বিষাণ বসু
প্রাবন্ধিক, গদ্যকার; পেশায় চিকিৎসক
তখন লকডাউনের শেষে আস্তে আস্তে যানবাহন চালু হচ্ছে। না, লোকাল ট্রেন তখনও চালু হয়নি, বাসের কথাই বলছি। তো যানবাহন চালু হতে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে, আমাদের ক্যানসার আউটডোরে, একটু একটু করে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এমনই একদিন একটি ইনডোর টিকিট এল— যাকে বলা হয়, ‘রেফার কেস’। অর্থাৎ রোগী ভর্তি আছেন অন্য কোনও বিভাগের ইনডোর ওয়ার্ডে, বহির্বিভাগে এসে দেখানোর মতো শারীরিক অবস্থা তাঁর নেই, আমাকেই শয্যাপার্শ্বে গিয়ে দেখে আসতে হবে।
ইনডোর বেডহেড টিকিট অর্থাৎ বিএইচটি-তে রোগীর শারীরিক অবস্থা তথা পরীক্ষানিরীক্ষার হালহকিকত লেখা থাকে। আর রেফারেল চিঠির সঙ্গে রোগী আসতে না-পারলেও একজন দায়িত্বশীল পরিজন থাকলে ভালো হয়, কেননা কিছু প্রশ্ন থাকলে সেগুলো আগেভাগেই জেনে নেওয়া যায়— রোগীর পাশে দাঁড়িয়ে, বিশেষত ক্যানসার-আক্রান্তের পাশে দাঁড়িয়ে সবক্ষেত্রে সব প্রশ্ন করা যায় না। বিএইচটি দেখে বুঝলাম, রোগীর পরিস্থিতি ভালো নয়। রোগীর বয়স অল্প। মাসকয়েক আগে গোড়ালির উপরে পেশীর ক্যানসারের কারণে একখানা পা হাঁটুর নীচ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। এখন সেই ক্যানসার বুকে ছড়িয়েছে। অন্যত্রও নিশ্চয়ই ছড়িয়েছে— পরীক্ষানিরীক্ষা সম্পূর্ণ হয়নি এখনও।
পরিজন হিসেবে ফাইলের সঙ্গে যিনি এসেছেন, দেখে মনে হল সদ্য কৈশোরোত্তীর্ণা— কুড়ি পার হয়েছে কিনা, আন্দাজ করা মুশকিল। পোশাক দেখে আর্থ-সামাজিক অবস্থা আন্দাজ করতে গেলে বলা যায়, খুব সস্তার জামাকাপড় নয়— তবে খুবই পুরনো, বহু ব্যবহারে জীর্ণ, মলিন। মেয়েটির দৃষ্টি কিঞ্চিৎ উদ্ভ্রান্ত। জানলাম, রোগী মেয়েটির স্বামী, সংসারে একমাত্র রোজগেরে ছিল স্বামীই, এখন সে-ই শয্যাশায়ী।
রোগীর বয়স কম, সেক্ষেত্রে অসুখের বাড়াবাড়ি হলেও হাল ছাড়াটা ঠিক নয়। তাই ভাবলাম, আগে রোগীর শারীরিক অবস্থাটা সরেজমিনে দেখে আসি। তারপর বাকি কথাবার্তা। মেয়েটিই সঙ্গে করে নিয়ে গেল। দেখলাম, ভিড় ওয়ার্ডে এক বিছানায় আধবসা অবস্থায় মাথা হাঁটুর ’পরে ঠেকিয়ে অদ্ভুত ত্রিভঙ্গ অবস্থায় স্থির হয়ে রয়েছে এক দীর্ঘদেহী জোয়ান। “শুনছ, ডাক্তারবাবু এসেছে”— মেয়েটি বারবার ধাক্কা দিয়ে ডাকার পরে ছেলেটি সোজা হওয়ার চেষ্টা করল— এবং সেই চেষ্টার পরিশ্রমেই প্রবল হাঁপাতে শুরু করল। বুকে অসহ্য যন্ত্রণা, সঙ্গে ভয়ঙ্কর শ্বাসকষ্ট, এমন কিম্ভুত বিভঙ্গে থাকলেই নাকি কিছুটা হলেও আরাম হয়, তাই এরকম করেই দিনরাত বিছানায় থাকে, মেয়েটি আমাকে জানায়। ছেলেটির দিকে একনজর দেখেই বুঝলাম, হাড় এবং চকচকে ত্বক— মাঝে আর কিছু নেই। পাঁজরার হাড় তো বটেই, সে হাড়ের খুটিনাটি গঠনও দৃশ্যমান, মাঝের চামড়াটুকু নিঃশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে ওঠানামা করছে। ছেলেটি হয়তো কিছু বলতে চাইছিল— পেরে উঠল না। অবশ্য তার চোখের দৃষ্টিতেই স্পষ্ট ছিল হতাশা। চিকিৎসককে বলেটলেও যে আর কিছু সেভাবে হওয়ার নেই, সেটি নিশ্চিতভাবে অনুভব করতে পারার হতাশা। বছর চব্বিশেকের একটি ছেলের চোখে সেই হতাশা দেখা এবং দেখে হজম করে ফেলা খুব সহজ কাজ নয়। আপনারা যারা ডাক্তারদের হৃদয়হীন ইত্যাদি বলে গালিগালাজ করেন, ঠিক কথাই বলেন— কেননা, এই হতাশার দৃষ্টিটিকে মুহূর্তেই বিস্মৃত হয়ে আমাদের মন দিতে হয় পরের রোগীতে, হৃদয়হীন না-হলে কাজটা সম্ভবই নয়। কিন্তু, সে কথা থাক।
রোগীর কাছ থেকে সরে এসে মেয়েটির সঙ্গে কথা বলতে শুরু করি। ছেলেটি কাঠের মিস্ত্রি— পুরো মিস্ত্রি নয়, মিস্ত্রির সহকারী। মেয়েটির সঙ্গে অল্পবয়সেই পরিচয়, প্রেম, বাড়ি থেকে পালিয়ে এসে বিয়ে, দু বছরের একটি শিশুকন্যাও আছে। পায়ের টিউমারের অপারেশন হয় সরকারি হাসপাতালেই। ডাক্তাররা বলেছিলেন, অপারেশনের ক্ষত সম্পূর্ণ শুকোলে পরবর্তী ধাপের চিকিৎসা শুরু হবে। না, ক্যানসার হয়েছে তেমনটি কেউ বলে দেয়নি, কেননা ফাইনাল রিপোর্ট তখনও আসেনি। কিন্তু, বাড়ি থেকে পালিয়ে আসার আগে মেয়েটি ক্লাস এইট অবধি পড়েছিল— ডাক্তারদের কথাবার্তায় ক্যানসারের ইঙ্গিত তার বুঝতে অসুবিধে হয়নি।
তাহলে? তারপর আর চিকিৎসার জন্যে গেলে না কেন? এত বড় অপারেশন তো জলে গেল পরবর্তী চিকিৎসা অগ্রাহ্য করার কারণে! অসুখ তো চিকিৎসার পর্যায়ের বাইরে চলে গেল এই অবহেলায়! ভর্ৎসনার উত্তরে মেয়েটি চুপ করে থাকে।
আস্তে আস্তে জানতে পারি, অপারেশনের পর বাড়ি ফিরতে না-ফিরতেই শুরু হয় লকডাউন। লকডাউন না-হলেও, কাজ অবশ্য এমনিতেও যেত। পা-কাটা হেল্পার আর কোন মিস্ত্রিই বা চাইবে? হাসপাতালে অপারেশন-চিকিৎসা বিনেপয়সাতেই হয়েছিল। কিন্তু, হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে থেকেই মাসদুয়েক স্বামী কাজে যেতে পারত না। তারপর তো ওই ভর্তি থাকার একমাস মেয়েটির রোজ যাতায়াত, দোকান থেকে খাবার কিনে খাওয়া— যেটুকু টাকাপয়সা বাড়িতে জমানো ছিল, সবই শূন্য। লকডাউন কেড়ে নিল এমনকি চেয়েচিন্তে খাবার জোগাড়ের সুযোগটুকুও। হাসপাতাল-ফেরত স্বামী কিংবা শিশুসন্তান— দুবেলা কারওই খাবার জোটেনি নিয়মিত। আশেপাশের বাড়ি থেকে যেটুকু জোগাড় হত, সেও বন্ধ হয়ে গেল। টান তো সবারই সংসারে।
মেয়েটি বুঝতে পারছিল, স্বামীকে নিয়ে হাসপাতালে যাওয়া জরুরি। মেয়েটি জানত, চিকিৎসায় দেরি হয়ে গেলে বিপদ আছে। কিন্তু আসবে কী করে? গাড়িঘোড়া নেই। গাড়ি ভাড়া করা তো সামর্থ্যের ঊর্ধ্বে। ক্ষতি, এমনকি অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে জেনেও কোনও উপায় খুঁজে পায়নি সে।
মেয়েটিকে বুঝিয়ে বলি, বড্ড দেরি হয়ে গিয়েছে, মা। আর কিছুই করার নেই। কষ্ট কমানোর জন্যেও যে কেমোথেরাপি, সেটুকু সহ্য করার ক্ষমতাও এখন আর স্বামীর নেই। এখন অপেক্ষা করা— যত তাড়াতাড়ি সব শেষ হয়, ততই ভালো— কেননা, যতদিন বেঁচে থাকবে, কষ্ট উত্তরোত্তর বাড়তেই থাকবে। খুব রূঢ় শোনালেও, এমন করে বলা ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। কেননা, অভিজ্ঞতা থেকেই জানি, মানসিক প্রস্তুতি বাদে আর কিছুই এই মেয়েটির হাতে নেই। সে কাজ যত তাড়াতাড়ি শুরু হয়, ততই ভালো। মেয়েটি উত্তর দেয় না কিছুই, আমার দিকে তাকিয়েও দেখে না— মাথা নিচু করে হাতের শাঁখাটি ইতস্তত নাড়াচাড়া করতে থাকে।
এই মেয়েটিরও ভোটার কার্ড আছে। সামনের নির্বাচনে ভোটও দেবে, হয়তো। ছেলেটি সম্ভবত ততদিন অবধি… থাকলেও, ভোটের লাইনে পৌঁছনোর পর্যায়ে থাকবে না। সুস্থ থাকলে অবশ্যই সেও ভোট দিতে যেত। আগের ভোটেও হয়তো লাইনে দাঁড়িয়ে বোতাম টিপেছে। রাম, নাকি বাম, নাকি বাংলার হয়ে নিজের মেয়েকে চেয়েছে— জিজ্ঞেস করিনি— কিন্তু, কাউকে না-কাউকে নিশ্চিত বাছতে চেয়েছিল। শিক্ষিত মধ্যবিত্ত মানুষের ভোটদান বিষয়ে বিভিন্ন উচ্চমার্গের ভাবনা থাকে। প্রান্তিক মানুষের হাতে শুধু ওই ভোটটুকুই সম্বল, তারা, ভোট দিতে যাব না, সহজে এমন ভেবে উঠতে পারে না।
কিন্তু, এই আমি, আপাত স্বাচ্ছন্দ্যের অবসরে, ভোটের কথা ভাবতে গিয়ে, ঠান্ডা মাথায় ভাবতে বসেছি, আগামী নির্বাচনে ঠিক কী ভেবে মেয়েটি বোতাম টিপবে?
সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, তথা ফ্যাসিজমের বিপদ? ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি কি শুনেছে মেয়েটি, যে নাম-পরিচয়ে মুসলমান হলেও, যার হাতে শাঁখা আর কপালে সিঁদুর? সে কি জানে, বাংলার গ্রামেগঞ্জে দুই ধর্মের এমন মিলেমিশে ওতপ্রোত হয়ে থাকাটাই ইদানীং চ্যালেঞ্জের মুখে? নারীবাদী বন্ধুরা অবশ্য বলেন, এমন করে শাঁখাসিঁদুর পরে থাকাটা নাকি পুরুষের কুনজর থেকে বাঁচার জন্যে ঢাল হিসেবেই, তবুও পুরোপুরি বিশ্বাস হয় না। বিবাহিতা ছাপ থাকলেও গায়ে হাত অনেকসময়ই পড়ে— আবার বেছে বেছে অবিবাহিতা হলে তবেই ধর্ষণ-শ্লীলতাহানির বিপদে পড়ে, এমনও নয়। শাঁখা-সিঁদুর মূলত লৌকিক আচার, যা সবসময় ধর্মের ব্যবধান মানে না, ইউটিলিটির হিসেব মেনেও চলে না। ঘোর ব্রাহ্মণ নাম-পদবীও কেমন করে বিপরীত ধর্মে ঢুকে যায়, সেও তো দেখেছি। রানি মুখার্জি খাতুন নামের একাধিক রোগী দেখতে পেয়েছি। তাঁদের কাছে, ‘রানি মুখার্জি’ পুরোটাই নাম। এই যে মিলেমিশে থাকার সংস্কৃতি, তার যে গোড়া থেকেই টান পড়েছে, সেই অধঃপতন ঠেকানো এখুনি জরুরি— মেয়েটির কাছে অগ্রাধিকার কি তা-ই?
মেয়েটি কি জানবে, তাদের মতো মানুষদের ‘সাম্প্রদায়িকতার বিপদ’ থেকে বাঁচাতে, ঠিক ‘তাদের’ ভোট পেতেই কি প্রাণপণে ‘অসাম্প্রদায়িক’ হয়ে উঠেছেন একদিকে সিদিকুল্লা চৌধুরী, আর উল্টোদিকে আব্বাস সিদ্দিকি? সাম্প্রদায়িকতার প্রতিরোধে সে কি ভোট দেবে সেই হিসেব কষে?
নাকি মেয়েটির চোখের সামনে থাকবে পঞ্চায়েত প্রধানের ফুলেফেঁপে ওঠা বাড়ি? থাকবে রেশনে চালের হিসেবের বাড়াকমা? আমফানের পরে ত্রিপল চাইতে গিয়ে অসম্মান? কিংবা প্রধানের শ্বশুরবাড়ির সকলের হাতে বিপিএল কার্ড থাকলেও, তার নিজের বারবার গিয়ে খালিহাতে ফিরে আসা?
দশ বছর আগে ভিন্ন এক রাজত্বে সমস্যাগুলো ঠিক এরকমই ছিল কি? সে জানে না। তখন সে নেহাতই বালিকা। কিন্তু, আশেপাশের লোকজনের মুখে শুনে খুব ভিন্ন কোনও ছবি তার চোখে পড়েনি।
কিংবা, ভোটের মেশিনের বোতামটি টেপার ঠিক আগেই, আরও কিছু প্রশ্ন কি তার মাথায় আসবে?
মেয়েটির সপরিবার স্বাস্থ্যসাথী কার্ড ছিল কিনা, সে প্রশ্ন অপ্রাসঙ্গিক, কেননা, তার স্বামীর চিকিৎসা আগাগোড়াই হয়েছে সরকারি হাসপাতালে, যেখানে চিকিৎসা পুরোপুরিই ফ্রি। তবু, সেই বিনামূল্যের চিকিৎসাই সে শেষমেশ চালিয়ে উঠতে পারল না। কেননা, শুধু চিকিৎসা বিনেপয়সায় হওয়াটাই যথেষ্ট নয়, সেই চিকিৎসাব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ না-হলে, বিনেপয়সার পরিষেবাও দুর্মূল্য হয়ে ওঠে। ছেলেটির কথাই ভেবে দেখুন। প্রতিটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে না-হোক, অন্তত প্রতিটি মহকুমা হাসপাতালেও যদি ক্যানসার চিকিৎসার ন্যূনতম পরিকাঠামো থাকত, ছেলেটিকে হয়তো এমন করে অকালে চলে যেতে হত না।
অথবা, আরও একটু আগে থেকে ভাবুন। প্রাথমিক স্বাস্থ্যপরিকাঠামো যদি আরেকটু মজবুত হত, হয়তো আরও আগে ধরে ফেলা যেত ছেলেটির অসুখ— এমন করে পা কেটে বাদ দেওয়ার প্রয়োজনই পড়ত না— ছেলেটি এমন করে কর্মহীন হয়ে সপরিবার অগাধ জলে পড়ত না। ভোটের বোতাম টেপার মুহূর্তে মেয়েটির মাথায় কি জাগবে এই সরল প্রশ্ন, যার উত্তর আর তত সরল নয়?
স্বাস্থ্য-চিকিৎসাকে যদি অধিকার হিসেবে দেখতে হয়, তাহলে তা তো শুধু বিনেপয়সায় পাওয়াটাই যথেষ্ট নয়— কিংবা সরকারি বিমার সহায়তায় পাঁচতারা হাসপাতালেও পাওয়ার সুযোগটুকুও যথেষ্ট নয়— অধিকার হিসেবে পেতে হলে পেতে হবে নাগালের মধ্যে— ভৌগোলিক অর্থে নাগাল— অর্থাৎ বাড়ি থেকে সহজ যাতায়াতের দূরত্বে। সেটুকু কেন হবে না? প্রশ্ন করবে মেয়েটি?
আসন্ন সঙ্কটের মুহূর্তে, মেয়েটির কি আফসোস হবে, ক্লাস এইট অবধি পড়ে আচমকা লেখাপড়া ছেড়ে দেওয়ার জন্যে? সম্ভবত না, কেননা সে জানে, মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিক তো দূর, বিএ-এমএ পাস করেও চাকরি মেলে না। অতএব, ইশকুল-কলেজে লেখাপড়া ব্যাপারটা পণ্ডশ্রম— আর্থসামাজিক অবস্থান অনুসারে বেকার মানুষ কাজ জোটানোর চেষ্টা করে— যেমন, মেয়েটি হয়তো খুঁজতে বসবে গ্রামের রাজমিস্ত্রির কাছে কামিনের কাজ। শহরে থাকলে, হয়তো পাশের ফ্ল্যাটবাড়িতে বাসন মাজার ঠিকে কাজ— ক্লাস এইট অবধি লেখাপড়াও কি সেক্ষেত্রে কাজে এল! অথচ, শিক্ষা জাগায় আত্মবিশ্বাস, যেটুকু না-থাকলে জীবনের অনেক ক্ষেত্রেই নিরন্তর ঠকে যেতে হয়। কিন্তু, এই কথাটা, এমনকি এই ঘনঘোর নির্বাচনের বাজারেও কেউ জোর গলায় বলে না— মেয়েটিও বুঝবে না হয়তো।
স্বাস্থ্যের মতো শিক্ষাও আর অধিকার নয়— এখন তা আরেকটা কিনে নেওয়ার মতো সামগ্রী। বিনেপয়সায় যে শিক্ষা মেলে, তা সাধারণের চোখে সম্মান হারিয়েছে। এবং স্বাস্থ্যের মতো হঠাৎ করে বিপদে ফেলে না বলেই, শিক্ষা ব্যাপারটা পুরোপুরিই অপশনাল— পেলেও হয়, না পেলেও আপনি কিছু হারাচ্ছেন না। শিক্ষার শেষে কাজের অধিকারের কথা কে আর বলছে! সে কথা তবুও বা যেটুকু উঠছে, শিক্ষার অধিকার বা সরকারি আয়োজনে শিক্ষার দুরবস্থার কথা প্রচারের বাদ্যিতে একেবারেই অনুপস্থিত। শিক্ষার পরিবেশের সঙ্গে শিক্ষার্থীর পুষ্টি, শিক্ষার্থীর বিদ্যায়তনে যাতায়াতের সুবন্দোবস্ত, আস্ত জামা-জুতো কিংবা স্কুলব্যাগ, সবই জড়িত নিঃসন্দেহে— কিন্তু, শুধু এটুকু নিয়েই তো শিক্ষা নয়। ছাত্রছাত্রীদের দুপুরের খাবার, সাইকেল, স্কুলব্যাগ, স্কুলের পোশাক কিংবা জুতো সরকারি উদ্যোগে দেওয়া ভালো কাজ অবশ্যই। কিন্তু, এর পাশাপাশি ইশকুলে লেখাপড়াটা যদি না হয়, তাহলে সেই মহৎ উদ্যোগের পুরোটাই লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। শিক্ষক যদি পড়ানো ছেড়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন চালডালের হিসেব রাখতে, কিংবা সরকারি প্রকল্পের গুণকীর্তন যদি তাঁর পেশাগত কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়, তাহলে নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, সরকার শিক্ষা ব্যাপারটাকে, সচেতনভাবেই, গুরুত্ব দিতে চাইছেন না। এর সঙ্গে শিক্ষকনিয়োগে কিংবা মিড-ডে মিলের খাবারের হিসেবের দুর্নীতির কথা জুড়লে তো পরিস্থিতির সঙ্কট ভয়াবহ হয়ে দাঁড়ায়। প্রশ্নগুলো সামনে এল কি সেভাবে?
অথবা, ভোটের লাইনে দাঁড়িয়ে মেয়েটির মনে কি একবারও এই প্রশ্ন জাগবে, যে, এত শত আয়োজনের মধ্যে, ওই অসহায় মুহূর্তে তার খাবার জুটল না কেন? প্রতিবেশীদের যেটুকু সামর্থ্য, সাহায্যের হাত তাঁরা বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু, তার ভোটে নির্বাচিত যে সরকার, তাঁরা? অসুস্থ হয়ে কাজ হারালে, এক তরুণের সপরিবার উপবাসই কেন অবশ্যম্ভাবী নিয়তি বলে মেনে নিতে হবে? এত প্রাচুর্য, রাষ্ট্রের এত শত ঘোষণা, এত মেলা-খেলা-উৎসব— তার ওপিঠে, পরিবারের রোজগেরে মানুষটি শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে অনাহার? একেই অনিবার্য বলে মেনে নিতে হবে? দুবেলা পেটপুরে খাবার কি নাগরিকের অধিকার নয়?
আমি জানি না, মেয়েটির মনে আদৌ প্রশ্নগুলো জাগবে কিনা। আমাদের প্রত্যেকের মনের প্রশ্নগুলো ছকে দেয় সমকালীন ভাবনার প্যারাডাইম। চেতনার নির্মাণও সেভাবেই। কথাটা কিঞ্চিৎ জটিল দর্শনের মতো শোনালেও, বাস্তব হতে উৎপন্ন এবং বাস্তবের ব্যাখ্যাকার বলেই এই দর্শনটুকু গ্রাহ্য। অতএব, প্রতিটি ভোটের আগে শোনা বাঁধা বুলির মতো, এবারের নির্বাচনও ‘অতি গুরুত্বপূর্ণ’— কিন্তু, অন্যান্য নির্বাচনের মতোই, এবারের নির্বাচনও আদতে অ্যাজেন্ডাহীন। অ্যাজেন্ডা অবশ্যই রয়েছে— কিন্তু, সে অ্যাজেন্ডা, মূলত, সবচাইতে কম খারাপকে বেছে নেওয়ার পক্ষে সওয়াল। আমাদের মনের প্রশ্নগুলো নির্ধারণ করে দেয় আমাদের চিন্তার প্যারাডাইম। আর্থসামাজিক সিঁড়িতে অনেক নীচে বসে থাকা মেয়েটিকেও সে প্যারাডাইম ছাড়বে না। দুবেলা ভরপেট খেতে পেয়ে সুস্থভাবে বেঁচে থাকা যে একটি সভ্য দেশের নাগরিক হিসেবে তার প্রাপ্য, তার অধিকার— ভাবতে পারবে কি মেয়েটি? সেই অধিকার অর্জনের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারত তার ভোটমেশিনের বোতাম, ভাবতে পারবে সে? না, আমি নিশ্চিত পারবে না। কেননা, সে যদি তেমন করে ভাবতে পারত, তাহলে ভোটমেশিনের দলীয় প্রতীকগুলো এই অধিকার বা তার অপ্রাপ্তি নিয়েই কথা বলত। অতএব, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা যাঁরা করছেন, তাঁদের প্রচারসভার বক্তব্যই পরোক্ষ প্রমাণ, এই মেয়েটির মতো মানুষেরা ন্যূনতম অধিকার অর্জনের জন্যে লড়াই তো দূর, সেসবের আশাও করে না।
মানুষের বেঁচে থাকার জন্যে জরুরি অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান আর তার সঙ্গে স্বাস্থ্য এবং শিক্ষা। শিক্ষার শেষে কাজ না-জুটলে প্রথম তিনটি জোটাতে কালঘাম জোটে— এবং শেষমেশ শিক্ষায়ও অনাগ্রহ জন্মায়। ন্যূনতম অধিকার বলে যেগুলোকে বুঝি, তা আয়ের ’পরে নির্ভরশীল হতে পারে না। অর্থাৎ আপনি কী খাবেন এবং কোথায় খাবেন, সে আপনার আয়-অনুসারী হতেই পারে, কিন্তু, আপনি দুবেলা পেট পুরে খেতে পাবেন কিনা, তা আয়নিরপেক্ষ হওয়াটাই সভ্য দেশের লক্ষণ হওয়া উচিত। স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও তা-ই। কিন্তু, আমাদের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বয়ানের অনুসারে নির্মিত রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা সেই কথাগুলো সামনে এনে উঠতে পারে না— ইচ্ছে করেই সামনে আনে না। রাষ্ট্রের কাছে, রাষ্ট্রব্যবস্থার কাছে মেয়েটির মতো মানুষদের প্রত্যাশা বিভিন্ন ব্যানার ও কাঁটাতার দিয়ে সীমায়িত হতে থাকে।
অতএব, বছর-কুড়ির মেয়েটির তরুণ স্বামী তিলে তিলে মরে যেতে থাকে, একবেলা আধপেটা খাবার খেয়ে ঘ্যানঘেনে কান্না কাঁদতে থাকে তার শিশুকন্যা, মেয়েটির দু চোখে ক্লান্তি হতাশা অতিক্রম করে জেগে উঠতে পারে না কোনও রাগ বা তীব্র ঘৃণা— আশা তো অনেক দূরের কথা।
বাড়ি ফিরে দিনের ক্লান্তি কাটাতে সান্ধ্য টিভির সামনে বসি চায়ের কাপ হাতে। ফ্যাসিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, দুর্নীতি, স্বৈরাচার, ঘুষ, দলবদল— শব্দগুলো কাপাসফুলের বীজের মতো হাল্কা হয়ে ঘুরে বেড়াতে থাকে আমার আশেপাশে।
মেয়েটি এবং আমি, দুজনে একই সাধারণ নির্বাচনের লাইনে দাঁড়াই, একই দেশের নাগরিক আমরা, তার প্রমাণ বলতে এটুকুই। মেয়েটির কাছে, মেয়েটির মতো ‘ওদের’ কাছে আমাদের প্রত্যাশা বলতে, আমাদের বেঁধে দেওয়া অ্যাজেন্ডা মেনে যেন ওরা আমাদের পছন্দের— অর্থাৎ আমাদের সবচেয়ে কম অপছন্দের— সরকার বেছে নেয়, এটুকুই। আর ওদের প্রত্যাশার কথা কবে কে-ই বা ভেবেছে!
পুনশ্চ
লেখাটা শেষ হয়ে গিয়েছিল। বাকি অংশটুকু স্রেফ অধিকন্তু— না-ও পড়তে পারেন। তবু, যেহেতু বই পড়েই জীবনের অধিকাংশ সময় কেটেছে, কাটছে, এক্ষেত্রেও একখানা বইয়ের গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটা আপনাদের শোনাই।
এমনই এক সাধারণ নির্বাচন। দেশের পার্লামেন্টের নির্বাচন। কিন্তু, সকাল থেকে ভোটের লাইনে লোক নেই। কেউই ভোট দিতে আসছে না। বুথ সুনসান। সকলেই চিন্তিত। কিন্তু, দুপুর গড়াতে আচমকাই ভোটের লাইন উপচে পড়তে থাকে। দলে দলে মানুষ এসে দাঁড়ান আর চুপচাপ ভোট দিয়ে নিঃশব্দে বাড়ি ফিরে যেতে থাকেন। বুথ-ফেরত সমীক্ষার জন্যে মিডিয়া এলে, কেউই উত্তর দেন না। হেসে মনে করিয়ে দেন, এ মা, কাকে ভোট দিয়েছি জিজ্ঞেস করাটা যে বেআইনি, জানেন না!
ঝটকাটা লাগে গণনার সময়। দেখা যায়, তিরাশি শতাংশ মানুষ জমা দিয়েছেন ফাঁকা ব্যালট— হ্যাঁ, বিলকুল ফাঁকা। তাঁরা কাউকে ভোট দেননি।
আতঙ্ক তৈরি হয় ক্ষমতাসীন শ্রেণির মধ্যে। ত্রাস। কী করা যেতে পারে এই পরিস্থিতিতে, সে নিয়ে তাঁরা দিশেহারা হয়ে যান। এক মন্ত্রী চমৎকার প্ল্যান ভাঁজেন। ঘোষণা করে দেন, দেশ এক সন্ত্রাসবাদী হানার মধ্যে পড়েছে। জারি হয় জরুরি অবস্থা। হঠাৎ করে ঘটে যায় এক বোমা বিস্ফোরণ। মিডিয়া সঙ্গে-সঙ্গেই জানিয়ে দেয়, এ সেই সন্ত্রাসবাদী হানারই অংশ। রাষ্ট্রব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য যে ‘গণতান্ত্রিক পদ্ধতি’, তাকেই যখন প্রত্যাখ্যান করেন দেশের অধিকাংশ নাগরিক, তখন রাষ্ট্রব্যবস্থার অছিরা ভারী সঙ্কটে পড়ে এলোমেলো আচরণ করতে থাকেন। রাষ্ট্র অতিরাষ্ট্রে পরিণত হয়ে সঙ্কটের মোকাবিলা করতে চায়।
বাকি গল্পটা বলার অবকাশ নেই। পর্তুগালের লেখক হোসে সারামাগো-র লেখা এই বই— ‘সিইং’। অর্থাৎ দেখা। এটি তাঁর পূর্ববর্তী বই ‘ব্লাইন্ডনেস’-এর সিক্যুয়েল।
না, ‘নোটা’-র সমর্থক আমি নই। ভোটের মেশিনে নোটা কোনও বিকল্প অ্যাজেন্ডার কথা বলতে পারে না— সঠিক অ্যাজেন্ডাগুলোর কথা জোরগলায় বলে উঠতে পারে না— কাজেই, এই ‘প্রত্যাখ্যান’ও এক অর্থে বর্তমান ক্ষমতাসীন শ্রেণির অ্যাজেন্ডাগুলোকেই জিতিয়ে দেয়। বিরোধী মতবাদীদের আলস্যের কারণেই গদিতে থেকে গিয়েছিলেন অতি-দক্ষিণপন্থী এবং অনাচারী রাজনীতিকরা, এ নজির পৃথিবীর ইতিহাসে কম নেই। এবং পরবর্তী ইতিহাস বলে, তার পরিণতি সুখকর হয়নি।
কিন্তু আজকাল বড্ড মনে হয়, বর্তমান রাজনীতির আপাত অ্যাজেন্ডাগুলো আমাদের স্বপ্ন দেখাটাকেই সীমায়িত করে দিতে চাইছে। জীবজগতের মধ্যে মনুষ্যজীবনকে ভিন্নতর করে চিহ্নিত করে দেয় যে কখানা বৈশিষ্ট্য, উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার অভ্যেস (নাকি অধিকার) তার মধ্যে একেবারে প্রাথমিক। স্বপ্নগুলোকে বেড়া দিয়ে বেঁধে ফেলার এই রাজনীতি, স্বপ্নগুলোকে গুলিয়ে দেওয়া অ্যাজেন্ডার এই রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করতে পারাটা জরুরি, খুবই জরুরি।
নির্বাচনের ঠিক মুখে,অন্ধকার-ছাওয়া হার্ড রিয়েলিটিময় এ লেখা। পড়ে, খানিক থম্ মেরে বসে আছি।
হয়তো প্রসঙ্গান্তর, হয়তো নয়,বলি, আমার সাহায্যকারিণী, বাড়িতে নিগ্রহ পায় রোজ, ওকে যখন ডিভোর্স নিতে বলি,ও বলে, শাঁখা সিঁদুর না পরলে, গ্রামের শেয়াল কুকুর ছিঁড়ে খাবে গো…