শুভেন্দু সরকার
ইংরিজি সাহিত্যর অধ্যাপক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক
১৮৪০-এ তত্ত্ববোধিনী পাঠশালায় ভূগোল আর পদার্থবিজ্ঞানের শিক্ষক নিযুক্ত হওয়ার আগেই অক্ষয়কুমার দত্ত (১৮২০-১৮৮৬) স্থির করেছিলেন, বাংলায় ছাত্রপাঠ্য উপযুক্ত বইয়ের অভাব মেটানো দরকার। খানিকটা সেই খামতি পূরণের জন্যেই তিনি লেখেন প্রাথমিক স্তরের ভূগোল নিয়ে একটি বই। সেটি তত্ত্ববোধিনী সভা (১৮৩৯-৫৯) ছাপল ১৮৪১-এ। অক্ষয়কুমার এও জানতেন, বিজ্ঞানচেতনার দিক দিয়েও বাঙালি রয়েছে বেশ পিছিয়ে। ব্রাহ্মধর্ম প্রসারের জন্যে চালু হলেও তিনি তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র সম্পাদক (১৮৪৩-৫৫) থাকাকালীন তাই সেখানে জায়গা পেল বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সমাজতত্ত্ব, শিল্প-সাহিত্য ও অন্যান্য বিষয়। বলা বাহুল্য, এসব নিবন্ধর বেশিরভাগই অক্ষয়কুমারের হাত দিয়ে বেরোত।
সেদিনের শিক্ষিত বাঙালি যুবক ছিল তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র উদ্দিষ্ট পাঠক। খ্রিস্টধর্মর বদলে স্রেফ বেদান্ত-উপনিষদ নয়, বাংলা ভাষায় স্বদেশের গৌরবময় ঐতিহ্যর পাশাপাশি প্রগতিশীল আধুনিক পাশ্চাত্য চিন্তাভাবনা সম্বন্ধে তাদের আগ্রহ বাড়ানোও হয়ে উঠল এই মাসিক পত্রিকাটির লক্ষ্য। সেই খেই ধরে অবশ্য দেখা দিল দেবেন্দ্রনাথের সঙ্গে অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগরের দ্বন্দ্ব। যেখানে অধ্যাত্মবাদী দেবেন্দ্রনাথের যাবতীয় উৎসাহ ছিল ঈশ্বর-কেন্দ্রিক সেখানে অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর চাইলেন বস্তুবাদী চেতনার ব্যাপ্তি। ১৮৪৮-এ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-র পেপার কমিটির সদস্য হন বিদ্যাসাগর; গড়ে ওঠে তাঁর সঙ্গে অক্ষয়কুমারের গাঢ় বন্ধুত্ব।
ঘটনা এই যে, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-য় লেখা অক্ষয়কুমারের বেশিরভাগ নিবন্ধ পরবর্তীকালে তাঁর বিভিন্ন বইয়ে আবার ছাপা হয়— তা সে ইস্কুল-কলেজের কমবয়সি ছাত্রদের পাঠ্য হোক বা বড়দের জন্যে ঐতিহাসিক ও দার্শনিক বিষয়। বোঝা যায়, তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা-কে শিক্ষার সার্বিক মাধ্যম ভেবেছিলেন অক্ষয়কুমার— যেখান থেকে রসদ পাবে কিশোর থেকে যুবক; তার ভিত্তিতে ক্রমে তৈরি হবে এক প্রগতিশীল প্রজন্ম যা পালটে দেবে বাঙালির ভবিষৎ।
বিদ্যাসাগর-অক্ষয়কুমার সর্বদা চাইতেন, বাংলা হোক জনশিক্ষার মাধ্যম। তাই সরকারি ইস্কুল খোলার পাশাপাশি দুজনেই জোর দিয়েছিলেন উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ আর ছাত্র-পাঠ্য বই বের করার ওপর। জীবনচরিত (১৮৪৯) দিয়ে বিদ্যাসাগরের প্রাথমিক স্তরের বই লেখা শুরু হল। তারপর একে একে বেরোল বোধোদয় (১৮৫১), নীতিবোধ (১৯৫১), বর্ণপরিচয় (প্রথম ও দ্বিতীয় ভাগ ১৮৫৫), কথামালা (১৮৫৬) চরিতাবলী (১৮৫৬) আর আখ্যানমঞ্জরী (১৮৬৩)। মনে রাখার ব্যাপার, ভাষা শিক্ষার পাশাপাশি ছোটদের মনোজগতের বিস্তার ঘটানোও লক্ষ্য ছিল বিদ্যাসাগরের। তাই নীতিশিক্ষা ছাড়াও এসব লেখায় শারীর ও প্রাণীবিদ্যার সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভিদ আর ভৌতজগতের প্রাথমিক পাঠ থাকল; এমনকি, সমাজবিদ্যার প্রসঙ্গও বাদ গেল না। অ-ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর জোর পড়ায় বিদ্যাসাগরের ছাত্রপাঠ্য বইগুলি নিজেদের ইস্কুলে চালু করার ব্যাপারে মিশনারিরা যে আপত্তি জানাবেন— এ তো স্বাভাবিক!
অন্যদিকে, অক্ষয়কুমার দত্তর চারুপাঠ-এর তিনটি ভাগ বেরোল যথাক্রমে ১৮৫২, ১৮৫৩ আর ১৮৫৯-এ। বিদ্যাসাগরের মতো শিশু নয়, তিনি বরং গুরুত্ব দিলেন কিশোরদের শিক্ষার ওপর। বোঝা যায়, ধাপে ধাপে ছাত্রদের মধ্যে ভাষাশিক্ষার পাশাপাশি পুরোদস্তুর বিজ্ঞানভিত্তিক চেতনা চারিয়ে দেওয়াই ছিল অক্ষয়কুমারের মূল লক্ষ্য। নানা বিদেশি সূত্র ঘেঁটে চারুপাঠ-এর জন্যে বিজ্ঞান-নির্ভর নিবন্ধগুলি (তারমধ্যে বেশকিছু আগেই বেরোয় তত্ত্ববোধিনী-তে) লেখেন তিনি। এও মনে রাখার, বিদ্যাসাগরের মতো অক্ষয়কুমারও নীতিশিক্ষা দিয়েছেন, কিন্তু তা ছাপিয়ে গেছে বাস্তব দুনিয়া সম্বন্ধে তাঁর অনুসন্ধিৎসা। যৌক্তিক ঈশ্বরবাদ (ডীজ্ম্) জগতের সৃষ্টিকর্তা হিসেবে ঈশ্বরকে অস্বীকার করে না কিন্তু সেখানে বেশি জোর পড়ে ভৌতজগতের নিয়মকানুন আর মানুষের শারীরিক ও মানসিক প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞানের ওপর। তাঁদের প্রত্যয়: সেসব নিয়ম জানা আর সেই অনুসারে চলার ওপরই নির্ভর করে মানুষের সুখ ও সমৃদ্ধি। বলা বাহুল্য, অক্ষয়কুমার (ও বিদ্যাসাগর) ছিলেন এই মতবাদে বিশ্বাসী। ইওরোপে বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থানের পেছনে বিজ্ঞান যে প্রগতিশীল ভূমিকা নেয়, তার প্রাথমিক দার্শনিক ভিত্তি ছিল যৌক্তিক ঈশ্বরবাদ। তবে ভুললে চলবে না, স্রেফ জাগতিক বিষয়ের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নয়, অক্ষয়কুমার দত্তর লেখায় স্বাদেশিকতার ছাপও প্রকট। অক্ষয়কুমার দত্তর বিশ্ববীক্ষা নির্ধারণ করত তাঁর যাবতীয় কাজকর্ম— যেখানে বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক চেতনা, নৈতিকতা আর স্বদেশপ্রেম হয়ে গেছিল মিলেমিশে একাকার। এও ঠিক, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার ঝুঁকেছিলেন অজ্ঞেয়বাদ (অ্যাগ্নস্টিসিজম্) আর ধ্রুববাদ (পজিটিভিজ্ম্)-এর দিকে। তাঁর ঈশ্বরবিশ্বাস ক্রমশ শিথিল হয়ে গেছিল।
নীতিবোধ-এর মতোই কাল্পনিক কাহিনির বদলে বিষয়-নির্ভর নিবন্ধ হাজির করা চারুপাঠ-এর উদ্দেশ্য ছিল। প্রথম ভাগের ‘বিজ্ঞাপন’-এ অক্ষয়কুমার দত্ত জানালেন,
যেরূপ প্রস্তাব পাঠ করিলে, করুণাময় পরমেশ্বরের বিশ্ব-কার্য্য সম্বন্ধীয় নানাবিধ বাস্তবিক বিষয়ের জ্ঞানলাভ হইতে পারে, তাহাই ইহাতে নিবেশিত হইয়াছে। এ সকল বিষয়ের আলোচনা, অকিঞ্চিৎকর কাল্পনিক গল্প পাঠ অপেক্ষা সমধিক কল্যাণকর, তাহার সন্দেহ নাই।
কিন্তু খেয়াল রাখার ব্যাপার, ভৌত, প্রাণী ও উদ্ভিদজগের জ্ঞানের পাশাপাশি সেখানে জায়গা পেল নীতিশিক্ষা। সচ্চরিত্রবান হওয়া আর অপরকে নানাভাবে সাহায্য করা সেই শিক্ষার উদ্দেশ্য। এমনকি, অক্ষয়কুমারের মতে এমন জীবনধারা হল ঈশ্বরের নিয়মের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বলা চলে, বিদ্যাচর্চার সঙ্গে সঙ্গে অক্ষয়কুমারের প্রকল্পে সমান গুরুত্ব পেত সমাজভাবনা। স্বাদেশিকতা অবশ্য ছিল এর মূল প্রেরণা। ‘স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি-সাধন’-এ তিনি লিখলেন:
জনসমাজে অবস্থিতিপূর্বক অপর সাধারণের বিদ্যা, বুদ্ধি, ধর্ম্ম প্রভৃতি সকল বিষয়ে উন্নতিসাধনার্থে চেষ্টা করা সর্ব্বতোভাবে কর্ত্তব্য। ইতর জন্তুর ন্যায় কেবল নিজের ও নিজ পরিবারের ভরণ-পোষণ করিয়া ক্ষান্ত থাকা মনুষ্যের ধর্ম্ম নয়। প্রতিদিবস আপন আপন নিত্যকর্ম্ম সমাপন করিয়া যৎকিঞ্চিৎ কাল যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহা স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি সাধনার্থে ক্ষেপণ করা কর্ত্তব্য। যাহাতে স্বদেশীয় লোকের জ্ঞান, ধর্ম্ম, সুখ ও স্বছন্দতা বৃদ্ধি হয়, কুরীতি সকল রহিত হইয়া সুরীতি সমুদায় সংস্থাপিত হয়, এবং রাজনিয়ম সংশোধিত ও সত্যধর্ম্ম প্রচারিত হয়, তদর্থে চেষ্টা করা উচিত। স্বীয় পরিবার প্রতিপালনের ন্যায় স্বদেশের শ্রীবৃদ্ধি সম্পাদনার্থে যত্ন, পরিশ্রম ও বুদ্ধি পরিচালন করাও যে মনুষ্যের অবশ্য কর্ত্তব্য কর্ম্ম, ইহা অনেকেই বিবেচনা করেন না। (৫৪)
চারুপাঠ-এর দ্বিতীয় ভাগের বিজ্ঞাপনে অবশ্য ‘নীতিগর্ভ প্রস্তাব’-এর প্রসঙ্গ তুলতে ভোলেননি অক্ষয়কুমার দত্ত। দেখার ব্যাপার, সাধারণ নিবন্ধর সঙ্গে সঙ্গে তিনি সেখানে যোগ করেছেন কয়েকটি ঐতিহাসিক চরিত্রর জীবনের ভিত্তিতে নীতিশিক্ষা। এছাড়া, দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ-এর ‘পরিশ্রম’-এ অক্ষয়কুমারের আর্থ-সামাজিক চিন্তাভাবনার একটি অত্যন্ত জরুরি দিক ফুটে উঠেছে— যা চারুপাঠ-এর প্রথম ভাগে চোখে পড়েনি। সমাজে বহাল অর্থনৈতিক বৈষম্য, পরজীবী উচ্চবিত্ত শ্রেণি, গরিবের অমানুষিক খাটনি— সবই এসেছে এই লেখায়।
যে জন-সমাজে ইন্দ্রিয়-পরায়ণ ব্যক্তিরা সংসারের কোন প্রকার উপকার না করিয়া, স্তূপাকার ভোজ্য ভোগ্য সামগ্রী ভোগ করিতেছেন এবং নির্ধন লোক, তাঁহাদের ইন্দ্রিয় সেবা-সমাধানার্থে প্রতিদিন ৩০/৪০ ত্রিশ চল্লিশ দণ্ড পরিশ্রম করিয়া, শরীরপাত করিতেছে, তাহার ব্যবস্থা প্রণালীর কোন স্থানে না কোন স্থানে কোন প্রকার দোষ অবশ্যই প্রবিষ্ট আছে, তাহার সন্দেহ নাই। তাহারা পর্য্যায়ক্রমে কেবল ক্লেশ ও নিদ্রা এই দুই বিষয়েরই সেবা করে। তাহাদের প্রধান প্রধান মনোবৃত্তি চিরনিদ্রায় নিদ্রিত থাকে। অন্য অন্য শিল্পযন্ত্রের ন্যায় তাহাদিগকেও এক একটি যন্ত্র বলিলে, বলা যায়। (৪১)
এমন অমানবিক সমাজব্যবস্থার জন্যে অবশ্য বড়লোকদের ভোগবিলাসকেই অক্ষয়কুমার দায়ী করেছেন। তাঁর মতে, বিত্তশালীরা যদি স্রেফ প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে সন্তুষ্ট থাকেন আর নিজেদের পছন্দমতো উপায়ে সমাজকল্যাণে সাহায্য করেন তাহলে অবস্থা পাল্টাবে। ধনী ব্যক্তির মনোজগতে পরিবর্তন ঘটলেই গরিবের দুঃখ ঘুচবে— এমনই ছিল তাঁর বিশ্বাস। এছাড়া, অক্ষয়কুমার ভরসা রাখেন স্বদেশপ্রেমের ওপর। ‘জন্মভূমি’ নিবন্ধর শেষে তাই তিনি ঘোষণা করলেন:
এতদৃশ স্নেহ-ভাজন জন্মভূমিকে দুঃখ-ভারাক্রান্ত বিপদ্গ্রস্ত দেখিয়া যাহার অন্তঃকরণ বিদীর্ণ না হয়, সে মানব বলিয়া গণ্য হইবার যোগ্য নহে। দুঃখের কঠোর হস্ত হইতে জন্ম-ভূমির পরিত্রাণ সাধনার্থ যত্নবান না হইয়া যে ব্যক্তি নিশ্চিন্তে কাল হরণ করিতে পারে, তাহার অন্তঃকরণ পাষাণময়, ইহাতে সন্দেহ নাই— তাহার অসার জীবন জীবনই নহে। (৮৩)
নীতিশিক্ষার জন্যে চারুপাঠ-এর তৃতীয় ভাগে (যা ছিল স্নাতকস্তরের পাঠ্য) অক্ষয়কুমার ব্যবহার করলেন স্বপ্ন-রূপক; প্রত্যেক পরিচ্ছেদে একটি করে ‘স্বপ্নদর্শন’। জোসেফ অ্যাডিসন (১৬৭২-১৭১৯)-এর ‘টেল্স্ অ্যান্ড অ্যালিগরিজ’-এ অন্তর্ভুক্ত রচনাগুলি অবশ্য এর মডেল— যেখানে অবাস্তবের মোড়কে পরিবেশিত হয়েছে নানা বিষয়ে লেখকের মতামত। অক্ষয়কুমারের তিনটি ‘স্বপ্নদর্শন’ নিয়ে ছড়িয়ে আলোচনা দরকার। সার্বিকভাবে তাঁর বিশ্ববীক্ষার কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকের পরিচয় পাওয়া যায় এখানে।
‘স্বপ্নদর্শন— বিদ্যা বিষয়ক’ নিঃসন্দেহে অ্যাডিসন-এর ‘দ্য ভিসন্ অফ মির্জা’-র প্রেরণায় লেখা। কিন্তু সেটির মূলের প্রেক্ষাপট বা বিষয়বস্তু— কিছুই ঠাঁই পায় নি অক্ষয়কুমারের লেখায়। অ্যাডিসন যেখানে ইহজীবনের দুঃখকষ্ট আর মরণোত্তর সুখের কথা বলেছেন সেখানে অক্ষয়কুমারের প্রতিপাদ্য হল বিদ্যানুরাগ। একথা ঠিক যে, নীতিশিক্ষাই এই রচনার অভীষ্ট তবু তারই ফাঁকে স্পষ্ট বেরিয়ে আসে শিক্ষা ও দর্শন সম্বন্ধে অক্ষয়কুমারের দৃষ্টিভঙ্গি। বিদ্যাদেবীর সঙ্গে বিদ্যাকাননে ‘কাব্য’ ও ‘জ্যোতিষ’ গাছ দেখার পর তিনি ‘গণিত’ গাছ দেখতে পেলেন; বুঝলেন, জ্যোতিষ আদতে গণিতেরই একটি শাখা। অক্ষয়কুমারের শিক্ষাচিন্তা কতখানি বিজ্ঞাননির্ভর ছিল নিচের বর্ণনাটি পড়লে বোঝা যাবে।
আমি এই শেষোক্ত তরুর ন্যায় সারবান বৃক্ষ আর একটিও দৃষ্টি করি নাই। তাহার কোন স্থানের কণামাত্রও ক্ষয় নাই ও কুত্রাপি একটিমাত্র ছিদ্র কিংবা চিহ্ন নাই। আমি এই অদ্ভুত তরুর বিষয় সবিশেষ জানিবার জন্য পরম কৌতূহলী হইয়া, বিদ্যাদেবীকে জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি কহিলেন,— “এই সারবান্ অক্ষয় বৃক্ষের নাম গণিত। তুমি কেবল সম্মুখবর্ত্তী জ্যোতিষ-তরুর মূল ইহাতে সম্বন্ধ দেখিতেছ, প্রদক্ষিণ করিয়া দেখ, অন্যান্য কত আশ্চর্য্য বৃক্ষ ও লতা ইহার স্কন্ধ হইতে উৎপন্ন হইয়া, তদুপরি প্রতিষ্ঠিত আছে।“ বস্তুতঃ আমি বেষ্টন করিয়া দেখিলাম, তাঁহার কথা প্রামানিক বটে; শাখা প্রশাখা ও বৃক্ষ-রুহ-সংবলিত এক গণিত-বৃক্ষ অর্দ্ধ কানন ব্যাপিয়া রহিয়াছে। (৪-৫)
শুধু তা-ই নয়, অক্ষয়কুমার এও বুঝিয়ে দেন, প্রাচীন ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চা পরবর্তীকালে স্বদেশে কতখানি অবহেলিত হয়েছে; তার জায়গা দখল করেছে অসার ভাববাদী দার্শনিক চেতনা। বলা বাহুল্য, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক পাশ্চাত্য বিদ্যাকেই তিনি সমর্থন জানিয়েছেন; পাশাপাশি সমসাময়িক গোঁড়া হিন্দু পণ্ডিতসমাজকেও তির্যক বিদ্রূপ করতে ছাড়েননি। বলা যায়, নিছক ছাত্রপাঠ্য বই জোগানোই অক্ষয়কুমারের উদ্দেশ্য ছিল না; একইসঙ্গে নিজের মতাদর্শও অল্পবয়েসিদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন তিনি।
… আমার সমভিব্যাহারিণী পথ-প্রদর্শিকা বনদেবী সানুগ্রহ বচনে বলিলেন,— “সর্ব্বদেশীয় বৃক্ষ-লতাদি আনয়ন করিয়া এ কাননে রোপণ করা গিয়াছে। জ্যোতিষ ও গণিতের কয়েকটা কলম তোমাদিগের দেশ হইতেও আহরণ করা গিয়াছে। দেখ, ভিন্ন-জাতীয় লোকে এই কাননে অবস্থিতি করিয়া, উৎসাহ ও যত্ন-সহকারে তাহার কেমন পরিপাট্য ও উন্নতি সাধন করিয়াছে! আর তোমার স্বদেশীয় লোকদিগকে ধিক্কার করিতে হয়; কারণ, যতগুলি বৃক্ষ রক্ষণাবেক্ষণের ভার কেবল তাঁহাদিগের উপর সমর্পিত আছে, প্রায় তাহার সমুদায়ই ভগ্ন ও শুষ্ক হইয়া যাইতেছে। দক্ষিণ দিকে যত বৃক্ষ দেখিতেছ, সমস্তই এক-জাতীয়; তাহার নাম স্মৃতি; আর বাম দিকে যত দৃষ্ট হইতেছে, তাহার নাম দর্শন।“ আমি ঐ উভয়জাতীয় বৃক্ষ অবলোকন করিয়া, যৎপরোনাস্তি ক্লেশ পাইলাম। ঐ সমস্ত সহজেই অসার, রন্ধ্র-পরিপূর্ণ, কোনটা বা নিতান্ত শূন্য-গর্ভ, তাহাতে আবার সমুচিত যত্ন-সহকারে পরিপালিত না হওয়াতে, অতিশয় দুরবস্থ হইয়া রহিয়াছে। দেখিলাম, দক্ষিণদিকে সমুদায় বৃক্ষ যদিও সম্যক্রূপে নষ্ট হয় নাই, কতকগুলি শুষ্ক ও ভগ্ন-শাখ হইয়াছে, কিন্তু পারিপাট্য নাই; বোধ হইল, যেন প্রবল ঝঞ্ঝাবাত দ্বারা সমুদায় বিপ্লুত ও বিপর্য্যস্ত হইয়া গিয়াছে। বামদিকের কোন বৃক্ষের কেবল স্কন্ধমাত্র আছে, কোনটির বা সমুদায় গিয়া এক দিকের একমাত্র শাখা আছে, তদ্ভিন্ন কোন কোন বৃক্ষের স্কন্ধমাত্র গোচর হইল না। এই দুঃসহ দুঃখের সময়ে এক পরমকৌতুক দেখিলাম, কতকগুলি অভিমানী মনুষ্য উভয়পার্শ্বস্থ বৃক্ষতলে উপবেশন করিয়া, অত্যন্ত দম্ভ ও ব্যাপকতা-সহকারে মহাকোলাহল ও বিষম কলহ আরম্ভ করিয়াছে। (৫-৬)
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদের ‘স্বপ্নদর্শন— কীর্তি বিষয়ক’-ও মৌলিক রচনা। প্রথম পরিচ্ছেদের রচনাটির মতো সেটির বিষয়বস্তুও একান্তই অক্ষয়কুমারের নির্বাচিত। ছাত্রদের অক্ষয়কুমার শুধু লক্ষ্যমুখী হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন, এমন নয়, এও বুঝিয়েছেন, কোন্ ধরনের কর্ম তাঁর কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই ‘কীর্তিনিকেতন’-এ বীরের চেয়েও অধিক প্রাধান্য পেলেন কবি।
পূর্ব্বোক্ত বীরগণ যেমন এক এক পুরাবৃত্তবিৎ পণ্ডিতের সমভিব্যাহারে তথায় প্রবেশ করিয়াছেন, কবিদিগকে সেরূপ কাহারও আনুকূল্য অপেক্ষা করিতে হয় নাই; বরং তাঁহারাও অনেকানেক বীর্য্যবান্ ও গুণবান্ ব্যক্তির কীর্ত্তি-নিকেতনে-প্রবেশ-বিষয়ের সহায়তা করিলেন। তাঁহারা সকলেই স্ব স্ব প্রধান; তাঁহাদের করস্থিত পুস্তকের কোন মনোহারিণী শক্তি আছে, দ্বারবানেরা তাহা দেখিবামাত্র তাঁহাদিগকে যত্ন-সহকারে পথ্ প্রদান করিল। দুই শ্মশ্রু-ধারী সহাস্য-বদন প্রাচীন পুরুষ এই শ্রেণীর মধ্যস্থল-বর্ত্তী অপূর্ব্ব সিংহাসনে উপবিষ্ট ছিলেন। প্রাচীনের মধ্যে এমন সুন্দর পুরুষ আর দৃষ্টি করি নাই। বিদ্যাধরী কহিলেন,— “এক জনের নাম বাল্মীকি, আর একজনের নাম হোমর।” (৪৮-৪৯)
এখানেই অবশ্য থামেননি অক্ষয়কুমার। সংস্কৃত ও পাশ্চাত্যর নানা কবি-নাট্যকারের নাম উল্লেখের পাশাপাশি তাঁদের কাজ সম্বন্ধে নিজের মনোভাব জানিয়েছেন তিনি। যেমন, মাঘ, ভারবি, ভবভূতি, ভারতচন্দ্রর তুলনায় তিনি এগিয়ে রাখেন বাল্মিকীকে; আবার বর্জ্জিল, ডান্টে, মিল্টন, বায়রন্-এর থেকে অক্ষয়কুমারের মতে শেক্সপিয়র বড় কবি। এছাড়া, সংস্কৃত সাহিত্য সম্পর্কে তৎকালীন বাঙালি যুবকদের উদাসীনতা আর পাশ্চাত্য সাহিত্যের প্রতি তাঁদের অনুরাগের প্রসঙ্গ এসেছে এখানে। আবার সংস্কৃত সাহিত্য নিয়ে বিদেশি পণ্ডিতদের উৎসাহর কথাও জানাতে ভোলেননি অক্ষয়কুমার।
এরপর এল আর্যভট্ট, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত আর ভাস্করাচার্যর কথা। তাঁরা বসেছিলেন কীর্তিদেবীর সামনে। এ কথা ঠিক, প্রাচীন ভারতের বিজ্ঞানচর্চা পরবর্তীকালে চালু থাকেনি; স্বদেশে তা নিয়ে নতুন করে উৎসাহ জাগে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সূত্রে। অক্ষয়কুমার তাই আর্যভট্টকে দিয়ে বলালেন:
পূর্ব্বে কেহই আমার যথার্থ মর্য্যাদা অবগত হইতে পারেন নাই; সুতরাং আমার কথায় আস্থা করা দূরে থাকুক, অত্যন্ত অশ্রদ্ধাই প্রকাশ করিয়াছিলেন। পরন্তু এই সমস্ত বিদেশীয় বন্ধু আমার অভিপ্রায় অবলম্বন করিয়া, আমার শ্রম সার্থক ও মুখোজ্জ্বল করিয়াছেন। (৫১)
নিঃসন্দেহে অক্ষয়কুমারের কাছে পাশ্চাত্যর বিজ্ঞানচর্চা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই কোপর্নিকস, গালিলিও আর নিউটন্ প্রমুখ অন্যদের চেয়ে উঁচু আসনে (যার মধ্যে আবার সবচেয়ে উপরে নিউটন্) বসলেন।
সাহিত্য আর বিজ্ঞানের এলাকা পেরিয়ে অক্ষয়কুমার ঢুকলেন দর্শনের জগতে। ছোট্ট একটি অংশে পরিষ্কার ফুটে উঠল তাঁর বস্তুবাদী বিশ্ববীক্ষা। তিনি যে বৈজ্ঞানিক দর্শনে বিশ্বাসী, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর ভাববাদী মতবাদকে একইসঙ্গে ভ্রান্ত আর আধুনিক যুগে অপ্রয়োজনীয় মনে করেন— তা মজার ছলে খুব সূক্ষ্মভাবে জানিয়ে দিলেন। বুঝতে অসুবিধে হয় না, কোন্ মতাদর্শ ছাত্রদের মধ্যে প্রচার করতে চেয়েছেন অক্ষয়কুমার।
বেদব্যাস ও শঙ্করাচার্য্য এবং প্লেটো ও পিথাগোরাসকেও দর্শন করলাম। প্রথমে তাঁহারা সকলের মধ্যস্থলে অবস্থিতি করিতেছিলেন, পরে ভূ-মণ্ডলের পশ্চিম-খণ্ড নিবাসী কতকগুলি নব্য গ্রন্থকারের প্রখর মুখ-জ্যোতিঃ সহ্য করিতে না পারিয়া, এক পার্শ্বে গিয়া উপবেশ করিলেন। (৫১)
চারুপাঠ (তৃতীয় ভাগ)-এর তৃতীয় পরিচ্ছেদের ‘স্বপ্নদর্শন,— ন্যায় বিষয়ক’ অবশ্য অ্যাডিসন-এর ‘দ্য ভিশন অফ জাস্টিস’ অবলম্বনে লেখা। বলা যায়, অ্যাডিসন-এর নিবন্ধে নিজের আর্থ-সামাজিক ভাবনার প্রতিফলন দেখে তার বেশিরভাগ অংশ প্রায় হুবহু অনুবাদ করলেন অক্ষয়কুমার দত্ত। মূলের অবৈধ সন্তান আর মহিলাদের প্রকৃত সৌন্দর্য ও অন্যান্য প্রসঙ্গ একেবারেই আসেনি চারুপাঠ-এ। তবে খেয়াল রাখতে হবে, স্বপ্নর প্রেক্ষাপটটি অক্ষয়কুমারের মৌলিক অবদান। দুজন সৎ অথচ আর্থিকভাবে প্রতারিত ব্যক্তির (যাঁরা তিক্ত অভিজ্ঞতার পর মানবসমাজ ত্যাগ করেছেন) সঙ্গে লেখকের মোলাকাত স্বপ্নটিকে আরও প্রাসঙ্গিক করে তুলল। বাস্তবের সমস্যাগুলির সমাধান ঘটল স্বপ্নে। আর এই ফাঁকে ছাত্রদের সততার শিক্ষা দেওয়ার পাশাপাশি অক্ষয়কুমার মেলে ধরলেন নিজের পছন্দমাফিক এক সমাজব্যবস্থা। এও মনে রাখার, বাস্তব জীবনে কীভাবে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা যায়— তা নিয়ে অ্যাডিসন আর অক্ষয়কুমারের হয়তো পূর্বনিধারিত প্রকল্প ছিল না, তাই স্বপ্নে ধর্ম-পুরুষকে (অ্যাডিসন-এর ন্যায়দেবী) জাদুদণ্ড দিয়ে ন্যায়বিচার করতে হল।
… ধর্ম্ম অনুমতি করিলেন,— “প্রথমতঃ বিষয়াধিকারের বিষয় সমাধা করিতে প্রবৃত্ত হইলাম। যে ধনে যাহার স্বত্ব আছে, তিনি তাহা এই দণ্ডেই প্রাপ্ত হইবেন। অথবা যাহার যত লেখ্যপত্র আছে, সমস্ত উপস্থিত কর।“ ইহা শুনিয়া যাবতীয় লোক স্ব স্ব স্বত্বাধিকার সপ্রমাণ করিবার নিমিত্ত বিবিধ-প্রকার লেখ্য-পত্র, আহরণ করিলেন। কি আশ্চর্য্য! তাহাদের উপর ন্যায়দণ্ডের জ্যোতিঃ পতিত হইবামাত্র, তাহাদের যথার্থ তত্ত্ব প্রকাশিত হইল। সেই দণ্ডের এ প্রকার আশ্চর্য্য গুণ যে, তদীর কিরণ-স্পর্শমাত্র যাবতীয় কৃত্রিম পত্র দগ্ধ হইয়া গেল। দহ্যমান পত্রের প্রজ্জ্বলিত অগ্নি, সমুদায় লাক্ষাদ্রব ও অনর্গল ধূমোদ্গম দ্বারা সে স্থান অতি ভয়ানক ও পরম বিস্ময়কর হইয়া উঠিল। কোন কোন পত্রের কেবল কতিপয় প্রক্ষিপ্ত অক্ষর নষ্ট হইয়া, তাহার অগ্নি নির্বাণ হইয়া গেল। কিতু শত শত মুদ্রার স্ট্যাম্পপত্র সকল দাবানল-দগ্ধ মহারণ্যের ন্যায় ভস্মীভূত হইয়া, পর্বতাকার হইল। সেই লক্ষ লক্ষ মণিময় দণ্ডের জ্যোতিঃ কত কত পরম গুহ্য স্থানে প্রবিষ্ট হইয়া, অলক্ষিত অপহৃত ও সংগোপিত লেখ্য-পত্র প্রকাশ করিয়া ফেলিল। (৮৭)
এরপর হল ন্যায়বিচার— প্রতারককে সরিয়ে যোগ্য লোককে সম্মান দেওয়ার পালা। এমনভাবে সেই উলট্পুরাণের বিবরণ দিলেন অক্ষয়কুমার:
কোন কোন স্থানে দেখিলাম, লক্ষপতি বা কোটিপতি ধনাঢ্য ব্যক্তি পরমশোভাকর অট্টালিকায় বহুমূল্য অত্যুত্তম আসনে উপবিষ্ট হইয়া, বন্ধু-বান্ধবদিগের সহিত আমোদ-প্রমোদে পরমসুখে কাল-হরণ করিতেছিলেন, ইতিমধ্যে একজন সামান্য গৃহস্থ অকস্মাৎ উপস্থিত হইয়া, তাঁহাকে আসনচ্যুত করিয়া দিল, এবং তিনি তৎক্ষণাৎ তথা হইতে নির্গত হইয়া, অতি পুরাতন বৃক্ষ-মূল-বিদ্ধ ভগ্ন গৃহে গিয়া বসবাস করিলেন। কুত্রচ দৃষ্টি করিলাম, যে সকল ধনাসক্ত, মহামান্য মনুষ্য সমধিক ধনাগম করিয়া, অতি উদার-ভাবে ব্যয় ব্যসন করিয়া আসিতেছিলেন, ও অতিশয় আড়ম্বর-সহকারে নিত্য-নৈমিত্তিক ক্রিয়াকলাপ সম্পন্ন করিয়া, বিপুল কীর্ত্তি-লাভ করিতেছিলেন, সহসা তাঁহাদের সামান্যরূপ উদারান্ন আহরণ করাও কঠিন হইল, এবং কতকগুলি নিরন্ন নির্ব্বিষয় ব্যক্তি আসিয়া, তাঁহাদের সমুদায় সম্পত্তি বিভাগ করিয়া লইল। (৮৮)
অক্ষয়কুমারের স্বপ্নর সমাজ একটি বিকল্প ব্যবস্থা হাজির করল। সেখানে “পরমহিতৈষী পুণ্যবান্ লোকেরা প্রথম শ্রেণীতে, বিদ্যাবান্ লোকেরা দ্বিতীয় শ্রেণীতে ও বিষয়-নিপুণব্যক্তি সকল তৃতীয় শ্রেণীতে নিবিষ্ট” থাকেন। শুধু তা-ই নয়, প্রথম শ্রেণীতে অক্ষয়কুমার দেখতে পেলেন “কতকগুলি হীন-জাতীয় এবং অজ্ঞাত-কুলশীল” মানুষ যাদের “জাগ্রৎকালে যাহাদের অঙ্গ স্পর্শ করিয়া, আপনাকে অশুচি বোধ” (৮৯) করেছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে অক্ষয়কুমার জাতপাত মানতেন না। স্বাভাবিক যে, চারুপাঠ-এ এই সামাজিক বৈষম্য ঠাঁই পাবে না। বলা বাহুল্য, এ অংশটি মূলে ছিল না; অক্ষয়কুমারই তা ঢুকিয়েছেন।
বিদ্বানদের বেলায় ধর্ম-পুরুষ সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিলেন “সর্ব্বোত্তম ধী-শক্তি-সম্পন্ন ব্যক্তি-সমুদায়কে” (৯০)। আর বৈষয়িকদের মধ্যে তিনি বাছলেন সেইসব লোক যাঁদের মধ্যে স্বার্থপরতা, ঘুষ নেওয়া আর অন্যকে কষ্ট দেওয়ার মতো বদগুণ অন্যদের চেয়ে অনেক কম।
দেখার ব্যাপার, পরিশ্রম আর কর্মদ্যোগকে সমাদর করতেন অক্ষয়কুমার। তাই ধর্মশীল ও বিদ্বানদের তিনি মনে করিয়ে দিলেন:
তোমরা বিদ্যবান্ ও ধর্ম্মশীল বটে; কিন্তু এ প্রকার গুণসম্পন্ন হইয়া, আলস্যের বশীভূত থাকা উচিত নয়। কতকগুলি পুস্তক-সমভিব্যাহারে বিরলে কাল-যাপনার্থে বিদ্যার সৃষ্টি হয় নাই, এবং সংসারে শুভাশুভ তাবৎ বিষয় উপেক্ষা করিয়া, অনুৎসাহে কালক্ষেপণ করাও ধর্মের উদ্দেশ্য নয়। ভূ-মণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া, যদি সংসারের কার্য্যই না করিলে, তবে জীবন ধারণের ফল কি? শিক্ষিত বিদ্যাকে যদি জগতের উপকারার্থে নিয়োগ না করিলে, তবে সে বিদ্যার প্রয়োজন কি? … (৯৩)
বিশুদ্ধ জ্ঞানচর্চায় অক্ষয়কুমারের কোনওদিন সায় ছিল না। জগতকে জানা আর নিজেদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পাশাপাশি ক্রমাগত জাগতিক উন্নতির মাধ্যম হিসেবে শিক্ষাকে দেখতেন তিনি। ধর্ম অক্ষয়কুমারের কাছে ছিল এক প্রগতিশীল দর্শন, ঈশ্বর নয় বরং বিজ্ঞানের সঙ্গে তার নিবিড় সম্পর্ক। এ কথা ঠিক যে, বিদ্যাসাগরের মতো তিনি কর্মবীর ছিলেন না; তাঁর যা কিছু অবদান তা বিদ্যাচর্চার দুনিয়াতেই সীমিত। কিন্তু এও মনে রাখতে হবে, সে জগৎ অন্তর্মুখী ছিল না। এক সুনির্দিষ্ট মতাদর্শ তাঁর সামগ্রিক লেখাজোখাকে রূপ দিয়েছিল। অক্ষয়কুমার চাইতেন, তাঁর বিশ্ববীক্ষা অনুপ্রাণিত করুক ছাত্রদের, তার ভিত্তিতে গড়ে উঠুক এক নতুন প্রজন্মর আগুয়ান বাঙালি যারা সমাজবদলে হাত জোগাবে। চারুপাঠ হল আগামী দিনের সেই পরিকল্পনার কর্মসূচি।
সূত্র
১. অক্ষয়কুমার দত্ত। চারুপাঠ। প্রথম ভাগ। ১৯৩০।
২. —। চারুপাঠ। দ্বিতীয় ভাগ। ১৮১৭ শকাব্দ।
৩. —। চারুপাঠ। তৃতীয় ভাগ। ১৯১২।
৪. Addison, Joseph. Essays of Joseph Addison. London: Macmillan, 1910.