সন্ধ্যা ছটায় আগত মেয়েটি

সন্ধ্যা ছটায় আগত মেয়েটি: গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ | ভাষান্তর: হারুন রশীদ

গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

 



ভাষান্তর: হারুন রশীদ

 

 

 

 

ঝট করে ঝুলন দরজাটা খুলে গেল। হোসের রেস্তোরাঁয় তখনও কোনও খদ্দের আসেনি। দেয়াল ঘড়িটায় সবেমাত্র ৬টার ঘন্টা বাজল। সে জানে তার নিয়মিত খদ্দেররা এতই সময়ানুবর্তী যে সাড়ে ছটার আগে কেউ আসবে না। দরজা ঠেলে একটি মেয়ে ঢুকল রেস্তোঁরায়। সে প্রতিদিন ঠিক এই সময়েই আসে। ঢুকেই সে নিঃশব্দে কাউন্টারের এক পাশের টুলে বসে পড়ল। তাঁর দুই ঠোঁটের মাঝখানে একটি অপ্রজ্জ্বলিত সিগারেট।

–হ্যালো রানি, কী খবর তোমার?

মেয়েটা বসার সঙ্গে সঙ্গে রসিকতার সঙ্গে হাঁক দিয়ে বলল হোসে। তারপর কাউন্টারের ভেতরের দিকে দাঁড়িয়ে একটা কাপড়ের টুকরো দিয়ে তার উপরিভাগটা মুছতে লাগল। যখনই কোনও খদ্দের ঢুকে হোসে মোছামুছির কাজটা শুরু করে। এমনকি এই মেয়েটা যার সঙ্গে একটু বেশি খাতির, তার আগমনেও ব্যতিক্রম হয় না।

মোটাসোটা গোলগাল শরীরের হোসে এই রেস্তোঁরার মালিক। সে তার হোটেলকর্মীসুলভ রসিকতা দিয়ে খদ্দেরদের মন জুড়ায়। কাউন্টারের অন্যপ্রান্ত থেকে হোসে আবারও বলে উঠল—

–আজ তুমি কী খেতে চাও বলো?
–কী খাব সেটা বলার আগে তোমাকে ভদ্রতা শেখানো দরকার।

মেয়েটা কাউন্টারে তার কনুই দুটো রেখে ঠোঁটের মাঝখানে না ধরানো সিগারেটটা এমনভাবে চেপে রেখেছে যেন সেটা হোসের নজরে পড়ে। ঠিকই নজরে পড়ল হোসের। তাড়াতাড়ি বলে উঠল সে—

–আহহা আমি খেয়াল করিনি রানি।
–তুমি অনেক কিছুই খেয়াল করতে শেখোনি হে। একটু বাঁকা সুরে মেয়েটা বলল।

হোসে মোছামুছির কাপড়টা রেখে পিছন ফিরে স্যাঁতসেঁতে কাপবোর্ডের ভেতরে হাত দিয়ে একটা দিয়াশলাই বের করে আনল। দিয়াশলাই জ্বালাতেই মেয়েটা ঝুঁকে তার রুক্ষ খসখসে দুই হাতের মধ্যে মুখটা নামিয়ে সিগারেটটা ধরাল। সেই অবকাশে হোসে মেয়েটার সস্তা পুরু ভেসলিন লাগানো চুলের বাহার এবং উন্মুক্ত কাঁধের উপর দিয়ে গোলাপী অন্তর্বাসের ফুলের কাজগুলো দেখতে লাগল। মেয়েটা যখন মাথা তুলল তখন তাঁর স্তনের ঊর্ধ্বাংশের সুডৌল ভাঁজেও চোখ গেল তার। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে মেয়েটা মাথা তুলতেই হোসে বলল—

–আজ তোমাকে খুব সুন্দর দেখাচ্ছে রানি।
–বাকোয়াজি রাখো। ওসব মিষ্টি কথা বলে আমার কাছ থেকে পয়সা আদায় করতে পারবে না। ঝামটা দিয়ে বলে উঠল মেয়েটা।
–আরে না! আমি সেজন্য বলিনি রানি। তবে আমি বাজি রেখে বলতে পারি আজ তোমার দুপুরের খাবারটা তেমন জুতসই হয়নি। হোসে বলল।

মেয়েটা তার হাত দুটো কোনাকুনি ভাঁজ করে, কাউন্টারের ওপর কনুইয়ের ভর দিয়ে সিগারেটে একটা জোরালো টান দিয়ে পুরু ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছেড়ে, রেস্তোরাঁর প্রশস্ত জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকাল। তার দৃষ্টিতে কেমন এক বিষণ্ণ নিঃসঙ্গতা ছড়ানো।

–তোমাকে জম্পেশ একখানা কাবাব ভেজে দেই, কী বলো? হোসে বলল।
–আমার হাতে কিন্তু এখনও কোনও টাকাপয়সা আসেনি। মেয়েটা সতর্ক করে দিল তাকে।
–গত তিন মাস ধরেই তো তোমার হাতে কোনও টাকাপয়সা নেই, তবু তো আমি তোমার জন্য ভালো খাবারের ব্যবস্থা করে যাচ্ছি। হোসে আশ্বস্ত করল।
–আজকের কথা একটু আলাদা। মেয়েটা তখনও বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে।
–প্রতিদিন একই ব্যাপার। ঘড়িতে ছটা বাজলে তুমি এসে উপস্থিত হও, তারপর বলো তুমি কুকুরের মত ক্ষুধার্ত এবং আমি তোমার জন্য ভালো কিছু তৈরি করে দেই। আজকে এটুকুই ব্যতিক্রম যে তুমি এসে বলোনি কুকুরের মত ক্ষুধার্ত তুমি।
–হ্যাঁ এটা ঠিক বলেছ। আজ এটাই ব্যতিক্রম। মেয়েটা তার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল।

সে তখন কাউন্টারের অন্য প্রান্তে ফ্রিজের পাশে গোছগাছের কাজ করছিল। মেয়েটা তার দিকে দুই তিন সেকেন্ড তাকিয়ে নিরীক্ষা করল। তারপর কাবার্ডের ওপরে দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখল ছটা বেজে তিন মিনিট। সে মুখ দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে গলায় একটু ভাব এনে বলে উঠল—

–আজ আমি ছটার সময় আসিনি কিন্তু হোসে। সে কারণেই আজ ব্যতিক্রম হল।

দেয়ালঘড়িটার দিকে তাকিয়ে হোসে বলল— আমি আমার হাত কেটে ফেলব যদি ঘড়িটা এক মিনিটও স্লো হয়।

–না হোসে মোটেও ঠিক বলছ না তুমি। আমি আজ ছটার সময় আসিনি। বলল মেয়েটা।
–কিন্তু তুমি যখন দরজা দিয়ে ভিতরে ঢুকছিলে তখনই এটা ছটার ঘন্টা বাজানো শেষ করেছিল। বলল হোসে।
–সে যাই বলো আমি এখানে আসার ১৫ মিনিট পার হয়ে গেছে কিন্তু।

হোসে তার ডান চোখের পাতাটা হাতের আঙুল দিয়ে ফাঁক করে মেয়েটার মুখের উপর মাথাটা নিয়ে গিয়ে বলল—

–আমার এখানে একটা ফুঁ দাও দেখি।

মেয়েটা ঝট করে মাথাটা পেছনে সরিয়ে নিল। তার চোখে তখন এক ধরনের ক্লান্তি আর বিরক্তি, তবু তাতে কেমন একটা মায়া আর বিষাদের যুগপৎ ছায়া খেলা করছিল।

–বোকার মত কথা বোলো না হোসে। ভেবেছ মাতাল হয়েছি আমি। তুমি জানো গত ছ মাস আমি মদ খাইনি। বলল মেয়েটা।
–ওসব চাপাবাজি অন্য কোথাও কোরো, আমার কাছে নয়। আমি নিশ্চিত এখানে আসার আগে তুমি কমপক্ষে গোটা দুয়েক পাঁইট মদ গিলে এসেছ।
–আহহা। কীভাবে টের পেলে? ঠিক ধরেছ দেখি। এদিকে আসার আগে এক বন্ধুর সঙ্গে কয়েক পেগ গিলে এসেছি। দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল মেয়েটা।
–এবার বুঝতে পেরেছি ঘটনা। হোসে বলল হেসে।
–ওতে বোঝাবুঝির কিছু নেই হোসে। ব্যাপার হল আমি এখানে ১৫ মিনিট ধরে আছি।

মেয়েটার কথা শুনে কাঁধ ঝাঁকিয়ে শ্রাগ করে নিরুপায় ভঙ্গি করে হোসে বলল— ঠিক আছে যদি তাই চাও, তাহলে তাই হবে। দিলাম তোমাকে ১৫ মিনিট। মানলাম তুমি ১৫ মিনিট আগেই এসেছ। তবে ১০ মিনিট আগে-পরে হলে এমন কীইবা এসে যায়?

–অনেক বড় ব্যাপার হোসে। যদিও ঘটনাটা ওরকম হোক তা আমি চাইনি। সে যাকগে, আসল কথা আমি এখানে ১৫ মিনিট ধরে আছি। মেয়েটা তার হাত দুটো কাউন্টারের ওপর টানটান করে ছড়িয়ে দিল, সেই সঙ্গে অনির্দিষ্ট কিছুর প্রতি এক ধরনের নির্বিকার অবহেলা ছু্ঁড়ে দিল যেন।
–ঠিক আছে রানি আমি তোমাকে গোটা একটা দিন এবং রাত দিয়ে দেব। তাতেই যদি তুমি সুখী হও। হেসে বলল হোসে। কথাবার্তা চালাবার পুরোটা সময় জুড়ে হোসে কাউন্টারের পেছনে তার জিনিসপত্র নাড়াচাড়া করছিল, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় রাখছিল। সে তার নিজের কাজটা করে যাচ্ছিল অভ্যস্ত হাতে।
–আমি আসলে তোমাকে সুখী দেখতে চাই। বলেই থেমে গেল হোসে। তারপর কী মনে করে মেয়েটার দিকে অন্যরকম একটা দৃষ্টি দিয়ে বলল—
–তুমি কি জানো আমি তোমাকে কত ভালোবাসি?

মেয়েটা এবার কেমন একটু শীতল চাহনি দিয়ে তার দিকে তাকাল। তারপর বলল—

–সত্যিই???? কী আশ্চর্য আবিষ্কার হোসে!!!! তুমি কি মনে করো এক লাখ টাকা দিলেও আমি তোমার সঙ্গে শুতে যাব?
–না না আমি ঠিক সেটা বোঝাতে চাইনি রানি। আবারও বলছি, তোমার দুপুরের খাবারটা সুবিধার হয়নি। কিছুটা বিব্রত হয়ে পাশ কাটাবার জন্য তড়িঘড়ি করে বলল হোসে।
–আমিও কিন্তু অন্য কিছু ভেবে কথাটা বলিনি। বলতে চেয়েছি কোনও মেয়ে এক লাখ টাকার বিনিময়েও তোমার ওই বিশাল শরীরের ওজন নিজের গায়ের ওপর নিতে রাজি হবে না। মেয়েটা এবার একটু তরল কণ্ঠে বলল।

কথাটা শুনে হোসে লজ্জায় একটু লাল হয়ে গেল। সে মেয়েটার দিকে পেছন ফিরে শেলফের জিনিসপত্র গোছাতে থাকল। মাথা না ঘুরিয়েই সে বলল—

–সত্যি তোমাকে আজ অসহ্য সুন্দর লাগছে রানি। আমার মনে হয় সবচেয়ে ভালো হয়, কাবাবটা খেয়ে তুমি বাড়ি গিয়ে ঘুম দাও।
–আজ আমার খিদে নেই। বলে মেয়েটা আবারও জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। ধূসর সন্ধ্যায় রাস্তায় চলাচলকারী লোকজনের দিকে তাকিয়ে কিছু যেন ভাবে। মুহূর্তের জন্য রেস্টুরেন্টের ভিতর নিস্তব্ধতা নেমে এল। হোসের কাপ প্লেট নাড়াচাড়ার টুংটাং শব্দ ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই।

হঠাৎ করে মেয়েটা বাইরে থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে হোসের দিকে তাকিয়ে কোমল সুস্থির আবেগময় কন্ঠে বলে উঠল—

–তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো হোসে?
–হ্যাঁ সত্যিই। এবার একটু শুকনো কণ্ঠে হোসে জবাব দিল।
–আমি তোমাকে যে সব কথা বললাম তা সত্ত্বেও তুমি আমাকে ভালোবাসো?
–কই, কী বললে তুমি আমাকে? হোসে তার দিকে না তাকিয়ে কণ্ঠে কোনওরূপ ওঠানামা ছাড়াই জানতে চাইল।
–সেই যে এক লক্ষ টাকার ব্যাপারটা বললাম। মেয়েটা তাকে স্মরণ করিয়ে দিল।
–ওহ ওটার কথা আমি তখনই ভুলে গেছি। হোসে বলল।
–তার মানে তুমি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
–হ্যাঁ নিশ্চয়ই। বলল হোসে।

আবারও কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজন। হোসে মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে আপন মনে কাজ করছে। মেয়েটা আরেক গাল ধোঁয়া ছেড়ে তাঁর বুকের ভারটা কাউন্টারের উপর রেখে মুখে একটু দুষ্টুমির ভঙ্গি করে জিভে কামড় দিয়ে লাস্যময়ী স্বরে বলল— এমনকি আমার সঙ্গে বিছানায় না গিয়েও তুমি আমাকে ভালোবাসবে?

এবার হোসে চোখ তুলে স্পষ্টভাবে মেয়েটার মুখের দিকে তাকাল।

–তুমি কি জানো, আমি তোমাকে এত ভালোবাসি যে আমি কখনওই তোমার সঙ্গে বিছানায় যাব না। বলল সে। তারপর হেঁটে এসে মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। তার পেশিবহুল হাত দুটো কাউন্টারের ওপর দিয়ে মেয়েটার সামনে রেখে সরাসরি মেয়েটার চোখে চোখ রেখে বলল,
–আমি তোমাকে এমনভাবে ভালোবাসি যে প্রতি রাতে তোমার সঙ্গে যে পুরুষটি বিছানায় যায়, তাকে আমি খুন করি মনে মনে।

এটা শুনে মেয়েটা প্রথমে একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। তারপরই সামলে নিয়ে গভীর মনোযোগী দৃষ্টি দিয়ে হোসের দিকে তাকাল। তাঁর  চেহারায় এক ধরনের বিচিত্র সহানুভূতি ও রসিকতার ছায়া একসঙ্গে খেলছিল। কিছুক্ষণের জন্য মেয়েটা চুপ থাকল। তারপর উচ্চস্বরে হেসে উঠে বলল—

–তুমি একটা হিংসুটে হোসে। আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না তুমি এরকম বেয়াড়া রকমের হিংসুটে হতে পারো!

লজ্জায় আবার লাল হয়ে গেল হোসে। গোপনে কিছু করতে গিয়ে ধরা পড়ে যাওয়া শিশুটির মতো লজ্জিত হয়ে মিনমিন স্বরে কোনওমতে বলল,

–যাহ কী যা তা বলছ! আজ কী হয়েছে তোমার বলো তো? মনে হচ্ছে তুমি কেমন অবুঝ আচরণ করছ। কেমন জানি অচেনা-অবুঝ আচরণ! আসলে তোমার এই নষ্ট জীবনটাই হয়তো ভোগাচ্ছে তোমাকে। বলতে বলতে সে হাতের কাপড়টা দিয়ে ঘাম মুছল।
–তো… তুমি বলতে চাইছ তুমি ঈর্ষান্বিত নও? মেয়েটা এবার একটু অদ্ভুত বিচিত্র এক দৃষ্টি দিয়ে হোসেকে বিদ্ধ করল, যে দৃষ্টিতে সংশয় এবং চ্যালেঞ্জ দুটোই মিশে আছে।
–হয়তো… হয়তো আমি ঈর্ষান্বিত। কিন্তু তুমি যেভাবে ভাবছ সেভাবে না।

হোসে তার শার্টের কলারটা একটু ঢিলা করে হাতের কাপড়টা দিয়ে গলা এবং ঘাড়ের ঘাম মুছতে থাকল।

–তাহলে কীভাবে?
–আমি তোমাকে এত বেশি ভালোবাসি যে তুমি যেসব কাজ করো সেটা দেখতে আমার খারাপ লাগে, কষ্ট হয়।
–কী কাজ?
–এই যে একেক দিন একেকজনের সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার ব্যাপারটা…
–তুমি কি সত্যিই একজন মানুষকে খুন করবে আমার সঙ্গে বিছানায় যাওয়া ঠেকানোর জন্য?
–না। বিছানায় যাওয়া ঠেকানোর জন্য তাকে খুন করব না। সে তোমার সঙ্গে বিছানায় গেছে সে কারণে খুন করব।
–ওই একই কথা হল। মেয়েটা বলল।

এবার দুজনের কথাবার্তার মধ্যে আরও খানিকটা ঘনিষ্ঠতা ভর করল। মেয়েটা নিচু স্বরে কোমল মুগ্ধতার সঙ্গে কথা বলছিল। দুজনে এত কাছাকাছি যে মেয়েটার মুখটা যেন হোসের গোলগাল বলিষ্ঠ কিন্তু শান্ত চেহারার সঙ্গে সেঁটে যাবে। হোসের বুকের ভেতর তোলপাড় চলছিল। সে স্থির দাঁড়িয়ে থাকলেও মেয়েটার উচ্চারিত শব্দগুলো তার মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন তুলছিল।

–তা ঠিক। হোসে বলল।
–তাহলে স্বীকার করছ তুমি একজন মানুষকে খুন করার উপযুক্ত। কথাটা বলার সময় মেয়েটা এক হাত দিয়ে হোসের খসখসে বাহুটা আঁকড়ে ধরে অন্য হাতটা দিয়ে তার পাছায় একটা চাপড় দিল।
–আমি যে কারণটা বলেছি সেই কারণের জন্য হলে আমি খুন করতে দ্বিধা করব না। হোসের কণ্ঠেও এক ধরনের নাটকীয়তায় এসে ভর করল।

এবার মেয়েটা ঠাট্টা ও রসিকতায় মেশানো  হাসিতে মেতে উঠে বলল—

–কী আজব কথা বলো তো? হোসে মানুষও খুন করতে পারে! এই মোটাসোটা গোলগাল চর্বিওয়ালা পেটমোটা বোকা লোকটা খুনখারাবির মতো কাজও করতে পারে? যে কিনা প্রতিদিন আমাকে সুস্বাদু খাবারের জোগান দেয়, বিনিময়ে একটা পয়সাও নেয় না। যে আমাকে প্রতিদিন মজার মজার গল্প শোনায় এবং আমি নতুন মানুষ খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত আমাকে সঙ্গ দেয়, সে কিনা মানুষ খুন করতে পারে এটাও কি বিশ্বাস করবে কেউ? কী অদ্ভুত ব্যাপার! তুমি তো রীতিমত আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছ হোসে।

হোসে এবার একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেল। বোধকরি একটু অপমানিতও বোধ করল। সম্ভবত মেয়েটা যখন ওরকম করে হাসতে শুরু করল তখন তার মনে হল সে ভুল কিছু বলেছে। মনে হল তাকে ঠকানো হয়েছে।

–তুমি মাতাল। তাই পাগলামি করছ। যাও বাড়ি গিয়ে ঘুমোও। মনে হয় না আজকে তোমার কিছু খাওয়া হবে। হোসে একটু বিরক্ত সুরে বলল।

মেয়েটার হাসি থেমে গেল সঙ্গে সঙ্গে। সে এখন গম্ভীর হয়ে বেদনালিপ্ত চেহারায় কাউন্টারের উপর তার মাথাটা রাখল। তাকিয়ে দেখতে থাকল লোকটা দূরে সরে গিয়ে ফ্রিজের কাছে গেল, ফ্রিজের দরজাটা খুলে খামোখা আবার বন্ধ করে দিল। তারপর কাউন্টারের অন্য প্রান্তে চলে গেল। সেখানে গিয়ে পরিষ্কার গ্লাসগুলোকে খামোখা মোছামুছি করল, শুরুতে যেমনটি করেছিল।

তখন মেয়েটা আবার তার দিকে তাকিয়ে স্থির শান্ত কণ্ঠে বলল— তুমি কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসো পেপিলো?

প্রিয় নামে ডাকা সত্ত্বেও সাড়া দিল না হোসে। সাড়া না পেয়ে মেয়েটা এবার একটু গলা তুলে ডাকল— হোসে।

কিন্তু পেপিলো ওরফে হোসে তার দিকে ফিরেও তাকাল না।

–হোসে!! এবার গলা আরও উঁচিয়ে ডাকল মেয়েটা। ডাক শুনে নিরুত্তাপ গলায় হোসে বলল—
–বাড়িতে যাও রানি এবং ঘুমিয়ে পড়ো। ঘুমোবার আগে ভালো করে গোসল করে নিও তাহলে ঘুম ভালো হবে।
–আমি সত্যি বলছি। আমি সিরিয়াস হোসে। বিশ্বাস করো আমি মাতাল নই। কণ্ঠে আকুলতা নিয়ে বলল মেয়েটা।
–তাহলে তুমি পাগল হয়ে গেছ। হোসে বলল।
–আরে শোনো না। তোমার সঙ্গে আমার আরও কথা আছে। এদিকে আসো তো। আবেগঘন স্বরে ডাকল মেয়েটা। এবার হোসে ধীর পায়ে এগিয়ে এল। কিছুটা আনন্দ কিছুটা অবিশ্বাস নিয়ে।
–আরও কাছে এসো প্লিজ। বলল মেয়েটা।

এবার মেয়েটার একদম কাছাকাছি গিয়ে ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল হোসে। মেয়েটা একটু ঝুঁকে দুই হাত দিয়ে তার চুলগুলো মুঠোর মধ্যে ধরে আদর করে টানতে টানতে বলল—

–তুমি আমাকে সেই কথাটা আবার বলবে শুরুতে যা বলেছিলে?
–কী বলছ তুমি? কোন কথা? হোসের মাথার চুল মেয়েটার হাতের মুঠোয় আবদ্ধ থাকা সত্ত্বেও তার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে বলল।
–সেই যে বললে তুমি সেই লোকটাকে খুন করবে আমার সঙ্গে বিছানায় যাওয়ার কারণে। মেয়েটা বলল।
–হ্যাঁ সেটা তো ঠিকই। তোমার সঙ্গে যে বিছানায় যাবে তাকেই আমি খুন করব।

মেয়েটা এবার তার চুল ছেড়ে দিল।

–সেক্ষেত্রে তুমি নিশ্চয় আমাকে রক্ষা করবে যদি আমি নিজেই সেই লোকটাকে খুন করি।

মেয়েটা খুব আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বলল হোসের শুয়োরের মতো বিশাল মাথাটিতে নিষ্ঠুর এক ঝাঁকুনি দিয়ে। কিন্তু হোসে কোন জবাব না দিয়ে হাসল শুধু।

–জবাব দাও হোসে। তুমি কি আমাকে রক্ষা করবে যদি আমিই তাকে খুন করি? বলল মেয়েটা।
–সেটা নির্ভর করবে অবস্থার উপর। ব্যাপারটা তুমি যত সহজে বলছ অত সহজ নয়। বলল হোসে।
–কিন্তু পুলিশ তোমার কথা যতটা বিশ্বাস করবে আর কাউকে ততটা বিশ্বাস করবে না। বলল মেয়েটা।

তার উপর মেয়েটার এতখানি আস্থার কথা শুনে হোসে খুব সম্মানিত ও সন্তুষ্ট বোধ করল এবং হাসল। মেয়েটা কাউন্টারের উপর দিয়ে তার দিকে ঝুঁকে বলল—

–এটা খুব সত্যি হোসে। আমি বাজি ধরে বলতে পারি তুমি জীবনে কখনও মিথ্যে কথা বলোনি।
–কিন্তু এতে করে তোমার কী লাভ হবে?
–লাভ আছে। পুলিশ তোমাকে চেনে এবং বিশ্বাস করে। সে কারণে তারা তোমাকে কোনও কিছুই দুবার জিজ্ঞেস করবে না। বলল মেয়েটা।

কাউন্টারের ওপাশে কিছুটা কম্পিত চিত্ত নিয়ে হোসে ভেবে পাচ্ছিল না সে কি বলবে। মেয়েটা আবারও জানালা দিয়ে বাইরে রাস্তার দিকে তাকাল। তারপর ঘড়ির দিকে তাকিয়ে গলার স্বর একটু বদলে কোনও খদ্দের আসার আগেই আলাপটা শেষ করার সুরে বলল—

–তুমি কি আমার জন্য স্রেফ একটা মিথ্যা কথা বলবে হোসে? শুধু একটা। আমি সিরিয়াস। বলবে তুমি?

এবার হোসে মেয়েটার দিকে অন্যরকম দৃষ্টি নিয়ে তাকাল। মেয়েটা তার দিকে এমন ধারালো চোখে তাকিয়ে আছে সেই দৃষ্টির ধার থেকে নিঃসৃত ভয়ানক কোনও চিন্তা তার মগজের মধ্যে ঘুরপাক খেয়ে এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে গেল। সে তার গলাটাকে সিরিয়াস করে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে বলল—

–আচ্ছা রানি ঠিক করে বলো তো তুমি কী ঝামেলা পাকিয়েছ? সত্যি সত্যি বলো আমাকে কী হয়েছে তোমার?

সে কাউন্টারের উপর হাত দুটো ভাঁজ করে রেখে মেয়েটার দিকে ঝুঁকে বলল। সেই সময় হোসের ভুঁড়িটা কাউন্টারের সঙ্গে চাপ খাওয়ার কারণে তার মুখ দিয়ে অ্যামোনিয়ার তীব্র দুর্গন্ধযুক্ত নিঃশ্বাস বেরিয়ে এসে মেয়েটার নাকে অসহ্য ধাক্কা দিচ্ছিল।

–এটা সত্যি খুব ভয়ানক ব্যাপার! আমাকে বলো তুমি কী ঝামেলার মধ্যে পড়েছ? হোসে আবারও জানতে চাইল।

মেয়েটা এবার অস্বীকার করার ভঙ্গিতে উল্টোদিকে তার মাথাটা নাড়াল।

–নাহ। তেমন সিরিয়াস কিছু না হোসে, আমি তোমার সঙ্গে মজা করছিলাম আসলে।

হোসে বোকার মতো তাকিয়ে থাকল মেয়েটার দিকে। তখন মেয়েটা আবার বলল— না হোসে, কাউকেই তোমার খুন করা লাগবে না।

–ওহ তাই! আমিও তো আসলে কখনওই কাউকে খুন করার কথা ভাবিনি। হোসেও এবার আগের কথা থেকে সরে এসে হতাশার সুরে যেন নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করল।
–কোনও পুরুষকে তোমার খুন করতে হবে না। কারণ আর কারও সঙ্গে আমি বিছানায় যাব না। মেয়েটা বলল।
–এই তো এতক্ষণে তুমি লাইনে এসেছ। আমি তো সবসময়ই ভেবেছি তোমার এসব আজেবাজে কাজে জুড়ে থাকার কোনও মানে হয় না। তুমি যদি এসব ছেড়ে ভালো হয়ে যাও আমি কথা দিচ্ছি আমি তোমাকে প্রতিদিন বিনাপয়সায় সবচেয়ে ভালো কাবাবটা খাওয়াব। হোসে বলল।
–ধন্যবাদ হোসে। কিন্তু আসলে সে কারণে নয়। কারণ হচ্ছে আমি নিজেই আর কখনও কারও সঙ্গে বিছানায় যেতে পারব না। বলল মেয়েটা।
–তুমি আবার সবকিছু গুলিয়ে ফেলছ দেখি। হোস এবার একটু অধৈর্য সুরে বলল।
–আমি কিছুই গুলিয়ে ফেলছি না হোসে। বলল মেয়েটা। আসনের ওপর মেয়েটা শরীরটা এলিয়ে দিয়ে বসলে হোসের চোখে পড়ল তার ব্রার ভেতরে চ্যাপ্টা হয়ে থাকা বিষণ্ণ স্তনজোড়ার দিকে।
–আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি এখান থেকে। কথা দিচ্ছি আমি আর কখনও ফিরে আসব না। তোমাকে কখনও বিরক্ত করব না। আমি আরও প্রতিজ্ঞা করছি যে আমি আর কখনও কারও সঙ্গে বিছানায় যাব না। বলল মেয়েটা।
–ওই অদ্ভুত ধারণা কখন এল তোমার মাথায়?
–মাত্র এক মিনিট আগে। মাত্র এক মিনিট আগে আমি বুঝতে পারলাম যে এটা খুব খারাপ একটা কাজ। বলল মেয়েটা।

টেবিল মোছার কাপড়টা নিয়ে হোসে আবারও গ্লাস মোছামুছি কাজ শুরু করল। মেয়েটার দিকে না তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করল—

–অবশ্যই। যেভাবে তুমি ওসব করো, এটা খুবই নোংরা কাজ। তোমার ওটা অনেক আগে বোঝা দরকার ছিল।
–অনেক আগে থেকেই আমি জানতাম কাজটা খারাপ কিন্তু একটু আগেই আমি ব্যাপারটা সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত হলাম। আসলে পুরুষদের ঘেন্না করি আমি।

বোকার মত হাসল হোসে। সে তার মাথাটা তুলে মেয়েটার দিকে তাকাল। সেও তখন হাসছে। কিন্তু সেই হাসিটা খুব বিভ্রান্তিকর, যার মধ্যে এক ধরনের গভীর রহস্য লুকোনো। মেয়েটার মুখটা এখন শরতের অপরিপক্ক শস্যের মতো চিকচিক করছে। মেয়েটা জানতে চাইল—

–আচ্ছা তুমি কি মনে করো পুলিশ সেই মেয়েটাকে ছেড়ে দেবে যে একজন পুরুষকে হত্যা করেছে তার সঙ্গে শোবার জন্য। তার সঙ্গে যারা যারা শুয়েছে তাদের সবাইকে সে ঘেন্না করে। সে কি ক্ষমার যোগ্য বলো?
–অত খারাপ কিছু ভাবছ কেন? ওরকম কিছু হওয়ার কোনও সম্ভাবনা নেই। বলল হোসে। এবার তার কণ্ঠের মধ্যে একটু করুণার ছাপ।
–যদি এমন হয়, সব সেরে সেই পুরুষটি যখন জামা-কাপড় পরছিল তখন মেয়েটার মনে হল এই লোকটাকে সে ঘৃণা করে অথচ তার সঙ্গেই সারা দুপুর সে বিছানায় গড়াগড়ি খেয়েছে। তাকে এত ঘেন্না লাগছে যে কিছুতে সেই গন্ধ দূর করা যাচ্ছে না।
–ওসব গন্ধ বেশিক্ষণ থাকে না। সাবান দিয়ে ধুলে চলে যায়। সেজন্য কাউকে খুনটুন করার দরকার নেই। মাফ করে দাও। হোসে একটু পরিবর্তিত কণ্ঠে বলল।

কিন্তু মেয়েটা আগের সুরে বলে যাচ্ছে— কিন্তু যদি এমন হয় লোকটাকে তার ঘেন্না হয় বলার পরও সে যদি পোশাক পরা বাদ দিয়ে তার উপর আবারও ঝাপিয়ে পড়ে চুমু খেতে শুরু করে এবং আবারও সেই কাজটা করে, তখন কী করার বলো?

–এমন কাজ কোনও ভদ্রলোক করতে পারে না। বলল হোসে।
–যদি সেটা করে বসে? যদি সে লোকটা ভদ্রলোক না হয়, যদি সেই মেয়েটার মনে হয় যে লোকটাকে সে এত ঘেন্না করে যে তার মরে যাওয়া উচিত। তখন সেই মেয়েটার যদি ইচ্ছে করে তার পেটের মধ্যে একটা ছুরি ঢুকিয়ে দিতে? মেয়েটা বলল।
–ভয়াবহ ব্যাপার। কিন্তু তুমি যেরকম বলছ সেরকম কোনও খবিস লোক দুনিয়াতে আছে বলে মনে হয় না। হোসে বলল।
–অবশ্যই আছে এবং ওরকম কাণ্ড করতেও পারে। ধরে নাও আমি যা বলেছি সেটাই সে করেছে।
–তাহলে মনে হয় খুন করার ব্যাপারটা অত অযৌক্তিক হবে না। হোসে বলল নির্বিকার ভঙ্গিতে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাউন্টারের উপরিভাগ মোছামুছির কাজটা করতে করতে। যেন এই মুহুর্তে কাজটা সে উপভোগ করছে। আলাপে তেমন মন নেই তার।
–তুমি একটা অশিক্ষিত জানোয়ার হোসে। বলো হোসে, তুমি আমাকে বলো, লোকটাকে আমার খুন করা উচিত কিনা। মেয়েটা তার শার্টের হাতা ধরে জোরে টান দিল।
–আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে। মানলাম। তুমি যেটা বলছ সেরকম হলে খুন না করে উপায় কী।
–ওটাকে কি আত্মরক্ষা বলা যায় না? মেয়েটা তার শার্টের হাতায় আবারও টান দিয়ে জিজ্ঞেস করল।
–নিশ্চয়ই। প্রায় আত্মরক্ষাই বলা চলে সেটাকে। হোসে তার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপে বলল। তার চেহারায় এক ধরনের রসিকতা এবং ভয়ের ছাপ একসঙ্গে কাজ করছে।
–যদি কোনও নারী ওই কাজটা করতে বাধ্য হয় তুমি কি তাকে রক্ষা করার জন্য একটা মিথ্যে কথা বলবে? মেয়েটা জিজ্ঞেস করল।
–সেটা নির্ভর করে…
–কীসের উপর নির্ভর করে? জানতে চাইল মেয়েটা।
–নির্ভর করে সেই মেয়েটার উপর।
–মনে করো এটা সেই মেয়ে যাকে তুমি খুব ভালোবাসো কিন্তু তাকে পেতে চাও না। যেমনটি তুমি বলেছিলে। তুমি শুধু তাকে ভালোবাসতে চাও। আর কিছু না।
–ঠিক আছে রানি তুমি যা বলো তাই হবে। একটু অলস বিরস কণ্ঠে বলল হোসে। তারপর চুপ হয়ে গেল আবার।

হোসে ঘড়ির দিকে তাকাল। দেখল সাড়ে ছটা বাজতে আর বেশি দেরি নাই। সে ভাবছে অল্প সময়ের ভিতর রেস্তোরাঁ লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। এটা মনে করে সে আরও দ্রুতগতিতে গ্লাসগুলো মুছতে শুরু করল সেই সঙ্গে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতে লাগল। মেয়েটা সেই একইভাবে টুলের উপর বসে রইল। বসে বসে গভীর মনোযোগের দৃষ্টি দিয়ে হোসের কাজকর্ম পর্যবেক্ষণ করতে করতে তার বিষণ্ণতা কিছুটা বুঝি কমে আসে। একটা প্রদীপ নিভে যাওয়ার আগে যেরকম উজ্জ্বলতা নিয়ে জ্বলতে থাকে, সেই দৃষ্টি দিয়ে হোসেকে দেখতে লাগল। হঠাৎ করে সে তার কণ্ঠ পরিবর্তন করে মরিয়া হয়ে ডাক দিল—

–হোসে!

মেয়েটার ডাক শুনে হোসে একটা নির্বিকার অলস স্থির বিষণ্ণ মাদী ঘোড়ার দৃষ্টি দিয়ে তার দিকে তাকাল। যেন সে তার কথা শোনার জন্য তাকায়নি। সে ওখানে আছে কিনা সেটা দেখার জন্য তাকিয়েছে। সেই দৃষ্টিতে কোনওরকম মুক্তি বা নিশ্চয়তার আশ্বাস নেই। যেন সে একটা তামাশা দেখছে।

–আমি তোমাকে বলেছি আমি আগামীকালই চলে যাচ্ছি। তুমি তো কিছু বললে না। বলল মেয়েটা।
–হ্যাঁ শুনেছি কিন্তু কোথায় যাচ্ছ সেটা তো বললে না। বলল হোসে।
–এমন কোনও জায়গায় যেখানে কোনও পুরুষের সঙ্গে আমাকে শুতে হবে না।
–ওহ তাহলে তুমি সত্যি সত্যি চলে যাচ্ছ? হোসে এমন ভাবে বলল যেন সে এইমাত্র সচেতন হল ব্যাপারটা নিয়ে।
–সেটা নির্ভর করছে তোমার ওপর। তুমি যদি ঠিকমত বলতে পারো আমি এখানে কটার সময় এসেছি। তাহলে আমি কালকে চলে যাব এবং আর কখনও এসব ঝামেলায় জড়াব না। সেটা নিশ্চয়ই তোমার ভালো লাগবে। মেয়েটা বলল।

হোসে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল এবং এ ব্যাপারে তার প্রতিশ্রুতি দান করল। মেয়েটা তখন তার দিকে ঝু্ঁকে এসে বলল— কিছুদিন পর ফিরে এসে আমি যদি দেখি এই চেয়ারে বসে তুমি অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে গল্প করছ তখন কিন্তু আমার খুব হিংসে হবে।

–যদি তুমি ফিরে আসো আমার জন্য বিশেষ কোনও উপহার নিয়ে আসবে তো? হোসে জানতে চাইল।
–কথা দিচ্ছি আমি তোমার জন্য একটি ভারী লক্ষ্মী ভালুকছানা খুঁজে আনব। মেয়েটা বলল।

হোসে হাসল এবং হাতের কাপড়ের টুকরোটা দুজনের মাঝখানে এমনভাবে ঝুলিয়ে দিল যাতে মনে হচ্ছে সে যেন একটা অদৃশ্য কাঁচের টুকরো পরিষ্কার করছে। মেয়েটাও হাসল এবং সে হাসিতে প্রশ্রয় এবং প্রণয়ের যুগপৎ ছাপ। এরপর হোসে কাউন্টারের অন্য প্রান্তে গিয়ে গ্লাসগুলো মুছতে শুরু করল।

–তারপর? হোসে জানতে চাইল।
–তোমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে— তুমি সত্যি বলবে তো আমি এখানে পৌনে ছটার সময় এসেছি? মেয়েটা জানতে চাইল।
–কিন্তু কেন? হোসে জিজ্ঞেস করল।
–কেন সেটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। ব্যাপার হচ্ছে তুমি এই কথাটা বলবে, ঠিক আছে?

হোসে তখন তাকিয়ে দেখল সুইং ডোর ঠেলে একজন খদ্দের ঢুকছে। সে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল বরাবর সাড়ে ছটা বাজে এখন।

–ঠিক আছে রানি তুমি যা বলছ তাই করব আমি। তুমি যা চাও তাই হবে। একটু বিক্ষিপ্ত স্বরে বলল হোসে।
–এই তো লক্ষ্মী ছেলে। এবার যাও আমার জন্য সুন্দর করে মাংসের কাবাবটা ভেজে আনো। বলল মেয়েটা।

লোকটা ফ্রিজ খুলে এক টুকরো মাংস বের করে প্লেটের উপর রাখল। তারপর চুলাটা জ্বালাল।

হোসে বলল— আমি তোমার জন্য খুব ভালো একটা বিদায়ী কাবাব ভাজব এখন।

–ধন্যবাদ পেপিলো‌। মেয়েটা বলল।

তারপরই মেয়েটা হঠাৎ করে চিন্তামগ্ন হয়ে পড়ল। সে যেন একটা কর্দমাক্ত ঘিনঘিনে বস্তি এলাকার ভিড়ের  মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলে ঘুরে মরছে। কাউন্টারের ওপাশে তেলে চুবানো মাংস ভাজার শব্দ তার কানে প্রবেশ করল না। হোসে যখন চুলার মধ্যে মাংসটা ভাজার জন্য উল্টেপাল্টে দিচ্ছিল তখন সমগ্র রেস্তোঁরায় ছড়িয়ে পড়া মৌ মৌ সুগন্ধটাও তার নাক স্পর্শ করল না। সে অতল চিন্তার গভীর সমুদ্রে একবার ডুবছে, একবার ভাসছে, কোথাও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। কিছুক্ষণ পর সে হঠাৎ করে মাথা তুলে তাকাল যেন এইমাত্র মৃত্যুগহ্বর থেকে ফিরে এসেছে। সে তাকিয়ে দেখল জ্বলন্ত চুলার প্রফুল্ল আগুনের আভায় হোসের মুখটা উদ্ভাসিত হয়ে আছে।

–পেপিলো…
–কী সোনা?
–কী ভাবছ তুমি?
–ভাবছি তুমি আমার জন্য লক্ষ্মী একটা ভালুকছানা খুঁজে পাবে কিনা…
–অবশ্যই খুঁজে পাব, কিন্তু আমি চাই যে যাওয়ার আগে তুমি আমাকে আরও একটা বিদায়ী উপহার দেবে। মেয়েটা বলল।

স্টোভের কাছ থেকে হোসে মেয়েটার দিকে বিস্মিত চোখে তাকাল।

–একটু রোসো.. এই তো শেষ হয়ে বলে। তা.. তুমি কি এই কাবাব ছাড়া আরও কিছু চাও?
–হ্যাঁ চাই। মেয়েটা বলল।
–কী সেটা? হোসে জিজ্ঞেস করল।
–আমি তোমার কাছে আরও পনেরো মিনিট সময় চাই। মেয়েটা জবাব দিল।

হোসে একটু পিছিয়ে গেল। তারপর ঘড়ির দিকে একবার তাকিয়ে কাউন্টারের অন্যদিকে বসা চুপচাপ বসে থাকা খদ্দেরের দিকে তাকাল।  তারপর চুলায় ভাজা হতে থাকা কাবাবের দিকে তাকিয়ে বলল,

–আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না রানি।
–বোকার মতো কথা বোলো না তো হোসে। তুমি ভাল করেই জানো আমি সাড়ে পাঁচটা থেকে এখানে বসে আছি। ওটা ঠিকমত বুঝতে পারলেই হবে।


*The Woman Who Came at Six O’Clock – Gabriel Garcia Marquez

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4662 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...