‘বাল্মীকির কুটির’, এক কবিতা-ভ্রমণ

তুষ্টি ভট্টাচার্য

 

কবি মজনু শাহর ‘বাল্মীকির কুটির’ বইটির সমালোচনা বা রিভিউ করার মতো দুঃসাহস আমার নেই, আমি সমালোচক নই, পাঠক মাত্র। আমি চাই না, কবির দুঃস্বপ্নেও কোনও কইমাছের মতো সমালোচক কানকোয় ভর করে কবিকে তালগাছ পর্যন্ত তাড়া করুক! ফলে একজন সাধারণ পাঠকের মতোই এই পাঠপ্রতিক্রিয়া লিখতে চাইছি। ইতালিবাসী কবি মজনু শাহর কবিতা পড়তে গেলে প্রথমেই কবিতার ‘মধ্যবিত্ত’ ধারণা, উপমা, অলঙ্কারকে দূরে সরিয়ে রেখে আসতে হবে। অতিকল্পনায় ভর দিয়ে মজনুর কবিতা উড়তে থাকে। একেক সময়ে কেমন একটা গা ছমছমে ভাবের মধ্যে টেনে নিয়ে যায়। এইসব কবিতায় রয়েছে তীব্র নীল বিষাদ, গাঢ় রঙের দুঃখ আর কোমল রঙের মায়া। ভূমিকার প্রথমেই কবি নিজেই বলেছেন— তাঁর এক শিউলিগাছের খোঁজে যাওয়ার কথা। যে শিউলিগাছটিকে তিনি খুঁজছেন, জানি না আজ পর্যন্ত তার দেখা পেয়েছেন কিনা, কিন্তু আমি অর্থাৎ পাঠক পেয়ে গেছি এক রূপক বৃক্ষকে। অতিনাটকীয় মাত্রায় রূপকের ব্যবহার তাঁর কবিতাকে ভারী করেনি, বরং সেই যে এক চুলের সীমারেখা, যা অতিক্রম করলেই কবিতা এবং না-কবিতার দেশ, সেই সীমাকে ছাড়িয়ে তাঁর কবিতা এক অন্য মাত্রা পেয়েছে। এ এক অন্য পাঠ অভিজ্ঞতা যাকে আমি কবিতা-ভ্রমণ বলছি। মজনু যেমন লিখেছেন— ‘কবিতা নয় গ্রাফটিং’। আমি সেই গ্রাফটিং-এর কাজটিই করেছি, তাও আবার মজনুরই কবিতার লাইন জুড়ে জুড়ে। এক কোলাজের আকারে আনতে চেয়েছি আমার ভ্রমণকে।

‘বাল্মীকির কুটির’ মজনু শাহর এক কবিতা সঙ্কলন, যেখানে একে একে এসেছে ‘আনকা মেঘের জীবনী’, ‘লীলাচূর্ণ’, ‘মধু ও মশলার বনে’, ‘জেব্রামাস্টার’, ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’, ‘আমি এক ড্রপ আউট ঘোড়া’, এবং ‘বাল্মীকির কুটির’। এইভাবে সেজেছে বইটি। প্রথমেই ভূমিকার কথায় আসি। ‘কাজুবাগানের মধ্যিখানে কোনও এক গাঢ় ঘুম তোমাকে পায়। পৃথিবী, অতিকায় জিগজ্যাগ পাজল, তার মধ্যে ঘুরছ, থামছ, ঘুরছ— একদিন লুপ্ত হবে সব কারু-আয়োজন, মিটে যাবে শব্দপিপাসা, আজ তবু তোমার পাশে চুপ করে আছে বীণা’। প্রশ্ন জাগে, সত্যিই কি শব্দপিপাসা মেটে? মৃত্যুর আগে এই তৃষ্ণা কি কোনও লেখককে ছাড় দেয়? এরপরেই কবি বলে উঠছেন, ‘আমার ইস্তেহার নাই, বহু শব পেরিয়ে শুধু একটি শিউলিগাছের কাছে পৌঁছতে চাইছি।’ পাঠকের আঁত, আঁতাত থেকে দূরে গিয়ে শুধু শিউলিগন্ধটুকু আসতে দিতে চেয়েছেন। কিন্তু পেয়েছিলেন কি সেই শিউলিগাছটিকে এ যাত্রায়? নাকি হারিয়ে ফেলেছিলেন সচেতনতার মুহূর্তে? এইরকম প্রশ্ন জাগাতে জাগাতে দীর্ঘ কবিতার মতো এই ভূমিকাটি এগোতে থাকে। শেষে কবি অবশ্য কবিতা বলতে তিনি কী বোঝেন, সেটারই ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি লিখছেন, ‘divine commands থেকে উৎসারিত হয় কবিতার পঙক্তিমালা, এইরূপ তত্ত্বে আমার সায় নাই তত, কেননা কবিতার তথাকথিত অ্যাঞ্জেলিয়মে আমি আস্থা রাখি না। পরিবর্তে, লৌকিক এক স্বরপ্রবাহকে আমি কবিতা ভাবি। ঐ একই কারণে, শব্দপুঞ্জ নয় ঈগলের ক্রুদ্ধ চোখ, তারা আছে ডানা হয়ে। শিকারের নিষ্ঠুরতা নিশ্চয় আছে জগতে, আমি তবু প্রথম পক্ষপাত রাখি তার ধীর উড়ে চলায়। তার রাজসিক একাকিত্বের অদ্ভুত লীলাই আমার অভিপ্রায়।’ এই ভূমিকাটি ২০১৭ সালের অক্টোবরে ব্রেসা, ইতালিতে বসে লিখেছিলেন কবি।

‘আনকা মেঘের জীবনী’ সিরিজটি ২০টি ছোট কবিতার সমষ্টি। উপক্রমণিকায় কবি লিখছেন, ‘দৈবাৎ এসে পড়েছি শব্দের রাস্তায়।/ ক্ষম, কবিতার পাহারাওয়ালা যত, ফিরে যাই/ অন্য কোনও দ্বন্দ্বে, যেখানে একটি বুলবুলি পাখি/ একবার গেয়ে উঠে মুছে ফেলেছিল নিজেকে’— সত্যিই কি আর ফেরা যায়! ফলে কবিতার পাহারাওয়ালাদের এড়িয়ে কবি লিখেছেন হাবাদের স্বর্গের রুটিবৃষ্টির কথা, নারঙ্গি বনের জেব্রার সারির কথা। ‘জেব্রামাস্টার’ সংঘমিত্রার সঙ্গে হেঁটেছেন, যখন একটানা দুলেছে কায়াপিঁড়ি, তখন ভেবেছেন— বসব কোথায়? উট নাকি উপসংহার, কোন দিকে যাব? যে মেডুসার মাথাকে খ্রিস্টের রুটির মতো লাগে তাকেই কি কবি চিঠি লিখেছেন বুনো আকাঙ্ক্ষায়? আর হস্তলিপি যখন বিবর্ণ হয়ে এল তখন তিনি দেখলেন এক বিবেচক উন্মাদ তাঁর ছেঁড়া চিঠিগুলো জোড়া দিয়ে চলেছেন! ক্যাসিনো টেবিলে অপেক্ষারত এক কাকাতুয়া এই সময়ে দেখে নিল এক তাসের রানির পিছে উড়ে গেল এক তাসের জোকার। আর আমরা? অন্ধকারের সাতশো পর্দা দেখতে দেখতে নিজেদের আকাঙ্ক্ষা আর না-আকাঙ্ক্ষার মধ্যে খুলে যেতে দেখলাম একটি দুটি দ্বন্দ্ব-জানলা। আর কী দেখলাম? দেখলাম, নিপুণভাবে শিরচ্ছেদ করা হল, অথচ জানতেও পারলাম না যে মরে গেছি! নব নব খুলির মিউজিয়ামে সাজানো রইল নব নব নররাক্ষসের মুখ। পৃথিবীর স্টেশন লুপ্ত হচ্ছে ক্রমশ। লৌহজং ধরা রেললাইন নিথর শুয়ে… আর আকাশে যে নীল বর্ণের সং ঘুমিয়ে রইল, তাকে ফেলে আমরা আবার অন্যদিকে চলে গেলাম। এখন রাত ক্রমে হেঁয়ালি ও বিশ্লেষণ-মুখর, নীলবর্ণ পুঁথিখানি খোলা পড়ে আছে। ফিরে এসো প্যারাফিন লণ্ঠন আর শিখিপাখা! তবুও তো, কোনও একদিন কোথাও জেগেছিল মেঘমল্লার। অথচ পরিণাম মুছে ফেলে চলে যেতে হয়েছিল প্রস্থানের দিকে। তীক্ষ্ণ পেন্সিলের দাগ ক্রমাগত মুছে যাচ্ছিল অনন্ত রবার। যেখানে যাওয়ার কথা ভেবেছিলাম, হালকা বেগুনি রঙের মেঘ এসে প্রেতের মতো ঢেকে দিয়েছিল পথঘাট। এতদিনে জেনেছি ভালো থাকার রহস্যে জড়িয়ে থাকে কিছু বিষপিঁপড়ে। তাই ছেড়ে যাচ্ছি এই পেখমের বিশ্বলোক। ইদানীং যখন বাঁশঝাড়ে চাঁদ আত্মহত্যা করতে চায়, কারা যেন দৌড়ে আসে সাইবার ঘুঘুদের কাছে। খুব তর্কে মাতে ওরা, আর আমিও মুখ ফসকে বলে ফেলি, কিমিদম!

#

 

‘লীলাচূর্ণ’ পর্বে রয়েছে ৩৬টি সনেটের সমষ্টি। উপক্রমণিকাটিও সনেটে লিখিত। পাঠকপ্রিয় এই পর্ব নিয়ে আমি বেশি কিছু লিখতে অক্ষম। কবিতা তো আর ব্যাখ্যার ধার ধারে না, অনুভূতির দাস। ফলে এই কবিতাগুলিকে আমি অলিখিত, অনুভূতির ঘরে জমা করে রাখলাম। পুরো পর্বটি জুড়ে আছে ‘শব্দই অস্তিত্ব তার, বীজ, গর্ভঘুম, মেঘমালা’। প্রথম কবিতাটি শুরু হয়েছে এমনভাবে— ‘আমাকে নিক্ষেপ করো পৌরাণিক গল্পের অরণ্যে/ একটি বিন্দুর মতো, শোনো, আর কিছু চাইব না’। অসম্ভব তীব্রতা আর তাড়নায় ছুটে চলেছে একের পর এক সনেট। ছুটতে ছুটতে আবার থমকে দাঁড়াচ্ছে ঘাসের পাখায়। তারপর মাটিতে অর্ধেক ডুবে থাকা রথের চাকার গোঁয়ার্তুমি কীভাবে যেন জেগে ওঠে। রঘু ডাকাত জেগে ওঠে। কাছে না এসেও বাক-বিভূতির দেশে পৌঁছে গিয়ে দেখা যায় ঘুম-হারা মীনশব্দ, কার স্পর্শ লেগে ওঠে ধীরে শিখীবর্ণ যবনিকা… পুরনো গল্পে এসে শয্যা পাতে রত্নাকর, ঘুমন্ত সমুদ্র থেকে উঠে এসে একটি কচ্ছপ বলে, দেখো ফের শুরু হল অলৌকিক পাতা-ঝরা… মেঘকে ডেকে এসময়ে বলা যায়— যাও মেঘ, তারে গিয়ে বলো, মরণের পরে থাকে শুধু গান। শোনো মেঘ, তুমি তো অমন নও, পার হও বাঘিনীর আত্মরতি, লবণ-পাহাড়। এ পৃথিবীতে পড়ে আছে চন্দন ঘষার গোল পিঁড়ি, অনৈসর্গিক আলো, আর এক নির্জন দৃশ্য-ভায়োলিন। এখানে শাশ্বত মদ পাবে। না-লিখে লেখার কাজটুকু প্রকৃতি যেভাবে সারে, সে-নিয়মে সে-অপেক্ষাতুর দেশে চলে এসো বন্ধু! বিকেলের নদীর এপাড়ে বিস্মৃতির মতো বড় ঘড়ি যেন উল্টো দিকে চলে…

এই ক্ষুদ্রবুদ্ধি প্রাণ আর এত বল্মীক-নির্মাণ, বলো কাহাতক আর! শব্দ যাকে ফকির করেছে ফিরেছে সে চুপিচুপি অন্ধ শিক্ষিকার ক্লাসে, ধূধূ-করা মাঠের নির্জনে। ব্যাখ্যাতীত সব দৃশ্য ভেসে যেতে থাকবে, তারপর অস্তিজিজ্ঞাসা শুধু। মৃত্যু আসে সম্রাজ্ঞীর বেশে, তার হাতে-ধরা চকোলেট পেয়ে গেলে কতদিন আমি কারুবাসনার মতো অপরাহ্নে আগলে রেখেছি। কখন যে মাথা-বিক্রি করে চলে গেছি ছদ্মযৌনতার কাছে… তারপর সেই কাটা মাথা কোলে করে হেঁটে তেজোমূর্তি হল কেউ। আমার মাথায় আজ ঝরে পড়ে শুধুই রজন… গানের ভিতর দিয়ে আমি কি পারব কোনওদিন শুশ্রূষায় পৌঁছে যেতে? সরে গেছে বজ্রগর্ভ মেঘ, চুমুক দিয়েছে কেউ আমার রক্তমদের গ্লাসে আর আমি সেটাকেই গূঢ় দরজাটি খুলবার সম্মতি ভেবেছি একদিন। ময়দানের ওপারে তারপরে কেউ একজন পাখিতে রূপান্তরিত হলেন। মাথায় সবুজ লণ্ঠন নিয়ে আশ্চর্য এক ক্যারাভান এসে থেমে গেল খুব কাছে। এবার তবে নর-বানরের সুনির্মম ঠাট্টা উপভোগ করো। ভোর থেকে বুটিদার পাখি ডেকে ডেকে হয়রান, তোমাকে বিমর্ষ দেখে নেচে যায় টারান্টেলা, আর তুমি নর-বানরের সামনে নগ্ন বসে রইলে, যেন এক মৃত্যুমথিত প্রেমিক! এরপর সচকিত বরফের থেকে উঠে এসে দেখি এক ভণ্ড কবি স্নানসূত্র শেখাচ্ছে দেবীকে। বাড়ি ফেরবার পথে মাতাল আরবি ঘোড়া ছুটে যায় চকোলেট সময়ের দিকে, বহুদূরে বাঘিনীর শান্ত দুধ গোপন স্বর্ণকলসে জমে থাকে। একটি পথ রুটি ঝলসানোর দৃশ্য থেকে সরে গেল অনাহারী—

কোড়া শিকারের পর ভুলেছি সকল স্তবগান। দ্রাক্ষা আর তামাকের গন্ধ ভরা সেই রাতে কামসূত্র ছুঁড়ে দেয় জল। অহম রাঙানো সেই গ্রন্থ রাক্ষুসী মাছের পেটে গিয়ে শেষে অমরত্ব পেল! সমস্ত দেখার মাঝে ছবি সব গুলে যায়, আমার ব্যথার পূজা সাঙ্গ হয় ব্যথার প্রভাতে। ঘুমিয়ে রয়েছ তুমি বাংলা কোনও প্রবাদের মতো, তামাটে রাখাল চুপ করে বসেছিল সারাদিন, আর শাপভ্রষ্ট তুমি ঘুমের ভিতরে খুঁজে পেলে অনেক তুলোর বল, ললিপপ, অজস্র কনডোম! ভয়ঙ্কর গতিপ্রাপ্ত হয় এক কনভয়, এদিকে ঘুমাচ্ছ তুমি, জ্বলে উঠছে আদিম প্রশ্নেরা। একটি বালিশে আজ ভাগাভাগি করে শুয়ে থাকি আমি ও আমার মৃত্যু। আমাদের পাথরের ঘর, রক্তাভ ঝর্ণার শব্দে ডুবে যেতে থাকে সারারাত। বড় দেরি হয়ে গেল। যদি আমি ও আমার মৃত্যু ঘুম শেষে উঠি, নষ্ট চোখ পড়ে থাকে বিছানায়! তবুও বসন্ত আসে। বনে বনান্তরে গিয়ে দেখে আসি ভেনাসের কোল রক্তভেজা আর পথে পথে প্রেমিকের হাড়গোড় পড়ে, মনে হবে এ পৃথিবী একদিন নাচঘর ছিল—মনে মনে নিজেকে বলি, ছোট্ট হাতপাখার মতো স্তব্ধ আর ব্যথাতুর হও, বের হও পদ্মচক্র ফুঁড়ে—

ক্ষয়ে ক্ষয়ে একদিন মুছে যাবে সব লিপিকুশলতা। তারপর মহাসর্প তোমার নৌকোটি ঘুমঘোরে ক্রমশ পেঁচিয়ে ফেলবে। আর এক আধ্যাত্মিক বিভা তোমায় বিস্মিত করে চলবে অন্তরীক্ষ জুড়ে। ঋষিবিড়ালেরা সবুজ লণ্ঠন নিয়ে আসে, আর আমি তাদের বার্তাগুলি পিপুলগাছের গায়ে লিখে রাখি ক্ষুর দিয়ে। আত্মদীপ নিভে গেছে বলে ঘুঙুর-পরা এক বিড়াল আমার ঘরে ঢুকে ঋষিত্ব দেখায়। উঠোনে তখন টাট্টুঘোড়ার ঠা ঠা হাসির মধ্যে বাতাসের অনুবাদ হতে দেখি। রুটিগাছ তলে বসে সারারাত দেবনিন্দা করি। রাতের বাগানে স্মৃতিগুলো বাদুড়ের মতো নষ্ট করে ফল। কার হাত থেকে ওই রুটি গর্ধভের পিঠে জমা হয়, তুমি তার কিছু জানো? সেই পুণ্যগাভীটিকে মাঝে মাঝে মনে পড়ে। মনে পড়ে বায়োস্কোপ আর সেই মুগ্ধ হরবোলা, আয়নার মধ্যে থেকে যিনি প্রশ্ন পাঠাতেন! ক্রমাগত নিজেদের মুদ্রিত হতে দেখি রাতের শরীরে আর বাতাসের ভুতুড়ে পৃষ্ঠায়…

স্কুলঘর খুলে বসে আছে এক রঙিন দানব, উড়ন্ত ছাত্রীরা এসে বুনোলতা জড়াচ্ছে আঙুলে— অকস্মাৎ মনে হল তুমি সেই সময়ের স্বর, তোমার গ্রহবৈগুণ্যে শুরু হল ভাষার নষ্টামি। অসংখ্য ব্যঙ্গমা আজ ছটফট করে মরে যায়, গীতিনাট্য শেষ হলে ব্যঙ্গমীরা আর্তনাদ করে, তীর্থফল হাতে পেয়ে কেঁদে ওঠে কেউ মধ্যরাতে। জগৎ শাসন করে একটা সবুজ টিকটিকি— একথা প্রমাণ করে তারপর মরে যাব। আপাতত দেখি এক বিরহী সিংহ, চাবুক, বেহালা আর ঝুমঝুমি। ওই মৃগশকটের পাশে তুমি কে এলে? কবে দেখিয়েছ ট্রাপিজের খেলা ঘুমের ভিতর? দিয়েছ আশ্চর্য ভাষা সেই জাতিস্মর পথে পথে, চাঁদের হিয়ার মাঝে সেইসব রয়েছে মুদ্রিত। আমার অস্বস্তি তুমি যেন বস্তুপৃথিবীর পাশে হাবা ছাইদানি আর গোপন আতঙ্ক হয়ে নক্ষত্রের দিকে চেয়ে থাকা এক খরগোশ। ভোরবেলা ফুটে উঠি আমি আর দেখি আধবুড়ো গাধা আজও তেমনি বিভ্রান্ত! তাই তোমাকে মূর্ছিত রেখে চলে গেছে সিংহপুরুষেরা। মূর্ছার ভিতরে একদিন আমিও দেখেছি বটফল, উন্মাদের চিঠি পেয়ে চলে গেছি ক্রীড়ারত পুতুলের দেশে। মাথার ভিতরে বৃষ্টি, শুধু বৃষ্টি বৃষ্টি অনুভব করে গেছি একটানা। আজ শুধু বৃষ্টি পান করে অমৃতের পুত্র হওয়া, শুধু মুর্দাফরাসের ভেজা মুখ থেকে কিছু শোনা…

তখন ভিজে যায় মাঠে তোমার বাহন… প্রেতলোক থেকে কেউ জুম করে দেখে সবকিছু, ভায়োলিন, ধূলিঝড়, সবকিছু পেয়ে, প্রতিপদে সর্পবন্ধু পেলে! অনন্ত ময়ূর আর অনন্ত কানন স্পষ্ট হল… প্রায় পোড়া পাতা কোনও এক পোড়া পাতার নিকটে চুপচাপ নিজেকে নেভায়। একদিন আলিশায় ভুয়োদর্শী গল্পের বেড়াল দেখা দেবে সন্ধেবেলা, সামান্য শিউলিগাছ, তুমি যেন বাজেয়প্ত করে নিও না আমায়… ইতিহাস, কাকাতুয়া, জেব্রা আছে সকলে নীরব! তোমার বিড়ালপ্রীতি দেখে বসেছে আহত পাখি, আর আধিভৌতিক কবিতার কাছে আসে অমিত্রাক্ষর জানা কাকাতুয়া। গ্রন্থের প্রহার আছে, শেষ স্নান আছে নীলিমায়। সাপলুডু খেলার গভীরে যে-ভয় আমাকে টানে, সেই মিথ্যে সিংহ, মিথ্যে দীপ আমাকে চিন্তার কারাগারে নিক্ষেপ করে। বসে থাকি আমি আর সেই শাদা দ্বাররক্ষী পাখি! আমাকে বলো না নিতে আর শশী-কুসুমের ভার, লাজারাস, লাজারাস কাম ফর্থ! শিকারির ফাঁদ ভেসে উঠছে বাল্মীকির পাশে, শোনা যাচ্ছে মৃদুতম সেই অন্ধ ধ্বনির অপেরা।

অন্তহীন জানালার কাছে দাঁড়িয়েছি একদিন, চাঁদের আলোয় মৃত্যু জয় করে আসা মাদী জেব্রা আর একটি বিষণ্ণ পাখি বসে থাকে ভ্রান্ত জামবনে। আমাকে কাঙাল করে নগ্ন নিরঞ্জন ওই আভা। এখন সমস্ত শব্দ বরফের মতো ভেসে উঠছে দেখে আমি দুলে উঠি। দৃশ্যেরা ইঙ্গিত করে, গোলাপ নির্গত হয় আর আমি পলায়ন করি।

যা-কিছু মাধুরী, প্রশ্ন, গোপন অক্ষত পাণ্ডুলিপি পড়ে থাকে ইতস্তত। কোথায় নিস্তার! আজ, নিস্তার পাবে না কেউ আর! আমার পথেরা গেছে ঋতপথ থেকে ক্রমে সরে— প্রথমে নারঙ্গী বন, আর তাকে ঘিরে অন্যসব দুর্গের প্রসঙ্গ। আলোকস্তম্ভের নিচে তক্ষকের সাথে আমি কাঁদি। অন্য কিছু সৃষ্টি হয় অন্ধকার মাঠের ওপার। আমাকে শেখাও, মাগো, কীভাবে মাখতে হয় ‘কালো’…

এখানে জ্বলন্ত কয়লার মতো সত্য ফুটে আছে। নাচতে নাচতে দেখো খুলে যাচ্ছে প্রত্যেকের নেংটি, পাগলা পানির দিকে যাচ্ছে সব নাচতে নাচতে। আমার এতই পাপ, ওরে, কালো আমাতে লাগে না।

কমলা রঙের ভাষার অধীন তুমি আছ, দারু, দ্রাক্ষা আর বাগার্থের লোভে কোনওদিন হাঁটিনি তোমার দিকে। তবু কোন অবসরে আসক্তি জেগেছে শব্দে, তোমার ভাষার ধূলি ঋষিবিড়ালের সারা গায়ে, ঝরে পড়ছে মৃত ঘাসে আর আমাদের ইস্তাহারে।

তোমার শরৎকাল অতি ব্যক্তিগত কথাগুলো বয়ে আনে, সে কি ট্রমা, এতখানি হলুদ, বঙ্কিম!

ঝড় তাকে বয়ে নেয় এক লীলাকক্ষ থেকে তুলে অন্য কোনও তামাশায়, যেখানে ঘুমায় বামনেরা চন্দ্রব্যর্থতার পরে। কোনও সবজান্তা পাখি যখন হীরের ডালে বসে ভবিতব্য বলে দেয়, চুপ থাকা বড় প্রয়োজন। দ্যাখো হৃদয়পেন্সিল ধীরে পূর্ণদ্যোমে ফিরে পাচ্ছে তার রচনাপদ্ধতি। প্রার্থনার এমন সময়ে, বন্ধু, বলো না বিদায়।

স্বপ্নের পাতাল অব্দি যদি তুমি ঘুরে এসে থাকো এমন নরক কোথা পাবে আর, সখা, শব যত ঢাকা পড়ে আছে পদ্মে। তবু রাত্রি গল্পে ভরে, পদ্ম থেকে একটি শিশির শবের অধরে ঝরে আর মাল্যবান অন্ধকারে কিছু রয় অপরূপ ভ্রমে—

#

 

‘মধু ও মশলার বনে’ একটি দীর্ঘ কবিতা। কবির বড় ভাই, আলী, মাত্র সাতদিনের পরমায়ু নিয়ে এই পৃথিবীতে এসেছিলেন। তাঁর কবরটুকুও আজ বিস্মৃত। সেই ভাইকে নিয়ে একটানা সারারাত ধরে বসে মজনু লিখেছেন এই কবিতাটি। ‘অঘ্রানের পথে পায়চারী করা মানুষের হৃদয়ের পথে ছাড়া মৃতেরা কোথাও আছে?’— এই প্রশ্ন ও বিভ্রমের ধূলি কখনও আমায় ঘিরে ফেলে, শত্রুর মতো। মনে হয়, নক্ষত্র বা পাতালে নয়, এক অচেনা বায়ুপ্রবাহের মধ্যে কোথাও আজ সে মুদ্রিত হয়ে আছে— নিচে, বিস্তীর্ণ মশলা বন। এই রকম ভূমিকা থেকেই সম্ভবত শুরু হয়ে গেছে কবিতাটি।

‘অনেক দূরের কেউ হয়ে গেছে যেন সে আজ,/ তবু আলী আলী বলে বহু বার/ ডাকলাম তাকে।/ আমার এ ডাক যতদূর প্রতিধ্বনিময়/ যতদূর হেঁটে এসে ভুলগুলোকেই/ পরম আত্মীয় বলে মনে হয়, জানা হল বিহঙ্গম মার্গ/ একদিন তার মধুঘুম/ আর পুড়ে যাওয়া মশলা বনে ঢুকে’। এইভাবে শুরু হয়েছে দীর্ঘকবিতাটি। খুবই শান্ত ধীর গতি তার প্রথমদিকে। যদিও পরে মজনুর লেখায় যেমন এক তীব্র মাদকতা থাকে, দ্বন্দ্ব আর দ্বিধায় ভেতরে পাঠককে ফেলে দেন তিনি, সেভাবেই এই কবিতাটিও এগিয়েছে।

‘কীভাবে যে খুলে গেছে আজ প্যান্ডোরা-বাক্সের মুখ/ এ নির্জন স্যানিটোরিয়ামে?/ শিমুলের তীক্ষ্ণ কাঁটা দিয়ে খোদাই করেছে কেউ/ এইসব প্রশ্নমালা,/ এইসব শিউলিফুলের অনুরোধে/ কোন নরকের সিঁড়িতে লুটাবে?’

আবার এরপরেই ‘ডালিম ফলের দিকে এক সৌন্দর্যের ভূত/ বিপন্ন ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে’। পাঠককে বিপন্ন করতে কবি বড়ই পছন্দ করেন এভাবে। ‘আমার পুরনো সাধ একবার শুয়ে থাকি/ কোনও দার্শনিক বিড়ালের পাশে।/ সে-ই একমাত্র/ যে-কিনা সইতে পারে ঘুমের প্রহার/ যে-কিনা দারুভূতের কাছ থেকে সবকিছু-খোলা-যায় এমন একটি চাবি/ চুরি করে মুখে তুলে এনে দিয়েছে আমাকে’।

‘এইখানে কোনও কোনও সাপের মাথায়/ রতিচিত্র আঁকা দেখে ভয় পেয়ে গেছি;/ আজও তোমাদের সাপলুডু খেলা থেকে/ কলহাস্য আসে, আর সারারাত/ এক লেজ-কাটা তক্ষক আমায়/ ভীষণ উত্যক্ত করে’। এই সব পঙক্তি পড়লে প্রথমেই মনে পড়ে, স্মৃতি কই এখানে? স্মৃতি ভুলে যাওয়া এক সহোদরের জন্যই বা তাকে ঘিরেই কি লিখিত হয়েছিল এই সুদীর্ঘ প্রবাহ? নাকি কবির মনের অন্য মনন এসে বিস্মৃতিকে উসকে দিয়েছে? ‘কানাগলির মাথায় যে-বাড়িটা আছে,/ কবিতার শত্রুরা সেখানে সুখে নিদ্রা যায়/ সেইখানে ঢুকে পড়ি।/ কোনওদিন কোনও স্খলিত মুহূর্তে/ এ-বাড়ির ছাদে কলাদেবী এসে বসেছিলেন কি?/ এখানে গানের বাক্স ভরে আছে সাপের সঙ্গমে…… ’

‘লাল মেঘ এসে জানি একদিন ঢেকে দেবে সব,/ তবু/ পড়লাম শব্দ দিয়ে তৈরি এক মরুভূমি/ পড়লাম মন্থর সারি/ ভোরের আকাশে…’ সত্যি সত্যিই একদিন লাল মেঘের এক টুকরোতে স্মৃতি ঢাকা পড়ে যাবে। আর ভোরের আকাশে ফুটে উঠবে আশা।

‘এইখানে ঘুমন্ত মুখের দিকে চেয়ে থাকে/ একটি গরিলা,/ এইখানে তুমিও ইঁদুরের কল নিয়ে বসে আছ,/ বানানো শিখেছ সব রকমের ফাঁদ,…’ ‘আর আমি চোখ তুকে নেয়া চোরের পিছনে/ হেঁটে ক্লান্ত হচ্ছি আজ। আগামীকাল আমাকে বুড়ো গরিলার মতো যেতে হবে/ যেখানে হয়েছে শুরু/ মচমচে আর পুরু হয়ে থাকা পাতার পৃথিবী’।

‘আলো আসে আলো আসে আলো…/ মৃত হৃদয়ের?’ এই জিজ্ঞাসা কি আমার ছিল না? আমাদের ছিল না? তারপর তো আমরাও নিজেদের বলি ‘সে বাঁশি তুলে নিয়ে বসো দেখি,/ রে অচেনা, স্থির হও, স্থির হও, স্থির—’

‘আমার মরণ হলে/ ক্ষীণতোয়া নদীতে ভাসিয়ে দিও,/ তারপর ঝরা তেজপাতা/ সাতদিন সাতরাত ধরে মিশিয়ে দিও জলে—’ এই বেদনার ভার পাঠক তুলে নেয় কাঁধে। তবুও ইচ্ছেরা থাকে। ‘বোধিপ্রাপ্ত কোনো বিড়ালের সাথে থেকে যেতে ইচ্ছে করে’। ‘যদি আর না-ই ফিরি, আপেল গাছের তলে/ বানাব কুটির।/ এই তো আমার মেঘ মিস্ট্রি মর্মলোক…/ এই তো আরেক আমি-র নেপথ্য বিশ্ব…/ এই তো আমার হর্ষকবুতর ভরা সরাইখানা…’

#

 

এরপরে জেব্রামাস্টারের কবিতা। জেব্রামাস্টার পর্বে অদ্ভুত রসের সঙ্গে শ্লেষ মিশ্রিত হয়ে একগুচ্ছ অন্য স্বাদের কবিতা পেয়ে যাই আমরা। আমার মনে হয়েছে এই পর্বে কবি কিছু নিরীক্ষার মধ্যে দিয়ে ভ্রমণ করেছেন। যার উপক্রমণিকায় কবি লিখছেন—

‘আজ আমার সকল সৃষ্টিছাড়া পঙ্‌ক্তির গায়ে বিকেলে ম্লান স্বর্ণচ্ছায়া এসে পড়ুক, কিম্বা তার পাশে জ্বলে উঠুক শুকনো পাতার স্তূপ। ব্যাধ ফিরে এসে দেখবে, ছাই উড়ছে শুধু’। ‘কেন তবে হারিয়ে যাও জেব্রাদের উন্মাদ-দৌড় শুরু হলে! একটু দাঁড়াও যদি, দেখতে পাবে মৃত ফুল ছড়ানো পথের কিনারে…’

জেব্রামাস্টার পর্বের শেষ কবিতার নামও জেব্রামাস্টার। আমি শেষ থেকেই শুরু করি এখানে।

‘আমি পড়াই জেব্রাদের স্কুলে। ছোট ছোট জেব্রারাই ছাত্র হিসেবে সবচেয়ে উপযুক্ত, একথা ক্রমে অনুভব করতে শুরু করেছি’।

‘আমার মা বাবা ভাই বোন কেউ নাই, বস্তুত। আমি বড় হয়েছি একটা লাল রঙের মাদী শেয়ালের কাছে’। এইরকম চমক দিয়ে যে কবিতার শুরু হল, তার শেষে না জানি কী আছে— সভয়ে এগোই।

‘শেয়াল-মা আমাকে জেব্রাদের গায়ে যেসব ডোরাকাটা দাগ আছে, তার তাৎপর্য বলে দিয়েছিল। বারবার সাবধান করে দিয়েছিল, কীর্তিমান পশুদের যৌনদৃশ্য দেখে আমি যেন কখনওই না হাসি। হাসলেই শেষ। এর আগে যারাই হেসেছে, নাভি থেকে এক ফুৎকারে উড়ে গেছে তাদের সমস্ত হাসি, আর পরিণত হয়েছে অভিশপ্ত কাব্য সমালোচকে। তারপর যথারীতি ক্রুদ্ধ কইমাছের দল তার পিছু নেয়’। সত্যি বলতে কী এরপর আর হাসা যায়? হাসি এলেও ভয়ে গিলে নিই। কে চায় অভিশপ্ত কাব্যসমালোচক হতে? রাগী কইমাছের কানকোর ঝাপটায় কে ক্ষতবিক্ষত হতে চায়? তার চেয়ে আমার এই জার্নিই ভালো।

‘আর কে না জানে, ছোট ছোট ছাত্রদের মগজ, কলিজা, মাংস, এমনকি এদের ঝকঝকে স্বপ্নভরা চোখ আর পায়ের কচি খুর— সবই খেতে খুব সুস্বাদু লাগে…’ জেব্রামাস্টারের অভিসন্ধি বুঝে নিয়ে আপাতত শুরুর দিকে যাই। ভাষার দিকে যাই। ‘আমার ভাষা তৈরি হয় সেই নির্জনতায়, জেব্রা যেখানে তার শাবকদের নিয়ে খেলা করে। বহু খুঁজে পেয়েছি পেজমার্কার, একটি বিয়োগচিহ্ন, একটি ডালিম, ফুলের ছায়া। বন্ধ দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে, লিখতে শুরু করি। একদিকে অসানোগ্রাফির ক্লাশ, অন্যদিকে তোমার সঙ্গে সাঁতার কাটার ইচ্ছে’। ইচ্ছে আর সংঘাতের মধ্যে থেকে উঠে আসি আমি। মনে হয় এই দুর্বোধ্য কিছু অতিনাটকীয় পঙক্তির মাঝে আমিও আটকা পড়ে গেছি। নিয়ন্ত্রণহীন এক জাহাজের মতো এ দিক থেকে ওদিকে ধাক্কা মারছি, ডুবে যাব বলেই।

‘বোবা সেজে থেকো না হে বাগীশ্বরী, ঘোলা চাঁদের দিকে তাকিও না আর। ফুটিছে মরণপুষ্প, ঘ্রাণ এত মাথা ঘুরে যায়। চোখের পাতার মতো লঘু হও, এত ঝিঁঝিগান, অজস্র আলপিন বিঁধে আছে যার মুখে, ও কি তোমারই মতো তাম্বুলসেবী, বীতনিদ্র নৈশকোকিলা?’

ভাবায়। ভাবনার মাঝে উড়ে আসে প্রশ্ন— ‘কিরিলভ! এখনও কি রাত্রি নেমে আসে চিন্তার ওপর? অন্য এক সিসিফাস ফিরে যায় তার ব্যক্তিগত পাথরের দিকে’।

‘জ্যোতির্ময় ঘুঘুদের সাথে, আমবাগানে, ছুটি শেষ হল’। কে এই ঘুঘু? ‘বলো বুদ্ধ বলো, বলো বার্তাবাহী মেঘ, এই অর্ধক্ষয়িত রংপেন্সিলের বাক্স নিয়ে আমি কী করব!’

তবে কি ‘বিশাল সেই ঘুড়ির সঙ্গেই উড়ে যেতে হবে?’ ‘এখন তোমার এক-পাহাড় উড়ো কথা, আমার এক-পাহাড় নীরবতার মধ্যে পাক খাচ্ছে। অল্প দূরে ভেসে উঠছে আগুনরাস্তা। ফিরে এসো, রাজকুমার, আমার আনন্দে, তোমার অন্ধ-ধূধূ আনন্দ মেশাও’। বন্ধু আছে, থাকেও আবার চলেও যায়। বিচ্ছেদের পরেই কি আমরা দাম্পত্যের আবর্তে প্রবেশ করি? ‘আসলে তোমার জন্যে কোথাও অপেক্ষা করে আছে কাঠবেড়ালি, তার বগলে এ বছরের রাশিফলের বই, আর অন্য হাতে সেক্স-পিস্তল’। ‘খবরদার, ভুলেও বেড়াল কোলে নিও না, যা দিনকাল পড়েছে, স্তনে আঁচড় দেবার ঘটনা গত পরশুও ঘটেছে ভূতের গলিতে’।

মনে মনে অনেকটা পথ অতিক্রম এসেছি এতক্ষণে। আর তখনই তিনটি পঙক্তি পথ জুড়ে দাঁড়ায়। ‘যে-কোনও সুদূরকে আজ অপরাহ্ণ বলে মনে হয়’। ‘আমার সবুজ অক্ষরগুলো ধুলোয় ঘুমায়’। ‘আগামী কোনও ঝড়ে হাতি, হিতোপদেশ সবই হয়ত একসঙ্গে উড়বে’।

এখানে একটি কবিতার শিরোনাম ‘না দারুনক্ষত্র, না বায়ুবীণা, না চুম্বন, না গ্যাসল্যাম্প’। এই কবিতার শুরু হচ্ছে এমনভাবে— ‘রাত্রির খোলা জানালা দিয়ে একদিন স্বয়ং চাঁদ ঢুকে পড়বে তোমার ফাঁকা ঘরে। প্রশ্ন উঠবে, এত লেখা ও লবঙ্গ কোন্‌ পুজোয় লাগে!’ ‘গাব্রিয়েলে’ কবিতায়— ‘গাব্রিয়েলে, বাড়ি কোথায় তোমার? শুনে, নাচল একটুখানি। তারপর সেই পুরনো হাসি। বললে, তুত্তা লা রোমা, আংকে, তুত্ত ইল্‌ মন্দ। ভাবখানা এই, কিছু নাই, তাই সবই আমার’। কবি যখন ‘আমার চিন্তাপদ্ধতি’ নিয়ে লিখবেন, কেমন হবে সেটি? ‘আমার চিন্তাপদ্ধতি সরাইখানার হট্টগোল ছাড়া কিছু নয়। যে-দুর্বোধ্য মৃদু হাসি আমার মুখে দেখতে পাও, তা শিখেছি ডন জুয়ানের কাছ থেকে’। ‘এই রংচিন্তা, আধারচিন্তা, আধেয়চিন্তা’ কবিতায় কবি ‘তোমার উদ্দেশে লেখা কিছু চির-অসমাপ্ত চিরকুট আজ ঝিনুকের খোলসের ভিতরে রেখে যাই—

১. সমুদ্র পাড়ি দেবার সময়, তোমার কথাগুলো হয়ে ওঠে মর্মর।
২. সারারাত বাঘের গন্ধ।
৩. ’৯৯৯৯৯৯৯৯৯
…………………
১৬. এই তবে ধ্যানমুগ্ধ সপ্তম বেড়াল?
১৭. আমার মৃত্যুর তারিখের ওপর মেরুন রঙের একটা পাহাড় বসে আছে’।

কবি ‘দেবতার সঙ্গে’ সময় কাটিয়েছেন। ‘জ্বর’ হলে ভেবেছেন ফিরে না আসুক আর সেই ‘সন্দীপন রাত্রি’। আর বলেছেন ‘বারবার কেঁপে উঠি। এমন স্পর্শ। আমি কি বের হব না সমস্ত বিমূর্ততা থেকে, কবিতার অশ্লীলতা ও স্বর্ণজাল থেকে? তবু স্পর্শ করো। ফণিমনসায় জ্বলে উঠুক ফুল। রুদ্র কোনও ফুল। হাওয়া এসে নগ্ন করে দেয় যেন তোমার মর্মরমূর্তি’।

#

বাল্মীকির কুটির । মজনু শাহ । চৈতন্য প্রকাশন । দাম: ৩০০ টাকা

ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না কাব্যগ্রন্থের ভূমিকায় কবি লিখেছেন— ‘জেন কোয়ানগুলোতে উত্থাপিত প্রশ্ন, এবং সেই প্রশ্নের প্রেক্ষিতে প্রায়শ-সম্পর্কহীন উত্তর যা আমরা দেখি, সেসব নিতান্ত উদ্দেশ্যহীন নয়। … আবার একই রকম ঘটনা ঘটতে দেখি ‘মসনবি’ পড়তে গিয়ে। যে-কোনও প্রশ্নের উত্তর সেখানে অবিরাম রূপকগল্পের ইশারামাত্রে সম্পন্ন হয়েছে। … মনের মধ্যে ঘটে চলা ‘আমি’ ও ‘অ্যান্টিআমি’র এই soliloquy সেই দিকে যাওয়ার একটা দুশ্চেষ্টা’।

ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়নার শুরু হচ্ছে এভাবে— ‘এখানে মিছেমিছি কী করছ তুমি?

সুমিষ্ট গুল্মের প্রতি ধাবিত ছিলাম এতদিন, আজ হো হো হাসির এক কিংবদন্তী রাস্তায় এসে পড়েছি। ঐ যে দেখতে পাচ্ছ অসীম রক্তথিয়েটার, আমি তার মর-কুশীলব। আল্লার মনের একবিন্দু’।

‘আমায় চিনতে পার?
তুমি আমার অল্টার-ইগো, হাওয়া এলোমেলো করা রাত্রির ভিতরে দেবদারুদের সঙ্গ দিতে পছন্দ কর, বস্তুত তুমি এক বসন্তসন্ধি’।
‘দেখেছ কখনও পাখিদের ধূলিস্নান?
আমার দেখাগুলো সবসময়ে রয়ে যায় অসম্পূর্ণ’।
‘পাখিদের মুখস্থ করতে পার? দুর্গা টুনটুনি দেখতে কেমন?
যখন কেউ আস্তে ধীরে ঢুকে পড়ে অগ্নিশিখায়, প্রেম বলি তাকে, নাম ধরে ডাক দেই, থামি, জঙ্গলে পতিত চাঁদ, কেউ তার সাক্ষাৎকার নিতে প্রস্তুত নয় আজ আর’।
‘পবিত্রতা কী?
ব্যক্তিগত কাঠগোলাপ’।
‘দারুচিনির দেশ কোথায়? স্বপ্নসমাধি কোথায়?
রক্তবর্ণ সিঁড়ি দিয়ে নেমে যেতে হয় সেই দেশে। সেখানে রৌদ্র, ছায়াভূমি, ধুলিঝড়, মুকুলগন্ধ, ভরা উঠোন আর আখরোট বাগানের আশ্চর্য মেশামেশি’।
‘ফের বাঘিনী?
তার জন্য আমি সাত ক্রোশ হেঁটেছি সেবার’।
‘গোপন চিঠিই কি তোমার লিরিক?
আমি যাকে ওস্তাদ ভেবে এসেছি, তা ঐ ক্রুদ্ধ কাঠঠোকরা। কোথা থেকে এত ক্রোধ সে জড়ো করেছে মাথায়, গাছেরা জানে তাকে!’
‘কিছু একটা লেখামাত্র মুছে যায় কেন এই নোটবুক থেকে?
এইসব মেঘে ঢাকা ডাইনির এক্তিয়ারে, মেটে রঙ পাখিদের যিনি সর্দার, তার এক্তিয়ারে’।
‘কেন ঊর্ধ্বনেত্র, সারা সন্ধ্যা ধরে?
লেবুগাছ যখন লেবু আর গন্ধে নুয়ে আসে, ফ্ল্যাশব্যাক করে সে হয়ত কিছু মনে করতে চায়’।
‘মাথার মধ্যে কে করে এত ফ্ল্যাশব্যাক?
এক অনন্ত স্বপ্নযোগী। পৃথিবীতে তার ছিল গোপন আয়না। আগুন ছড়ানো রাস্তা ছিল। ছিল মূর্ছিতা নর্তকী, যেমন থাকে কারও কারও। বটগাছের পেছনে তার দোলনা আজও ভয়াবহভাবে দুলে যায়’।
‘এসব যে বলে সে কি রাত্রিদেবতা?
তার ঘুম এক ভ্রমরময় চক্র। বুদ্ধছবি, চাঁদ এসে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে সেই গুপ্ত চক্রপথে’।
এইভাবে প্রশ্নোত্তরের ভেতরে চলতে চলতে কখন যেন অনেকটা চলে এসেছি! আরও কিছু পথ বাকি।
‘প্রতিবিম্বের লক্ষ্য কী?
কবিতা ও বুনো ভালুকটিকে মনে করিয়ে দেয়া। তুমি যে বৃদ্ধ পাখিদের সভায় হেসেছিলে একদিন, সেইসবও’।
‘কথা-বলা গাছ তুমি দেখেছ কখনও?
সারাক্ষণ সে এসে ঢুকে পড়তে চায় স্বপ্নে। পাতাগুলি তার ভবিষ্যদ্বাণী-ভরা। সকলই অনন্ত’।
‘সকলই অনন্ত?
সকলই অনন্ত জেনে সর্বভূত সত্যের মধু খেতে আসে’।
একেবারে শেষের দুপাতায় এসে গিয়ে প্রশ্নোত্তরের দৈর্ঘ্য কমে এসে যেন র‍্যাপিড ফায়ারের চলন ধরেছে।
‘কবিতা! অতি বিরল সেই মাধবীমুহূর্তের মুখোমুখি হবার যোগ্য কি তুমি?
অন্তত এটুকু স্পষ্ট বুঝেছি, না। সেজন্যই, হায়, না-কবিতার দিকে চলেছি’।
‘আর?
হো হো হাসির এক কিংবদন্তী রাস্তা
আর?
না-ঘুমানো একটি বৌমাছ ভেসে থাকা লক্ষ লক্ষ মৃত মাছেদের দেখে বেড়াচ্ছে আর অন্য এক মজনু তাকে অনুসরণ করে চলেছে নীরবে
আর?
নক্ষত্রের শান্ত মনোলোক, তুমিই আমার একমাত্র কমরেড
আর?
আর কিছু নাই, আর কিছু নাই গো ময়ূরী তোমার কিরণমাখা দেহ আলগোছে সরিয়ে নাও অন্য জগতে’।

#

 

‘আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া’ পর্বের লেখাগুলি সম্বন্ধেও কবির ভাষাতেই বলি। ‘এই গ্রন্থের লেখাগুলো, তাৎক্ষণিক! বা সামান্যকে খুঁজে ফেরা। অবশ্য আমার সব লেখাই কমবেশি এমন। জগতে তুচ্ছ, অতি-তুচ্ছ, স্খলিত যা কিছু, সেসবের দিকে benevolent curiocity নিয়ে যদি তাকাই, একেকটি মুহূর্ত সেখানে ভাবনাবীজ যে, প্যারাডক্স হয়ে উঠতে সক্ষম, কখনও যেন তারা মাধবী! বাকফসলের রাজ্যে, কী-বা নাম হতে পারে এদের, ব্ল্যাকহিউমর? হেত্বাভাস? ন্যানো? চিত্রোক্তি, না অন্য কিছু? যা-ই হোক, তেমন দাবি না রেখে, একজন হরবোলার মতো শুধু দেখে যাওয়া, আর সংক্ষিপ্ততম করে টুকে রাখা। ইমেজারি সন্ধান! কবিতার সেট-থিওরি, করণকৌশল, আর সমস্ত আখ্যানবর্ণনার বাইরে এসে, সন্ধ্যার আকাশে ভেসে বেড়ানো একখানি ছোট সিন্ধুমেঘ যতটুকু বলে, তারই আয়োজন’।

একেই কি তবে অণুকবিতা বলব পক্ষান্তরে? যাই নাম হোক না কেন, এই পর্বে ২৬২টি এক বা দু লাইনের ছোট ছোট কবিতা রয়েছে। রুমি, শামস্‌-এর উল্লেখও রয়েছে এই পর্বে। সেই হেতু এবং কবিতার ফর্ম দেখে রুমির মসনবির কথা মাথায় আসলেও আসতে পারে পাঠকের।

এক নম্বর যেন ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’র রেশ টেনে প্রশ্নোত্তর দিয়েই শুরু হল।

কে তুমি?
…আমাকে বলছ? আমি? ওহ, তবে শনো, আমি এক ড্রপআউট ঘোড়া।

তোমার সূক্ষ্ম-সত্তা গিলে খায় আমার সৃষ্টিকে।

অপ্রকাশিত পাখিটির কথা ভাবি, সে কখন ফুটে উঠবে কসমিক আলোয়, তার জন্য আমার সমস্ত অপেক্ষা।

২০

কাকাতুয়া-সম্রাট, কোথায় তোমার লণ্ঠন ও বন্দুক?

২১

শামস, এই খ্যাতি-লিপ্সা, এই মেরুপথের অন্ত না পাই। এ কি নয় গাধার সঙ্গে সঙ্গম!

৩৭

আমার ব্যথা ও রাত্রি একে অন্যকে সারারাত সেলাই করে চলেছে।

৫২

ঝরাপাতা, এই নাও আমার মধ্যযুগীয় শরীর, বাক্যশরীর।

৬০

আগুন রঙের সিংহ ফ্যা ফ্যা করে ঘুরছে আর মিসিং লিঙ্ক জুড়ে শব্দ হচ্ছে চাবুকের।

৬১

মাঝে মাঝে আমার মনটাকে তুলো-ঠাসা মৃত খরগোশের মতো ঠেকে।

৯৪

সামনে যেতে কাঠবিড়ালিটি অভয় দেয়, এই সুড়ঙ্গ পেরোলেই রমণবিদ্যা।

৯৫

হেঁটে চলেছে ছায়ামূর্তি। স্মরণীয় অগ্নিশিখা জ্বলছে ব্রহ্মকমলের পাশে। আজ আমার শুধুই আহরণ। স্টাফ্‌ড পেঁচা আর অতি লালবর্ণ ক্যালেন্ডার খুঁজে ফেরা।

১২১

জগত লুণ্ঠন হয়, তপ্তকাঞ্চনবর্ণা, তোমার নাচের সময়।

১২২

একটি স্ফুলিঙ্গে কেঁদে ওঠে আল্লাহ্‌র ব্যাখ্যা।

১৩২

ঘাসফুল কোনও এক নক্ষত্রকে সারাক্ষণ প্রশ্ন পাঠায়।

১৫২

একজনের চাঁদ আরেকজনের তেজপাতা দিয়ে কী করে ঢাকবে তুমি?

১৫৩

বাঁশপাতা, পাঠযোগ্য হয়ে ওঠো আমার সম্মুখে।

১৬৪

সেই পরম নিখোঁজ ফিরে এসে যদি না তার মুঠো খুলে ধরে, কীভাবে পাব অধিকবিতার মুহূর্ত!

১৮৭

কোনও একটা নির্জন-প্রবন্ধ আমি ঘোড়ার পিঠে বসে ভাবতে ভাবতে হারিয়ে ফেলি।

১৯৪

তার আর বাক্য নাই, চোখ দুটি বিস্ফারিত, সূক্ষ্ম স্পর্শ তবু ভাষা ও ভ্রমরের প্রতি।

২০৩

চল্‌ চল্‌, বন্ধন-তিতিক্ষা, চল্‌, রে প্রশ্নরূপী নিঃসঙ্গতা, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল।

২০৮

মৃত্যুআয়নার ভিতর ও কার এক ঝলক প্রকাশিত মুখ? লেজঝোলা পাখিটির আজ অশ্রুপাত।

২১৭

রাত্রির তৃতীয় পঙ্‌ক্তি থেকে উৎসারিত সমস্ত পাখি।

২২০

একটি শ্লোক উচ্চারিত হল, রত্নছায়াময় চামর দোলাও।

২২৭

রুটি-পোড়া গন্ধের ভিতর, আরও এক স্তর খুলে গেলে বুনো রাত্রি, অযুক্তিসুন্দরভাবে উঠে যাচ্ছে কয়েকটি ছায়ামূর্তি শাদা সোপান বেয়ে।

২৪৩

কবিতা নয়, গ্রাফ্‌টিং, কে আগে তবে বেজে উঠবে এই সন্ধেবেলায়, গ্রান্ডফাদার ক্লোক, না মৃত পাতারা?

২৫৩

আমি কোনওদিন ঐ রতিশিক্ষিকার টয়ট্রেনে চড়ব না আর?

২৫৮

অন্য এক জেব্রামাস্টার তাঁবুর মধ্যে শুয়ে ছটফট করছে, আর বাতাসে দোল খাচ্ছে ঝাড়লণ্ঠন।

২৬২

এক বইবিরোধী রাতের দিকে সরে যাই। একটি অত্যুজ্জ্বল শোভাযাত্রা ফুটে উঠল বুঝি। আরও একটি ধ্বনিময় পৃথিবী জেগে ওঠে সহসা। অন্ধকারে কেউ এসে অস্ফুটে শুধায়, ‘ভয় কিসের?’

#

 

সেই ‘আনকা মেঘের কাহিনী’ থেকে ‘ব্রহ্মাণ্ডের গোপন আয়না’ পর্যন্ত কবির জার্নি লক্ষ করলে এটুকু স্পষ্ট বোঝা যায়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিণত হয়েছে বোধ। অতিরিক্ত নিরীক্ষাধর্মী লেখার থেকে তিনি ক্রমে ঝুঁকেছেন দর্শন ও কিঞ্চিৎ সুফিয়ানায়। যদিও কবিতা বলতে কবি যে স্বরনিক্ষেপের কথা বারবার উল্লেখ করেছেন, তার উপস্থিতি রয়েছেই। সর্বশেষ পরিক্রমা বাল্মীকির কুটির, যার প্রায় প্রত্যেকটি কবিতা আমার বিশেষ পছন্দের, তারই ভূমিকায় কবি লিখেছেন একটি কবিতাই।

‘আকাঙ্ক্ষার ফাঁদে পড়ে, তুমিও কি হারাওনি লক্ষ লক্ষ স্পার্ম?/ দেখো, এরা কিংবদন্তীর কথা কিছু বলছে না, তবু/ সূর্যাস্তের দিকে যাবার পথে তুমি বীণা হয়ে ওঠো, এখানে/ ক্রৌঞ্চমিথুন, পাতার কুটির, এক বাল্মীকি ঘুমায় চিরকাল’।

এক গুচ্ছ কবিতার সমাহার এই বাল্মীকির কুটিরে রয়েছে। ‘ভুতূড়ে মাঠে’ কবিতা দিয়ে এই পর্ব শুরু।

‘আবার এসেছি আমি সেই ভুতূড়ে মাঠে। কিছুক্ষণ বসব।/ আমের মুকুল ঝরেছে অনেক। গাধার পিঠে যিনি এক্ষণ মাঠ/ পেরোলেন, উনি যিশুর সাঙ্গাত নন।……’

আইডিয়ার মস্তানি চলছে জগতে। কিছুক্ষণ সেই মস্তানি দেখি। পরক্ষণে ভাবি, সাপেদের বাক্সের মধ্যে ভরানোই আমার মূল কাজ। আরও কিছুদিন বাদামগাছের মতো থাকো। এর বেশি চেও না। তুমিও শিল্পকূট, তখন, মধ্যরাতের দিকে ধাবমান নীলবর্ণ পথিক। কে বলবে তোমার সামনে গায়ে আগুন ধরে যাওয়া একটি সিংহ ছুটতে ছুটতে কোন্‌ নির্বাণে পৌঁছবে?

হ্যাঁ, মুহূর্তই হয়ে উঠতে পারে মিথ। এবং রাক্ষস। আজ আর সমরখন্দের কোনও পণ্ডিতের কাছে আমি পৌঁছতে পারব না, শব্দের কাছেও, যারা ছিল প্রকৃত ঘুড়ি, কুমারী মাছের মতো একা, বা অচেনা শক্তি। ডুবোপাহাড়, তুমি কি সুচরিতা?

যে-অবয়ব সঙ্গী হতে চেয়েছিল, তাকে আর কোথাও খুঁজে পাবে না তুমি। শোনো, তুমি এক অলীক ভ্রমণার্থী বৈ কিছু নও। সাত আটটা বনবিড়াল এইমাত্র তোমার বিছানায় উঠে এল, তারা ছিঁড়ে ফেলবে বালিশ! আজও তুমি বাড়ি ফিরবে অনেক রাতে। রাত্রিবেলা একেকটা মৌরিফুল, একেকজনের স্বপ্ন আরেকজনের কাছে নিঃশব্দে বিক্রি করে দেয়। একেকটা মৌরিফুল, কী যে হারামি, একবার ভাবো!

আমি নেমে এসেছি দাস ভর্তি জাহাজ থেকে। চলো হে ময়ূর, এবার অলঙ্কারশাস্ত্র অবধি ঘুরে আসি। রুটিগাছের গল্প শুনি, সেটাই-বা কোথায়? তারপরে ধরো, বন্ধুত্ব! তোমাকে অতিক্রম করে বিশাল কোনো ময়াল। শিউলিগন্ধ-মাখা মাটি ফিরে পাব আর! ডিপ্রেশন, হে প্রিয়। ছায়াযুদ্ধ, আবার মেনে নিও। গয়নার নৌকায় হরিণের কাটা মুণ্ডু থেকে যে-রক্ত ঝরছে, তা কি কবিতা? মরে গেছে এক যুদ্ধ-ফেরত অশ্ব, আমি তার মতো, হে নীলাভ কাঁচের পাত্র, আমি অনেকখানি তোমারও মতো, সুধা!

সমস্ত পাতা হারিয়ে ফেলা কাঠগোলাপ গাছ, কেমন আছ তুমি? ও আমার অকেজো গ্যাসবেলুন, কেমন আছ? একটি শুক অন্য সারির দিকে তাকিয়ে নীরব। এখানে, খুব নির্জনতা। জানি সারারাত তুমি একবার শিখা হবে, একবার শ্যামা। খুব যৌনতাও একবার। তারপর পেখম গুটিয়ে ঘুমের ভিতর। একটি বিভাস তবু শুনতে পার উন্মাদ গায়কের কাছে।

চারিদিকে মোক্ষদাস, মোক্ষদাসী, কত শব্দ ছুঁড়ে দিচ্ছে তারা, তুমি তবু ভোঁ হয়ে আছ সারাক্ষণ। বোঝা যায় কি যায় না এমন একটা পথ ঢেকে আছে বাঁশপাতায়। একটি লাল বাদামপাতা কতদূর আর উড়ে যেতে পারে! নিখিল সেই উড়ে চলা লাল বাদামপাতা তাকে জানে, পরাক্রান্ত ঝড় তুলে নেবে একদিন সৃজনের ছদমবেশে, আদিম প্রশ্নেরা তাকে জানে।

জবাফুল ভরা একটা নৌকায় বসে আছ তুমি। আর মালার্মের কবিতা পড়ে বোকাসোকা ভাবে তাকাচ্ছ চারিদিকে। ক্রম বিলীয়মান জগৎ থেকে যেন কিসের গন্ধ আসে। আমি চাই না সূর্য আমার মধ্যে প্রবেশ করুক। কী ভয়াবহ, কোনও ক্লিওপেট্রা যদি ঘরে ঢোকে। কী চাও এখানে, পান্না-কোকিল? কিং লিয়ারকে তুমি বাধ্য করতে পার না নতুন কোনও সম্পর্কে। এখন স্বসৃষ্ট ফ্যান্টম থেকে তার বেরোবার মুহূর্ত।

অতিকায় স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে কর্পোরেট ঋষি, বাইরে ছটফট করছে ফিটন গাড়ির ঘোড়া। কবিতা লেখা সঙ্গমের চেয়ে উৎকৃষ্ট রসিকতা যদি ভাবো, তবে মাথা কেটে ফেলার আগে আরও কিছু মাটি খাও, ভবিষ্যৎগণনার জলপাত্রে ডুবে আছে একটি সেগুন পাতা, এইসব এক মনে দেখা। ভাবমূর্তির ছায়া হয়ে থেকো না, ও আমার হুতোম পাখি। স্বপ্নেও তুমি ব্যর্থ। স্তব্ধ ভাষা। অনন্ত সঙ্কেত, কথার অনন্ত সঙ্কেত স্তূপ হতে থাকে শুধু।

অনেক মেঘসঞ্চার হল। তোমার কাণ্ডকীর্তি বুঝতে না-পারাটুকু আমায় বিদ্রূপ করে। শ্বাস নাও এই মশলাবনে। নিষিদ্ধ বইগুলি উড়তে গিয়ে এখন জব্দ হয়ে পড়ে আছে ময়দানে। কে কাকে ট্রিগার করছে, কে কার বানাচ্ছে ফাঁদ? যে-সামান্য জ্ঞানটুকু হল সবই কমবেশি আঘাত থেকে। শোনো, নিজামউদ্দিন আউলিয়া, আজ শুধু একটুখানি চাঁদের আলো শুষে নেয়া।

শিকারের দুন্দুভি বাজে। ছেড়ে যাচ্ছ শালফুলের গন্ধ। দেখা দিচ্ছে পঙ্‌ক্তির মরুভূমি। এরপর শুধু স্বপ্নাভাস। সব তর্ক থেকে বেরিয়ে যাব, তবু কি স্বচক্ষে দেখব একটি ডোডো! চুরাশি রকম প্রশ্নের ফেরে পড়েছি। জয়দ্রথের মুণ্ডু গড়াগড়ি খায় নিষাদের দেশে। এই সমস্ত লিখে রাখব তেমন ভাষা কই! বাঘের থাবার তলে আমার অসংশোধিত পাণ্ডুলিপি, ভৌতিক বাতাসে আমার সুতীব্র ইচ্ছেরা কয়েক রতি আফিমের প্রায়। যদি আমি উত্তীর্ণ হতে না পারি তবু এই বনপথ, আর অজস্র পেখম, আগের মতো প্রজ্ঞাপূর্ণ রয়ে যাবে।

এই আমাদের তাসের দেশ। কে আমাদের গিলে খাবে, বিড়াল? কাব্যপঙ্‌ক্তি, নাকি হুর্সাল? সূর্যের ঝরোকা, তুমি কিছু জানো? পৌরাণিক ঘুমগাড়ির চাকা সারাই করছে একা এক পুরুষ বেশ্যা। ঘুমগাড়ি সচল হলে উঠে বসো, তারপর বাজাও মাউথঅর্গান। বেজে ওঠো তুমিও। কোথাও না কোথাও জায়মান হচ্ছে ভবঘুরেদের পৃথিবী। পড়ে আছে আধখানা রুটি, ফল, ব্যবহৃত সাঁতার-পোশাক। মনে করো এই টগর, এর কেউ নাই। অন্য এক টগর কখনও তাকে চুম্বন করেনি। চলেছি ‘কেন তুমি’-র দিকে। ধ্রুবতারা হও বা না হও, অত না ছুটে আমার ঘোড়ায় উঠে বসো’। একটা ঘূর্ণিনৃত্য ছাড়া আর কোনো পরিচয় আছে কি তোমার? যিশু কি আকাশে উড়ে গিয়েছিলেন! আকাশ তত অন্ধকার নয়। আচ্ছা, স্বর্গের রাস্তাঘাট কেমন, ঘাসগুলো এখানকার মতো? বই টই পড়ে কেউ?

উড়াইনি ফুর্তির পায়রা। শুধু হাউই ছুটে যাওয়া দেখি। একটি মোরগফুল। দাঁড়ের ময়না বলে উঠল সহসা, অনিশ্চিত! কোনও তত্ত্বনির্ণয় করিনি। শুধু কোনও ক্লাউন যখন গুটিয়ে নেয় তার পেখম, আমাতে বিলীন হতে দেই তার মৃত্যুরঙিন অবয়ব।

এইখানে এসে বন্ধ হয় বাল্মীকির কুটিরের ঝাঁপ। যদিও জানি অবারিত এই দ্বার যে কোনও পাঠকের কাছেই। এবং অব্যর্থও বটে। ফিরে ফিরে আসতে হবে এইখানে। দু একটি পাতা উড়িয়ে আবার স্থির হয়ে বসলে নিজস্ব ভাবনার জগত তাকে ডাক দেবে। কবিতা এমনই হয় হয়ত। দুর্বোধ্যের তকমা ঝেরে ফেলে দিয়ে সে অনায়াস হয়ে ওঠে প্রিয় পাঠকের কাছে। মস্তিষ্কের ক্রিয়া সচল থেকে যায় তার অনাদিকাল। আরোহণ যেমন ছিল, অবরোহণেও সমান স্বচ্ছ সেই সুরের ধারা গড়িয়ে চলতে থাকে আবহমান কাল ধরে। যেসব কবিতারা থেকে যায় তাদের মাঝে আমিও থেকে যেতে চাই অনন্ত কাল ধরে।

 

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4650 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...