লক্ষ্মীর প্রয়োজন লক্ষ্মীর ভাণ্ডার

অরিজিতা দত্ত

 


অধ্যাপক, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

 

 

 

ভারতবর্ষের সাম্প্রতিক কালের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পগুলির মধ্যে নবতম সংযোজন পশ্চিমবঙ্গের লক্ষ্মী ভাণ্ডার। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী যাদের বাড়িতে সরকারি চাকুরিরত বা পেনশনভোগী মানুষ নেই, তাদের বাড়ির মহিলারা এই প্রকল্পে সম্পৃক্ত হতে পারেন এবং তাঁরা মাসিক ৫০০ টাকা (সাধারণ শ্রেণিভুক্ত হলে) বা ১০০০ টাকা (তপশিলি জাতি বা উপজাতিভুক্ত হলে) পাবেন সরাসরি তাঁদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। এই অনুদান দেওয়ার জন্যে প্রতি মাসে আনুমানিক ১১০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে সরকারি সূত্রে জানা গেছে। প্রকল্প শুরু হওয়া থেকেই অভাবিত সাড়া মিলেছে এই প্রকল্পে। সরকারি দপ্তর থেকে আশা করা হচ্ছে যে এই প্রকল্পে মোট ২ কোটি মহিলা যোগদান করবেন এবং ব্যাঙ্কে সহজেই এই টাকা পাবেন। স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে (একটি সামাজিক স্বাস্থ্যবিমা যা পশ্চিমবঙ্গ সরকার বেশ কয়েক বছর ধরে চালাচ্ছেন) যারা নথিভুক্ত, তারাই এই প্রকল্পে নাম লেখাতে পারবেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সাথী প্রকল্পে যে পরিসংখ্যান বা তথ্যশালা তৈরি হয়ে রয়েছে, তার ওপরেই এই নতুন প্রকল্পের শিলান্যাস হবে।

সংবাদমাধ্যমের নানা রিপোর্টে এই লক্ষ্মী ভাণ্ডার এক অভূতপূর্ব চাহিদার চিত্র ধরা পড়েছে। রাজ্য জুড়ে যে দুয়ারে সরকার নীতির মাধ্যমে পাড়ায় পাড়ায় ক্যাম্প চলছে, তাতে প্রতিদিন প্রায় ১৫ লক্ষ মানুষ হাজির হচ্ছেন যাঁদের বেশিরভাগই লক্ষ্মীর ভাণ্ডারে নাম লেখাতে। অনেক ক্ষেত্রেই কোভিড বিধি ভেঙে প্রচুর মানুষের ভিড় জমছে, ঠেলাঠেলি ও পদপৃষ্টে আহত হওয়ার ঘটনাও খবরের শিরোনামে আসছে। শুধু দুঃস্থ মহিলারাই নন, সম্পন্ন ঘরের মহিলারাও যেভাবে ৫০০ টাকার জন্যে আবেদন করছেন তাতে রাজ্যের কিছু মানুষ অবাক, কিছু মানুষ হতাশ ও কিছু মানুষ খুশি হচ্ছেন। আজ এই নাতিদীর্ঘ প্রবন্ধে এই প্রকল্পের তাত্ত্বিক দিকগুলি নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক।

প্রথমত, সামাজিক সুরক্ষা কী? সামাজিক সুরক্ষা হল সেইসব সরকারি বা বেসরকারি প্রকল্প যা মানুষকে আয় বা ভোগব্যয়ের জন্যে, তাদের দারিদ্রের সঙ্গে লড়াই করতে, কাজের অভাব মেটাতে সাহায্য করে এবং বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষকে জীবনের নানা সুরক্ষা প্রদান করে। মানুষের জীবনচক্রের আবর্তে সময়োচিত সাহায্য বয়ষ্ক ভাতা হিসেবে বেশিরভাগ উন্নত দেশেও প্রদেয়। সেখানে মানুষ অল্প বয়স থেকেই জেনে যান যে বার্ধ্যক্যে তাঁদের সঙ্গে ছেলেমেয়েরা না থাকলেও রাষ্ট্র আছে। তাঁদের স্বাস্থ্যপরিষেবা থেকে প্রাত্যহিক যত্ন রাষ্ট্রই সব ব্যবস্থা নেবে। তাই সারাজীবন তাঁরা এই ভেবে অর্থ জমা করেন না যে সঞ্চয় না থাকলে তাঁদের কী হবে! ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষিতে বয়স্ক, বিধবা, বিশেষভাবে সক্ষম মানুষের জন্যে মাসোহারা দেওয়া বা পেনশন প্রদান করার নীতি বহু পুরনো। স্বাস্থ্যের জন্যে সামাজিক বিমার চলও ইদানিংকালে শুরু হয়েছে। আইএলও-র সোশ্যাল প্রোটেকশন ফ্লোর (২০১২) অনুযায়ী বলা হয়েছিল যে শুধু যাঁরা বয়স্ক বা বিশেষভাবে সক্ষম তাঁদের জন্যেই নয়, কর্মক্ষম মানুষের ন্যূনতম আয় নিশ্চিত করতে অবশ্যই সামাজিক সুরক্ষা থাকা উচিত, যা দিয়ে তাঁরা নিজের শিশুদের স্বাস্থ্য ও পড়াশুনো চালাতে পারেন। কিন্তু, অন্য সব সামাজিক ও আর্থিক বৈশিষ্ট্য ব্যতিরেকে সমস্ত মহিলার জন্যে মাসিক সাহায্য প্রদান করার মাধ্যমে একভাবে আমরা মেনে নিলাম যে মহিলারা এখনও আমাদের দেশে প্রান্তিক সম্প্রদায়ের অন্তর্গত এবং এই প্রকল্পের শুরুতে সব শ্রেণির মহিলাদের মধ্যে উৎসাহ প্রমাণ করল সত্যিই আজও মহিলাদের নিয়মিত অর্থের জোগান কত প্রয়োজন।

সাম্প্রতিক অতিমারির আবহে সামাজিক সুরক্ষা ও সোজাসুজি সুবিধা প্রদানের (ডাইরেক্ট বেনিফিট ট্রান্সফার) প্রয়োজনীয়তা নতুন করে সামনে এল এদেশেও। অভিবাসী মজুরদের জন্যে প্রধানমন্ত্রী জন ধন যোজনার মাধ্যমে অনেকেই সাহায্য পেয়েছেন, তথ্য বলছে। কিন্তু অভিবাসী ছাড়াও অতিমারি ও তার পরবর্তী সময়ের অর্থনৈতিক মন্দায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন ভারতের এক বৃহৎ অংশের মানুষ। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদরা অনেকেই মনে করেছেন এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন অর্থনৈতিক উদ্দীপনা বা স্টিমুলাস। ব্যয়ের জন্যে কৃপণতা না করে সাধারণ মানুষের হাতে আয় বা ব্যয়যোগ্য জিনিস তুলে দেওয়াই এখন প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিত। জনগণ যে আর্থিক দারিদ্র ও বেকারত্বের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তাতে মূল প্রয়োজন অনুদান নিঃসন্দেহে। সরকারের বাজেটে কত ঘাটতি হবে সেটা ভাবার সময় এখন নয়। নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ শ্রী অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী বলেছেন দরকার হলে কেন্দ্রীয় সরকার টাকা ছাপিয়ে মানুষের হাতে দিক জিনিস কিনতে, পরবর্তী মূল্যবৃদ্ধি পরে সামলানো যাবে। অর্থাৎ, নিঃসন্দেহে এই ধরনের সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপারে দরবার করেছেন তাঁরা।

পশ্চিমবঙ্গে শেষ কয়েক বছরের আর্থিক বৃদ্ধি দেশের মধ্যে বেশ ওপরের দিকে। ২০১৮-১৯ সালে রাজ্যের আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল ১০.৭ শতাংশ, যে সময়ে গোটা ভারতের অর্থনীতি বৃদ্ধি পেয়েছিল মাত্র ৬.৭ শতাংশ হারে। এর সঙ্গে বেড়েছে কর আদায়ের সাফল্য। কিন্তু, এ রাজ্যের মূল চিন্তা দুটি। প্রথমত রাজ্যের অর্থনীতির এক-তৃতীয়াংশ চলে যায় ঋণ শোধ করতে। ফলত হাতে থাকা অর্থ সবসময়ই বাড়ন্ত মনে হয়। দ্বিতীয়ত, এ রাজ্যে শিল্পায়ন সম্পর্কে অনেক আশা ও স্বপ্ন থাকলেও বাস্তবে খুব একটা উন্নতি করা যায়নি, নতুন চাকরি সংস্থান করা সহজ হয়নি, যদিও বেকারত্বের হার বেড়ে গেলেও তা সর্বভারতীয় পরিসংখ্যানের নিচেই আছে। ছোট ও মাঝারি শিল্পও তেমনভাবে সুবিধা করতে পারেনি. সরকারের তরফ থেকে খরচের একটা বড় অংশ নিয়েছে সামাজিক সুরক্ষা ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে নানান পরিকল্পনা। সব মিলিয়ে রাজ্যের অর্থনীতিতে সরকারি অনুদান ও সামাজিক সুরক্ষার ব্যাপ্তি ক্রমাগত বেড়েছে।

কিন্তু এ প্রসঙ্গে যে কথাটা মনে আসে প্রথম, তা হল মহিলাদের জন্যে সত্যি কি পৃথক সুরক্ষাকবচ দরকার? এ কথা অনস্বীকার্য যে যেকোনও উন্নয়নের পদ্ধতিতে সংবেদনশীল ও দুর্বল স্থানে থাকেন মহিলারা, যাঁদের মূল কাজ বলে মনে করা হয় সংসার সামলানো, বাচ্চার জন্ম দেওয়া ও দেখাশুনো করা। একদিকে তাঁদের সংসার সম্পর্কিত কাজ সাবসময়ই কোনও অর্থনৈতিক মূল্য পায় না, অন্যদিকে সংসারের যাবতীয় যত্নপ্রদানকারী (কেয়ার গিভার) হওয়ায় বাড়ি থেকে বেশি দূরে তাঁরা গিয়ে কাজ করতে পারছেন না। সঙ্গে থাকছে কাজের জায়গায় মহিলাদের প্রয়োজনীয় সুরক্ষা, সুবিধা ইত্যাদি। আমাদের দেশে মহিলারা বেশিরভাগই কাজ করেন অসংগঠিত ক্ষেত্রে যেখানে এই ধরনের সব সুবিধা প্রায় নেই-ই: নারীপুরুষ নির্বিশেষে। কিন্তু জীবনচক্রের হিসাবে নারীসুরক্ষা অনেক বেশি প্রয়োজনীয় বলে সেখানে মহিলাদের কাজ করা বেশ অসুবিধাজনক। তবু অসংগঠিত ক্ষেত্রে মহিলারা অনেকেই কাজ করেন বাধ্য হয়ে, সংসারের আর্থিক দুর্দশা থেকে মুক্তি পেতে। সেই কাজ একেবারেই ডিসেন্ট বা শালীন কাজ নয়: তাতে না থাকে সামাজিক সুরক্ষা, না থাকে অসুখজনিত কারণে ছুটির বিধান। আর্থিকভাবেও তাঁরা নানাভাবে শোষণের স্বীকার হন, অধিকাংশ সময়েই তাঁরা একই কাজ করার জন্যে কম বেতন পান। ফলত তাঁদের নিজেদের প্রয়োজনীয় খরচ করতে পারেন না সংসারের নিয়মিত খরচ জুগিয়ে। তাই ২০১৯ সালে ভারতবর্ষের মহিলাদের মধ্যে মাত্র ২৬ শতাংশ কাজ করতেন, বাকিরা বাড়িতে থাকতে পছন্দ করতেন বা বাধ্য হতেন।

এ প্রসঙ্গে মনে রাখা প্রয়োজন যে এই প্রবণতা শহরের শিক্ষিত মহিলাদের মধ্যেও প্রবল। শিক্ষিত মহিলারা যেহেতু শিক্ষিত পুরুষদের বিয়ে করেন, তাই তাঁদের সংসারে আর্থিক অনটন সাধারণত কম থাকে। তাই বিবাহিত ও ন্যূনতম কলেজশিক্ষা প্রাপ্ত মহিলাদের মাত্র ১৩ শতাংশ বাড়ির বাইরে কাজ করেন এ দেশে, যেখানে এই পরিসংখ্যানটা প্রায় ২২ শতাংশ যারা বিবাহিত ও অশিক্ষিত। সাধারণভাবে, আমরা যে মনে করি যে শিক্ষা বাড়লে মহিলারা আয়জনক কাজে সম্পৃক্ত হতে পারবেন বা পারেন, সেটা একদমই ভুল। এডুকেশন এফেক্ট আর ইনকাম এফেক্ট একসঙ্গে মিলে উচ্চশিক্ষিত মহিলাদের কাজের জগৎ থেকে সরিয়ে দেয়। এর সঙ্গে সংগঠিত কাজের জায়গাতেও মহিলারা নানান অসুবিধার সম্মুখীন হন, যার ফলে তাঁদের অনেকেই কাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন আর স্বামীর দেওয়া হাতখরচের টাকায় খুশি থাকতে হয়।

সরকারি নথি অনুযায়ী, ২০২০ সালে অতিমারির সময় থেকে মহিলাদের কাজ করা এবং রোজগার করার প্রবণতা প্রায় ১৬ শতাংশ কমে গেছে। পুরুষদের তুলনায় মহিলারা বেকারত্বের কবলে পড়েছেন বেশি। কারণ নিম্ন দক্ষতার যেসব কাজে মহিলারা বেশি অংশ নিয়ে থাকেন, সেগুলি লকডাউনের সময় থেকে বেশি বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অতিমারির প্রকোপ যখন কমেছে, মহিলাদের ওই কাজের জায়গাগুলো অনেকটাই পুরুষদের দখলে গেছে যাতায়াতের অসুবিধার জন্যে এবং স্কুল বন্ধ থাকায় শিশুদের পরিচর্যা করার প্রয়োজনীয়তা বাড়ায়।

এইসব দিক আলোচনা করে দেখা যাচ্ছে সত্যিই মহিলাদের জন্যে সামাজিক সুরক্ষার প্রয়োজন খুব বেশি। একদিকে পিতৃতন্ত্রের চিরকালীন চাপে তাঁদের বাড়ির বাইরে যাওয়া মুশকিল, সংসার সামলানোটাই তাঁদের মূল কাজ বলে মনে করানো হয়, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা পুরুষের ও গৃহস্থালির হতে পারে, মহিলারা শুধু তার থেকে ভাগ পান মাত্র। অন্যদিকে কাজের ক্ষেত্রেও তাঁরা নানা অসুবিধার সম্মুখীন হন। প্রসবসংক্রান্ত ছুটি (মেটার্নিটি লিভ) আর শিশুপালনের ছুটির (চাইল্ড কেয়ার লিভ) কথা আইনে থাকলেও বেসরকারি সংস্থাগুলি এই ছুটি দিতে হবে ভেবে তাঁদের চাকরি দেওয়ার ক্ষেত্রে রক্ষণশীল মনোভাব দেখায়। সব মিলিয়ে নিজের টাকা যা নিজের ইচ্ছেমতো খরচ করা যায় সেটা খুব কম মহিলার কাছেই থাকে এবং তা আজকের দিনেও সত্য। তাই পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যে, যেখানে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি যথেষ্ট আর যেখানে মহিলাদের শিক্ষার হার সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে অনেকটাই বেশি, সেখানেও লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের মতো সামাজিক সুরক্ষার দরকার পড়ল। ৫০০ টাকার জন্যে উচ্চবর্ণের অবস্থাপন্ন মহিলাদের আকুতি অন্যায্য বা অবাক হওয়ার মতো নয়। নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে নিজের টাকা তো বটে! হোক না অল্প!

রইল বাকি শেষ কথা। টাকা কোথা থেকে আসবে? বিগত এক দশক ধরে আমরা জানি এই রাজ্যের আর্থিক স্বাস্থ্য বিশেষ ভালো নয়। সেক্ষেত্রে আমাদের কাছে বিকল্প হল ট্যাক্স বাড়ানো বা নতুন ঋণ নেওয়া। এই দুটোই যেহেতু রাজ্যের পক্ষে এই মুহূর্তে করা দুষ্কর, একমাত্র বিকল্প হল খরচের পুনর্বিন্যাস। যে সমস্ত ক্ষেত্রে সরকারি খরচ না করলেও চলে, সেগুলি কমানোর জন্যে বিশেষ নীতি নেওয়া আবশ্যক। সঙ্গে থাকে রাজনৈতিক অঙ্গীকার। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় যদি সরকারের ইচ্ছে ও যুক্তি সঠিক থাকে তাহলে সামাজিক সুরক্ষার পথে সরকারি বাজেটে ঘাটতি অন্তরায় হতে পারে না বা হওয়া উচিতও নয়।

About চার নম্বর প্ল্যাটফর্ম 4666 Articles
ইন্টারনেটের নতুন কাগজ

Be the first to comment

আপনার মতামত...