রামানুজ মুখোপাধ্যায়
অধ্যাপক, সাহিত্য-অনুরাগী, ইতিহাস ও লোকশিল্প গবেষক
মৈত্রেয়ী দেবীর ‘কুটিরবাসী রবীন্দ্রনাথ’ বইটির কথা মনে পড়ে। ঢাকার স্বাধীন বাংলা সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে। সেখানে আছে কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের তত্ত্বাবধানে ‘উদয়ন’ বাড়িটি গড়ে ওঠার পরের কিছু স্মৃতি। শান্তিনিকেতনের ‘উত্তরায়ণ’ চত্বরে এ-বাড়ি আমরা অনেকেই দেখেছি। মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছিলেন, “রবীন্দ্রনাথ অবশ্য এ বাড়িতে থাকতেই চাইতেন না।” শেষদিকে এ-বাড়িতে কবিকে থাকতে হয়েছিল নানা প্রয়োজনে। মৈত্রেয়ী দেবীকে প্রশ্ন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ: “বলতে পার আমার আশ্রমের মধ্যে ওরা রাজবাড়ি বানাল কেন? ওরা যদি কলকাতায় বা পতিসরে বানাত আমার কিছু বলার ছিল না, কিন্তু আমার আশ্রমে কেন?” কবির আপত্তি ছিল বাড়ির সামনের গোলাপবাগানটি নিয়েও। বাবার এ-আপত্তিতে ‘ক্ষুণ্ণ’ হয়েছিলেন রথীন্দ্রনাথ। মৈত্রেয়ী দেবীকে রথীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “দেখো বাবা কীরকম ভুল বোঝেন। ওঁর জন্যই তো সব। আমাদের কি আছে বল? ওঁর কাছেই দেশ-বিদেশ থেকে মান্যগণ্য মানুষ আসেন, আমরা আতিথ্যের ব্যবস্থা রাখি।” রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে দেশ-বিদেশের বহু গুণী মানুষ এসেছিলেন শান্তিনিকেতন আশ্রমে। এখানে এসে তাঁরাও থাকতেন ছোট-ছোট মাটির বাড়িতে। আশ্রমের শিক্ষকরাও কি অনেকে স্বেচ্ছায় বরণ করে নেননি এর বাইরের অনাড়ম্বর আয়োজন আর ভিতরের অনন্ত ঐশ্বর্যের সম্ভাবনাকে? সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় ছিল মৈত্রেয়ী দেবীর মাধ্যমে রথীন্দ্রনাথকে দেওয়া রবীন্দ্রনাথের উত্তরটি। কী গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কবি জানিয়ে দিতে পেরেছিলেন: “আমি তো জানি যারা আমার কাছে আসে তারা আমি গাছতলাতে থাকলেও আসত।” না, এর মধ্যে কবির কোনও আত্ম-অহঙ্কার নেই। অন্তরের ঐশ্বর্য যতখানি মাধুর্যে ভরা থাকলে একজন মানুষ এ-কথা বলতে পারেন, এই ইমারতমণ্ডিত বিশ্ববিদ্যালয়টি কি তার ছিটেফোঁটাও পারবে কখনও? অর্ধশতাব্দী আগে ‘কুটিরবাসী’ শীর্ষক সেই গদ্যের শেষে মৈত্রেয়ী দেবী জানিয়েছিলেন, শান্তিনিকেতনের বড় বড় ইমারত দপ্তরখানা ইত্যাদি দেখলে তাঁর রবীন্দ্রনাথের সেই কথাগুলি মনে পড়ে। তিনি লিখেছেন: “আমি যেন শুনতে পাই একটি একটি করে পাথর খসে পড়ছে। কিন্তু এটা তো ভুল। পাথর তো খসেনি বরং পাকা হয়েছে। তবু গড়াটাকেই ভাঙ্গা বলে মনে করবার মনোবিকার আমায় ছাড়তে চায় না।” মৈত্রেয়ী দেবীর এই বেদনাতুর ‘মনোবিকার’ কি তাঁর একার, এর মধ্যে কি লুকিয়ে নেই আমাদেরও চাপা দীর্ঘশ্বাস?
২.
১৯২১-এ সৈয়দ মুজতবা আলী (১৯০৪-৭৪) যখন শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন তখনও সেখানে স্নাতক স্তরের পড়াশুনো শুরু হয়নি। মুজতবা আলী জানিয়েছেন, “ছ’মাস পরে আচার্য ব্রজেন্দ্রনাথ শীলের পৌরোহিত্যে তার ভিত্তিপত্তন হয়।” তখন সেই ক্লাসে মাত্র জনাদশেক শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁরা প্রত্যেকেই বিদ্যালয়স্তরের পড়াশুনো সমাপ্ত করেছিলেন এখানেই। সৈয়দ মুজতবা আলী স্নাতক স্তরে প্রথম ‘বাইরের ছাত্র’। তিনি এখানে পড়াশুনো করতে এসেছিলেন অখণ্ড বঙ্গের শ্রীহট্ট থেকে। ১৯২১ থেকে ১৯২৬ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে পড়াশুনো করার পর তিনি যোগ দিয়েছিলেন কাবুলের শিক্ষাবিভাগে অধ্যাপনার কাজে। পড়াতেন ফরাসি ও ইংরেজি। সংস্কৃত, হিন্দি, উর্দু, গুজরাটি, মারাঠি-সহ অন্তত পনেরোটি ভাষায় ছিল তাঁর অধিকার। ১৯২৮-৩০ নাগাদ জার্মানির এক বিশ্ববিদ্যালয়ে শেষ করেছিলেন তাঁর প্রথাগত গবেষণার কাজ। বরোদা রাজ্যে তিনি পড়াতেন তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব। বিশ্বভারতীর ইসলামি সংস্কৃতির প্রধান অধ্যাপক ছিলেন। তাঁর সুখ্যাত বাংলা বইগুলির কথা আমরা জানি। জানি ‘গুরুদেব ও রবীন্দ্রনাথ’ বইটির কথাও। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এতগুলি বিদ্যায়তনের অভিজ্ঞতা তাঁকে ঋদ্ধ করেছিল। তিনি রবীন্দ্রনথের সান্নিধ্যস্পর্শে উপলব্ধি করেছিলেন: “…এ গুরুর আলৌকিক ক্ষমতার সঙ্গে কারওই তুলনা হয় না।” মুজতবা আলী লিখেছেন: “…আমার মনোজগৎ রবীন্দ্রনাথের গড়া।” এই শান্তিনিকেতনে কেমন কেটেছিল মুজতবা আলীর শেষজীবন? ১৯৬৫-তে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একটি চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন: “…শান্তিনিকেতনে ভদ্রলোকের পক্ষে থাকা অসম্ভব। (আমি সর্ব সম্পর্ক ছিন্ন করে দূরে বোলপুর শহরে থাকি।)” এই সময়ে সুনীল চিঠিতে মুজতবা আলীকে জানিয়েছিলেন: “আমাদের তো ধারণা ও অভিজ্ঞতা যে ঐ জায়গাটা এখন খুবই বিশ্রী।” মুজতবা আলীর কাছে সুনীল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছিলেন: “…আপনি যে মুসলমান এ জন্যও আপনাকে কখনো বিড়ম্বনা সহ্য করতে হয় কি না ভেবে ভয়ে বুক দুরদুর করে।” স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে মুজতবা আলী উত্তর দিয়েছিলেন: “আমার পাঠকরা যখন আমাকে মুসলমান বলে অবহেলা করে না, তখন শান্তিনিকেতনের clerk, (Registrar), Garage Manager (Vice Chancellor) কী ভাবে সে তো ব্রাদার “লস্যি”!” মুজতবা আলীর মতো মানুষও যখন সেই ১৯৬৫-তেই নিঃসঙ্কোচে এ-কথা লিখে যেতে পারেন, তখন কি আমাদের মনে হয় না, দিনেকালে বিশ্বভারতী নামক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়টি এমনই হয়ে উঠেছিল, যার সঙ্গে কবির আশ্রম-ভাবনার আর অন্তরের যোগ ছিল না বিশেষ?
৩.
এই সময়ের এক অগ্রগণ্য কবির মন ভালো হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন-সম্পৃক্ত কোনও স্মৃতিকথা পড়লে। মন যেমন ভালো হয়ে যায় তাঁর, তেমনি কান্নাও পায় অঝোর ধারায়। সে-কবি থাকেন কলকাতা থেকে দূরে, পুরুলিয়ায়। প্রথাগত পড়াশুনোয় তাঁর আগ্রহ ছিল না কখনও। প্রান্তজনের ছোট-ছোট সুখ-দুঃখ আর নিজস্ব এক কবিভাষা নিয়ে বাংলা কবিতার অঙ্গনে তিনি জেগে আছেন রুক্ষ মাটির বুকে ফুটে থাকা রক্তপলাশের মতো। রবীন্দ্রনাথের কবিতার ভাবলোকের সঙ্গে এ-কবির জগৎ সর্বতোভাবে আলাদা। বিগত চারটি দশক, প্রায় প্রত্যেক বছর তিনি আসেন শান্তিনিকেতনে। আমাদের এই কবি একবার জিজ্ঞেস করেছিলেন শঙ্খ ঘোষকে, রবীন্দ্রনাথ আর শান্তিনিকেতনের স্মৃতিকথা পড়লেই কেন তাঁর এমন কান্না পায়? তিনি কি গতজন্মে ছাত্র ছিলেন রবীন্দ্রনাথের আশ্রমের? শঙ্খ ঘোষ তাঁকে বলেছিলেন, এ আসলে মনের গভীরে মুখ-লুকিয়ে-থাকা এক ভালোবাসার অমোঘ টান, এবং তারই সঙ্গে লগ্ন-হয়ে-থাকা এক দুঃখবোধ। কিসের দুঃখ, জিজ্ঞেস করেছিলাম আমাদের এই শ্রদ্ধাভাজন কবিকে। তিনি বললেন, “মিল নেই আর ভিতরে-বাইরে কোত্থাও। রবীন্দ্রনাথ যা ভেবেছিলেন, আর এই-যে বিশ্ববিদ্যালয়টিকে দেখছি চারটি দশকেরও বেশি সময় ধরে, এ কি এক?” এ-কবি পরজন্মের কল্পনা করতে ভালোবাসেন। পরজন্মে তো তিনি রবীন্দ্রনাথের আশ্রম বিদ্যালয়ের সামান্য এক ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন দেখেন এখনও। কোনও কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হওয়ার স্বপ্ন তো তাঁর ছিল না আগে, এখন নেই, কল্পিত আগামী-জন্মেও থাকবে না। তাই এত দুঃখবোধ ভিতরে-ভিতরে। মনের কোণে তাই তো এত অশ্রু ঝরে স্মৃতিকথায় রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর সেই স্বপ্নলোকের ছবি দেখলে।
আমরা শুধু ভাবি, এ কার শতবর্ষ? ‘বিশ্বভারতী’ নামক কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়টির? কেন্দ্রীয় সরকারের মদতপুষ্ট এই বিশ্ববিদ্যালয়টির জন্ম অনেক পরে। এ তো আসলে কবির বিশ্বভারতীর স্বপ্নকল্পনার শতবর্ষ। আমাদের জন্ম-জন্মান্তরের প্রণাম সেই স্বপ্নকল্পনাটির প্রতি।