বায়ুদূষণ: একটি নাগরিক সমস্যা

সোমনাথ মুখোপাধ্যায়

 


প্রাবন্ধিক, অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক

 

 

 

ঢাকে ভোটের কাঠি পড়তেই আমাদের চেনা চারপাশের আমেজটা রাতারাতি বেমালুম বদলে যায়। প্রতিদিনের চেনা খবরের কাগজগুলো ভরে ওঠে গরমাগরম রাজনৈতিক খেউড় আর ভোটসার্কাসের কুশীলব ক্লাউনদের নানান কসরতের খবরে। আম পাঠক কী করবে! সে সব খবরে নিজেদেরকে ডুবিয়ে রাখতে আমরা বাধ্য হই। এমনই সব খবরের ভিড়ে নিজেকে আড়াল করে রাখতে চাওয়া লাজুক মানুষের মত মুখ লুকিয়ে থাকে কিছু খবর। সেদিন এরকমই এক খবরে সাতসকালেই বয়ঃভারে ঘোলাটে হয়ে আসা চোখ দুটো হঠাৎই আটকে গেল। দেশের রাজধানী থেকে পিটিআই পরিবেশিত খবরের শিরোনাম “বিশ্বের দূষিত ৩০টি শহরের মধ্যে ২২টি ভারতেই: রিপোর্ট”। এখানেই শেষ নয়। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত রাজধানী শহরগুলির মধ্যে শীর্ষে রয়েছে দিল্লি, আমাদের দেশের রাজধানী। সুইস সংস্থা ‘আইকিউ এয়ার’ রিপোর্ট জানাচ্ছে দিল্লি ছাড়া বিশ্বের দূষিত শহরগুলির মধ্যে রয়েছে ভারতের আরও ২১টি শহর। তারা হল গাজিয়াবাদ, বুলন্দশহর, বিসরাখ, নয়ডা, গ্রেটার নয়ডা, জালালপুর, কানপুর, লখনৌ, মিরাট। এদের অবস্থান বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের শিরোপা পাওয়া চিনা শহর জিনজিয়াংয়ের ঠিক পরে— দ্বিতীয় থেকে নবম ক্রমপর্যায়ে। দশম স্থানে সেই দিল্লি। এই তালিকায় সগৌরবে থাকা অন্যান্য ভারতীয় শহরগুলি হল— ভিওয়ানি, আগ্রা, ফরিদাবাদ, ঝিন্দ, হিসার, ফতেহাবাদ বন্ধওয়াড়ি, গুরুগ্রাম, যমুনানগর, রোহতক, ধারুহেরা ও মোজাফফরপুর। এত দীর্ঘ ভারতীয় শহরের তালিকা যে নাম লিখতে লিখতে হাঁপিয়ে ওঠে মন। ইদানিং নানা আন্তর্জাতিক ক্রমতালিকায় পিছু হটতে থাকা ভারতবর্ষের নামের ক্ষেত্রে এ এক উদ্বেগজনক সংযোজন। এই প্রসঙ্গে চুপিসারে দু-চারটি মনকথা কইবার জন্যই এই প্রবন্ধের অবতারণা।

 

প্রসঙ্গ: বায়ুমণ্ডল

জলের মাছেদের মত আমরাও এক অদৃশ্য গ্যাসের সমুদ্রের মধ্যে ডুবে রয়েছি। পৃথিবীর গভীরতম সমুদ্র-অংশের তুলনায় এই গ্যাসসমুদ্রের বিস্তৃতি বা গভীরতা অনেক অনেক বেশি— প্রায় ১০০০০ কিলোমিটার। রসময় পঞ্চভূতের অন্যতম উপাদান বায়ু তথা বায়ুমণ্ডল কতগুলি গ্যাসের মিশ্রণ। আবহবিজ্ঞানীরা উপাদানগুলোকে দুটো ভাগে ভাগ করেছেন। ১. স্থায়ী উপাদান এবং ২. পরিবর্তনশীল উপাদান। ক্লাসের শান্ত ছেলেদের নিয়ে যেমন মাস্টারমশাইদের বিশেষ উদ্বেগ থাকে না, যত চিন্তা দুরন্তদের নিয়ে, বায়ুমণ্ডলের ক্ষেত্রেও কিন্তু তেমনটাই ঘটে। এই সমস্ত উপাদান প্রাকৃতিক নিয়মেই তাদের ভারসাম্য বজায় রেখে চলে। তবে পরিবর্তনশীল উপাদানগুলির অনুপাতের পরিবর্তন ঘটলে বায়ুমণ্ডলের সুস্থিতি বা গুণগত ভারসাম্যের উদ্বেগজনক পরিবর্তন ঘটে, বায়ুর প্রাণদায়ী বৈশিষ্ট্যের অবনমন হয়। একেই সোজা কথায় আমরা বায়ুদূষণ বলি। বায়ুদূষণ এই সময়ের পৃথিবীর অন্যতম প্রধান সমস্যা। তবে, বায়ুদূষণের সমস্যাটা নিছকই একালের তেমনটা বোধহয় নয়। আজ যে গ্যাসসাগরে আমাদের, পার্থিব প্রাণীকুলের নিত্য বিচরণ, সেই বায়ুমণ্ডলও তার সৃষ্টির আদিপর্ব থেকে নানা পরিবর্তনের পথ দিয়ে আজকের অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। আগামী দিনেও সে তার গ্যাসীয় অনুপাতের ভারসাম্যে কোনও রদবদল হবে না তেমনটা কিন্তু নয়। তাহলে প্রশ্ন উঠবেই বদল যদি স্বাভাবিক হয় তাহলে বায়ুদূষণ নিয়ে এত হৈ চৈ, গেল গেল আর্তনাদের কী প্রয়োজন! মনে রাখতে হবে সমস্যাটা বায়ুমণ্ডলের নয়, সমস্যাটা আমাদের, আমাদের অস্তিত্বের। পৃথিবীতে আদি উদ্ভিদ-প্রাণের সংযোজন আদি বায়ুমণ্ডলের গ্যাসীয় অনুপাতে এক বড় পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। প্রথমে জলে, আরও পরে স্থলভাগে উদ্ভিদের আবির্ভাব বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে। কমতে থাকে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের অনুপাত। প্রাণদায়ী অক্সিজেন গ্যাসের উপস্থিতি কালক্রমে বিচিত্র প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণময় বিকাশের পথকে প্রশস্ত করে। আজ উদ্বেগের কারণ এখানেই। বায়ু দূষিত হচ্ছে। দূষণের মাত্রা যত বাড়ছে ততই কমছে এই পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের সম্ভাবনা। আজ তাই সারা পৃথিবী জুড়েই ঘরের, বাইরের বায়ুর গুণগত স্থিতাবস্থা (ambient air quality) বজায় রাখার কথা বলা হচ্ছে। বায়ুমণ্ডলে অবস্থিত উপকরণ যেমন পার্টিকুলেট ম্যাটার, ওজোন গ্যাস সহ অন্যান্য ফটোকেমিক্যাল অক্সিডেন্ট সমূহ, কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড এবং সিসার উপস্থিতির মাত্রা যত বাড়বে তত কমবে বায়ুর প্রাণদায়ী গুণগত স্থিতাবস্থার মান। আমাদের উদ্বেগ শঙ্কা চিন্তা এখানেই।

 

নগরায়ণ ও বায়ুদূষণ

কলকাতা শহরের লাগোয়া যে দ্রুত বদলে যাওয়া শহুরে জনপদে বিগত প্রায় তিন দশক কাল ধরে আমার বাস, তার নামের সঙ্গে এখনও আশ্চর্যজনকভাবে লেপ্টে রয়েছে ‘গ্রাম’ শব্দটি। নাগরিক সমাজের কাছে ‘গ্রাম’ শব্দটির কদর নেই, ফলে আমার একান্ত পরিজন মহলের অনেকেই আমার বর্তমান আবাসের নাম শুনলে এখনো ভ্রূ কুঁচকে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলেন ‘ও তোমরা… গেরামে থাকো!’ আমার অবশ্য তাতে কিছু আসে যায় না। তবে উপেক্ষার বহর কিঞ্চিৎ অধিক হলে পরিবারের অন্য সদস্যরা প্রত্যুত্তর দিতে ছাড়েন না। এক্ষেত্রে আমার শহুরে উপলব্ধ নাগরিক পরিষেবার লম্বা তালিকা পেশ করে ঢাল বাগিয়ে তারা আত্মশহরের মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে নেমে পড়ে। যুক্তিতর্কের কূটকচালে জয়ী হলে আমার ‘গেরাম’ শহরের তকমা লাভ করে, আর আমরা পাই এক আত্মপ্রসন্নতা। জয়ের স্মারক।

যে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলে এই পর্বের আলোচনা শুরু করেছি সেই বিষয়টি— গৌরবের প্রসঙ্গটি— একটি দেশের ক্ষেত্রেও আজ সমানভাবে প্রযোজ্য। কেন বলছি এ কথা? যেসব সূচকের সাহায্যে কোনও দেশের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পরিমাপ করা হয় তার মধ্যে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাপকাঠিটি হল মোট জনসংখ্যার সাপেক্ষে শহরবাসী জনসংখ্যার অনুপাত। এই হিসেবে দেশের শহরবাসী জনসংখ্যার অনুপাত বাড়লে আন্তর্জাতিক স্তরে দেশের সম্মান বাড়ে, আমাদের চওড়া বুক আরও চওড়া হয়। অথচ ভারতের এক গৌরবময় অতীত রয়েছে বিশ্বের নগরায়ণের ইতিহাসে। ভুললে চলবে না প্রাচীন সিন্ধু সভ্যতা— যার গৌরবময় উত্তরাধিকারী আমরা— ছিল একান্তভাবেই নাগরিক সভ্যতার পীঠভূমি। অবশ্য সেই গৌরবের স্রোতপ্রবাহ পরবর্তীকালে সমান ধারায় বজায় থাকেনি নানান কারণে। বিশ্বের নগরায়নের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাব যে শিল্পবিপ্লবের (১৭৬০-১৮৪০) অনুষঙ্গে ইউরোপে নগরায়নের ঢেউ লাগে। এই ঢেউ ভারতে আছড়ে পড়তে অনেক অনেক বেলা গড়িয়ে যায়। তাই এই দেশে নগরায়ণের হার শ্লথ। উপরন্তু ভারতের আর্থিক বিকাশের মূল অবলম্বন হল কৃষি। এই কারণে ভারতের মোট জনসংখ্যার অনুপাতে শহর, নগর বা পৌর এলাকাবাসী মানুষের অনুপাত যথেষ্ট কম— ৩৫ শতাংশ।

আলোচনার শুরুতে পৃথিবীর দূষিত শহরগুলির তালিকায় ঠাঁই পাওয়া যে ২২টি শহরের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার তালিকার দিকে আর একবার নজর দেওয়া যাক। এই তালিকায় যেসব শহরের নাম রয়েছে তাদের মধ্যে দিল্লিকে বাদ দিলে ১০টি শহর উত্তরপ্রদেশের, রাজস্থানের ১টি, হরিয়ানার ৯টি এবং ১টি শহর বিহার রাজ্যের অন্তর্গত। সদ্য সদ্য শহরের তকমা পাওয়া নবজাত এই শহরগুলি গড়ে উঠেছে মূলত জনসংখ্যার নিরিখে। ফলে নয়ডা, কানপুর, লক্ষ্ণৌ, মিরাট বা আগ্রাকে বাদ দিলে অন্য শহরগুলো খানিকটা অপরিচিত শুধু নয়, শহরের নাগরিক পরিকাঠামোর বিচারেও বেশ পিছিয়ে রয়েছে। এইসব জনপদে লোকজনের আনাগোনা বেড়েছে বটে, কিন্তু পরিকাঠামোকেন্দ্রিক পরিষেবার ততটা উন্নতি হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এসব জনপদে নিরন্তর আছড়ে পড়ছে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা গ্রামীণ জনসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত স্রোত, বাড়ছে ভিড়, তড়িঘড়ি গড়ে উঠছে কিছু পরিষেবাব্যবস্থা, মাথা উঁচিয়ে গজিয়ে ওঠা কিছু ‘মকান’, ফাস্টফুডের দোকান, সস্তা বিনোদনব্যবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি। এমনই সব শহরে দূষণের মাত্রা বা ব্যাপ্তি কেবল বায়ুমণ্ডলের দূষণেই সীমাবদ্ধ রয়েছে তা কিন্তু নয়। পঞ্চভূতের অন্যসব উপাদানের অবস্থাও বেহাল, বিপন্ন। ‘প্রত্যেক ক্রিয়ারই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে’— বলবিদ্যার এই সূত্রকে মেনে নগরায়ণের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নেমে আসতে চলেছে এই ভয়ঙ্কর বিপর্যয়। আর একটু তলিয়ে দেখা যাক বিষয়টা।

 

বাতাস, তুমি কেমন আছ?

ছোটবেলা সাততাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠিয়ে ঠাকুরমা বলতেন— যা ছাদে গিয়ে বুক ভরে নে রে শ্বাস বিশুদ্ধ বাতাসে। প্রবীণা এই মানুষটির বিশ্বাস ছিল ভোরের বাতাস দিনের অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক প্রাণদায়ী শুদ্ধতর থাকে। আমার ঘুমাতুর চোখ আলসেমির অর্গল এঁটে শয্যা আঁকড়ে পড়ে থাকতে চাইলে, ঠাকুমা কুঁড়েমির গাল দিয়ে নিজেই গুটি গুটি পায়ে বেরিয়ে পড়তেন প্রভাতী পরিক্রমায়। সত্যিই কি ভোরের বাতাস দিনের অন্য সময়ের চেয়ে শুদ্ধতর থাকে? এখন ঠাকুমা নেই। ভোরের আলো চোখে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে চোখ মেলে মাথার কাছে রাখা মুঠোফোন হাতে তুলে ওয়েদার বাটনে আঙুল ঠেকাতেই সেদিনের আবহাওয়া সংক্রান্ত নানা তথ্যের সঙ্গে ভেসে ওঠে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইন্ডেক্স) সংক্রান্ত তথ্য। তা দেখে ভোরঘুম ছুটে যায়। ভোরের বাতাসের বিপদজনক সূচকমান ভয় দেখায় আয়েসি শহুরে যাপনকে। সতর্কবাণী দেখে ঘেমে ওঠে শরীর— AQI: 184. Unhealthy. Air quality is extremely poor. Try to stay indoors. Close your doors and windows. ভোরের বাতাসে থাকা অতিথি উপাদানের সূচকমান আরও শঙ্কিত করে যখন দেখি— PM2.5: 173.0, PM10: 184.5, SO2: 23.4, NO2: 26.8, O3: 8.1, CO: 3.5। সূচকভাষ্যের সাঙ্কেতিক নির্দেশ দেখে মাথা গরম হয়ে ওঠে, মশারির ভেতরে ঘুরপাক খাওয়া সারারাতের ক্লান্ত বাতাস ভারি হয়ে ওঠে, বুকের বাঁ দিকটা চিনচিন করতে থাকে অজানিত উদ্বেগে। অনেকটা সবুজ হয়ে থাকা আমার গ্রামশহরের বাতাসের হাল যদি এমন হয়, তাহলে তালিকায় থাকা ২২টি ভারতীয় শহরের কী হাল!

নানান সূত্রে আগত ওই বায়বীয় উপাদানগুলি সম্পর্কে, তাদের বিরুদ্ধতা বিষয়ে, দু-একটি কথা এই অবসরে জেনে নিই।

  • PM10: পার্টিকুলেট ম্যাটার। শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা তৈরিতে এর জুড়ি মেলা ভার। সহন মাত্রার অতিরিক্ত উপস্থিতি চোখ ও গলার ক্ষতি করে। আয়তনে বড় হওয়ার দরুন এইসব কণিকা শ্বাসযন্ত্র সহজে গ্রহণ করতে পারে না। ফলে মানুষ ধীরে ধীরে হাঁপানি রোগীতে পরিণত হয়।
  • PM2.5: ফাইন পার্টিকুলেট ম্যাটার। আয়তনে ছোট হওয়ায় নাসাপথে সহজেই শরীরে ঢুকে পড়ে ফুসফুস ও হৃদযন্ত্রকে বিকল করে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রনিক শ্বাসযন্ত্রের রোগীতে পরিণত হয় মানুষ।
  • NO2: নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড। শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা তৈরি করে।
  • SO2: সালফার ডাই অক্সাইড। ক্রনিক ব্রঙ্কাইটিসের অন্যতম কারণ।
  • O3: গ্রাউন্ড লেভেল ওজোন। শ্বাসযন্ত্রের সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে বুকের যন্ত্রণা বাড়ায়।
  • CO: কার্বন মনোক্সাইড। মাথা যন্ত্রণার মত প্রাথমিক সমস্যা থেকে হৃদরোগের মতো জটিল সমস্যা সৃষ্টিতে এই উপাদানের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

এসব তথ্যকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা মানেই হল নিজেদের অন্তিম সময়কে ত্বরান্বিত করা। কখনও দারিদ্র্যের দোহাই দিয়ে, কখনও উন্নয়নের ঢাকে তাল ঠোকার অছিলায়, কখনও বা উন্নততর জীবনের স্বপ্নমোহে আমরা বিভ্রান্ত হই। এই সমস্যা বিকাশশীল বিশ্বের। এই মুহূর্তে করোনার দাপটে ত্রস্ত বিশ্ব। সভ্যতার সকল গরিমাকে খাটো করে বহাল তবিয়তে মারণ-নৃত্যে মেতে রয়েছে এই অণুজীব। মৃত্যুর মিছিল দেখে আঁতকে উঠছে সারা বিশ্ব। অথচ চিকিৎসকদের অভিমত, শ্বাসযন্ত্রের প্রদাহজনিত সমস্যায় অনেক অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে জীবন হারাচ্ছে। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই সমস্যা, বায়ুদূষণের সমস্যা যত প্রকট হচ্ছে তত বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। অথচ আমরা উদাসীন এই ঘনায়মান বিপর্যয় সম্পর্কে। সমস্যাটি কেবল বায়ুতেই সীমাবদ্ধ থাকছে তেমনটাও তো নয়। পঞ্চভূতের প্রাণময় উপাদানগুলি একে অন্যের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কে অন্বিত। তাই একের অসুখে অন্যরাও সমানভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। বিপন্ন হচ্ছে ধরিত্রী ও তার সন্তানেরা।

 

এসো! এবার একটু সচেতন হই…

শহুরে পরিমণ্ডলে বায়ুদূষণের সমস্যা তৈরিতে মানুষের ভূমিকা যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হয়ত সবাই বুঝতে পারছি। এই বিষয়ে মানুষকে দায়ী করার অন্যতম কারণ হল এই যে, শহর প্রকৃতি তৈরি করে না। প্রকৃতির ক্যানভাসকে বদলে ফেলে নিজের ইচ্ছেমতো শহর জনপদ গড়ে তোলে মানুষ। নিজের খেয়ালের পালে বাতাস লাগাতে গিয়ে প্রকৃতি পরিবেশের বিপুল ক্ষতি করে। নগরায়ণের দৌলতে কেবল ক্ষিতি, অপ, তেজ, মরুৎ আর ব্যোমের রসময় ভারসাম্যই বিপর্যস্ত হয় না, বিপুল পরিমাণে প্রাকৃতিক সম্পদের অপচয় হয়, বাড়ে জীবনের ঝুঁকি। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে হর্ম্যমালার সারি তুলতে গিয়ে বিপুলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত জীব পরিমণ্ডলকে, বাস্তুতান্ত্রিক সুস্থিতিকে। ভারতের সবচেয়ে দূষিত শহরগুলোর দিকে আরও একবার নজর দিলে আমরা দেখব এই ভুঁইফোড় শহরগুলির অধিকাংশই উর্বর সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির শস্যভাণ্ডার-কেন্দ্রিক, যেখানে একসময় গড়ে উঠেছিল হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর পাশাপাশি ঢোলাভীরা, বানাওয়ালি, রোপার, জ্ঞানেশ্বর-এর মত একদা সমৃদ্ধ জনপদগুলি। আজ তাদের অস্তিত্ব কোথায়? পৃথিবীর নানা প্রান্তে এমন বিলুপ্ত নগর-জনপদের প্রত্ননিদর্শন মিলবে। প্রকৃতির নিয়মকে পাশ কাটিয়ে মানুষ নিজের মতো করে চলতে চেয়েছে এতাবৎ কাল, ফল— বিশেষ করে দীর্ঘমেয়াদি ফল মোটেই সুখকর হয়নি মানুষের পক্ষে। তাও অতীত থেকে হয়তো কোনও শিক্ষাই নিইনি আমরা। সামনে আমাদের চলতে হবে একথা যেমন ঠিক, তেমনই ঠিক প্রকৃতির সঙ্গে পথ চলার বিষয়টি। মনে রাখতে হবে এই অমোঘ সত্যটি— ‘নগরজীবন ভঙ্গুর, টেকসই নয়।’ আজ পৃথিবীর দূষিত শহরের তালিকায় যে সমস্ত শহরের নাম নেই, সেই সমস্ত শহর বা নগরের মানুষরা যেন মনে না করেন— থাক, আমরা নিরাপদ! আমাদের শহরের নাম তালিকায় নেই! মনে রাখতে হবে দেশ-কাল-সময় নিরপেক্ষভাবে আমরা সকলেই এক ও অভিন্ন বায়বীয় শামিয়ানার নিচে বসবাস করি। আজ এই ছাতার কোনও অংশ ছিঁড়ে গেলে তার প্রভাব অন্য অংশেও পড়বে। তখন হাত কামড়ে মনস্তাপ করা ছাড়া আর গতি থাকবে না।

শেষ করব সাম্প্রতিক অতীতের কিছু সুখস্মৃতি দিয়ে। লকডাউন পর্বে পৃথিবী বেশ সুখে ছিল। কলকারখানার ধোঁয়া নেই, গাড়িঘোড়া চলা নেই, মানুষজনের ইতর কোলাহল নেই— ধরিত্রীর সে এক বড় সুখের সময়। পৃথিবীর বিধ্বস্ত শৃঙ্খলা যেন হঠাৎ করে তার হারিয়ে যাওয়া সুর, তাল, ছন্দকে ফিরে পেল দিনকতকের জন্য। বেশ স্বস্তিতে ছিল পৃথিবী কয়েকটা দিন। মানুষের জীবনে সুখ সহজে স্থায়ী হয় না। লকডাউন পর্ব মিটতেই পৃথিবী তার পুরনো গোলমেলে ছন্দে ফিরছে। ২০২১ সাল হয়ত হতে চলেছে সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে দূষিত বছর। আর এই কারণেই বাড়ছে আশঙ্কা, দুশ্চিন্তা।

এই অবস্থা থেকে কীভাবে মুক্ত হব আমরা? খুব কঠিন প্রশ্ন। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের ভোগের মাত্রা না কমালে দুর্ভোগের মাত্রা আরও বাড়বে। পরিমিত ভোগ প্রকৃতির অবাধ লুণ্ঠন ও যথেচ্ছ অপব্যবহারে রাশ টানতে পারে অনেকটাই। আমাদের এতকালের জীবনাদর্শের বদল ঘটাতেই হবে। ফসল কাটার পর অবশিষ্টাংশকে পুড়িয়ে বায়ুকে দূষিত করা চলবে না। এই বিষয়টি নগর-বায়ুদূষণের অন্যতম কারণ। আইনের প্রয়োগে আরও কঠোর হতে হবে। আর চাই ব্যাপক নাগরিক সচেতনতা। কাজটা এখনই শুরু হোক। আজ, এই মুহূর্তে…

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4887 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

1 Comment

  1. লেখাটা পুরনো তবে সমস্যা আজ‌ও সমানভাবে বর্তমান ও বর্ধমান। খুব জরুরি আলোচনা।

আপনার মতামত...