এলেন গিন্সবার্গের কবিতা

এলেন গিন্সবার্গের কবিতা | সোনালী চক্রবর্তী

সোনালী চক্রবর্তী

 

বিট জেনারেশনের অন্যতম প্রবক্তা আমেরিকান কবি আরউইন এলেন গিন্সবার্গের জন্ম ১৯২৬ সালে। তাঁর প্রতিটি কবিতা তীব্র প্রতিরোধের দলিল রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, অর্থনৈতিক আগ্রাসন আর যৌনতার অবদমনের বিপক্ষে। তাঁর সর্বাধিক বিতর্কিত কবিতা “হাউল” এর জন্য তাঁকে অশ্লীলতার দায়ে রাষ্ট্র কর্তৃক অভিযুক্ত করা হয়। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী এলেন তাঁর ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত অনাড়ম্বর যাপনের দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গেছেন। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাপেক্ষে রচিত তাঁর “সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড” কবিতাটি বাঙালি উদ্বাস্তুদের মর্মন্তুদ বেদনাকে ব্যাখ্যায়িত করেছে। যে রাষ্ট্রের সঙ্গে তাঁর আমরণ জেহাদ পরবর্তীতে সেই রাষ্ট্রই তাঁকে বিভিন্ন সম্মানে সম্মানিত করেছে। আজীবন যুদ্ধের বিপক্ষে গান গেয়ে যাওয়া কবি এলেন ১৯৯৭ সালে নশ্বরতা থেকে মুক্তি নেন।

 

আসমানি ফেরেস্তাটি

সমুদ্রতীরের অধিত্যকায়, হামানদিস্তা গাছে হেলান দিয়ে,
মার্লিন এক যান্ত্রিক প্রেমের জন্য বিলাপ করছে।

সে এক পূর্ণাকার খেলনা, অমরত্বের পুতুল,
শুভ্র ইস্পাত নির্মিত অবাস্তব কোনও টুপির আকারের তার চুল।

পাউডারমাখা, চুনকাম করা তার মুখ যন্ত্রমানবের মতো স্থাবর,
কপালের পাশে, একটা চোখের ধার থেকে ঝিলিক দিচ্ছে একটা ছোট্ট সাদা চাবি।

চোখের সাদা অংশের ভিতর গাঁথা নিষ্প্রাণ নীল তারারন্ধ্র দিয়ে,
সে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে,
চোখ বন্ধ করতেই চাবিটা নিজে থেকে ঘুরে গেল।

সে চোখ খুলতেই, জাদুঘরের ভাস্কর্যের মতো তারা অমিত্রাক্ষর হয়ে উঠল,
তার যন্ত্র গতিশীল হয়ে উঠতেই, চাবিটি আপনা থেকে আবার পর্যায় বদলে নিল।

আপনারা হয়তো ভাবছেন,
অন্তঃস্থিত উৎপীড়নের সমাপ্তির জন্যে এ আমার কোনও পরিকল্পনা,
কিন্তু আমার চিন্তাকে দখল করে রাখবে,
এখনও অবধি এমন কোনও পুরুষ আমি খুঁজে পাইনি।

 

একটি ঊষরতার কথা

মেঘমুক্ত আকাশের মতো এখন চেতনা বিশুদ্ধ,
সুতরাং এখনই তো সময় বিজনপ্রদেশে গৃহ নির্মাণের।

চোখ দিয়ে প্রলাপ বকা ছাড়া কী-ই বা করেছি বৃক্ষে?
অতএব স্থাপনা হোক, দারা-পুত্র-পরিবার, যাচ্ঞা করি প্রতিবেশী।

অথবা, ধ্বংস হয়ে যাই একাকীত্বে, নতুবা ক্ষুধার তাড়নায়,
বা অশনিতে কিংবা মেনে নেওয়ায়,
(গৃহপালিত করে তুলতে হয় হৃদয় আর পরিধান করতে হয় সহ্য)

আর সম্ভবত গড়ে তোলা যায় আমার ঘুরে বেড়ানোর এক ভাবমূর্তি,
এক ছোট্ট প্রতিমা— পথের ধারের মন্দিরে— রাহীদের কাছে নিদর্শনের মতো—
এই উপবনে আমি অতন্দ্র জীবিত আর এই ই আমার গৃহ।

 

সর্বজনীন সম্ভাষণসমূহ

দাঁড়াও সরকারের প্রতিপক্ষে, তোমার ঈশ্বরের বিপরীতে,
হয়ে ওঠো দায়িত্ববোধহীন।
উচ্চারণ করো শুধু সেইটুকু যা আমরা জানি আর ধারণা করি।
স্বয়ম্ভুরা নিগ্রহপরায়ণ,
পরিবর্তন একমাত্র অসীম।
সাধারণ বুদ্ধি ধারণ করে নিত্য বিভাব।
প্রতিপালন করো যা অবিস্মরণীয়,
ঘোষণা করো যা তুমি গ্রাহ্য করছ,
লুফে নাও চিন্তারত তোমার মননকে,
অত্যুৎজ্জ্বলেরা স্বয়ং নির্বাচিত।
যদি আমরা কাউকে প্রকাশ নাও করতে পারি,
আমরা তো মুক্ত যা প্রাণে আসে তা লিখতে।
স্মরণে রাখো ভবিষ্যৎকে,
আমেরিকা মহাদেশে নাগরিক সম্মানের দাম কানাকড়ি।
মন্ত্রণা শুধু নিজেকেই দিতে পারি,
নিজের মৃত্যুকে পানীয় করে ফেলো না নিজের,
দুই অণু যখন পরস্পরের ঝন আওয়াজে সচকিত করে আমাদের,
তারও একজন পর্যবেক্ষক প্রয়োজন হয়
বৈজ্ঞানিক তথ্যের স্বীকৃতি পেতে।
পরিমাপের সূচকেরা নির্ধারণ করে দেয়
বিস্ময়কর পৃথিবীর আবির্ভাব।
(আইনস্টাইনের পরবর্তী সময়ে)
এই বিশ্ব আত্মবাদী।
হুইটম্যান উদযাপন করেছিলেন মানবতা।
আমরা দর্শকমাত্র, পরিমাপের সূচক, চোখ, বিষয়, ব্যক্তি।
এই মহাবিশ্ব আদি মানব।
আভ্যন্তরীণ মস্তিষ্ক বাহ্যিক করোটির মতোই বিস্তৃত।
চিন্তাশক্তির মধ্যবর্তী স্তরে কী?
এই চৈতন্য মহাশূন্য।
নিঃশব্দে, আমরা রাতের শয্যায় নিজেদের কী বলি?
“যা প্রথম উপলব্ধি, তাই শ্রেষ্ঠতম”।
বোধ সুষম, শিল্প সুগঠিত,
সর্বোচ্চ তথ্য, সর্বনিম্ন সংখ্যক অক্ষর,
ঘনীভূত অন্বয়, নিরেট ধ্বনি,
উচ্চারিত বাগধারার তীব্র বিচ্ছিন্ন অংশেরাই বিশিষ্ট।
ছন্দে এগোনো, স্বরবর্ণের আবর্তন,
স্বরকে ঘিরে থাকা হলবর্ণদের বোধগম্যতা।
স্বাদু হয় স্বরধ্বনি, মূল্যবৃদ্ধি ঘটে ব্যঞ্জনবর্ণদের,
শুধু তার দৃষ্টিসাপেক্ষে বিষয় জ্ঞাতব্য হয়,
বাকিরা তো দৃশ্যের পরিমাপ করে যা আমরা দেখি, তার ভিত্তিতে,
সরলতা হয়ে ওঠে মস্তিষ্কবিকৃতির হন্তারক।

 

কাব্য

এই পৃথিবীর ভার হল প্রেম,
একাকিত্বের চাপের নীচে,
অসন্তোষের বোঝার নীচে,
যে পাষাণ,
যে দায় আমরা বয়ে নিয়ে চলি,
তা প্রেম।

কে অস্বীকার করতে পারে?
স্বপ্নে প্রেম শরীর স্পর্শ করে,
চিন্তায় অলৌকিকের নির্মাণ ঘটায়,
জন্মইস্তক কল্পনায় মানুষকে পীড়ন করে চলে,
হৃদয় পেরিয়েও,
দাহ্য সে হয়েই চলে শুদ্ধি অর্জনে,
কারণ জীবনের দায়িত্ব প্রেম।

কিন্তু আমরা এই ভার পৌঁছে দি ক্লান্তিকরভাবে,
তাই বিশ্রাম নিতেই হয়,
ভালোবাসার ভুজে পরিশেষে,
বিশ্রাম নিতেই হয়,
প্রেমের হাতে সমর্পণে।

প্রেম ব্যতিরেকে নেই কোনও নিশ্চলতা,
প্রেমের স্বপ্ন ব্যতীত আছে যাবতীয় নিদ্রাহীনতা,
উন্মাদ হও বা সুশীতল,
দেবদূতদের নিয়ে অন্ধকার আবৃত থাকো বা নিছক যন্ত্র,
অন্তিম আকাঙ্ক্ষা প্রেম।
নির্মম হওয়া যায় না,
না যায় সত্যকে অস্বীকার করা,
প্রতিসংহারের উপায় থাকে না,
যদি প্রেম প্রত্যাখ্যাত হয়।

এ গুরুভার অতি দুর্বহ।

বিনিময়ে আসবে না কিছুই,
জেনেও দিয়ে যেতে হবে,
কারণ একান্তে বোধের অঞ্জলি কবেই সম্পূর্ণ,
গৌরবের সমস্ত সীমাকে লঙ্ঘন করে।

উত্তপ্ত শরীরদ্বয় যৌথতায় উদ্ভাসিত হয়,
অন্ধকারে, হাত পৌঁছতে চায় স্থূল দেহের কেন্দ্রে,
প্রশান্তিতে ত্বকের স্ফূরণ আসে অনাবিল,
আর আত্মা আনন্দময় হয়ে আবির্ভূত হয় চোখে।

এই সেই, এই ই তো সেই,
যা আমার অভিপ্রায়,
আমি সর্বদা প্রার্থনা করেছি,
আমি নিত্য কামনা রেখেছি,
প্রত্যাবর্তন করতে,
সেই শরীরে,
যেখানে আমি জন্মেছিলাম।

 

উন্মত্ত এতিম

রেলপথ আর নদীর ধারে,
বিনীতভাবে মা তাকে নিয়ে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে।
সে এক পলাতক, ক্ষমতাবান দেবদূত পুত্র।
আর তার কল্পনায় অনেক গাড়ি,
স্বপ্নে সে তাদের সবার সওয়ারী।

অবাস্তব মোটরগাড়ি,
আর মৃত, কলঙ্কিত মফস্বলের জীবাত্মাদের মধ্যে
এই উদ্ভিন্ন হয়ে ওঠা কি অসম্ভব নির্জন।

কি অসম্ভব একাকী,
শুধুমাত্র কল্পনায় ভর দিয়ে সৃষ্টি করা যে তার আরণ্যকের সৌন্দর্য নিছক পূর্বপুরুষের পুরাণ,
যা সে উত্তরাধিকার সূত্রে পায়নি।

পরবর্তীতে যখন সে স্মৃতির অপ্রকৃতিস্থ রশ্মিতে,
প্রহেলিকার মধ্যে থেকে জেগে উঠবে,
সে কি অলীক ঈশ্বরের অস্তিতে বিশ্বাস লালন করবে?

স্বীকৃতি,
তার অহং সাপেক্ষে যা অতি দুষ্প্রাপ্য,
তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটে শুধু স্বপ্নে,
তার অতীত আর্তি,
শুধুই অপর কোনও জন্মের।

স্বত্বের একটি প্রশ্নে,
আহত তার আঘাত হারিয়েছে সরলতায়,
একটি লিঙ্গ, একটি বধকাষ্ঠ,
প্রেমের একটি পরম কৃতিত্ব।

আর পিতাটি,
মেধার জটিলতায়,
ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরে শোক পালনে রত।
অপ্রত্যাশিত এই প্রসঙ্গে সে অজ্ঞাত,
এক হাজার মাইল দূরত্ব থেকে,
প্রাণোচ্ছ্বল নবজাতকটি,
খিড়কি দুয়োরের দিকে এগোচ্ছে।

 

Facebook Notice for EU! You need to login to view and post FB Comments!
About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4245 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...