা করতে যাচ্ছে।”
আর ওই উন্মুক্ত বিষ্ঠার সাথে আস্তে আস্তে রোগের একটা সম্পর্ক শুরু হয়ে যায়। এই প্রতিষেধক সুস্থ জীবনের জন্য একটা পরিবর্তিত ইচ্ছের প্রয়োজন – একটা জোরালো উদাহরণ হিসেবে বলা যায় – বিষ্ঠাসহ বদ্ধ ঘরের থেকে অন্তত: অসুস্থ আত্মীয় ভালো। এই সহস্রবর্ষীয় অজ্ঞানতার অন্যায়কে কি তাড়ানো সম্ভব? এটা আমার কাছে খুব বড় একটা প্রশ্ন, আর আমরা অবশ্যই খুব আশু সমাধানের আশা করতে পারি না।
(এই সাক্ষাৎকার পাকিস্তানের ডন পত্রিকায় ২৩এ ডিসেম্বর ২০১৪ তারিখে প্রকাশিত। পত্রিকার অনুমতি নিয়ে পুনঃপ্রকাশিত। মূল সাক্ষাৎকার পড়তে হলে এখানে ক্লিক করুন।)